মহালয়া

মহালয়া মানেই দেবী দুর্গার আবাহন নয়

চিরশ্রী দেবনাথ

মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন নয় তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পিত়ৃলোক হিসেবে যা কল্পনা করা হয়,মহালয়ার দিন সেই পিতৃলোক থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিছুটা নিচে নেমে আসেন,  সেই সময় উত্তর প্রজন্ম তাঁদের উদ্দেশ্যে  তিল জল চাল বা জব অর্পণ করেন , পূর্বপুরুষরা তৃপ্ত হোন , সব মিলিয়ে যেন একটি মহান ও পবিত্রতম আলয় সৃষ্টি হয় যা থেকেই শব্দটি মহালয় । যে কেউ এইদিনে তার পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে পারে আর এই শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের অতি ক্ষুদ্র অংশের নাম হচ্ছে তর্পণ।
 মানুষ জন্মলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি ঋণের দ্বারা আবদ্ধ হয়। দেবঋণ,  ঋষিঋণ এবং পিতৃঋণ। কারণ প্রত্যেক ধর্মের মানুষই সাধারন
ভাবে মনে করে তারা   ঈশ্বরের সন্তান। অতএব এই জীবনলাভের জন্য ভগবানের কাছে ঋণী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যাগ যজ্ঞের মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি আমরা। ঋষিঋণ মানে গুরুর প্রতি ঋণ যা প্রাচীনভারতের তপোবন শিক্ষা থেকে শুরু করে এখনকার বিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত , বিদ্যা অর্জন , গুরুকে উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন এবং গুরুদক্ষিণার মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার একটি আজীবনের প্রচেষ্টা থাকে আমাদের।  
 আর অবশ্যই জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর প্রতি মানুষের চির ঋণ। ওরা আমাদের শিশু থেকে যেভাবে বড় করেছেন বার্ধক্যে তাদেরকে আবার তা ফিরিয়ে দিতে হবে। আর আমাদের সুবিশাল পিতৃলোক,  মহালয়ার বিশেষদিনে  এটা শুধু
মাত্র বংশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট থাকেনা, লতায়পাতায় বিস্তৃত হয়ে সমস্ত মৃত আপনজনদের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়। ‘মহ’ শব্দের প্রাথমিকভাবে  আরো একটি অর্থ রয়েছে।  ‘মহ’ বলতে বোঝায় পুজো বা উৎসব। তা থেকে ব্যুৎপত্তি করলে হয়  মহ+আলয় = মহালয় অর্থাৎ পুজো বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। তবে শব্দটিকে কেন স্ত্রীলিঙ্গ করা হলো এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোন কারণ না থাকলেও যেহেতু অমাবস্যার আঁধার কেটে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয় কয়েকদিন পরেই , সেই আসন্ন উৎসবের কথা ভেবেই শব্দটিকে বলা হয় মহালয়া ।
 মহালয়া শব্দটির আরো কিছু বিশেষ অর্থ রয়েছে। এখানে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। যা ডাক্তারি পরিভাষায় মাল্টি অর্গ্যান ফেলিউর। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না বা ব্রেণ ডেথ হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই এই শব্দটিকে হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 
 ১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই মহালয়াকে দুর্গাপুজোর আবাহনের রূপ দেওয়ার কারিগর  বলা যায়।
বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 
আর একটি জিনিস যেটা হলো সেলিব্রেশন বা উৎসব। আমরা সবকিছুই আজকাল সেলিব্রেট করি। শিক্ষক দিবস থেকে শুরু করে, মহালয়া  এক ভয়ানক সেলিব্রেশন। কারণ মানুষ এখন শোক বয়ে নেবার মতো ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। তাই শোকের সঙ্গে মিশে যায় সেলিব্রেশন। 
মহালয়া প্রকৃতপক্ষে পরম শ্রদ্ধায় একান্তমনে পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের দিন। কিন্তু নদীবক্ষে যখন কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়ে এই কাজটি করে তখন তা ব্যক্তিগত থাকে না। ছড়িয়ে পরে। বহুজন একত্রিত হয়ে কোন কাজ করাটাই হয়ে যায় সেলিব্রেশন। আমরা তখন বলতে চাই শুভ মহালয়া ।
পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের বহু গল্প আছে। তারমধ্যে একটি বিখ্যাত গল্প দাতা কর্ণের গল্প। এ দিয়েই শেষ করব লেখাটি । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।


এই পক্ষই পৃথিবীতে পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

তেমনি রামায়নে রাম দুর্গার পুজো করার আগে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। কারন যেকোন ভালো কাজ করার আগেই পূর্বপুরুষকে
তৃপ্ত করতে হয়। এজন্যই শরৎকালে দুর্গার যে অকাল বোধন হয় তার আগে মহালয়ায় পিতৃ তর্পণ এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ বলে মনে করা হয়। 









মহালয়া

#মহালয়া দেবী দুর্গার আবাহন নয়
.........................

 এই প্রথমবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের 
“ আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর “ শুনলেই কেন যেন ভীষণ মনখারাপ লাগছে । শুনতেই ইচ্ছে করছে না । 
মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার আবাহনের যে সত্যিকার অর্থে কোনো যোগাযোগই নেই  অন্তঃস্থল থেকেই অনুভব করতে পারছি।
আসলে তো মহালয়ার সকালে বাজলো তোমার আলোর বেণু আসন্ন দুর্গাপুজোর সঙ্গে জোর করে সংযোগ করিয়ে দেওয়ার একটি নস্টালজিক সেতু মাত্র । সেই অর্থে শাস্ত্রীয় কোনো যোগাযোগ নেই মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর। 
 চারদিকে মেয়েদের ওপর এতো হিংস্র,  নিষ্ঠুর,  রূঢ় অত্যাচার শক্তি আরাধনার অর্থটাকেই স্থূল এবং মূল্যহীন করে দিয়েছে। 
বহু মানুষের রুটি রোজগার জড়িয়ে থাকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে শুধুমাত্র একারণেই পুজো হোক। আসলে তো কোথাও আলোর বেণু বাজছে না । মৃত্যুরূপী এক আসুরিক শক্তির কাছে মেয়েরা জন্মমাত্র পরাজিত হয়ে আছে। বহু কিছু জিতে নিতে পারলেও এখানে মেয়েদের হারতেই হবে। সেই মুহূর্তে তার দুহাতে কোন ধারালোো  অস্ত্র আশ্চর্য উপায়ে কোনদিনই গজিয়ে উঠবে না যার মাধ্যমে সে নিজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া অসুরকে বধ করে দিতে পারে। 

 মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার এক তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন তো  নয়ই ,  তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে ।

মহালয়া শব্দটিতে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। 
 কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না  হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই প্রেত শব্দটিকে কখনই  হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 

মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ মানেই আমাদের তিনটি ঋণ আজীবনের সঙ্গী,  দেবঋণ, ঋষিঋণ আর পিতৃমাতৃ ঋণ। দেবার্চ্চনার মাধ্যমে দেবঋণ,  গুরু দক্ষিণার মাধ্যমে ঋষিঋণ বা শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ঋণ আমরা কিছুটা হলেও শোধ করি। আর মাতা পিতার প্রতি যে ঋণ তা আসলে তাদের প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই আংশিক শোধ করা যায়,  তবুও তর্পণের মাধ্যমে হয়তো সেই অদেখা পুর্বপুরুষদের প্রতি জল তিল দান করে আমরা বাহ্যিকভাবে হলেও কিছুটা ঋণ শোধ করার একটি প্রয়াস চালিয়ে যাই। যদিও আমার মনে হয় বৃদ্ধ মা বাবার প্রতি কোনো কর্তব্য পালন না করে মৃত্যুর পর ঘটা করে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করা অর্থহীন। 
 ধর্ম মানলে ঋণ শোধ করার শ্রেষ্ঠ দিন হচ্ছে মহালয়া । সেদিন  আমাদের সমস্ত পূর্বপুরুষেরা পিতৃলোক থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়  আর সেজন্যই সৃষ্টি হয় এক মহান আলয়ের,  তাই দিনটি মহালয় ।
কিন্তু আমরা তাকে স্ত্রীলিঙ্গ বা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত করি তার সঙ্গে আসন্ন  দেবীপক্ষের উৎসবমুখর যোগাযোগ রয়েছে একারণে বলেই মনে করা হয়। 
কারণ মহ শব্দের আর একটি অর্থ উৎসব। মহালয় মানে উৎসবের আলয়। 
রাম  রাবণকে যুদ্ধে হারাবার জন্য শরৎকালে দেবীকে অসময়ে অন্য তিথিতে আবাহন করেন। আর  আমাদের ধর্মে যেকোন বড় কাজের আগে পিতৃপুরুষদের পুজো করার বিধান রয়েছে। রামও দুর্গা পুজো করার আগে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন, সেজন্যও মহালয়ায় পিতৃপুরুষদের জন্য শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার ধর্মীয় রীতির সঙ্গে দুর্গাপুজো জড়িয়ে যায় । আর একটি বহুল প্রচলিত গল্প তো সবারই জানা,  দাতা কর্ণের গল্প।  কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। তা থেকেই তর্পণ নামের
অনুষ্ঠানটির সূচনা হয় হিন্দু ধর্মে , এটাও মনে করা হয়। 
 মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।
১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 

কিন্তু বহু দুঃখজনক  কারণের  সমাপতন ঘটে যাওয়ায় এবছরের দুর্গাপুজো উৎসব নয়,  উৎসব এবার একটি কাঠামো মাত্র , যার ওপর রঙ চড়ানোর তুলিতে হাত রাখতে আমার মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। মহালয়ার সকালে চণ্ডীপাঠ এক দুঃসহ কালকুণ্ডলীর নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনে হচ্ছে শুধু।  পুজোর আগে যে মা বাবার কন্যা চিরতরে বিসর্জিত হয়ে গেল এক নারকীয় হত্যায়, তা ভুলতে পারছি না কিছুতেই।)

#চিরশ্রীদেবনাথ

ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ..আবহ ও প্রবহমানতা

চিরশ্রী দেবনাথ



ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ...আবহ এবং প্রবহমানতা 

......................................................



কবিতা, কোন একটি ভূখন্ডের সাহিত্য নির্যাস , সেই ভূখন্ডের আত্ম অভিমান। আলো ও আঁধারের ঐকতান নিয়ে কবিরা লিখে ফেলেন জনপদের সংগ্রাম ও ভালোবাসার কথা। কবিদের পৃথিবী একটাই। তবুও পাঠক সব কবিদের কাছ থেকে সতন্ত্রতা আশা করে। মনে করে কবিদের বক্তব্যে মিশে থাকবে বিশেষ কোনো অঞ্চলের আবেগ মুক্তির অপরূপ ব্যথা আর আনন্দের যুগ্ম প্রতিলিপি।

ভারতবর্ষের এক কোণে পড়ে থাকা এই প্রাচীন ভূখন্ডের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, অজস্র সাহিত্যপদাতিকের কলমে লেখা হয়েছে বিচিত্র কথকতা। কাব্য থেকে কবিতা হতে সময় লেগেছে বহুদিন, আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে কেটে গেছে অনেক বছর। কবিতার কোন শেষ কথা হয় না, তেমনি কোন কবিতাই পুরনো হয়  না।  কালজয়ী কবিতার ভাষ্য চিরদিনই নতুন এবং স্রোতের 

মুখে দাঁড়িয়ে থাকে  পর্বত চুড়োর মতো। তাকে পাশে রেখেই নতুন সময়ের কবিতা ভাসিয়ে দেয় তার 

সিডার কাঠের আড়ম্বরহীন মজবুত নৌকো, যা ঝড়কে বলে সঙ্গে আয়, প্রেম ও  যৌনতাকে দেখে পাখির তীক্ষ্ণ চোখে, খুঁটে খায় জঞ্জাল, ডানায় সোনালী রোদ পড়লে উড়ে যায় দিকচক্রবালের দিকে, যেখানে সূর্যদেব নিরন্তর গভীর ধ্যানরত। 

প্রথমে চলে যেতে হয় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে। রাজন্য ত্রিপুরার এই অভিজাত জীবন স্রোত থেকেই শুরু হয়েছে ত্রিপুরার বাংলা কাব্যের পথচলা।  রাজ আমলের আখ্যান কাব্যগুলো এক একটি ঐতিহাসিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে সময়কার ত্রিপুরার জীবন, যুদ্ধ, সংগ্রাম, ধর্মীয় আচার আচরণ, রাজ্যশাসন, রাজভক্তি ইত্যাদি নিয়ে চিরাচরিত কাব্যছন্দে, সম্পূর্ণ ভাবে স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত হয়েছে। ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটতে আরম্ভ করে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য এবং রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের পর থেকেই। বীরচন্দ্রের নিজস্ব সাহিত্যকৃতির মাধ্যমেই সূচিত হয়েছে সহজাত 

কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রথম গীতিকবিতার বিস্তার। তিনি নিজের মনের চিন্তনকে কাব্যরূপ দিলেন। 

বীরচন্দ্রমাণিক্য ছয়টি কাব্য রচনা করেন, হোরি ,ঝুলন ,প্রেমমরীচিকা ,অকাল কুসুম ,সোহাগ ,উচ্ছাস ।এসব কাব্যগুলো মূলত গানের সংগ্রহ। বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর বাংলার শেষ বৈষ্ণব পদকর্তা নামে অভিহিত হয়েছেন। ত্রিপুরায় আখ্যান ও পাঁচালি রীতির কাব্যের ধারা ভেঙে দিলেন কবি বীরচন্দ্র।

মন্দ পওন  চুম্বত ফুল

     গন্ধ চহুদিশি ডারিয়া,

গুন গুন করু  মত্ত মধুপ 

পিউ পিউ বোলে পাপিয়া,

আমার গৌরকিশোর করু নবভাবে

   কতহুঁ নবীন ভঙ্গিয়া,

ঝুলতহি পহুঁ কতহুঁ ভাতি

সঙ্গে কতহুঁ সঙ্গিয়া 

বীরচন্দ্র মূলত ব্রজবুলি  মৈথিলি, ও বাংলাতেই তার পদগুলো রচনা করেছিলেন।

বীরচন্দ্র কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী। জন্ম আঠারশো চৌশট্টিতে।  তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, প্রথম কাব্য 'কণিকা ', দ্বিতীয় কাব্য 'শোকগাথা ' তৃতীয় কাব্য 'প্রীতি '।প্রকৃতির সঙ্গে আপন অনুভবের সংমিশ্রণের কাব্যময় প্রকাশ ঘটে তার লেখায়।  মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এই নারী ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাহিত্যচর্চা, শিল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে  মানসিকতা সমৃদ্ধ করেছেন , কবিতায় নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিক জগতকে খুঁজেছেন, সুললিত ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। আধুনিক আলোচকদের বেশীরভাগেরই অভিমত, রাজগী ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী। সমসাময়িক কবি, সভাকবি মদনমোহনমিত্রের কন্যা কুমুদিনী বসু, ছিয়াশিটি কবিতা নিয়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ আভা ঢাকা গেজেট ও সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিল। রাধাকিশোর তনয় নরেন্দ্রকিশোর দেববর্মণের ভাবসমৃদ্ধ কবিতা এবং সঙ্গীতও সুখপাঠ্য। অনঙ্গমোহিনীর কবিতায় কবিতা আস্তে আস্তে বাস্তবের জগতে পা বাড়িয়েছিল, চলে আসে চল্লিশের দশক, রাজ পরিবার থেকে সতন্ত্র কবিতাধারার সূত্রপাত। স্বাধীনতা পূর্বোত্তর ভারত, অস্থির সময় ইত্যাদি মিলেমিশে অনঙ্গমোহিনীর পরবর্তী কালে অনেকদিন ত্রিপুরার কাব্যজগতে তেমন কেউ আসেনি।

বা যারা লিখেছেন বেশীরভাগই গীতিকবিতার অনুসারী, ব্যক্তিগত বিলাপ কিংবা অলস মেদুর জীবনের হাতছানি। কিন্তু সেইসময় বাংলা কবিতার রূপ বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। অথচ ত্রিপুরা আধুনিক কবিতার সুর থেকে তখন পর্যন্ত ছিল  বিচ্ছিন্ন, তাই আধুনিক কবিতাচর্চার ইতিহাস ত্রিপুরায় খুব বেশী প্রাচীন নয়। বৃহত্তর বঙ্গসমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এইসময়ের ত্রিপুরার সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বাঙালিদের ঢল। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপও ততটা প্রভাব ফেলেনি এ রাজ্যের অরণ্যলালিত নিস্তরঙ্গ অলস জীবনপ্রবাহকে। তবুও এই সময়ের কিছু দুর্বল কারিগর যা আধুনিক কবিতার বীজ ধারণ করতে শুরু করেছিলেন তারা হলেন অজিতবন্ধু দেববর্মণ, নুরুল হুদা, সমাচার চক্রবর্তী, বিধূভূষণ ভট্টাচার্য, মণিময় দেববর্মণ, অশ্বিনী আঢ্য, আব্দুল মতিন প্রমুখ। ষাটের দশক, রবীন্দ্রভাব, বৈষ্ণবকাব্যের ললিতময় বিভঙ্গ পেরিয়ে যে যুগসন্ধির কবিরা পদার্পন করলেন তাদের প্রচেষ্টার সফল রূপায়ন দেখা যায়, প্রান্তিক ( ১৯৬২) ত্রিপুরার প্রথম কবিতা সংকলনে । রণেন্দ্রনাথ দেব, বিজনকৃষ্ণ  চৌধুরী, সলিল কৃষ্ণ  দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, প্রদীপ চৌধুরী, কিরণশঙ্কর রায়, অশোক দাশগুপ্ত, প্রবীর দাস প্রমুখ। ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় সলিকৃষ্ণ  দেববর্মণ, জোড়ালো সতন্ত্র স্বর। কবিতা তার কাছে সচেতন নির্মান নয়, তিনি কবিতাকে বলেছেন, উদ্বুদ্ধ অবস্থার শব্দভাষ্য। ১৯৭৩ সালে, কবি স্বপন সেনগুপ্তের সম্পাদনায় বের হয়, গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্য সংকলন, দ্বাদশ অশ্বারোহী । 

ষাটের দশক এবং সত্তরের দশক থেকেই ত্রিপুরার বাংলা কবিতার নিজস্ব রূপটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এই সময়ে যারা বিশিষ্ট ভাবে নিজেদের চেনালেন, খুব অল্প কয়েকজনের নাম বলছি, কল্যানব্রত চক্রবর্তী, পীযূষ রাউত, শঙ্খপল্লব আদিত্য, স্বপন সেনগুপ্ত, নকুল রায়, দিব্যেন্দু নাগ,অসীম দত্ত রায়,  সমরজিৎ সিংহ, প্রমুখরা।  মহিলাদের মধ্যে অপরাজিতা রায়, করবী দেববর্মণ, সুনীতি দেবনাথ, শক্তি দত্ত রায়।    কারো কারো কবিতা এইসময়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কখনো কখনো সে ব্যঞ্জনাহীন রাজনৈতিক বিবৃতি কিংবা প্রচার, আবার ঘৃণা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, প্রতিরোধ, স্থানিকতা  সমস্ত আবেগই তুমুল ভাবে চলে এলো ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় । 

এই সময়কালে ত্রিপুরার বাংলা কবিতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নকশাল ও হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে কবিতায়, অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন এই আন্দোলনকে তাঁদের লেখালেখির মাধ্যমে। তবে  তাৎক্ষণিক উন্মাদনা কবিতার গায়ে সময়ের ছাপ রাখলেও, অনেক কবিসত্ত্বাকে বিভ্রান্ত এবং বিপর্যস্ত করেছে, তাঁদের নিজস্ব কবিতার ভাষা পরিবর্তিত হয়ে অন্যের কাছ থেকে ধার করা আঙ্গিক নিয়ে দুর্বলতর এবং কৃত্রিম হতে হতে হারিয়ে ফেলেছে সজীব কবিতার ভাষ্য।  

গ্রুপ সেঞ্চুরী কাব্য আন্দোলন, ত্রিপুরার কবিতাকে বিভিন্ন রূপ ও সত্তা দেয়। 

গ্রুপ সেঞ্চুরি আন্দোলন ছিল একটি সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। কবিতাকে আত্মায় স্থাপন করে  করে চিত্রকলা, সংগীত, ভাস্কর্য, নাটক  সব কিছুর মাধ্যমে প্রতিটি শিল্পী যাতে প্রাণখুলে নিজের শিল্পসত্ত্বার উন্মোচন করতে পারে সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলন ছিল ইস্তেহার বিহীন।

এইসময় ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে থাকে। বাম আন্দোলন তখন চুরান্ত পর্যায়ে। কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক অভিঘাত আসে। তারপর আবার নতুন শাসনকালের প্রবর্তন এবং লেখক শিল্পীদের বক্তব্যকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা। কবির স্পর্ধাকে দমিয়ে রাখার চিরাচরিত প্রয়াস। যদিও কবি মাত্রই এই দাবিয়ে রাখার কৌশলের বাইরে রক্ত পলাশের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠেন। তাই তিনি যুগ নির্নায়ক।  

১৯৮০ র উগ্রপন্থী বিধ্ধস্ত ত্রিপুরা, দাঙ্গা, নকশাল ভাবধারা, প্রাপ্ত স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের হাভাতে চেহারা, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে কবিতা চলতে লাগলো।

সত্তরের প্রবহমানতা এবং আশির দশককের অস্থিরতাকে যারা কবিতায় ধারণ করেছেন তাদের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য কবিরা, হলেন, সেলিম  মুস্তাফা, অমিতাভ কর, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, দিলীপ দাস,  কিশোররঞ্জন দে, সন্তোষ রায়, লক্ষণ বণিক, সুবিনয় দাশ, শুভেশ চৌধুরী  এবং আরো অনেক।

ভারতীয় পুরাণ, বেদ, দর্শনতত্ত্ব , চতুর শব্দ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার ইত্যাদির ঘনঘোর নিয়ে কবি মিলনকান্তি দত্ত, সমাজ সময়ের বিশ্লেষণ, পুঁজিবাদ, নিরাবেগ শৈল্পিক সুষমা, তীব্র শ্লেষ অথচ সুগভীর অনুচ্চ স্বর নিয়ে কবি পল্লব ভট্টাচার্য।  কবি মণিকা বরুয়া, পাঞ্চালী দেববর্মণ, মাধব বণিক, রসরাজ নাথ, সুজিত দেব, রত্নময় দে, প্রত্যুষ দেব, বিশ্বজিৎ দেব, হিমাদ্রী দেব,  সত্যজিৎ দত্ত, অলক দাশগুপ্ত প্রমুখ,তাঁদের লেখা অসংখ্য কাব্য গ্রন্থ এবং সংকলন আমাদের সম্পদ। 

নব্বইয়ের দশকে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা বিষয়ের বিভিন্নতায়, পরিবেশনের সৌকুমার্য ও তীক্ষ্ণতায় ছুঁয়ে গেছে মানব জীবনদলিলের সমস্ত সীমা এবং অন্তহীন পরিসীমার মেধাবী দিগন্ত। এই দশকের উজ্জ্বল নাম  অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, প্রদীপ মজুমদার, কাকলী গঙ্গোপাধ্যায়,   স্বাতী ইন্দু,  বিধাত্রী দাম, সুতপা রায়,  অশীন বর্মণ, জাফর সাদেক,আকবর আহমেদ, পদ্মশ্রী মজুমদার, প্রীতি আচার্য, শিউলি শর্মা প্রমুখ।

উদার অর্থনীতিবাদ, বিশ্বায়ন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ, উগ্র ধর্মীয় মতবাদ, সাম্প্রদায়িকতার নতুন রসায়ন, দিশাহীন তরুণ প্রজন্ম, চরম বেকারত্ব, অন্ধকার এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকা নিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি একবিংশ শতকে। ত্রিপুরার কবিতা এই সমস্ত কিছুকে প্রত্যেক মুহূর্তে ধারণ করে  আরোও অনেক বেশি উজ্জ্বল  এবং বৈচিত্র্যে ঝলমল  হয়ে উঠছে, কবিতার আকুতি আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন যুগের আহ্বানে  । শূন্য দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথমভাগে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা পৌঁছেছে  বিশ্বমানে। এই যে আলোকময় বিস্ফোরণ, আমরা এই সময়ে যারা লিখছি, তারা চাই না কখনো এর শেষ হোক। অভিঘাত এবং ভাঙচুরের আশ্চর্য সম্মেলনে ত্রিপুরার বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সময় হোক চিরপ্রবহমান । ত্রিপুরার সাম্প্রতিকতম কবিতা চর্চার কথা বলব আমি। বর্তমান সময় যেভাবে দগ্ধ করছে কবির হৃদয়কে, কবিতা তো সেই রক্তাক্ত অক্ষরের মেঠো সুর। 

কবিতা কোন সংগঠিত শিল্প নয়, সমস্ত সংগঠন আর সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়ে যেখানে বিপন্ন সংঘাত আর প্রেমের সুর বেজে ওঠে সেটাই কবিতা।

"দেহের অসুখ জানালা খুলে চাঁদ দেখতে বেরোয় / খুব একা হয়ে গেলে পড়ে ", ( অনিরুদ্ধ সাহা)  ত্রিপুরার এই সময়ের এক  তরুণ কবির কবিতার লাইন, এই পংক্তি দিয়েই প্রবেশ করব আমরা একবিংশ শতকের অস্থির, বিষাদাচ্ছন্ন কবিমনের ব্যাকুলতার কাছে।

"মানুষ বাড়িতে না থাকলে গাছ

মানুষ বাড়িতে না থাকলে পাখি

বনের গন্ধ ছড়িয়ে যায়

দীর্ঘদিনের মঞ্জুরীর ক্ষুধা

আগ্রাসী হয়ে উঠে

কতদিনের প্রতিশোধ "( অভিজিৎ চক্রবর্তী) 

কবিতার কথা লিখতে বলেন অনেকেই। আসলে যে কবিতার কাছে এলে নীরব হয়ে যায় মন, সেই কবিতার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ত্রিপুরার শূন্য দশক বা প্রথম দশকের কবিতার মধ্যে স্নিগ্ধতা বেশি। শ্লেষ বা বিদ্রুপের তেমন কালোয়াতি দেখা যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। হয়তো সেই আততায়ী ছোরা অন্যভাবে কবিতায় এসেছে,

"রিক্সায় কোনো আয়না থাকে না

কেউ কেউ পরে লাগান

পেছনে আসা গাড়ি দেখতে নয়

পেছনে বসা যাত্রী দেখতে

যখন ছোরা মারেন পেছন থেকে কেউ

তখন তাঁদের চেহারা যেমন হয়

অনেক রিক্সাওয়ালাই সেটা দেখতে ভালোবাসেন। "( অভিজিৎ দাস) ।

এক আজব মহামারী আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, গভীর ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার স্তব করছে পৃথিবীর নতুন তরুণটি,

"ডিপ্রেশন এক বুদ্ধিজীবী রোগ।

ক্রমাগত আমরা হেরেই যাই শুধু

ক্রমাগত নিরর্থক জিতেই যাই আমরা

সমস্ত জয় ও পরাজয়ের সম্মিলিত যোগফল    

নিয়ে আমরা ক্রমশ নীল হতে থাকি। '( পার্থ ঘোষ ) '।

বিশ্বাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বিষসিক্ত তির চলে যায়, তার পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা কবিতা,

"বিশ্বাসেরও বয়েস হয়েছে ঢের

ঝুলকালিতে মাখামাখি এখন

আমরাও এসে দাঁড়াই কার্নিশে

অন্ধকারে হাতে হাত রেখে,

নিজেরা বলাবলি করি

বুকের ভেতর একটা আস্ত সূর্য

জ্বলে উঠতে

আর কতটা সময় বাকি? " ( শঙ্খ সেনগুপ্ত)  

ত্রিপুরার একজন নবীনতম কবির কবিতা থেকে,

"কী খোলা খোলা আঙুল তোমার আজও

মধ্যমায় ছড়িয়ে রাখে

পুরনো হাওয়াকল! 

নিষাদ বয়ে এনে কোমল গান্ধর্ব,

মূর্ছনা, মেতেছিলো তেমনি

অঙ্গনবাড়ির জানালা ..."( সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য )। 

 অঙ্গনবাড়ির জানলা দিয়ে কবিতা ঢুকে পড়ল আমার শৈশবে, এটাই অসাধারণ লাগল আমার। 

ত্রিপুরার কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের তরুণ গবেষক, অভিজিৎ চক্রবর্তী বলেছেন,

"নাগরিক জটিলতা, ত্রিপুরার কবিতার কখনোই মূল স্বর নয়। স্থানিক ভূগোলের যন্ত্রণা, ক্ষোভ, টানাপোড়নের চাইতেও প্রকৃতির অসীম ব্যাপ্তি বা উদারতার ভিতর দিয়ে ত্রিপুরার কবিতা বিকাশ লাভ করেছে। "

আসলে একদিকে উদ্বাস্তু মানসিকতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ভয়, ত্রিপুরার কবিদের স্পষ্টবাদিতায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তাই কবিতায় এসেছে ভাষার সৌকর্য, ভাব, নান্দনিকতা ইত্যাদি।

আমরা পড়ব ত্রিপুরার কবি মৃণালকান্তি দেবনাথের একটি কবিতা,

"আমাদের বাড়ির সামনে কোন শমীবৃক্ষ ছিল না। যার নীচে এসে বসতে পারেন বোধিসত্ত্বের মতো প্রাজ্ঞ তরুণ। তবে পেছনে ছিল ঝিঁঝি ডাকা কাঁঠালবাগান। যেখানে হলুদ চোখের তক্ষক শিশুদের স্কুলের, ঘুমোবার সময় ইত্যাদি অ্যালার্ম ঘড়ির মতো মনে করিয়ে দিত। বিল ক্লিন্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যখন পোখরানের জবাবে পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানালো তখন আমরা বড়ো হচ্ছিলাম। আসলে সুদের হার কমা বাড়া, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এসবে শিশুদের কোনোদিন কিছু যায় আসেনি "।

পঙ্কজ বণিক,  রাহুল সিনহা, চিত্তরঞ্জন দেবনাথ, মৌলিক মজুমদার, প্রাণজয় সিনহা, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, বাপ্পা চক্রবর্তী, গোবিন্দ ধর, সুমিতা ধর বসু ঠাকুর, অর্পিতা আচার্য, দেবাশ্রিতা চৌধুরী, মন্দিরা লস্কর, রিয়া দেবী, অভীক কুমার দে, হারাধন বৈরাগী, শুভ্রসংকর দাশ, পায়েল দেব, জেরী চন্দ, সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য, দেবাশীষ চৌধুরী, মুনমুন দেব, প্রিয়তমা দত্ত, অনুরাগ ভৌমিক,  অমলকান্তি চন্দ আরোও প্রমুখ।  এইমাত্র যাদের কথা বললাম, তারা সবাই কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ের লেখক নন, কেউ কেউ অনেকদিন আগে থেকেই লিখছেন, এখনো লিখছেন আবার কেউ সদ্য লিখছেন। এই প্রজন্মের কবিদের কাছে ধরা দিয়েছে লেখার গলিত লাভা।যারা একইসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে পরিযায়ী মানুষের গৃহহীনতা। দেখতে পাচ্ছে দীর্ঘদিন একটি দেশে বাস করলেও মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না আসলেই তার কোন দেশ আছে কী নেই। কখনো পার্শ্ববর্তী দেশ অথবা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে  আসা অসহায় রিফিউজির দল বাস করতে বাধ্য হচ্ছে আর একটি ভূখন্ডে। তাদের সন্তানসন্ততিদের শৈশব, যৌবন কেটে যাচ্ছে শরনার্থী শিবিরে। ত্রিপুরার বর্তমান বাংলা কবিতা এসব দেখছে, লিখছে, তাদের পূর্বসূরীরাও লিখেছিল অতীতকে, আজ আবার অনিশ্চিত বর্তমান আমাদের সামনে।

এই নিয়ে নতুন করে ত্রিপুরার সৈকত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হল, "দেশভাগের কবিতা " পড়ব কিছু লাইন এই বইটি থেকে।

কবি তমা বর্মনের কবিতায়, 

"রাষ্ট্রের করপুটে গণকবর বিছিয়ে শুয়ে আছে উনিশ লক্ষ জীবন, পরিচয় পত্র, 

স্বদেশপ্রীতির প্রতিটি যুদ্ধাক্ষর থমকে বঙ্গবুকে অপমানে

সংলাপে ছয়লাপ রাজতন্ত্র প্রপিতামহের সমাধির পাশে

ধ্বনি দিচ্ছে কারা 'ওরা আমরা '!"

"কবি সুমন পাটারী লিখেছেন,

"বরাক আর ব্রহ্মপুত্রের তীরে

উনিশ লক্ষ ভোটার

উনিশ লক্ষ তারার মাস্তুল থেকে

উনিশ লক্ষ দড়ি ঝুলিয়ে

আত্মহত্যা করেছে এক রাতে

কারণ রাষ্ট্র তাদের ভূমি ও দড়ি ঝুলানোর গাছ থেকে উচ্ছেদ করেছে রাতারাতি। "



আমরা যাচ্ছি বৈশ্বিক অতিমারীর মধ্যে দিয়ে। পেনডেমিক আমাদের সমস্ত অহংকারকে চূর্ণ করে দিয়েছে। লকডাউনের দিনগুলোতে মানুষ নিজেদের বিষাদ অতিক্রম করতে গান বেঁধেছে, কবিতা লিখেছে। সৃজনশীলতার কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে আত্ম উন্মোচন করতে চাইছে। এই আবহে রচিত হয়েছে প্রচুর কবিতা। সৈকত প্রকাশন পেনডেমিকের সময়কালকে ধরে রাখতে আরো একটি কাব্য সংকলন বের করেছে, "কোরনাকাল "।সেখান থেকে কয়েকটি পংক্তি উচ্চারিত হোক। 



"রক্তে বাঁধানো শ্রমিকের পা,

উচ্ছ্বাসের মতো বহুল প্রচারিত মৃতদেহের কাছে শিশুটি কাঁদে,

তার একমাত্র প্রজাপতিটি হারিয়ে গেছে বলে "।( আম্রপালী দে)।



"একটা পৃথিবীর দু 'চোখেই কোরোনার ভয়!

আরেকটি পৃথিবীর ভয় ত্রি নয়নে

এক চোখে কোরোনা আরেক চোখে ক্ষুধার ছোবল

আর তৃতীয় চোখে রাষ্ট্রীয় লাঠি!  '( সঞ্জীব দে)  '।



হঠাৎ করে এই  ধারাবাহিক মৃত্যু মিছিল আমাদের কেমন যেন সংকুচিত, ভয়ার্ত করে দিচ্ছে। আর্তনাদ হারিয়ে বুক ঠেলে উঠে আসছে কেবল অস্ফুট শব্দ অনর্গল। 



"আমাদের কথা হয়েছিল মহামারীতে

আমাদের সাক্ষীর ভার নিয়েছে এই পেনডেমিক

আমরা কথা বলার ভার পাখিদের দিয়ে নির্ভার থেকেছি

আমরা নিস্তব্ধ হওয়ার অনুভব মহামারী থেকে নিয়েছি

আমাদের শরীর স্পর্শ করে গেছে সমুদ্রের জলো হাওয়া

আমাদের প্রিয় আগুন হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নিষ্ঠুর খবর

আমাদের ব্যথার ইতিহাস খেলো হয়ে গেছে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার কাছে

আমরা ক্রমাগত তুচ্ছ হয়ে গেছি মহামারীর কাছে ...( চিরশ্রী দেবনাথ )।



সৃজন হলো প্রবহমানতার ধারক ও বাহক। পৃথিবীর বুকে যত যুদ্ধ, যত মৃত্যু, যত অসুস্থতাই আসুক, মানুষ কবিতা লেখা    বন্ধ করবে না। মানুষ ভালোবাসবে, কবিতা  লিখবে, চারপাশ থেকে কুড়িয়ে আনবে সময়ের বিচ্ছুরিত স্তোত্র, ত্রিপুরার কবিতা, ত্রিপুরার মানুষের সম্মিলিত সত্তার বাস্তব প্রতিফলন, যার মধ্যে রহস্যবিস্তারের জন্য ঢুকে পড়েছে মেখলা চিতার ক্ষিপ্রতা, নাগকেশরের গন্ধ, পাহাড়ী ছরার মুখরতা।



কবি তমালশেখরের একটি কবিতা  দিয়ে আজ ইতি টানব এই লেখার,

" দারিদ্র বিলাস " কবিতার নাম। 



"ভাঙা দেওয়াল -

আরো একটু ভেঙে দিয়ে

দেখছি চাঁদ। "

এই বিপন্ন ঝুলন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হতে থাক ত্রিপুরার  বাংলা কবিতা।




সৃজনের মাধ্যমে আলোকিত হোক বিষাদ

( প্রকাশিত ...জঠর)

"সৃজনের মাধ্যমে আলোকিত হোক বিষাদ "
……………
চিরশ্রী দেবনাথ

জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দিত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যুর আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?

“কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম অসল্ মে দনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”

কথাটি বলেছিলেন, পৃথিবীর একজন আধুনিকতম  মানুষ, তাঁর নাম মির্জা গালিব। একজন কাব্য আলোচকের মতে ভারতবর্ষে নাকি দুটোমাত্র প্রেরিত বই রয়েছে,একটি হলো    বেদ এবং অপরটি হলো মির্জা গালিবের কাব্য সংকলন। মোগল সাম্রাজ্য অস্ত যাচ্ছে, ম্যালেরিয়া মহামারী আক্রান্ত দিল্লী, ব্রিটিশদের কঠিন হাতে সিপাহী বিদ্রোহ দমিত হচ্ছে, চারদিকে রক্ত, খুন, হাহাকার, মৃত্যু, সাহিত্য সংস্কৃতির এমন অন্ধকার সময় যেন আর কখনো আসেনি,  রঙিন গুলদস্তার মতো ঐতিহাসিক দিল্লি নগরী শ্মশানে পরিনত হচ্ছে, আর দারিদ্র ও ক্ষুধার মাঝে বসে মির্জাগালিব লিখছেন, আত্মজীবনী, আমরা জানতে পারছি আজ ইতিহাসের সেই ব্যথাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা আশংকা করছিলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের, কোন্ কোন্ দেশের মধ্যে লাগতে পারে, ইত্যাদি। 
সেই বিশ্বযুদ্ধ কিন্তু প্রায় শুরু হয়ে গেছে, চলছে,
একটি দেশ আর একটি দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কোথাও সমুদ্রের বেলাভূমিতে পরে থাকছে বস্তাবন্দী শিশুদের মৃতদেহ । 
 পৃথিবীর সমস্ত দেশ এক দিকে, অন্যদিকে ছোট্ট একটি ভাইরাস। তার বিরুদ্ধেও লড়াই চলছে এখনও, শারীরিক ক্ষতি ও মানসিক ট্রমা কোনটাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্মহীনতার হতাশ প্রান্তর। 
তাই বলে কী সৃজন থেমে থেকেছে?
যত বেশি বেশি অন্ধকারের মধ্যে আমরা ঢুকেছি, তত  অবাধ্য হয়ে কলম ধরেছি। 
যদিও, ' Hunger have no choice ' তবুও ইতিহাস কিন্তু আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়। 
আর যেহেতু আমি কবিতা  লিখি তাই কবিদের ওপর বর্ষিত যাবতীয় অভিশাপও কিন্তু আমার বেশ গায়ে লাগে, বিশ্ববিখ্যাত Poetry পত্রিকার প্রতিষ্ঠাত্রী-সম্পাদিকা হ্যারিয়েট মনরো, যিনি নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত কবি, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা একটি সম্পাদকীয়তে যুদ্ধকে romanticize করবার জন্য কবিদের দায়ী করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। এই ভ্রম সংশোধন করার দায়িত্ব তিনি ন্যস্ত করেছেন কবিদের কাঁধেই:
তেমনি সদ্য বিগত মহামারীও কিন্তু কবিদের  নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছে, আসলে সবাই বাঁচতে চেয়েছে। তাই এতো এতো গল্প, কবিতা রচিত হয়ে গেলো।
আমাদের আরো একটি দীর্ঘ যুদ্ধ করতে হচ্ছে, যারা লিখছি তাদের জন্য, সেই যুদ্ধটা হলো ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধে। সৃজনশীল মানুষদের কাছে    এই অন্ধকার থেকে কখনো আলো আসে, কখনো তা পাথরের মতো নিরেট। আমরা এই রাজ্যে যারা  লেখালেখি করছি, তারা আসলে 
কেনো লিখছি। বিশেষত বৃহত্তর বাঙালি পাঠক সমাজ আমাদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত নয়। আমাদের কারোরই এখন পর্যন্ত নোবেল প্রাইজ ইত্যাদি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কেউ কেউ বলবেন উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমরা লিখছি, কেউ বলবেন নিজেদের আনন্দ দেওয়ার জন্য, মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য লিখছি, কিন্তু এই তাগিদটুকু কতোদিন থাকবে, একসময় সামনে শুকনো খাদ ছাড়া তো আর কিছুই থাকবে না, তবুও যেহেতু লিখতে শুরু করেছি, তাই থামতে পারছি না  এবং যে জিনিসটা ভীষণভাবে অনুভব করছি তা হলো সমালোচকদের অভাব। খারাপ লেখার থেকে ভালো লেখাকে তুলে আনতে এবং একটি অকাব্যিক শব্দ ব্যবহার করছি  ' বাজার ' সেই বাজার তৈরি করতে হলে, লেখক মাত্রই দ্বারস্থ হতে হবে নিরপেক্ষ সমালোচকের। আজ  ত্রিপুরার সাহিত্যিকরা যা কিছু লিখছেন, তার বেশিরভাগই আড়ালে রয়ে গেছে, আলোচনা করার মতো রসদ আছে, এমন কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস বাছাই করে সেগুলোর ধারাবাহিক পদ্ধতিতে আলোচনা  হওয়াটা খুব  দরকার। 
পাঠকের মনন এবং বোধের জমি তৈরি করেন সমালোচক। পাঠকের মেধাকে শান দেওয়ার দায়িত্ব সমালোচকের। আর একবার যদি বোদ্ধা, মননশীল পাঠক তৈরি হয়, তবে তা নিশ্চিত ভাবে কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অউপন্যাস, অকবিতা, দুর্বল গল্প প্রকাশিত হয়ে 
সাহিত্যের অবনমন ঘটানোর থেকে রাজ্যের মৌলিক সাহিত্যের সমৃদ্ধির  জন্য আলোচনা হোক। 
তাহলেই শুধু বইের সংখ্যা এবং গুণগতমানের মাঝখানে যে একটি গভীর কুয়ো রয়েছে সেটা খুঁজে পাওয়া যাবে, আর আমার মতো কুয়োর ব্যাঙ কতটুকু সাগরের ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পেয়েছি তা বোঝা যাবে। 
বর্তমান সময়ে সৃজনের সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ,
জাপানের মর্যাদাপূর্ণ একটি সাহিত্য পুরস্কার হলো আকুতাগাওয়া সাহিত্য পুরস্কার। জাপানি ঔপন্যাসিক রিয়ুনোসুকে আকুতাগাওয়ার স্মরণে ১৯৩৫ সাল থেকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়ে আসছে।
এ বছর জাপানি সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার আকুতাগাওয়া পুরস্কার জেতা জাপানি লেখক রি কুদান, লেখকদের তাদের লেখায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছেন।
'দ্য টোকিও টাওয়ার অফ সিম্পেথি' (জাপানি ভাষায় 'টোকিও টু দোজো তো') উপন্যাসের জন্য পুরস্কার জেতার পর লেখক একটি প্রেস কনফারেন্সে  নিশ্চিত করেছিলেন যে, তার এই বইটির প্রায় ৫ ভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় লেখা হয়েছে।
 'দ্য টোকিও টাওয়ার অফ সিম্পেথি' উপন্যাসটির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন বিচারকরা। বিচারক কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, এই বইতে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। 
লেখক কুদান ব্যাখ্যা করেছেন যে তিনি AI
 ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষার সারমর্ম বা প্রকৃতি অন্বেষণ করতে চেয়েছিলেন।
পাঠকদেরর মনে হয়েছে, বইয়ের প্রকৃত গল্পের চেয়ে লেখার ধরন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের মতে বইটি জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য অধ্যয়নের জন্য উপযুক্ত, যেখানে ভাষাগত দক্ষতার ওপর প্রায়শই জোর দেওয়া হয় ।
লেখাকে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর করতে লেখক সাহায্য নিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার । নিজস্বতাকে ছাপিয়ে এখানে যে সূক্ষ্মতার প্রকাশ দেখানো হয়েছে তা লেখকের নিজস্ব আভিজাত্যকে ক্ষুন্ন করে বৈকি । 
এটা অনেকটা কনটেন্ট রাইটিংএর মতো হয়ে যাচ্ছে বা অফিসিয়েল চিঠি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগেও তো আমরা লেখালেখিতে রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতাম। ভালো লিখতে হলে ভালো পড়ুয়া হওয়া চাই। ফারাকটা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখানে টিচারের কাজ করছে, কারেকশন করছে, কোথাও লেখাটা আর নিজের থাকছে না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে লেখালেখির ভাষ্য এভাবেই বদলে যাবে অতি দ্রুত হয়তো কোথাও মূল্যহীন । এখানে শূন্যতা ও বিষাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এইসময়ের লেখক ও পাঠক সমাজ। 
একজন কবিকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, কবিতার কাছেই আবার আসবো। কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করছি কবিতার আশ্চর্য শক্তি। গল্প বা উপন্যাসের পাঠক হয়তো বেশি, কিন্তু সবচেয়ে দ্রুত যা বিকীর্ণ হয় এবং সারা বিশ্বে যার বিকেন্দ্রীকরণ হয় সবচেয়ে বেশি, তা একমাত্র কবিতাই। কেন জানি মনে হয় সাহিত্যের
বিশুদ্ধতম মৌলিক রূপ হলো কবিতা। 
 পোয়েট্রি’-তে শেলি বলেছিলেন: “poets are the unacknowledged legislators of the world .
ইংরেজি কবিতার অন্যতম স্তম্ভ এলিয়ট ১৯৪৩ সালে একটি বক্তৃতায় বলছেন: “একজন কবির দায়িত্ব আগে ভাষার প্রতি, তারপর মানুষের প্রতি। ভাষার সংরক্ষণ, পরিবর্ধন ও সর্বোপরি ভাষার উন্নতিসাধনই তার প্রাথমিক কর্তব্য।” আর সমালোচকের মতে কবি হিসাবে ইলিয়ট সর্বদাই “relatively indifferent, or uninterested, observer of the phenomenal world”
কবিদের চিন্তা ভাবনায় একটি লিমিটেশন আছে, ভাবজগতের বাইরে, তিনি বাকি যা কিছু বলবেন সব নাকি মূল্যহীন, কবিতাটিই তার ভাষ্য। কবিতাটি শক্তিশালী না হলে কবি হারিয়ে গেলেন। কিন্তু কবিকে তাহলে  কেন  ভয় পায় মানুষ? কেন জেল বন্দি করে রাখে? কেন কবিকে হত্যা করে তার মৃতদেহ গুম করে দেয় শাসক? অথচ কবিতা কোনো কাজের নয়, অন্নের সংস্থান কোনোদিনই কবিতা দেয় না? তবুও  পেনডেমিক,  রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিপন্নতার সময়ও প্রচুর কবিতা লেখা হলো, বেরুলো অনেক কবিতার  বই। 
কবিতা আসলে যেকোন জায়গা থেকে শুরু হতে পারে, যে কোন জায়গায় শেষ হয়ে যেতে পারে, ছোট্ট একটি দৃশ্যকল্পের এরকম অসীম ভাব বিস্তারের ক্ষমতা আর কোথাও নেই কবিতা ছাড়া । 
রবীন্দ্রনাথ নিজেও একসময় জানিয়েছিলেন তাঁর বলিষ্ঠতা এবং দুর্বলতার জায়গা একটাই; inconsistancy।’ একটি ভঙ্গুর সত্তা আমাদের গ্রাস করতে করতে লিখিয়ে নেয়। 
একটাই দ্বন্দ্ব চিরকালীন, টু বি ওর নট টু বি। রাজনীতিক এবং কবি, দুজনেরই মানুষের সঙ্গে দ্রুত কানেক্ট হবার ক্ষমতা প্রচুর, কবি যদি নির্জনতার পূজারীও হোন, তার কবিতা কিন্তু পৃথিবীর ধুলো মাখা পথিক, দৃশ্যকল্পতার এই মায়াবর্তে দাঁড়িয়ে তাই আমার কাছে মনে হয়, দু মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা থাকলে একটি কবিতা লেখাই যেতে পারে, যা বিনামূল্যে নীল জ্যোৎস্নার আনন্দ দিতে পারে।

বর্ষার কবিতা

বর্ষা দিনে 
......... 

শহর জুড়ে নামছে বৃষ্টি
ভেজাবে এবার জলের ছাট
 রুদ্ধ দ্বার, শুভ্র রাত
মরু গোধূলি  উটের সারি
এক টুকরো বেলুচিস্তান 

কাঁদছে আকাশ পড়ছে নীল
হচ্ছে তারা অভিমান 
দিচ্ছে আঘাত হালকা করে
ধমণীতে  ভোরের সেতার 

উড়ছে খালি  চপের ঠোঙা
তরুণী হাত রেলিং ধরে
মিষ্টি বৃষ্টি দিচ্ছে ফোঁটা
ঘেমো কপালে এই দুপুরে

ফিরছে স্কুল খয়েরী স্কার্ট
ঝপাস ঝপাস আকাশ ফাঁক
ছুটছে ছাতা নম্বর কম
ভেতরে ভয় বাইরে হাসি
এই বয়সেই রাখছে বাজি

শেষ বিকেলে সাজছো তুমি
হলুদ প্লাজো লাল কুর্তি
টুকরো বিদ্যুৎ হাত ব্যাগে
রেখেছো ভারী যত্ন করে
আইসক্রিম ঠোঁটে নিচ্ছো চেটে
একটু ধুলো, ইঞ্চি আকাশ
গলার খাঁজে আটকে রইল
তিনটি কথা ক্লান্ত বাতাস 

 বারান্দাতে ভিজছে পাপোশ
ডুবছে ধুলো রন্ধ্রপথে 
যাচ্ছে চুরি পায়ের ছাপ

বর্ষা তোমার কায়দা ভারী
লিখছো চিঠি পাতার ডগায়
টুপ করে পড়ছে হেসে 
পলকা ঘাসের দুষ্ট নৌকো
ছুটছে তাতেই  পাগল হয়ে 
 
যেদিন ছিল দরকার খুব
সেদিন তুমি ঝরোনি 

খাতায় শুধু জিরো দাগ
হতাশ চোখে আকাশ দেখা
হৃদয়ে ছিল অবুঝ  অসুখ 
সে এক গভীর বেলা
অন্যমনস্ক দুঃখ খেলা

রাস্তায় আজ হলুদ ভীড়
কেমন যেন অদ্ভুত সব
একটুখানি কাটলো পা
রক্ত ঝরলো দু এক ফোটা
আস্তে আস্তে দীর্ঘ ক্ষত
বাজার ঘুরে ঔষুধ এলো
বললাম আমি লাগাবো না

মেঘ করেছে সারা বেলা
ভৈরবীতে আসবে দামাল
ঘুমের কাছে ছুটি নিয়েছি
লিখবো শুধু বৃষ্টি দাগ
দেবো কেবল সেই মেয়েকে 
বলছে যে শুষ্ক হেসে 

ঘোর বর্ষায় চিনছো যাকে
 আসছে বছর ভাববে বসে
হয়েছিল সে এক মস্ত ভুল... নির্ভুল 
ঝরবে জল নতুন ছাতার
ভিজবে তখন আনমনে
চোখ রেখো অনামিকায়
নিভছে সেথায় গতবারের মেঘলা রোদ ...

© চিরশ্রী দেবনাথ

গলনাঙ্ক নির্ধারিত হয়নি

গলনাঙ্ক নির্ধারিত হয়নি 

***************

সৌন্দর্যের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়

মেয়েরা তাদের মুখের ত্বকে জোঁক বসিয়ে রাখত। 

 ওরা টেনে নিত রক্ত, ফ্যাকাশে মুখে ছেয়ে যেতো নিরক্ত জ্যোৎস্নার ভৌতিক আভা,

সেই জ্যোৎস্নার মুখোশ নিয়ে পারিজাত বনে ঘুরে বেড়াত ললনারা, তাদের নখের শ্রী বৃদ্ধি করত

মৃত প্রজাপতির পাখার গুঁড়ো, 

 মসৃণ নখশিরায় তাই বিগত জন্মের শুঁয়োপোকার বক্র চলন,    

মিলনোদ্যত সমুদ্র জীবকে হত্যা করলে যে মহামূল্য 

জৈব রস পাওয়া যায়, তার মোক্ষম লেহনে দেহ বল্লরী উদ্ধত শিখার মতো লকলকে হয়ে ওঠে, 

পারদ কণিকা মিশ্রণে ঢাকা ঠোঁটের নিচে, 

উত্তর গোলার্ধ জুড়ে আসন্ন বসন্তের ষড়যন্ত্র, 

কুমিরের রক্তে যেন মিশরীয় ভালোবাসার ফেনিল দ্যোতনা 

প্রত্যেকটি সৌন্দর্যই শেষপর্যন্ত পুরুষগমন করে না, 

দ্যুতি, তীক্ষ্ণতা, কেশদামের পুষ্পশোভা, শয্যায় খুলে রেখে, কিছু কিছু মেয়ে হেঁটে যায় ধূসর প্রান্তরে,

তাদের গ্রীবা থেকে নেমে আসা দুর্বোধ্য অ্যামাকো

কেউ পড়তে চায়নি কোনোদিন। 

দীর্ঘ কবিতা, চিরশ্রী দেবনাথ

প্রথম কবিতা



মধুপত্র 




দীর্ঘ লেখা আসার আগে হাঁটু গেড়ে  বসি

শরীর থেকে  ক্রোধ নেমে যায়, 

নেমে যায় অশ্রুকাম ,মলিন জীবন 

থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মধুশ্বাস

পাখি হারিয়ে ফেলা অরণ্য যেন 

তোমার প্রতীক ।এই লঘু  স্তন ও

 বিরামচিহ্ন দিয়ে অঙ্কিত চরাচর

দ্রোণফুলের সুগন্ধ বয়ে আনা ভোর, মৃত্যুর শ্বাস

 


প্রত্যেকে নিশাচর, সকরুণ বিরোধে 

অবহেলা সয়ে যায় শীতের আয়ুর মতো ;

 এখানে আমি আছি অথবা নেই ;

 আছে শুধু রেখে যাওয়া শরীরের 

নিঃসীম পচন ।নদীর ঢালে অপুষ্টিতে

 বেড়ে ওঠা চিনার ফলের  ফ্যাকাশে 

বীজের দানায় দানায় আত্মহত্যাসম প্রাণ, 

ছেঁড়া পতাকা পড়ে  আছে, 

ধূসর সংগ্রামের দগ্ধ চিহ্ন। 


দেবী আসছে, পথে জ্বেলে রাখো

 আলো, সশস্ত্র জওয়ান !

 মা...ঢেকে রাখো বুক, পাহাড়ি কোমড়,

পৃথিবীতে ভয়, ছিঁড়ে ফেলে শরীর, 

চারদিকে শুধু মেয়েদের শরীর, 

আমাদের লেখায় তারা মেধাবী উষ্ণ!

দেবীকন্যারা কামদুনি,  মণিপুর হয়ে 

এসো, ওদের বারান্দায় বসে পুজো নিও, বেলপাতা, যজ্ঞের ধোঁয়া, 

রক্ত মাখা ফুল নিয়ে পায়ে পায়ে এসো, 

এখানে এখন পুজোর আয়োজন, চন্দন ধূপ...


যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়া পরাজিত 

সৈনিক সুন্দর! গৃহমুখী প্রাণ,

 দরজায় মায়ের অপেক্ষা হলুদ 

সম্বরার ঘ্রাণ ।নারীর কোলে মাথা 

রাখবে সে যুবক পুন্য হীন, 

ফিরে এসেছে যেন অচেনা হাওয়া 

কিংশুকের শব নিয়ে উদাস বসন্তে, 

তারপর, কবিয়াল হৃদয় খুলে দাহ 

দেখাও, দেখো এই আবাহন, 

বাঁশের বনে কেন নিঃশব্দে হেঁটে 

যাচ্ছে শান্ত চোখের ডাহুক ! 


ধান কাটার পর যে মাঠ পড়ে থাকে

 তার কাছে গিয়েছি ,জলে ভেজা

 দুর্বল মেরুদণ্ড, হাতের পাতায় মগ্ন ভোর

আমার পায়ের শব্দে ঘুম থেকে উঠেছে

 মাটির কীট, চোরা ঘাসে কেটেছে পা, 

নির্জন সূর্যের ছেঁড়া আলো

হেঁটে যেতে যেতে শরীর থেকে 

ঝরে গেছে আবরণ , দীর্ঘতম মাঠ, 

জলশূন্য চোখে উপল মাছের 

কোলাহল, পৃথিবী দ্বিধা হতে 

গিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার মতো, 

সোনালি ঘরে রাখা ভেজা ধান,  

পচন ধরেছে এইমাত্র


কুয়াশা নামেনি এখনও, বর্ষার দুখি 

ধারা চরাচরে ,আনাজের নরম শিকড় 

গলে গেছে, নষ্ট হয়েছে ফসল

পুজো যেন অভিঘাত, ভয়ঙ্কর 

নদীস্রোত, কান্না। কিশোরীর 

দু বেণি বেয়ে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত

এই সুখ মৃত্তিকার মতো, 

মুঠো থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে গাছ, 

এসো পাখি, সবুজ তাপে 

পুড়ে যাক স্মৃতিস্মারক 


হলুদ সর্ষের খেত নেই, 

জলে ভরা শস্যহীন মাঠ

আগাছা আর বেগুনি ফুলের ঝোপ, 

গোধূলির আসনে ম্লান ফুলের দল, 

অসুস্থ মানুষের চোখে তবু

ভিড় করে আসে উৎসবের 

হারানো দিন, পায়ে পায়ে

 জড়িয়ে আছে এই দংশন, 

শ্যামাপোকা, কোজাগরীর মোহ, 

নিবেদন করি মাঝে মাঝে, 

কোথায় লোভহীন দেবতার থান, 

উজ্জ্বল রশ্মি দিও, চোখ ছিন্ন 

করে চলে যাবে ভেতরে, 

অনেক নিচে হাওয়ার মতো 

শোক, মৃদু সুখ ...



ভালোবাসি বলে, করতলে তিল 

হরিতকী, শুশ্রূষা। মৃত্যুশোক ভুলে 

যেতে চাই তাই তর্পণ মানি না

বাসক গাছের পাতা তুলে আনি, 

নীলকণ্ঠের মধুবিষ

পাত্র ভরে রাখা অদৃশ্য ধোঁয়া, 

চোখ জ্বালা করা। 

যখন অবিশ্বাস করি এই 

মোহকান্তার, কন্ঠে ঢালি 

নেশার মতন, দেখি ঘুঘু 

ডেকে যাচ্ছে চরাচরে,

রোপিত হচ্ছে যেন শুধু 

কালো দ্রাক্ষার বীজ ...



এখানে এসেছি বলে মহুয়ার 

গাছ ছায়া মেলে দিল

বনের গন্ধ যেন যুবতীর ঘোর, 

কৈশোরের মফসসলের চৌরাস্তা 

থেকে আরো ঘন হয়ে সর নামে 

জ্যোৎস্নার!  গুল্মপথে নির্বিকার 

আজ সেই নারী, শুনশান আকাশ, 

বোবা নক্ষত্র বাড়িয়েছে হাত, 

এই তবে মৃত পূর্ব পুরুষ, 

সময় হয়ে গেলে চিনে নিও ইশারা,

 গলে গেছে পাপতাপ, সকরুণ 

আলো শুধু ভেসে বেড়ায় অস্মিত প্রান্তরে।



বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে শহরে 

 ভেসে আসে জুরি নদীর দীর্ঘশ্বাস

শুষ্কতা এতো জলীয় কেন? 

কেন দিকচিহ্ন আগলে রাখে 

মন্দিরের দরজা।  পথিক ফিরে যেও !

এখানে ইতিহাস নেই,  

স্তব্ধ ধানের তুষ আছে

গড়ে ওঠা এক মিশ্রবসতির 

সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ।কার্তিকের 

সংকীর্তন থেকে প্রসাদ কুড়িও

শোক ছিঁড়ে যেন নিরাকার ব্রহ্ম জেগে ওঠে



ব্যর্থ জীবন দ্রুত আগুনের কাছে 

যেতে চায় ,আগুন পেরোলে যেন 

কিছু না থাকে আর 

স্বর্গের রতিচিহ্ন অথবা 

নরকের সহবাস

শূন্য থেকে এসে শুধু বিলীন , 

চিহ্নমাত্র ভুল জেগে নেই কোথাও



নারী ফিরে গেলে মৌ দাগ পড়ে থাকে

পুরুষ ফিরে গেলে দিকচক্রবাল

ফিরে যেতে যেতে অভ্যাস হয়ে 

যায় সমস্ত বিরহবিন্দু

উদাসীনতার বৈভবে মেতে উঠছি , 

হয়তো ঝরে যাচ্ছে  আত্মরতি

ভাঙা সঙ্গীতে ভেসে আসছে 

আমারই কন্ঠ অকাতর

আগে শুনিনি, কেঁপে উঠছি, 

হাত ডুবিয়ে তুলে আনছি পাহাড়ি বাদল



শূন্যমাত্র জানি, ফিরে দেখা 

বকুলের খুধা ,জলবায়ুর উষ্ন  

বার্তা পেলে কেঁদে উঠি

খুলে দেখি অবারিত বায়ুসম্ভার , 

গরিব মেধা ,শীতের করুণ পাতার 

 ,ওপর শিশিরের দাগ , যত্নে গড়া 

মাকরসার ঘরবাড়ি আর অস্থায়ী

আমি, এখান থেকে চলে যেতে যেতে

খুৃৃঁজে পেয়েছি কড়ির মালা , 

ঈশ্বরহীন । জৈব গন্ধে ভরা ।


একদিন উচ্ছাসের কামনা 

করেছিলাম ,বসন্তের নরম ধুলো 

মাখা সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়ানো । 

তারপর জেনেছি খুব কঠিন

দুইজন একসঙ্গে হওয়া কোনো এক

গোধূলিতে। সেই থেকে বহে বায়ু ,

ক্রমাগত ব্যক্তিগত পদ্ম সম্ভারে

জমানো হয়ে গেছে না হওয়া দিনলিপি।


দুঃখযাত্রা শেষে আবারও জেগেছে পৃথিবী

মৃত্যুভার , শোক সন্তাপ নিয়ে ব্যথিত 

শঙ্খের মতো যেন ভোরের আকাশ ।

এসো ' সন্তর্পন ' তোমাকে ছুঁয়ে দিই

দমকলের সাইরেনের মতো কি 

কোথাও সংকেত দিল  অশুভ !

ছিন্নধারাপাতে গলে গেছে তুঁতফলের রঙ

ফ্যাকাশে বিস্ময়ে কাঁটাভরা চোখে দেখে

মন্বন্তরের মাঠেও কেউ বলে  ওঠে

 " আহা চলো তো "

 সোনালি খাবারের মতোই মেয়েরা

 ছেলেদের খেয়ে ফেলে 

এই অভিশাপ পেতে পেতে ছেয়ে 

গেছে শুধু গ্রহণ আর পাপ 


অনন্ত কাম হয়ে ওঠো

চোখে কাম , চোরা থুতনিতে কাম

তোমাকে দেখে দ্রবীভূত হয়ে গেছে অন্ধকার

তোমারই কামে আগুন জ্বেলে

পুড়িয়ে দিচ্ছো নরম শঙ্খের মুখ

অবারিত কাম শেষে

শরীরে এখন শান্ত নগ্ন জল


হে ক্ষণিক এসো , লৌহপাত্র নিয়ে ।

 স্বচ্ছতোয়ায় হাত রাখি,

পৃথিবীর অজানা গহ্বর যেন,

 লেখা আছে সেখানে কোনো

এক জন্মান্তরের ইতিহাস , 

অশ্লেষা নক্ষত্রের অভিশাপ, 

অভিশপ্তরা সুন্দর হয়

জনারণ্যে তারা বিদ্যুতের 

মতো আঘাত দেয়,

কাঙালের মতো কাঁদে।


অনন্ত আলোর মতো জেগে 

উঠেছে পৃথিবী ,ছড়ানো নৃশংসতা,  

ডানা ভাঙা আকুতি

ডিনামাইট আর বোমারুর গর্জন

তারই ফাঁকে নতুন কান্না জেগেছে

দুহাত মেলে যে চারাগাছ 

জন্ম নিয়েছে ,সে কি শোক 

ভুলে যাবে দ্রুত, মৃত্যুর ওপর 

দাঁড়িয়ে বাক্স খুলে বের করবে 

পান্না রঙের যোনি !


 

প্রতি ঋতুতে  কবিতা লিখি ,

ঋতুর পর ঋতু কবিতা

 লিখতে লিখতে

ঋতুহীন দিনে বসবাস ঘনিয়ে 

আসছে ক্রমাগত

দুধঘাসে ছাওয়া নদীতীর 

আমাকে জীবনের লোভ দিও, 

প্রথম স্নানের চিহ্ন

তুলে এনে বলো এসব 

এক মানুষীর অবহেলা

ভুলতে পারিনা ঐ সন্ধ্যা , 

ফিরে আসা ধূপগন্ধ

শেষশয্যায় আমার শরীরে 

সব ক্ষত জেনে রেখো

বিস্মৃত প্রেমের দারুচিনি গাছ



আধা শহরে বাস করি, পাগলের সংখ্যা কম

প্লাস্টিকের চেয়ার ও গোল টেবিলে 

সন্ধ্যার আড্ডা হয় ,কুকুরেরা শোনে, 

কিছু মানুষও । আড্ডা শেষে রাস্তায়

 একা ঘুরে বেড়ায় অরিজিৎ সিং এর 

গানের কলি, গেয়ে গেছে বখাটে ছেলে, 

নেশা আর গান, হোলির দিনে 

তাকে ডেকে এনো, ধর্মগ্রন্থ ছিঁড়ে 

যজ্ঞের ধুনো দিও, শহরে ছেড়ে দিলে

 সে তখন পাখির মতো হয়ে যাবে ,

 মিহি সুর, তর্জনীহীন, অন্ধকার চোখ



পৃথিবীর বুকে এখন শৈত্য ঝড়

যুদ্ধের কারবারিতে জিডিপির 

ওঠানামা ,পাহাড়ের ভেতরে

 ইন্টারনেট সংকেত নেই

তবুও গোপন যুদ্ধ আছে, 

মশাল জ্বালানো হয় না

ক্রমবর্ধমান জ্বালানীর দাম, 

নেভানো আগুন। 

অন্ধকারে বিবশ কিছু মানুষের দল, 

পরস্পরের কাঁধ খুঁজে বেড়ায়,

ধারালো অস্ত্র হারিয়ে গেছে শুনেছি

হয়তো বন্ধুত্ব চায় সংকেতহীন 

জঙ্গলে... মধুর শিস। 


ভারতবর্ষ এতো ধার্মিক ছিল না ,

এখন হয়েছে।

যখন তখন আকাশবাণী শুনি, 

দধিচির হাড় শপিংমলে বিক্রি হয়. 

 চড়া জি এস টি ।

কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির 

অনেকক্ষণ হলো টয়লেট পেয়েছে ।

সে হাসছে,বসতে নিষেধ আছে।

বাইশো টাকার কালো ব্লেজারের নিচে

ভাত আর আলুসেদ্ধ হজম হয়ে গেছে কবেই।

তারও গার্লফ্রেন্ড আছে, অস্থায়ী চাকরি করে।

এখন সবাই অস্থায়ী,  বেতন অনিশ্চিত।

নীল কাজল আর ন্যুড লিপস্টিকের নিচে

অবারিত কামনার ছলছল ।



শহরে মিছিল,অটোওয়ালারা 

পতাকা লাগিয়েছে ,রামমন্দিরের ছবি। 

বাড়িতে হলুদ চাল এসেছে, পরমান্ন রাঁধব। মহাকাব্য তৈরি করছি আমরাই। 

মহাকাব্যে রাবণ নেই, 

আশ্চর্য এক রামায়ন শুষে নিচ্ছে জলজ অক্ষর।

হে মেধাবী দেশ ছেড়ে যেও না। 

রাজনীতিতে এসো, 

বশিষ্ঠের মতো শিকড় ছড়ানো শেখো।





কবি তৈরি হচ্ছে, 

পোশাকের নিচে শূন্য হৃদয়।

ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে সরু গলায়। 

শীতার্ত জোঁক ধীরে ধীরে কামড়ে ধরে ধমনী

রক্তপাতেও থেমে থাকে না বসন্তের বিবরণ

সামনের লোকগুলো ঘুমিয়ে গেছে ।

উত্তরীয় আর স্মারকের দোকানে 

বাকি  পড়ে আছে টাকা। 

রক্তখাওয়া জোঁকের মুখে নুন ছেড়ে দিই,  

আরো একটি কবিতার জন্ম

দিতে গিয়ে যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে কেউ।



জনহীন রাস্তায় নিঃসঙ্গ  পি. সি.ও আর

 জয়পুরি দোপাট্টার মেয়েটি , 

শ্যামলা মুখখানি হারিয়ে গেছে কোথাও 

 ছায়া দিয়ে সাজানো এক অদ্ভুত বাতিঘর ,

 ক্যাশবাক্সে প্রেমিকার নাম্বার রেখে গেছে দোহারা যুবক

জেরক্স মেশিনখানি নষ্ট হয়েছে কবে

আশিকির গান বাজছে আজো, 

শুধু শেষ হয়ে গেছে নব্বইয়ের দশক 



কবিতা লিখি,

 যেমন লেখে প্রেমহীন মানুষ, 

ভালোবাসাগুলো শরীরের কাছে গিয়ে

ফেরার পথ খুঁজে, শয্যায় শায়িত সেই ধ্রুব

অভিমান নিয়ে বনমহোৎসবে সামিল হই 

গাছেদের মিলন নেই, অথচ বসন্ত আছে

ফুলসম্ভার,  সুগন্ধি আর প্রবল ঝড়ের দিনে

নম্র উচ্ছাস, হাওরার মাতন, কেবল স্পর্শ নেই। 




শান্তি এসেছে, 

খয়েরি খামে পাইন গাছের বীজ

সমান্তরাল পথরেখা, শুকনো মাছের গন্ধ,

অনার্য নারী মাটির পাত্রে রেখেছে ভাতের মণ্ড, 

টিউবওয়েলের জল ঢেলে, হেসে ওঠে চিকন, 

গর্বিত চোখ। হোক চোলাই ! 

দেহে তো নতুন জোশ। 

ঢুঁপি ছরার জল ছেঁকে পাওয়া কাংলা মাছ, 

কালোকৃষ্ণ পাতার গন্ধ নিয়ে 

ফুটে উঠেছে হলুদ ঝোল।

সন্ধ্যা বড়ো মরমী হয়, 

পিচ রাস্তা ছেড়ে দিয়ে

ধীরে ধীরে  মিশে যায় রুগ্ন গ্রামের শরীরে।



যে পথে পৌষ ঢোকে আমি তার সঙ্গী বাউল

পরনে কুসুম রঙের পালক, নীল তিলক

শূন্যতা তুলে নিয়ে যেতে, ধানের খেতে এলাম

অগ্রহায়নের বৃষ্টিতে নরম হয়ে গেছে পাকা ধান

বিষণ্ণতার রোদ ছুঁয়ে মগ্নতা এসেছে তার

অসময়ে বৃষ্টি  হলে আমিও লক্ষ্যহীনতায় ভুগি

ভেতরে ভেতরে সুগন্ধি পচন, পোকা, ব্যর্থ 

কবিতা মাদুলি, আভূমি প্রণাম করে ক্ষমা

তুলে নিয়ে যাচ্ছি, মুখ ফসকে অঙ্গার বেরিয়ে

যায় যখন তখন, ঠান্ডা ধার, নিঃশব্দের ঝকঝকে

আভরণ পরে ডিসেম্বরেই আমার ভেতর যতো

অকারণ প্রপাত। 



চাকার আওয়াজ যেন রাত্রির অভিঘাত

এতো দ্রুতগামী ট্রেন দিয়ে কি করব?

যদি ছায়া না দেখতে দেখতে যেতে পারি

পুরনো দিনের মতো অলস হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়

ফোন নং হারিয়ে গিয়ে যেখানে আমি অবান্তর

ঘাসের ওপর দিয়ে চলে গেছে কিছু মানুষের পায়ে হাঁটা পথ ....





 সৌরভ ছড়ানো এই বেঁচে থাকা শেষ হবে 

না যেন কোনোদিন, কখনো শাকের আঁটির মতো সংসার আর ছলনার মায়াময় জাজিম, ডুবে গেছি । যে স্তর ছেড়ে আসি সেখানে অমৃতের জন্ম হয় , প্রেতিনীর মতো এগিয়ে এসেছি পদচিহ্ন নেই, বাসভূমিতে মন্ত্র জেগেছে, 

ধোঁয়ার জলসা । চারপাশে ভিড় হোক,

 শান্ত মলিন জল ,মাছজন্ম ভালো , 

জলহীন সমাধিতেই শেষ




আমি যে লেখা লিখি ,সে আমার ফাঁদ

ফাঁদে পা দিয়েই কামড়ে ধরি কন্ঠ

তারপর ফোঁটা ফোঁটা করে গড়তে থাকে

অম্ল ও ক্ষার ...এক একটি আত্মহত্যার খবর 

নাড়িয়ে দিয়ে যায় ছাইয়ের মতো রাতে , বেঁচে থাকা মানুষেরা স্তব্ধ সাদা পাথরগুলো নিয়ে আলোচনা করে,আমাদের নিঃশ্বাসে তাদের

দীর্ঘ শ্বাস হারায় ,আত্মহত্যার কারণ শোনা যায় ,

কিন্তু সে কারণ একটি ফুলের মৃত্যুর মিথ্যে গুজব



পুরস্কার প্রাপ্তি , ধর্ষণ আর হত্যার খবর 

একসঙ্গে পড়ি , কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকি,জলাভূমিতে বেড়ে ওঠা কলমি লতার

মায়াবী তুচ্ছতাগুলোই শুধু আমার হোক  

...জ্যোৎস্নার মতো পরিকল্পনাহীন ,

এরকম বেঁচে থাকি আরো কিছুদিন 



কোনোদিন ভোরবেলায় ভুল করে উঠি

দেখি লাইট পোস্ট ঢেকে আছে স্বর্গীয় আলোয়

মনে হয় এল ই ডি বাল্ব নয় , না দেখা মেসেজ

সকাল হতে হতে বিস্মৃত মায়াবীলোক 

রান্নাঘরে ধোঁয়া ওঠে , তরুণ শাকসব্জি স্পর্শ করতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে আঙুল 



অস্বীকার করতে ভালো লাগে যেমন তুমিও করো

একে অপরকে অস্বীকার করতে করতে

চোরা কুঠুরিই সম্বল,

হতাশ হওয়াও নেশার মতন

তবুও আমরা অস্বীকার করি

এই মাঠ ,শ্বেতফলে ভরা গাছ ,

 বহু নিচে ছড়ানো শেকড়



কেন জানি রোজ মৃত্যুর কথা ভাবি

কীভাবে মরব কে জানে

হয়তো আমার মায়ের মতন

শুষ্ক গলায় চলে গেছে জলহীন

আমিও যাবো এভাবে যাহোক একটা

জলহীন,  কবিতাহীন,  গানহীন



মুখর ছিলাম ,এখন পুরনো বাড়ির মতো উত্তাপহীন,যেসমস্ত উদ্ভাস কবিতা ছিল

ছত্রাকের স্থবিরতায় জমেছে  ফ্যাকাশে চর্বি

আত্মা ক্ষয়হীন এবং উজ্জ্বল ।

  এই বিশ্বাস আছে কোথাও এখনো ,

তাই আবারও উঠে যাবো 

অক্ষরে ছড়ানো আবেগে ভেসে বেড়াবে ক্রৌঞ্চমিথুন ।




শহরের একটিমাত্র মৃতপ্রায় নদীকে নিয়ে


আমরা স্রোতের স্বপ্ন দেখি    


আমাদের জল কমে যাচ্ছে


মেশিন দিয়ে নদীর আরো গভীরে যাই


দগদগে ক্ষত থেকে দমকে দমকে ওঠে কিছু জলের বেদনা, 


স্নানঘরে সেইসব জলবিন্দু থেকে অনিশ্চিত ফেনা 


ছড়িয়ে পড়ে শরীর থেকে শরীরে


এই জল তাই ভালোবাসা জানেনা, 


আসলে ভালোবাসা বলে কিছু নেই, 


আছে শুধু দেহ ও ক্ষত উন্মোচন । 
















দ্বিতীয় কবিতা


আশ্বিনের বিকেল

......


এমন  বৃষ্টিদিন এসেছে

 কয়েক ঋতু পর, উন্মুক্ত !

 স্নানযাত্রায় গোঠের ঠাকুর

 যেন আমাদের পাহাড়ে, 

শটিবন, বাঁশঝাড়, ধলাই নদী, 

পোড়া আলুর প্রসাদ, 

গহন ছেড়ে এই মাত্র 

সন্ধ্যা পথপ্রান্তে সমাগত,  

অন্ধত্ব প্রবাহিত হয়ে ধুয়ে 

নিয়ে যাচ্ছে ক্লেদ, ছিন্ন বল্কল,

 এখানে সমাধিক্ষেত্র, মনসার থান, 

দরগার সীমানা, ধূপবাতি, মোম,

 আগাছার ফুল নিয়ে চলে যাচ্ছে, 

তমসা সুন্দরী, গতবছর মরেছে সে

 সাপের কামড়ে, দু 'হাতে কুয়াশার

 ঠোঙা, নীলকণ্ঠ ফুলের রস,

 ক্ষীণ হাসি, জ্যোৎস্নার প্রেতিনী যেন, 

বর্ষা ধুয়ে দিতে চায় যত 

তাঁর দুঃখ সমারোহ, 

হেলেঞ্চার জঙ্গলে ভরে গেছে পথ, 

গোধূলির ভাঙা আলো পড়ে

 যেন স্বর্ণসম রূপ, তাম্রবর্ণ যুবা,

 প্রবল জীবন, সাদাটে সন্ধ্যায় 

আলোড়ন তুলে গেছে গ্রামে, 

দাঁড়াও ক্ষণিক, শান্ত বারিধারায়, 

ধুয়ে যাক অশুভ বচন,

 মাটি পেয়েছে জননের ক্ষমতা,

 কাদামাটি জলে মিশে যায় 

শুধু প্রসবের সুখ... বেদনা। 






কাঁঠালের হলুদ শাঁসের মতো 

আঠালো লেখা কী করে

 লিখবে গ্রাম্য কবি,

 যদি তাকে উপেক্ষা করে

 যায় গভীর সেই প্রেম, 

উদাস স্তনের মতো খালি 

হয়ে গেছে  মৃৎ পাত্র,

 ধানের শিকড় থেকে 

আনো বংশধারা, জিন। 

ব্যক্তিগত ছিল যে নারী,  

আর জন্ম দিতে চায় না, 

ভুলে গেছে মিলন মুহূর্ত, 

তার গাভীর নাম শশী,

 উঠোনে ঝরছে নতুন দুগ্ধ,

আঠারোমুড়ার জঙ্গল থেকে 

সোজা চলে গেছে উৎরাই পথ,

 রোমশ ছাগল শিশু আর 

পাহাড়ি ছরার জলে, 

নীরবে নামছে কায়াহীন 

সংসার, এখানে মরে গেলে 

যেন জন্ম হয় আবার, 

রিফিউজি লতা ঘেরা 

বাসুকির খোপে লাল জবা, 

কালো তাগা, তাবিজের বন্ধন, 

পাঠ শেষ , ফিরে এসো বধূ, 

এই অনিহা ছেড়ে,

 সংসার সংসার খেলা 

হোক পুনর্বার, হিম চাঁপার

 সৌরভ খুঁজে পাক মৌমাছির 

আস্তানা, ধূপগাছে ছাওয়া 

দেবদেউলে ধরা পড়ি

 জৈষ্ঠ্যের চন্দ্রগ্রহণে।






এই যে বিস্তৃত মনু নদীর অববাহিকা

ঘোলা জলের অন্তর্লীন স্রোতধারা, 

পাহাড় ধুয়ে আসা সেগুন, শিমুলের

 শিকড়স্নাত জল, নিশিন্দা আর কালো 

ওঝা গাছ,  দু একটি শ্মশানঘাট, 

পোড়া কাঠ, মাটির কলসী, কাল রাতের

 ঘন বর্ষা নিয়ে গেছে লোভ আর দংশনে মৃত

 দেহের ছাই, তারে মেলে দেওয়া হলুদ লাল 

শাড়ি, বাড়ির উঠোন ঘেঁষে চলে যাওয়া

মাটির রাস্তা, যেতে যেতে শশা, কুমড়ো,

গন্ধরাজ লেবু, কাঁঠাল কিনে নেওয়া,

 শ্মশান দেখে ফেরার সময়, সংসারের    

কথা ভাবা, চোরা স্রোত, জলের ঘূর্ণি 

দেখতে দেখতে আবার স্থবিরতায় আসা, 

পায়ের পাতায় মোরগের নরম পালক, 

ভাট ফুলের ঝোপের কাছে দুটো বক

 নির্নিমেষ আর তাদের গলার কাছে 

পিছলে যাচ্ছে মেঘভাঙা রোদ, কেমন

যেন মিলেমিশে আছি, হয়তো আমার

আর ভাবার কিছু নেই, তর্ক মরে গেলে 

মানুষ এমনই খোলা হাওয়ার মতো হয়ে যায় ।


 কোনো লেখাই আসল নয়, 

আগুন থেকে জন্ম নিয়ে আসেনি

 সেই ঢেউ, জ্যোৎস্না থেকে চুরি 

করেছি আলো ,জোনাকি থেকে

 গোপন আলোর অভিসার, 

পল্লবিত গাছ থেকে

ছায়ার নরম কৃষ্ণ ইতিহাস

রৌদ্র দগ্ধ দুপুরের হলকা

মুখে মেখে যাকে চলে যেতে

দেখেছি অভিমানে, তার মুখ থেকে

কুড়িয়ে এনেছি দু একটি অঙ্গার

গরিব হয়েছি , হৃদয়ে ধারণ

করেছি গৈরিক, নির্বাণের স্তুতি    

দীর্ঘ রাস্তা …স্বর্ণচোরা

ঘাসে ঢাকা, শস্যের খেতের পাশে, 

ঝড়ের আকাশের নিচে যেদিন মাটি 

গেয়ে উঠবে দাহ গান, বল্কল

খুলে দেখবো অস্তিত্ব বলতে ছিল

খানিকটা বর্ণমালা, শঙ্খমুখের পাতা।




ছোট গ্রাম, নদী নেই তার,

 ছরা আছে ,উঠোনের পাশ

 দিয়ে বয়ে চলা,

 কিশোরীর তরুণ হাতের মতো,

 মুঠোতে  নাগচম্পার দাম, 

অর্জুন বৃক্ষের মুকুল, 

বাড়িতে বাড়িতে সুপুরি 

গাছের দেহ দিয়ে তৈরি 

ব্যক্তিগত ঘাটখানা, 

দু একখানি বড়শি রাখা, 

টিলার পাশ দিয়ে চলে

 গেছে যেন সে এক গ্রামীণ ভৈরবী,

 গোপনে নিয়েছে শুঁকে 

গর্জন গাছের পাতায় মোরা 

পান্তা ভাত, ধানি লঙ্কার গোছ, 

শুঁটকির ভর্তা, রান্নাঘরের ছনের 

চাল থেকে ঝরে পরে রাতের শিশির, 

শব্দহীন !  নৌকো নেই কোথাও, 

সাঁকো আছে,  বড়ো আপন, 

এখানে জন্ম নিয়ে মেয়েটি 

রয়ে গেছে এখানেই, 

বাপের ভিটে ছেড়ে গেছে 

কেবল দু'ঘর, একই রয়ে

 গেছে জলের উৎস, ছায়ার পতন, 

মনখারাপ হলে পা দুলিয়ে  

জলে তুলেছে ঢেউ, 

দুধ জ্যোৎস্নায় ভেজা 

বাঁশপাতা পড়েছে ঘাটের কোণে,  

ভাসতে ভাসতে পাশের ঘাট 

থেকে ডেকে এনেছে মাকে, 

শীর্ণ শরীর, মায়া ভরা চোখ, 

পাথরের থানে তার যাবতীয় 

বিশ্বাস কমলা সিঁদুরে লেখা, 

মেয়ের বাড়ি যেতে  হবে বলে 

নিয়েছে, কচুর লতি, কাঁঠালের

 বীজ, দিব্য গন্ধ স্বর্ণমুসুরি চাল।




মনুনদীর তীরে যে সন্ধ্যা নেমে 

আসে ,তা নিমের ছায়ার মতো ,

পারের কাছে শ্মশান বলেই

 মনু স্ত্রী হতে পারেনি

ভুলবশতঃ আমরা তাকে

 নদী বলি ।শূন্য বক্ষে বর্ষার

 ঘোলা জল ভরে দিয়ে 

শোকাতুর মানুষকে বাড়ি 

পাঠিয়ে দেয় ,ফিরে আসতে 

আসতে দেখি কুশের বনে 

জেগে উঠছে কাশের চারা 




ত্রিপুরার কিছু দুঃখ ও মোহ, 

সিঁদলের গন্ধ থেকে আসা,

পোড়ানোর সময় গলতে থাকে 

আঁশের নিচে থাকা নুন, চর্বি, 

ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে খাদ্যনালী, 

পুঁটিমাছ আর মরিচের ঝাঁঝে, 

খালি হয়ে যায় পূর্ববঙ্গের জমিদার

 রিফিউজিদের পাত, নির্দ্বিধায় 

দুহাজার টাকা কেজি, ইলিশের 

গল্প ওঠে আজকাল, আর কবে 

কোন কালে সতের টাকা দিয়ে

 কিনে আনা হতো নববর্ষার স্বাদ, 

ছিল এক কাটাতারহীন নির্দোষ

 চোরা কারবারি,আমাদের গরিব

 জিহ্বা এখনো এসব, আঁশটে

 দুর্বল অনভিজাত খুচরো গল্প

 উগড়ে দিয়ে মৃত্যুবাসরে সন্ধ্যার 

কীর্তন গেয়ে, খোল করতাল 

বাজিয়ে,বিড়ি ফুঁকতে ফুৃঁকতে 

বাড়ি ফেরে রোমশ অন্ধকারে। 





খাং বাঁশের বেড়া, শিল বরুয়ার খুঁটি 

বেতুয়ার টুকরি করে এনেছে পাহাড়ের মাটি

ঘর উঠছে ঘর, নয়নতারার অঙ্গন, 

ঈশান দিয়েছে পুরোহিত, পুজো হয়েছে

মুরগি আর কবুতরের মাংসল প্রসাদ

রক্তের শুভ্রতা দিয়ে তৈরি ঘর মনোরম

সুন্দি গাছের নতুন খাটে শুরু হয় 

চোখে চোখ রাখা, ঠোঁটে মাকড়সার 

পবিত্র জাল, ঘর বেঁচে থাকে ততদিন,

যতদিন ইঁদুর, বেড়াল, আদার ঝোপ,

হলুদ গাছ, চাঁদের আলো পারস্পরিক 




 গান গাইতে জানি না, জন্ম থেকেই 

বেসুরো।  এটা অভিশাপ। 

আমার কাছে লুকোনো আছে

 কিছু ঝর্ণা ও পাথর। 

পাথর বসিয়ে বসিয়ে পথ 

বানিয়ে দিই, বাঁকাচোরা, পিছল। 

তাতে ঝর্ণার কষ্ট হয়, রক্তক্ষরণে 

ভেসে যায় সে, কোনোদিন 

এই রক্তস্রোত নিয়ে আসবে সুর, 

নিষ্ঠুরতা মুছে যাবে আমার, 

অপেক্ষা করছি, 

দুর্বল ঠিকানা রইল এখানে,


 " পূর্ব হিমালয়ের নিম্নভাবর 

অঞ্চলের বাসিন্দা,  

কালবৈশাখীর বিকেল থেকে 

কবিতা লিখে আসছি “







একটি সন্ধ্যা হচ্ছে, যেন সব 

সন্তান দূরে চলে গেছে, 

একা কোনো মা শাঁখ বাজাচ্ছে, 

ঘরের আলোয়, ফুটে ফুটে উঠছে

 চলে যাওয়া মেয়েদের পা,

 শ্যামলা সবুজ তরল মুখের 

ছায়াগুলো পালং শাকের মতো 

নরম, তারা রয়ে গেছে মায়ের চোখে, 

সন্ধ্যার সর নেমে আসছে মফস্বলের

 লাইটপোস্টে ভাঙা পিচ রাস্তায়,

 ছুটি হয়ে যাওয়া নিচু অফিসবাড়িতে,  

পৃথিবীর সব শহরে এমনি সন্ধ্যা আসে,

 চুপচাপ। স্মৃতির শহরে জাহাজডুবির 

খবর ছাপা হয়, আবহে হারমোনিয়ামের 

সুর, প্রত্যেকটি সন্ধ্যা প্রিয় অতীত, 

নীরব আততায়ী, খেয়ে ফেলে 

মেয়েদের কলিজা, নরম জরায়ু।



অজস্র গাছ কেটে নিলে, 

পাহাড়ে ভাঙন নামে,  

শালিক পাখি সন্তানহারা, 

পুত্রঞ্জীব গাছ গিয়েছে মরে, 

দেহ জাগো, ভিড় করো অরণ্যের 

মতো, প্রখর মিলন, বিশ্বস্ত মেঘে 

ঢাকা সেদিনের চরাচর, গড়িয়া 

পুজোর মাস, গাছের সঙ্গে গাছ 

মিশে যাচ্ছে, ধনেশের পালক 

পড়ে গেছে নিচে, হাজার রঙের 

জখম, সেইদিন সব গাছ হয়েছিল 

মানুষের মতো চন্দ্রকামুক, 

তাদের আশ্লেষে ঝড় হয়েছিল, 

বোঝেনি কেউ, ধ্রুব ভেঙে 

জেগে উঠেছিল ভাস্কর্য, 

ভোরের বেলায়, নিভে গেছে সব, 

চিহ্নমাত্র নেই, শুধু সবুজ লতার

 চর উদ্ভিন্ন সৌরভ




যেন সে অনেকদিন পর এলো,

 বহু সকালের পর, নিশিডাক 

ফিরে গেছে কত, দ্বাদশীর আকাশ

 চূর্ণ মেঘের মতো নেমেছে উঠোনে,

 সভ্রান্ত লয়ে এসেছে সে, 

হলুদ গোলাপের স্তবকে রহস্য 

ছড়িয়ে যায় কুবু পাখির ডাক, 

খাসিয়া পানের বাটা রেখো, 

ভেজানো সুপুরি কুচি, 

যাদের ভালোবেসেছিলাম, 

নীরবে এসেছি ছেড়ে, সেইসব  

রূপোলি ভালোবাসা দিয়ে 

অঙ্কিত এই চরাচর 



সেগুন,  শিমুল, গর্জন, জারুল, 

মেহগনি ,গামাই, অর্জুন, অগরু

  চিরহরিৎ পুরুষ গাছ, বর্ষার গায়ক।

এখন গাছ নয় কাঠ শুধু কাঠ, 

চামড়া নেই, ভেতরের মাংসগুলো 

খাঁ খাঁ করছে ।

হেমন্ত ঋতুর বিষাদ আঁকা, 

শরতের সুখ ,বুড়াছা দেবতার 

পুজো হয়েছিল কোনোদিন

হয়তো লেগে আছে মাঘ মাসের বলির দাগ

বনজামের হারানো রঙে এখন কেঁদে ওঠে

ভৃঙ্গরাজ, উদাল ঝোপের ছায়ায় ছায়ায়

সে ছিল এক বনভূমি, ফেনি থেকে মনু, 

শাকানের চুড়ো, এখন গাছ নয়,

 কাঠ শুধু কাঠ,চামড়া নেই, 

খাঁ খাঁ করছে মাংস, রক্তময় নিস্তব্ধতা


 .

বড়ো বড়ো সড়ক হচ্ছে আমাদের, 

পাহাড় ফেটে যাচ্ছে, কালচে ঝর্ণার ধারা

মসৃণ রাস্তায় এখন দ্রুত চলে যায় গাড়ি

আমার হাত থেকে হারিয়ে গেছে কবিতা

অশরীরী ছায়া নিয়ে মৃত বনে ঘুরে বেড়ায় 

গাছের শিশুরা, কোথায় গেল হাজার পাখি

আমি প্রতিদিন এই একটি লেখাই লিখছি

 গাছ কাটা হয়েছে, বৃষ্টি কমে গেছে

ঝড়ের নামকরণ হওয়ার পর হিসহিসে 

গলায় শহুরে লোকজন বলে ' চিয়ার্স '। 

এখন গাছগুলো আবার লাগিয়ে 

দিয়ে যান মাননীয় কর্তৃপক্ষ, 

রেইন ট্রি বড়ো হতে দীর্ঘ সময় লাগে ...

ততদিন  শুষ্ক  হাত, মরু হৃদয়, 

বিপুল কাতরতা, হয়তো আমৃত্যু ! 


পুনরায় এসেছে আশ্বিনের শেষ

গাড়ই ব্রত করে ফিরে যাচ্ছে বধূ,

কোলে কাঁখে নীরব মধ্যাহ্ন, 

খালি বাড়ি পূর্ণ হোক সন্তান সন্ততিতে, 

বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা নামবে হয়তো 

কাল সকালে, অতসী ফুলে

ভরে যাবে পশ্চিমের পুকুরের ঘাট,

পায়েস পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে 

মেয়েটি, গ্রীষ্মের গন্ধমাখা 

কালোজিরা চাল জোগাড় হয়েছে, 

আলো মরে আসছে, দিন চলে 

গেল...একটি দিন। 

উপবাস, আর দুর্বল শরীর 

ফেলে যায় ঋণ, অনুতাপে লবনাক্ত। 




আসাম আগরতলা জাতীয় সড়কে

এখন বাঁক কমে গেছে

সরল হতে হতে দ্রুত হচ্ছে গতি

কোথায় রহস্য ঘেরা এক পশলা অন্ধকার

আর ঋজু নাগার্জ্জুন গাছ?

ত্রিপুরার রাস্তা তবে কি হারিয়ে ফেলেছে

তার শরীরের মায়াবী ধার

বাঁক হারিয়ে গেলে অজানাও হারিয়ে যায়

অজ্ঞাত বাঁকেই সব মৌতাত

সংকীর্তনের মতো সহজ হয়ে যেও না তুমি

লোভ জাগিয়ে রেখো শ্মশানের ডোমের মতো

মৃত্যু এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে

বলে যাবো একাদশ বাঁকে আমি ছিলাম









লেখক পরিচিতি


চিরশ্রী দেবনাথের জন্ম ত্রিপুরার কৈলাসহরে , ১৯৭৯ এর ১২ ফেব্রুয়ারী।  বাবা রাধাগোবিন্দ মজুমদার, মা মায়ারানি মজুমদার।  গণিতে স্নাতকোত্তর এবং শিক্ষিকা।ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নয়টি,  তিনটি উপন্যাস, দুটো ছোট গল্প সংকলন, একটি অণুগল্প সংকলন, কবিতা সংক্রান্ত যৌথ বই একটি । ‘ কীর্ণকাল ‘ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন যৌথভাবে আটবছর ধরে প্রকাশ করে চলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন

 কবিতা আত্মার সঙ্গে মিশে গেলে আর ফেরা যায় না। 

mobile phone : 9402143011
chirasree.debnath@gmail.com