মা, অভিমান ও আমি
মা, অভিমান ও আমি
.........................................
মা, গভীর মেঘনা নদীতে দেখো নেমে আসছে
হেমন্ত রাত, কালো অমাবস্যা,
দৌলতখাঁ র নদীঘরে জ্বলে উঠছে ঝকঝকে
হারিকেনের হাসনুহেনা আলো,
জাফরিকাটা কাঠের জানালায় একটি লক্ষ্মী পেঁচা
ডেকে উঠল আলতো করে,
নরম নরম মেয়েটির দিকে চেয়ে।
আজ ফ্ল্যাশব্যাকে আমি আর তুমি।
তোমার ছোট্ট মেয়ে নই,
তোমার সখী হয়ে তোমার সব না বলা কথা শেয়ার করবো।
ঐ যে কাঠের দোতলা বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড় ছুঁয়ে যেত মেঘনার আকন্ঠ যৌবন,
তোমার দুটি চোখ, দুই দেশ, ধানক্ষেত, কাশবন, বাতাসঢেউ,
তুমি কি কখনো ভালোবেসেছিলে মা....
কোনও তরুণ কি রেখে গিয়েছিল তার ভীরু চাহনি তোমার চোখে,
খুব বেহায়ার মতো আজ যদি সব জানতে চাই!
তরুণ অধ্যাপকের সঙ্গে তোমার বিয়ে,
বিস্তৃত নদীপ্রবাহ ছেড়ে এই দুরন্ত ঝরনার কিরাতভূমি, কেমন লাগতো তোমার?
প্রাচুর্য ছেড়ে, গোপী ডাক্তার কিনা,
বিয়ে দিলো এক সাধারণ মেধাবী তরুণের হাতে,
তবে তাই হোক।
তারপর তো আমাদের সেই ইটের বাড়ি,
বছরে বছরে তার জোড়াতালি এক্সটেনশন্,
দুই হাতে সংসার, তেল, নুন, আমি, আমরা,
যেদিন ডিমের ঝোল রান্না হতো,
তুমি বলতে যাতো, সুতোর রিল থেকে একটুকরো
সাদা সুতো নিয়ে আয়,
সেই সমান করে আধখানা ডিম আমার বেলাভূমি, ঐ সুতোটাতে আজও আমি হেঁটে চলেছি, আমার অভিমানী মাকে নিয়ে,
শরৎবিকেলে কালো চোখে দেখতাম
হঠাৎ একটি সমুদ্রঢেউ,ঐ সমুদ্রের দ্বীপ আমি আজ।
বাবু বোধহয় ভাবতো, তুমি আছো সব আছে,
শুধু কাজ আর কাজ,
তুমি কিন্তু আশা করতে বারান্দায় ভেসে আসা, ডালিমফুলের গন্ধছড়ানো একটি রামধনু বিকেল,
সবগুলো মশলার কৌটো এখনো তেমনি আছে।
লাল, হলুদ, শ্লেট রঙে উড়তে থাকে বৈষ্ণবী হোলি।
কখনো কি রঙ্ খেলেছিলে বাবুর সাথে?
গম্ভীর বাবু চশমাচোখে শুধুই ছাত্র পড়ান,
তোমার যে ছিল একটুকরো বালিকামন, শিশু উচ্ছ্বাস!
এমনি করেই হারিয়ে গেলো হলুদ লালের বসন্ত বিকেলগুলো।
এবার যখন ভরা নবমীতে,
তোমার খালি ঘরে রাত কাটাচ্ছিলাম আমি,
গভীর রাতে দেখি, বাবু ঘরময় হাঁটছেন।
সকাল,সন্ধ্যা, রাত গুলিয়ে ফেলেছেন সব।
আলঝেইমারস, ভুলে গেছেন বাকি অন্যকিছু,
এখন খুঁজছেন শুধু তোমাকেই।
আবার সব ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মা তোমাকে,
মনে হয় আনকোরা, অতল, মেঘনা মেয়েকে আবার চোখে হারাই,
হাতে মেলেছি কোজাগরী আকাশ,
জোৎস্নায় মুখ ঢেকেছে নক্ষত্র,
অভিমান পুড়ে পুড়ে বিষাদী কোমলগান্ধার।
তুমি যেদিন চলে গেলে, .....জুলাই মাসের ভরন্ত মনু নদী,
কি স্রোত আর স্রোত! নদী যেন শ্মশান ছুঁয়ে নিয়ে গেলো তোমাকে মেঘনার তীরে।
তাই তো গোপী ডাক্তারের বাড়িতে আজ জ্বলে উঠেছে দীপান্বিতা ....
কাঠের গেটে অবিশ্রান্ত কুয়াশা ভিজে ভিজে
কালো হয়ে আছে,
ছায়াপথে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি,
আমি, অভিমান আর আমার বালিকা মা ....
0 মন্তব্য(গুলি):