তথ্য জানার অধিকার আইন কি এবং কেন?

১২:৪৪ AM চিরশ্রী দেবনাথ 1 Comments












"আমার টাকা, আমাকেই হিসাব দাও "....মজদুর কিষাণ শক্তি সংগঠনের এই ছোট্ট দাবি নিয়ে রাজস্থানের রাজসমুন্দ জেলার দেবডুংরি পঞ্চায়েতে যে আন্দোলন শ্রীমতি অরুনা রায় তাঁর সহকর্মীরা আরম্ভ  করেছিলেন গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, তার ফলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং পরে দুইহাজার পাঁচ সালের পনেরই জুন কেন্দ্রীয় তথ্যের অধিকার আইন পাশ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে:
উনিশশো নিরানববই খ্রিস্টাব্দে কমনওয়েলথ দেশগুলির সরকার প্রধানদের বৈঠকেও তথ্যের অধিকারের গুরুত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। একটি হিসেব অনুসারে চল্লিশটিরও বেশী দেশে সরকারি তথ্যভান্ডারে নাগরিকের অধিকার সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তিরিশটির মতো দেশ ব্যাপারে আইন প্রনয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইউরোপ ছাড়াও এশিয়ার ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানে এই আইন প্রণীত হয়েছে। উন্নত দেশগুলি যথা আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে সরকারি তথ্য নথি সম্পর্কে নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন নির্দেশিকা জারি করেছে। দুই হাজার দুই সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়া শহরে ছয়এিশটি দেশের মানুষ মিলিত হয়ে "Freedom of Information Advocates Network "নামে একটি মঞ্চ গড়ে তোলে। তথ্য জানার অধিকার নিয়ে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ওই মঞ্চ আঠাশ সেপ্টেম্বরকে প্রতি বছর "জানার অধিকার দিবস "হিসাবে পালন করার ডাক দিয়েছে।

আমাদের দেশে:
সরকারি গোপনীয়তা আইনের পাঁচ নং ধারার আশ্রয়ে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন রাখা হত। জনগনের টাকা যা নানা কর ব্যবস্হার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব হিসাবে সংগ্রহ করে তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা জানার অধিকার থেকে জনগন ছিল বঞ্চিত। এই অদ্ভুত পরিস্হিতিতে ক্রমশঃ দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। দেশের বর্তমান শাসন পরিচালনার পটভূমিতে তথ্যের অধিকার জাতীয় স্তরে এক বড়ো বিষয় হিসেবে উঠে আসে এবং বিভিন্ন প্রদেশে জনমত গড়ে উঠে। পাশ হয় তথ্যে স্বাধীনতা আইন দু হাজার দুই। তবে তা ছিল অনেক ত্রুটি যুক্ত। অবশেষে মন্এীস্তরে, আধিকারিকস্তরে সুশীল সমাজের নানা স্তরে অনেক আলাপ আলোচনার পর প্রায় দেরশোর মতো সংশোধনী সহ দুইহাজার পাঁচ সালের বারো অক্টোবর থেকে জম্মু কাশ্মীর বাদে দেশের সব রাজ্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই কেন্দ্রীয় আইন কার্যকর হয়। আইনটি সংসদে পাশ হয় দুইহাজার পাঁচ সালের পনেরই জুন। কেন্দ্রীয় সরকার আইন করার আগে কয়েকটি রাজ্য সরকারও আইন করেছিল। এই রাজ্যগুলি হলো তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, অসম, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, গোয়া, জম্মু কাশ্মীর। তথ্য কি?... সাধারণভাবে ষোল ধরনের তথ্যের আধার নাগরিকদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছে এই আইন। সেগুলো হলো যেকোন ধরনের রেকর্ড, ডকুমেন্টস, অফিসমেমো, মেল, মতামত, পরামর্শ, সরকারি আদেশনামা, গাড়ির লগবুক, কোন প্রামাণ্য কাজের নমুনা, অডিও ডিডিয় ক্লিপিংস ইত্যাদি।
তথ্য কে বা কারা দেবে?
প্রতিটি সরকারি দপ্তরে এক বা একাধিক অফিসারকে জনতথ্য আধিকারিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যারা নাগরিকের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করে জানাবেন। তাছাড়া আছেন সহকারি জনতথ্য আধিকারিক। 

কিভাবে তথ্য চাইতে হবে
............................................যে বিষয়ে তথ্য দরকার তার উল্লেখ করে, হিন্দি বা ইংরেজি বা যে কোন স্হানীয় সরকারি ভাষায় দরখাস্ত লিখে নির্ধারিত ফি সহ জনতথ্য আধিকারিক কে দিতে হবে। বিষয়ে নির্দিষ্ট ফর্ম রয়েছে। এছাড়া মেলেও তথ্য চেয়ে আবেদন করা যায়। দরখাস্ত জমা করার সর্বাধিক তিরিশ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তর দরখাস্তকারীকে তথ্য জানাতে বাধ্য। কোন ব্যক্তির জীবন সম্পওি রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য জানাতে হবে দরখাস্ত পাওয়ার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে।
আইনটির সীমাবদ্ধতা:
দেশের সার্বভৌমত্ব, সংহতি, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বা সমর কৌশল বিঘ্নিত হতে পারে এমন তথ্য, বৈজ্ঞানিক এবং আর্থিক স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে, অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে এমন তথ্য জানানো যাবে না। যেসব তথ্য কোনো ব্যক্তির মেধাসও্বের অধিকার লঙ্ঘন করবে কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এই আইন সরাসরি প্রযোজ্য নয়। এই আইনের মাধ্যমে, যে কোন নাগরিক সরকারের বিবেচনাধীন কোন বিষয়ে কিংবা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কেন দেরী হচ্ছে ব্যাপারেও প্রশ্ন করতে পারেন। তথ্য না দিলে, ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে জনতথ্য আধিকারিক কে আর্থিক দন্ড দিতে পারে কমিশন। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত দরিদ্র সাধারণ মানুষের হাতে শুধু অধিকার দিলে হবে না, সেই অধিকার যাতে সে কাজে লাগাতে পারে
তা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। আজ থেকে বাইশ শো বছর আগে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সম্রাট অশোক তাঁর প্রজাদের তথ্যের অধিকারকে সুনিশ্চিত করেছিলেন সমস্তরকম জনবহুল স্হানে শিলালিপি, স্তম্ভলিপি স্হাপন করে শুধু তাই নয় মূললিপির অনুলিপিকে বহনযোগ্য ছোট ছোট পাথরে, মহামাত্যদের মাধ্যমে প্রজাগনের কাছে পাঠানোর ব্যবস্হা করেছিলেন। আজ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে এই আইন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে সহজেই পৌঁছে দেওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে বহু সমাজসেবী সংস্থা, তথ্যের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য কর্মী যারা ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে তিনি তথ্যপ্রকাশের বাধানিষেধকে কিংবা তথ্য আড়াল করার চেষ্টাকে পৃথিবীর বৃহত্তম দুর্ভিক্ষ গুলোর অন্যতম কারন বলেছেন। কারণ এই দুর্ভিক্ষ গুলোর সময় উপযুক্ত তথ্য থাকলে খাদ্যশস্যের যোগান অসম্ভব ছিল না। গনতন্ত্রে তাই তথ্যের অধিকার গরিবের. রক্ষাকবচ। গনতন্ত্রের বহু দুর্বলতা সও্বেও তথ্যের দ্রুত সম্প্রচার যেখানে বাধা সৃষ্টি করা যায় না বলে সরকারকে টিকে থাকার স্বার্থে জরুরীকালীন অবস্থার ভিওিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় সরকার গুলি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রণয়ন করা আইন বিভিন্ন দেশের আইনসভার মাধ্যমে আপামর জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পর্কে তাদের সঙ্গে কোন পরামর্শ বা মতামত নেওয়া হচ্ছে না। তাদের জীবন, অর্থনীতি বা পরিবেশের উপর তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। একবার এই আইন প্রণীত হলেই সুশাসনের অজুহাতে এগুলো কার্যকর করা হচ্ছে। ফলে সেই সব বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষগুলি চরম অবিচারের শিকার হচ্ছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নামে, মানুষের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাই স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের তথ্যের অধিকারের পথে অন্যায্য আইনগুলিকে অপসারণ করে তার জায়গায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রণালী উদ্ভাবনের প্রয়োজন, যা জনসাধারণকে তথ্যের ভিওিতে পছন্দ অনুযায়ী চলতে সাহায্য করবে। এইভাবে তথ্যের অধিকার এবং স্বচ্ছতাকে এমন এক গণতান্ত্রিক শাসনপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত করা দরকার যার সাহায্যে সত্যিই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভব।

© চিরশ্রী দেবনাথ


1 টি মন্তব্য:

  1. আমি পঞ্চায়েতের কোন কোন কোন বিষয়ে তথ্য জানতে পারি ? , আমি কি জানতে এইধরনের প্রশ্ন যে ,* পুরো একটা বছরে সরকার কতটাকা একটা গ্রামের উন্নতিকল্পে দিয়েছে এবং তা কোথায় কোথায় খরচ করেছে তার রেকড কপি কি পাওয়া যাবে । দয়াকরে উত্তরটি জানাবেন মেইল করে । (email- hasanraja1934@gmail.com

    উত্তরমুছুন