কয়েকটি বইের পাঠ প্রতিক্রিয়া, চিরশ্রী দেবনাথ।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১
বইয়ের নাম ...আঠারোটি দীর্ঘ কবিতা
লেখক ...সেলিম মুস্তাফা
সৈকত প্রকাশন
মূল্য...১৫০ টাকা
"আমি আপনাদের কাছে আসিনি
আমি খুঁজছি আমাকেই
আজ সকাল থেকে আমি গায়েব
কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না আমাকে
সোস্যাল সাইটের কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে আমার নাবালক ছবি
ছিঃ ছিঃ! কী কান্ড ভাবুন!
সিনিয়র সিটিজেন হবার পরও আমি নাবালক রয়ে গেলাম
আর আপনারা হয়ে গেলেন বোবা শালগ্রাম "
"আমি কোথাও নেই " অষ্টাদশতম দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি পংক্তি।
তিনি সেলিম মুস্তাফা।
কবি অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছেন। এই দ্বন্দ্বটি আমার মধ্যেও শাখা প্রশাখা বিস্তার করছে। আমি কোথায়, আসলেই কি কবিতায় বসতবাড়ি, কবিত্বের যে কোন বাসস্থান হয় না। সংঘাত আর যাযাবর মনোবৃত্তিই কবিতা , সবসময় নতুন কিছু চাই।
"নিজেকে ছাড়া আমি সব দেখি সব শুনি
তোমাকে চিনি আর তাকেও চিনি
যাকে পাইনি "
এই তাকে কোন কবি পেতে চায় বলুন, তাকে নিয়েই তো সমুদ্রের সফেন উচ্ছ্বাস।
"আমি তো নিজেই নিজেকে সন্দেহ করি
আমার শরীরে পাগলের হাত পা
আমার রক্তে নির্ঘুম সমুদ্রলবণ "
এই পংক্তিটি মনে হলো আমারই কথা। আমার আমাকেই সন্দেহ হয়। কবি যদি ঈশ্বরের দূত হোন তবে সৃষ্টির প্রতি এই সন্দেহগামিতা তাকে আরো দক্ষ করবে ।
এটা বইটির শেষতম কবিতা। রচনাকাল লেখা নেই।
সতেরোতম কবিতা ..."বাবু, ও বাবু "
এই কবিতাটি খুব বেশী প্রত্যক্ষ ভাবে সমাজকে ছুঁয়ে গেছে। কবিতায় উঠে এসেছে ধর্মনগর শহর, দৈনন্দিন যাপনের খুচরো অভিঘাত। চারপাশে আবর্তিত সাধারণ চরিত্রগুলোর বাঙ্ময়তা, হতাশার ঝুরো বালি, কবির চোখ সমস্ত যাপনকেই চেনা চোখে পরিচয় করিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন কবির একান্ত কাঠগড়ায়, যেখানে বিচারক আমার মতো অবার্চীন পাঠক।
"রাইমোহন "...রচনাকাল দুইহাজার চৌদ্দ।
এখানের কবি বাস্তবতার লেখক। আধুনিকতার ক্রমাগত বিনির্মাণের প্রতীক হয়ে ওঠে কবিতাটির চরিত্র রিক্সাচালক, "রাইমোহন "।
এই কবিতাটিতে কবির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অপেক্ষা দৃষ্টির বহুমুখীতার অভিঘাত প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এই কবিতায় তিনি একজন সরল কবিতার পিতা।
খুব সহজভাবে তিনি বলেন
"মানুষ কতকিছু খায়,
রিক্সা খেয়েছে, এখন টমটম খায়,
বাসগাড়ি খেয়েছে, এখন রেল খায়,
আগরতলায় তো অটোঅলারা টমটম..ই খাইয়্যা ফেলাইছে ...
হাড্ডি গুঁড়া কইরা দিছে এক্কেবারে!
...
....
খাওন ছাড়া এ দুনিয়ায় আর আছে কী? সব মিছা! "
"ঘর "...রচনাকাল ...নভেম্বর, ২০১৩
"কবিদের অশ্বডিম্ব থেকে কখনোই
ঘোড়া বেরোয় না, জঞ্জাল আর অবমাননা,
সব এখানেই আছে, এই ঘরে,
ঘরের ভেতর আরও একটা ঘরে...অন্ধকারে,
তবু,
ঘর এক দুনির্বার টান! "
আমার কথাই। যে কবির এই ঘর নেই, সে কবিতা বানাতে পারে না, পারে না নিরন্তর মাকরসার জাল সরাতে যা ক্রমশ জড়িয়ে ধরে আছে কবির সমস্ত অস্তিত্বকে। এই জাল সরিয়ে সরিয়ে কবিতার গলা জড়িয়ে ধরা।
"কবিরা যা বলেন তা কোথাও মেলে না
যা কল্পনা করেন তা অকল্প্য বেদনা, "
সব মানুষ অন্তরে অন্তরে কবি। খুনীরও আছে কবিতা, প্রতারকেরও আছে কবিতা, কারণ কবিতা নির্গমন। সুন্দর এবং অসুন্দরের। তাই এই পংক্তিতে আমি কবির সাথে একমত নই। অকল্প্য শব্দটিতে আমি আটকে গেলাম। এখানে কি বলা যায়। যে বেদনা অকল্প্য তা কল্পনা করবো কি করে? সংশয় রেখে গেলাম কবি।
"জল পড়ে পাতা নড়ে না "....রচনাকাল ...২০০৯
কবিতাটিতে রয়েছে মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা আর ধার লাগা অনুভব।
কবি বলেন,
"আঙুলের দশটি নখে
কিছু তো থাকবেই আঁধার! "
আমার তখন বলতে ইচ্ছে হলো,
....আঁধার আমাকে আলো দিও, দিও শাপগ্রস্ত কবিতাকাল।
কবি সেলিম মুস্তাফা বলেন
"রবীন্দ্রসংগীতের বড় দাম..
কোনো ডায়া..বাঁয়া নেই, মৃদঙ্গ পরাণ...
একই অঙ্গ দুদিকে বাজে! "
"কাঁটাতার "...২০০৯
এই কবিতায় একটি স্তবক সবকিছু বলে দেয়
"কবিতা মুক্তির কথা কখনো বলে না।
শুধু প্রতিদিন
নিত্যনতুন
কাঁটাতারে
নিজেরে জড়ায়! "
"আজ পাঠশালা বন্ধ "...রচনাকাল ...২০০৬
এই কবিতাটি ত্রিপুরার দামছড়ায় বসে রচিত। কবি এখানে প্রতিটি লাইনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এখানে কবিতা নির্মাণের সমস্ত সম্ভাবনাসূত্রকে আশ্চর্যজনক ভাবে জয় করে হয়ে উঠেছে চরম এক আত্মগত কাল। কবি একই সঙ্গে দুটো সময়কালের কথক।
..."কেহ কিছু বলে না।
না শব, না শিব।
শব্দ আজ অনন্তকে ছুঁইয়াছে। অনন্ত ডোম হইয়া তাবৎ মাটির কলস ভাঙিতে লাগিল।
গঙ্গা কাঁদিল।
সতী কাঁদিল।
কেহ টের পাইল না। "
এই অংশটি এক মোহ সময় কবিতার। তন্ময়তা। কবিতার অনবদ্য ফ্রাসট্রেশন। এসব অংশ হৃদয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না বলে শুধু পড়ো পড়ো।
"জীবন মহুয়া "...রচনাকাল...১৯৯০
"যারা বলে ভালোবাসা অপরাধ, আর যারা বলে অপরাধই ভালোবাসা...
তারা প্রণম্য, তবু দেখা হয় না তাদের "
"আমার স্বভাবে আছে এইসব দ্বিচারিতা
কাঁটার সংলাপ,
মনে হয় ভ্রষ্ট হয়ে আছি
মানুষের কষ্ট হয়ে আছি "
কবিরা কিভাবে যেন অন্তরের কথা লিখে ফেলেন। কবিতায় প্রতিটি পাপ তাই অবিরাম পবিত্রতার কথন। শুধু এখানেই কবিতা সব জয় করে বসে আছে।
বারবারই তিনি দার্শনিক হোন আবার চরম এক সংসারী হয়ে, পিতা হয়ে, ফিরে আসেন গৃহে, সেই লেবুফুলের চেনা সুবাসিত গন্ধে লালিত কবির বারান্দায়।
"এই পাহাড় ঘুম দাঙ্গা প্রেম ও প্রণিপাত "...রচনাকাল ...১৯৮৩, কাঞ্চনপুর, ত্রিপুরা।
এ কবিতাতেই আছে, কবির বিখ্যাত লাইন,
"উত্তুঙ্গ জম্পুই আজ বিষ খাওয়া যুবতীর মতো নীল হয়ে আছে,
তাকালে কষ্ট হয়. ..না তাকালে আরো "
"কিন্তু আমরা ভালোবেসেছি, এ কেমন ভালোবাসা!
আমরা সকলেই ভালোবেসেছি কিছু ফুল কিছু পাখি আর বন্দুক,
ফুল পাখি আর বন্দুক সবই মেয়েমানুষের দিকে গেছে,
মেয়েমানুষ কোনদিকে গেছে আমরা কেউ জানি না, আমি জানি না, "
কবি এখানে মেয়েমানুষ শব্দটির ব্যবহার করেছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই শব্দটি পছন্দ করি না। মানুষ, মানুষী হতে পারে কিংবা মানব...মানবী, কিন্তু কবিতা এখানে যে কথাকে বলতে চেয়েছে সেখানে "মেয়েমানুষ "ছাড়া আর সমস্ত শব্দই তেমন জোড়ালো নয়। তাই এই মেয়েমানুষ একটি অন্ধকারাছন্ন অবয়ব, রহস্য আর আলো, যার দিকেই অভিমুখ থাকে ফুল, পাখি আর বন্দুকের।
এ কবিতা কবির যৌবনের কবিতা। ঠিক এসময়কালেই তার অন্য কবিতা
"ইতি জঙ্গলকাহিনী "...রচনাকাল ....১৯৮২"
তখনই তিনি লিখেছেন,
"একটি রূপোর আংটি থেকে যায় তবু
আমাদেরই কারো কনিষ্ঠায়, রক্তে
সঞ্চারিত থেকে যায় কিছু কিছু বিষ,
বাসুদেব, তুমি কি জান
রক্তে বিষ মেশালো কে? "
এই বিষ আমাদের সকলের মধ্যেই মসৃনভাবে সঞ্চালিত, মাঝে মাঝেই ছোবল দিতে ইচ্ছে করে, মানবীয় ছোবল।
"আমার প্রিয়ার শরীরে ছিল পানিফল "...রচনাকাল ...১৯৮২,
"চেয়ার -টেবিল -কাগজ -কলম তুমি গুলিয়ে ফেলেছো. ..তুমি কেঁদেছো. ..
কাদের যেন ভালোবাসা ...কাদের প্রতি তোমার ভালোবাসা
রক্তে জীবানুর মতো
তোমার মুখে আরেকজনের মুখ ...তোমাকে বিব্রত গাছ মনে হয় "
এ এক আশ্চর্য মুখোশ, অজান্তে মুখে বসে যায় তার যাবতীয় অসহয়তা নিয়ে। আমরা হেরে যেতে যেতে মুখোশ নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যাই।
"বাহান্ন তাসের পর "...রচনাকাল...১৯৭৮, ধর্মনগর, এই বইখানির প্রথম দীর্ঘ কবিতা।
কবি সেলিম মুস্তাফার সুপরিচিত কবিতা।
"তুমি জীবন শেখাবে? কতটুকু জান?
বাহান্ন তাসের পরও আরো এক তাস থেকে যায়. .."
"আমি যে তোমাকে আজ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি!
একদিন ভালোও তো বেসেছি,
আজও কি মানচিত্রে সেই চিহ্ন নেই? "
নাই, সে চিহ্ন নাই, সে চিহ্ন মুছতে মুছতে দীর্ঘ জীবনের জবানবন্দি লিখে যায় কবি।
"কিন্তু, তুমি তো জানতে ...
একটা কুকুরের চেয়ে একটা চাবুক পুষতে
ঢের বেশি মাংস প্রয়োজন! তুমি তো জানতে
এ মাংস মাংস নয়, এ আমার মেধা এবং আমারই হৃদয় "...
এই পাঠ প্রতিক্রিয়া একটি অসম্পূর্ণ পরিভ্রমণ। আসলে কোন পাঠ প্রতিক্রিয়াই সঠিক নয়। এক এক সময়ে এক এক কবিতা নাড়িয়ে দিয়ে যায়, আঘাত করে কবিতার নিভৃত গৌরবে।
তবুও এই আঠারোটি দীর্ঘ কবিতার সঙ্গে আমার এক সপ্তাহ যাপনকাল একটু ভাগ করে নিলাম কবিতার পাঠকদের সঙ্গে।
পুনশ্চ ...একটি কবিতায়, "কইরা "লিখেছি, এখানে কবি, 'র 'এর পর য ফলা দিয়েছেন, কিন্তু আমি এটা টাইপ করতে পারিনি, তাই, 'কইরা 'লিখেছি।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
বই এর নাম ..."নরক চতুর্দশী "
লেখক ...মিলনকান্তি দত্ত
মূল্য ...৩০ টাকা
প্রজন্মচত্বরের পক্ষে জ্যোতির্ময় রায় কর্তৃক প্রকাশিত
মলাটপট ...অনীকপতি রায়
ত্রিপুরার কবিতাজগতের সঙ্গে যারা একটু হলেও যুক্ত আছেন, তারা কবি মিলনকান্তিকে না পড়লে বলতে হবে অনেককিছুই পড়েননি। প্রচারবিমুখ এই কবি, উত্তর ত্রিপুরার পানিসাগর নামে ছোট্ট একটি জায়গায় থেকে কবিতা সাধনা করেন। বর্তমানে তিনি স্যোশাল মিডিয়ায় আসায় আমরা তাকে অল্প অল্প পাচ্ছি। তবে তা বলতে গেলে কিছুই নয়। অসাধারণ বক্তা, আলোচক, চিত্রশিল্পী, ভাষা নিয়ে অগাধ জ্ঞান, কবিতা নিয়ে তুমুল আগ্রহ, এমনকি নবীনতর যে কবি লিখতে এসেছেন তাকেও নিবিড়ভাবে পড়া, কখনো দেখা হলে ভালো লাগা অংশটুকু সেই তরুণলেখককে বলে তাকে চমকে দেওয়া এবং অনুপ্রাণিত করা এসব কিছু মিলিয়েই কবি মিলনকান্তি দত্ত।
তার মোট কতগুলো বই আছে আমার সঠিক জানা নেই, কয়েকটি বই হলো, মিলনকান্তি দত্তের কবিতা, মিলনকান্তি দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা , একশটি ওয়ান লাইনার, রবীন্দ্র সুক্ত ...মিলনকান্তি দত্ত, উত্তর পূর্বাঞ্চলের মহিলা কবিদের বাংলা কবিতা ...সম্পাদনা মিলনকান্তি দত্ত, আরোও বেশ কিছু। সম্প্রতি, ২০১৯ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, চৌদ্দটি মন্ত্র নিয়ে
তাঁর বই, "নরকচতুর্দশী ", তিনি কবিতাকে মন্ত্রই বলেন। তাই আমিও তাই লিখলাম। অনেকে তাঁকে সন্ত মিলনকান্তি বলেন, তবে এই নামটি আমার কেন জানি পছন্দ হয়নি। আমি তাঁকে কবি মিলনকান্তি দত্তই বলব সবসময়। বইটির পেছনে কয়েকটি লাইন আছে, সেটা দিলাম এখানে,
"মন কী তত্ত্ব কর?
উন্মত্তের ঘর আঁধার ! "
শিরোদেশে ঊনপঞ্চাশী পবনের
ঘোর ভর করে আছে এ কবির।
মিলনকান্তি দত্ত, ত্রিপুরা তাঁর
আবাল্যের মৃত্তিকা হলেও,
বাংলা কবিতা তাঁকে দিয়েছে
বিশদ ভূগোলখণ্ড।
"শ্রেষ্ঠ কবিতা "প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর, মাত্র চৌদ্দটি মন্ত্র নিয়ে এই কবিতাপুঁথিটি আমরা বের করলাম এই জন্য যে, লেখাগুলি বিশেষ্য হয়ে আছে অপূর্ব এক মানুষিক সংবেদে।
আমারো তাই মনে হলো।
কবিতার বই এর বিক্রি নগন্য। তার ওপর ফেসবুকে প্রকাশিত হলে, মানুষ আরোও কিনবেন না। তবুও ফেসবুক কবিতাকে অনেক মানুষের কাছে একসঙ্গে অল্পসময়ে পৌঁছে দেয়। কবি কি তাঁর কবিতা বিক্রি করে কোনদিন লাভক্ষতির কথা ভাবেন, তিনি ভাবেন পাঠক পড়ুক। সেই কথা ভেবেই বইটি থেকে আমি বেশ কয়েকটি কবিতা এই পোস্টটির সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি।
আশা করব কবি এবং প্রকাশক কিছু মনে করবেন না।
তীব্র শ্লেষ, বিদ্রুপ, কৌতুক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, জীবনবোধের চরম সূক্ষ্মতায় থেকে এক আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে তিনি কবিতা লিখেছেন।
দুরন্ত আধুনিকতা আর প্রজ্ঞাবানের ঋদ্ধ প্রাচীনতার আশ্চর্য সংমিশ্রণে কবি মিলনকান্তি দত্তের কবিতা
প্রাণময় হয়ে ওঠে।
কবিতাগুলো পড়ে মুগ্ধ এবং স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন কাজ ছিল না।
এক
সন্ধ্যাভাষা
"সকল বিচ্ছেদের এক রা
মিলন
সকল মিলনের এক ঘা
বিচ্ছেদ
ভালোবাসা স্বয়ং এক সন্ধ্যাভাষা,
মুনিদত্ত লিখেনি তার টীকা
এই জেনে, মিলনকান্তি বরং আপনিই
ক্যালকেরিয়া সালফিউরিকা! "
দুই
যখন কবিতা লিখি না
যখন কবিতা লিখি না তখন আমি কে?
প্রজাপতি কি আমাকে স্বপ্ন দ্যাখে?
ঘোস্ট আমি? ঘোস্ট বাংলা ভূত,
ভূতের বাংলা অতীত।
যে অতীত দৈর্ঘ্যে কষ্টের সমান,
মানুষ মাঝে মাঝে তাকে পায়।
তবু সে দেখিল কোন ভূত?
আমি যাকে ভালোবাসি, সে ভূত!
ফোঁটা ফোঁটা পাখিঝরা আকাশপাতালে
একটি খাঁচা সেদিন শিস্ মেরে
খুব ভিজেছিল।
তিন
ম্যানিফেস্টো
ছাত্রীর মা কে ভালোবেসে গৃহশিক্ষকতা
খুন হয়ে গেল পাড়াযুদ্ধে তাকেও শহিদ
বলা হয়, কিছুই তো আর অরাজনৈতিক নয়।
মদ খেয়ে কেউ একজন আমাকে খুব বকে গেছে,
আমিও তাকে খেয়ে ঈশ্বরকে খুব বকে দিলাম,
ঈশ্বর আমাকে খেয়ে স্বয়ং মাতাল হলেন না
বরং লিখে রাখলেন এককলম বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত,
ভালোবাসাই ম্যানিফেস্টো, রাজনীতি সে এক
ভুল ঐতিহাসিক। ...."
এবং বুদ্ধিজীব কবিতা থেকে,
"যে দেশে ঈশ্বর স্বয়ং বামন অবতার,
সে দেশে আশ্চর্যের উচ্চতা ১৮২ মিটার!
মাত্র? উইদাউট এনি বাক্যালাপ,
কথাবিপ্লবের বোবা
নিজের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বুঝিয়ে দিলেন
এর চেয়ে ঢের বেশি উচ্চতায়
এক আশ্চর্য বাস করে! "
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৩
বইয়ের নাম... আমার অ্যাম্বুশ
লেখক ...প্রবুদ্ধসুন্দর কর
প্রথম প্রকাশ ...জানুয়ারি, ২০১৮
প্রকাশক ...অক্ষর পাবলিকেশনস্
প্রথমেই খুব আঞ্চলিক ভাবে একটি কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ত্রিপুরায় যারা কবিতা লিখছেন, বিশেষ করে শূন্য দশকের তরুণরা, তাদের এই বইটি পড়তে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। এ হলো বইটির স্বঅর্জিত অভিমান। প্রায় সবগুলো গদ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে লিখিত। আমিও পড়েছি। তারপর "আমার অ্যাম্বুশ "নামে এই গদ্য সংকলন। নির্দিষ্ট কোন বিষয় নয়, তবে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কবিতা অনুসারী, কবিতাকে হৃদয়ে রেখে স্পষ্টভাবে কবিতাচর্চার একটি মুক্ত আকাশ একজন বুদ্ধিমান কবির মস্তিস্কে যথাযথ আলো হাওয়া বিস্তার করবেই, আমার মনে হয়। বইটি পড়তে হবে নির্লিপ্তভাবে। কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের লেখা এই গদ্য সংকলনটিতে বহু কবিতার বই এবং কবির নামের উল্লেখ আছে, যা বর্তমানের অনেক তরুণ কবি শোনেননি, কিন্তু সেইসব কবিরা বাংলা কবিতা জগতের ধারালো কিরিচ, যাদের লেখা পড়া উচিত। গদ্যগুলো কবির ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের কবিদের কবিতা এবং নিজের কবিতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। সমস্ত গদ্যগুলোই এত দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লেখা হয়েছে যে, পড়লে মনে হবে কবির কথাই ধ্রুব। এবং লেখাগুলো পড়ার পর বহু তরুণই হতাশাগ্রস্ত হবেন কিংবা অন্য দিক দিয়ে দেখলে আত্ম সমালোচনা করার একটি যথার্থ ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন।
তীক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলক লেখার এই মেধাবী সংকলনটি কবিকে যারা পছন্দ করেন না, তারাও নিশ্চিত পড়েছেন আশা করি।
"নীল ক্ষুর ও চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ " নামের গদ্যটি দিয়ে বইটি শুরু। যেখানে প্রথম আমি কবি রমেন্দ্রকুমারের কথা জানতে পারি। রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর "ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি ", যেখানে আছে একশ বাহাত্তরটি কবিতা, রচনাকাল ১৩৫৫-১৩৯০, "তুমি তিনপইঠা ন্যায় নও, তুমি যুক্তির চেয়েও চমৎকারা ! প্রসঙ্গান্তরে গেলাম।
গেলাম এই কারণে "আমার অ্যাম্বুস " বইটিও ঘন ঘন প্রসঙ্গান্তরে গেছে, গদ্যগুলোর প্রত্যেকটি লাইন বহু দিক নির্দেশ করে, বাকিটা পাঠকের ওপর।
'উপমা 'গদ্যটিতে উপমা নির্ভর বাংলা কবিতার অতি সামান্য কয়েকটি উপমার উল্লেখ কিন্তু এক সাংঘাতিক খননকার্য চালিয়েছিল কিছুসময়ের জন্য এবং এই সূত্রে খুঁজে খুঁজে বিখ্যাত উপমার সন্ধান আমাকে বেশ অনেকটাই আনন্দ দিয়েছে। তারপর ছন্দ সংক্রান্ত গদ্যটি আমাদের দুর্বলতাকে ঢেকে রাখার ঔদ্ধত্যকে যুক্তিহীন ও অক্ষমতার আবেগতাড়িত
জেদ হিসেবে প্রমাণ করলেও এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। আর একটি বহুবার পঠিত কবিতা, কবি মিলনকান্তি দত্তের, "একটি মন্ত্রকবিতার উচ্চারণ ও পাঠ "
কবিতাকে কিভাবে পড়া উচিত চিনিয়ে দেয়।
অপরাধকাব্য, ভূমিকাসাহিত্য, বিনয়পিটক,
বহিঃপ্রকৃতি অন্তঃপ্রকৃতি, ইত্যাদি গদ্যগুলো বহুপঠিত হওয়ার পরও আরেকবার পড়লে বা কিছুদিন পর পড়লে নতুন করে আবার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।
আমার ব্যক্তিগত পাঠপ্রতিক্রিয়া বলে, কবির এই গদ্য সংকলন তথ্যনির্ভর, আবেগবর্জিত, কঠোর এবং সুপাঠ্য।
তবে বইটিতে একটি সূচীপত্রের অভাব খুব অনুভূত হলো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৪
কাব্যগ্রন্থ "শাহেনশাহের কাছে আর্জি "
লেখক : অমিতাভ কর
প্রচ্ছদ : অমিতাভ কর
মূল্য ১৫০ টাকা
নীহারিকা প্রকাশনা
ক্লাসমেট
অনিমেষ অনেক বছর পর নেমে এসেছিল ফ্রান্স থেকে,
যখন মেসোমশাই চলে গিছলেন কষ্ট পেয়ে ।
এবার মাসিমা কফি টেবিলে কফির মগ হাতে,
' কাম্য মৃত্যু ',সবাই বলছে।
আমাদের স্কুল জীবনের নানা গল্প,
'তারপর, সুবল কেমন আছে, ''মোহিত হঠাৎ চলে গেল
এইসব অর্থহীন কথা বিনিময় ক্রমশই
অনভ্যস্ত সঙ্গমের মতো হয়ে উঠে
আমরা আড়ষ্টভাবে অন্ধকারে খুব চুপচাপ বসে থাকি,
এ দেখাই শেষ দেখা, দুজনেই জানি।
কবি অমিতাভ করের কবিতা। বইয়র নাম, "শাহেনশাহের কাছে আর্জি ",প্রকাশ হবে নীহারিকা প্রকাশনা থেকে এই বইমেলায়। বইটির একটি ছোট্ট ভূমিকা রয়েছে, সেটিই লিখছি এখানে,
"আমরা কবিতাকে ভালোবাসি, আর কবিতা যাদের ভালোবাসে, তাঁদের অন্যতম আবু বেন আদম হচ্ছেন অমিতাভ কর, "লিখেছেন ত্রিপুরার নব্বইয়ের দশকের এক বিখ্যাত কবি। সমস্ত সংঘারামের বাইরে অনন্তসম্ভব আত্মার কবিতার নীরব সাধক অমিতাভ। তাঁর কবিতায় চলে আসে গণতন্ত্রের পোষাক পরা একনায়ক শাহেনশাহ থেকে শুরু করে রহস্যময় দুর্গ, প্রেম, মানুষের একাতীত্ব, শোষনের গল্প এবং কখনো কখনো কাফকা - সুলভ কুয়াশা। শব্দের নিত্য ভাঙাগড়া অনায়াসে জুড়ে দিয়ে অমিতাভ পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন নিজেরই মুখমুখি। তাই এই বইেয়র কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন হলেও পাঠক মসৃণভাবে পেরিয়ে যেতে পারবেন মাইন পুঁতে রাখা সবুজ ধানখেত। "
কবির জন্ম ১৯৫০ এ, ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। ভারতীয় আরক্ষাকৃত্যকে অতিরিক্ত মহানির্দেশক হিসেবে অবসরে গিয়েছেন। তিনি রুশ কবি ওসিপ মান্দেলস্তামের কবিতার অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন, আর্জেন্টিনার কবি রবের্তো হুয়ার্রোজের কবিতা, অনুবাদ গ্রন্থটির নাম, "লম্বব কবিতা ",কারণ রবের্তো হুয়ার্রোজের সব কাব্যগ্রন্থের নামই পোয়েসিয়া ভার্টিকেল বা লম্ব কবিতা। প্রকাশিত হবে এবার নীহারিকা প্রকাশনা থেকে।
কবি অমিতাভ করের "শাহেনশাহের নিকট আর্জি ",
"একদিন ভুলে যাওয়া গানগুলি স্মৃতি ও গীটারের কর্ডসহ
ফিরে আসবে। ফিরে আসবে আমগাছে বাঁধা দোলনা,
পুরনো শাড়ী দিয়ে বানানো চাঁদোয়া, কৈশোরের বিস্তৃত নগরী,
মৃতদের ব্যর্থতা, বাইসাইকেলের দিন, হানাবাড়ি, মানুষের ভাষা।
এসো, প্রিয়তম শূন্যতা, নাইটল্যাম্প নিবিয়ে দাও আর দেয়াল লিখন ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠুক।
যারা কুয়াশার অজুহাত দেয় তুমি তাদের বলে দিও কার
নাম চলে এসেছিল তোমার ঠোঁটে, কার কাছে তুমি হেঁটে গিয়েছিলে বহুদূর। ছেঁড়া মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে
অনেক দেখেছ শিশুদের অবোধ্য এস এম এস। তুমি বলে দিও
গানে গানে আমরা শুধু নিজেদের ভোলাচ্ছি, খুঁজছি। "
(গান)
কবির অন্যান্য বইগুলো হচ্ছে,
এই রৌদ্রময় প্রান্তর
ভাঙা কাচের রাত
বেইলি ব্রিজের পর ( নীহারিকা প্রকাশনা)
ভরোনেঝ নোটবুকস ( অনুবাদ) ।
কবির লেখা আরেকটি কবিতা দিচ্ছি,
অজাত
যে সন্তান কোনদিন তোমার ছিল না তবু শব্দহীন বাসা বেঁধেছিল, কোনদিন লাথিও ছোঁড়েনি, সেই রেখে গেছে শুষ্ক জলদাগ, আটসপ্তাহের স্মৃতি, অবিশ্বাস, ভয়, আনন্দের পূর্বাভাস। যার জন্মদিন কখনো আসেনি, তার আয়ুর হিসেব করো? যার আয়ু বাস্তবিক ল্যাবের পরীক্ষা থেকে, অপক্ক বাবার আনন্দে লাফানো, তোমাকে চুম্বন, আলিঙ্গন থেকে শুরু হয়ে গাইনোর মনিটরে শেষ হয়েছিল - তাকে কত আয়ু দেবে? ঘুমুতে যাবার আগে আর কতদিন কথা কবে শ্রুতিহীন তার সাথে? শোক, আর কত দীর্ঘ হবে, ভালোবাসা, কত নিদ্রাহীন? সে তো যাওয়ার আগে জেনে গিয়েছিল - কাকে বলে শোক, কাকে বলে ভালোবাসা।
কবি সুস্থ থেকে আমাদের আরো সমৃদ্ধ করুন এই শুভকামনা আমার।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৫
বইয়ের নাম... আমার অ্যাম্বুশ
লেখক ...প্রবুদ্ধসুন্দর কর
প্রথম প্রকাশ ...জানুয়ারি, ২০১৮
প্রকাশক ...অক্ষর পাবলিকেশনস্
প্রথমেই খুব আঞ্চলিক ভাবে একটি কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ত্রিপুরায় যারা কবিতা লিখছেন, বিশেষ করে শূন্য দশকের তরুণরা, তাদের এই বইটি পড়তে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। এ হলো বইটির স্বঅর্জিত অভিমান। প্রায় সবগুলো গদ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে লিখিত। আমিও পড়েছি। তারপর "আমার অ্যাম্বুশ "নামে এই গদ্য সংকলন। নির্দিষ্ট কোন বিষয় নয়, তবে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কবিতা অনুসারী, কবিতাকে হৃদয়ে রেখে স্পষ্টভাবে কবিতাচর্চার একটি মুক্ত আকাশ একজন বুদ্ধিমান কবির মস্তিস্কে যথাযথ আলো হাওয়া বিস্তার করবেই, আমার মনে হয়। বইটি পড়তে হবে নির্লিপ্তভাবে। কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের লেখা এই গদ্য সংকলনটিতে বহু কবিতার বই এবং কবির নামের উল্লেখ আছে, যা বর্তমানের অনেক তরুণ কবি শোনেননি, কিন্তু সেইসব কবিরা বাংলা কবিতা জগতের ধারালো কিরিচ, যাদের লেখা পড়া উচিত। গদ্যগুলো কবির ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের কবিদের কবিতা এবং নিজের কবিতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। সমস্ত গদ্যগুলোই এত দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লেখা হয়েছে যে, পড়লে মনে হবে কবির কথাই ধ্রুব। এবং লেখাগুলো পড়ার পর বহু তরুণই হতাশাগ্রস্ত হবেন কিংবা অন্য দিক দিয়ে দেখলে আত্ম সমালোচনা করার একটি যথার্থ ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন।
তীক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলক লেখার এই মেধাবী সংকলনটি কবিকে যারা পছন্দ করেন না, তারাও নিশ্চিত পড়েছেন আশা করি।
"নীল ক্ষুর ও চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ " নামের গদ্যটি দিয়ে বইটি শুরু। যেখানে প্রথম আমি কবি রমেন্দ্রকুমারের কথা জানতে পারি। রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর "ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি ", যেখানে আছে একশ বাহাত্তরটি কবিতা, রচনাকাল ১৩৫৫-১৩৯০, "তুমি তিনপইঠা ন্যায় নও, তুমি যুক্তির চেয়েও চমৎকারা ! প্রসঙ্গান্তরে গেলাম।
গেলাম এই কারণে "আমার অ্যাম্বুস " বইটিও ঘন ঘন প্রসঙ্গান্তরে গেছে, গদ্যগুলোর প্রত্যেকটি লাইন বহু দিক নির্দেশ করে, বাকিটা পাঠকের ওপর।
'উপমা 'গদ্যটিতে উপমা নির্ভর বাংলা কবিতার অতি সামান্য কয়েকটি উপমার উল্লেখ কিন্তু এক সাংঘাতিক খননকার্য চালিয়েছিল কিছুসময়ের জন্য এবং এই সূত্রে খুঁজে খুঁজে বিখ্যাত উপমার সন্ধান আমাকে বেশ অনেকটাই আনন্দ দিয়েছে। তারপর ছন্দ সংক্রান্ত গদ্যটি আমাদের দুর্বলতাকে ঢেকে রাখার ঔদ্ধত্যকে যুক্তিহীন ও অক্ষমতার আবেগতাড়িত
জেদ হিসেবে প্রমাণ করলেও এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। আর একটি বহুবার পঠিত কবিতা, কবি মিলনকান্তি দত্তের, "একটি মন্ত্রকবিতার উচ্চারণ ও পাঠ "
কবিতাকে কিভাবে পড়া উচিত চিনিয়ে দেয়।
অপরাধকাব্য, ভূমিকাসাহিত্য, বিনয়পিটক,
বহিঃপ্রকৃতি অন্তঃপ্রকৃতি, ইত্যাদি গদ্যগুলো বহুপঠিত হওয়ার পরও আরেকবার পড়লে বা কিছুদিন পর পড়লে নতুন করে আবার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।
আমার ব্যক্তিগত পাঠপ্রতিক্রিয়া বলে, কবির এই গদ্য সংকলন তথ্যনির্ভর, আবেগবর্জিত, কঠোর এবং সুপাঠ্য।
তবে বইটিতে একটি সূচীপত্রের অভাব খুব অনুভূত হলো
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৬
গদ্যসংগ্রহ "রোদের কনভয় "
লেখক প্রদীপ মজুমদার
ছবি ও অলঙ্করণ পার্থপ্রতীম গাঙ্গুলী
নীহারিকা প্রকাশনা
মূল্য ২৫০ টাকা
লেখকের ভাষা দিয়েই শুরু করছি,
"ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে ভেতর বাড়ির দরোজা। ভেতর বাড়িতে নানানরকম দৃশ্য। দৃষ্টির এই বিস্তৃত পরিসরে তখন আমিই একমাত্র দর্শক, আমিই বিষয়। তখনও মরমে বাজতে থাকা গানটিই ধীরে ধীরে যেন রূপ পরিগ্রহ করছে। এই শ্রাবণ জ্যোৎস্নার দুইপ্রহরে মুখোমুখি গান ও আমি, আমি ও গান,
অতিলৌকিক ও প্রাকৃতিক এক উৎসবের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছি। আমাদের চতুর্দিকে নৈঃশব্দ্য ও আলোর অন্তর্জাল। "
একটি মধ্যযাম আসে। তখন বসন্তকাল বিকীর্ণ হয়েছে। ঋতুপারঙ্গমতায় বয়ে গেছে নেশাগ্রস্ত সময়। তখন মনে হয় লিখি। মনে হয়, ছোটবেলার বিস্তৃত উঠোন থেকে ধুলো মাটির
আঙরাখা পাতায় তুলে রাখি বিষাদনির্দিষ্ট আশ্লেষে । যেসমস্ত ভ্রমণ ছিল চন্দ্রাহত, মান্দার ফুলের প্রলোভনে আত্মিক, তা থেকে জীবন বারি তুলে আনি। সেখানে অক্ষয় প্রেম আছে পাঁজরের মজবুত সন্ধিস্থলে, যা বিস্তারিত বর্ণন ছাড়াও, তেমন কোন দিক নির্দেশ ছাড়াও কোন পাহাড়ী জায়গার কুয়াশানির্নীত অভিযোজন প্রার্থনা করে । সেখানে গীর্জার ঘন্টা ধ্বনি অধিক বাঙ্ময়, নির্জনতা ও বিরহ রচিত। হয়তো সমুদ্রবিক্ষিপ্ত ঝিনুকের নীরব ভাষা দূরাগত পাহাড়ের প্রকোষ্ঠে বৈপরিত্যের লিপি আকীর্ণ করে যায়, বইটির প্রতিটি গদ্য এরকমই।
পাথরের ওপর আঘাত করলে যেমন একটি ব্যথাতুর শব্দজঙ্গম সৃষ্টি হয়, "রোদের কনভয় " গদ্য সংকলনটিতে রয়েছে, সেরকম সাতাশটি পুরুষালি গদ্য, ভুবন মাঝির নির্বিকার ভাব রয়েছে তাতে। কখনোও মনে হয় লেখক নিরাসক্তিতে লিখেছেন, কখনোও মনে হয় জীবনকে ভালোবেসে প্রচণ্ড আসক্তি ও আবেগের যৌথ পদ সঞ্চারে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে কয়েকটি নির্জন গুহার আলোআঁধারময় প্রকোষ্ঠ।
লেখকের ভাষায়,
"স্মৃতির বাঁ পাশ ঘেঁষে এখনও আড়মোড়া ভাঙছে হেমন্তের নদী। মাঝে জেগে থাকার চরাটি, যার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে জেলে ডিঙির বহর, জালের রূপালি মাছ, মাঝিদের ভাটিয়ালি। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই ভেঙে পড়া দিনের পাড় ঘেঁষে, পসরা সাজানো নৌকার তরতর করে এগিয়ে চলা। ছইয়ের ভেতর টিমটিম দুলতে থাকা কেরোসিন বাতি ; কত পুরানো? কতই বা!
এখনো সে বাতির আলো বহুদূর থেকে রাতের অন্ধকার চিরে স্মৃতির কার্নিশে এসে বসে। বসে লেখার পাতায় "...
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৭
কবি সণজিত বণিকের তিনটি কবিতার বই ...কিছু কথা /...চিরশ্রী দেবনাথ
ত্রিপুরার কবিতার জগতে কবি সন্জিত বণিক একটি সুপরিচিত নাম। দীর্ঘদিন ধরে লিখে আসছেন। প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ মানবতা ইদানিং, কবরখোঁড়ার আওয়াজ, প্রেম ও পূর্ণজন্ম, সময়ের দুরন্ত জিরাফ, তোমার জন্য ভোর, আলো আঁধারের গল্প, মন চলো কবিগ্রাম ও পায়ের চিহ্ন। দুইহাজার ষোলর ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই..."মিশ্ররাগের মেয়ে "। সম্পাদনা করেন কবিতা ও কবিতা শিল্পের কাগজ শাব্দিক।
কবির লেখা তিনটি কবিতার বই "মিশ্ররাগের মেয়ে, পায়ের চিন্হ, তোমার জন্য ভোর এই প্রসঙ্গে কিছু কথা। আন্তর্জাল আমাদের এই ক্ষয়িত জীবনে মিশে গেছে শ্বাস হয়ে, মিশ্ররাগের যে মেয়েটি প্রতিদিন কাজ করে, দুপয়সা আয় করে, তারও জীবনের রসদ এই মোবাইল, কাজের বাড়িতে ঢোকার আগে তার গায়ের প্রজাপতি রঙ .....পাখির শিষ ঢেলে দেয় মোবাইলে , গান শোনে, কথা বলে, হাওয়ায় ভাসতে থাকে এই রাজকুমারী সময় টুকু, আর বাকি সময় তার হাঁটাচলা কঠিন মেঝেতে, অসাধারণ বাঙ্ময় একটি কবিতা। এই বইটি পৃথিবীর সব লড়াকু মেয়েদের উদ্দেশ্য উৎসর্গীত, কিন্তু দোতারা কবিতায় যেন নারীর সঙ্গে পুরুষের অকৃত্রিম এক যুগলবন্দীই তিনি এঁকেছেন অজান্তেই।'মেয়েটি 'কবিতায় "এ বিশ্বাসে মেয়েটি ভালো থাকে, বইমেলা ঘুরে ফেরে সারাবেলা "..কি সহজ বলিষ্ঠ উচ্চারণ।
"পায়ের চিন্হ "আরেকটি কবিতার বই, 'ফেলে দেওয়ার কিছুই নেই '...."ফেলে দেওয়ার কিছুই নেই এই জগতে, মেনে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সময়যাপন ও খতিয়ে দেখার বাকি রাস্তা "একটি অকাট সত্যি কে সাধারণ ভাবে বলে দেন, মিলে যায় পাঠকের সঙ্গে অথবা "বিষন্নতার আরেক নাম সমাধি /যেখানে চুপচাপ শুয়ে আছে মৃত আত্মার বাঁধানো ছবি /" মন কিছু সময়ের জন্য বাউল বাউল। তিনি বলে যান ..."দিনভর সূর্যের মুখ না দেখেও /ভালোবাসায় মগ্ন থাকে যে জীবন /তাকেই বলে বেঁচে থাকা /..এভাবেই কবিকে খুঁজে পাওয়া যায় সহজিয়া রূপে, মন কেমনিয়া সুরে।
"তোমার জন্য ভোর " কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা
"আলজাইমার "..প্রথম লাইন .."পৃথিবীর জন্য কিছু রেখে যাবার পর আক্রান্ত হয়েছে যে মানুষটি, সে একজন কবি "..ভীষণ ভালো লাগলো। কবিরা আক্রান্ত হোন, নিন্দিত হোন, হারিয়ে যান, তবুও কিছু শব্দকণা কেন যে ছড়িয়ে দেন, তা কবিই জানেন। অথবা আর কতো ভেতরে গেলে /তোমার বুকের ভেতর যেতে পারি/শুনতে পারি...আমার মনের কিংবা বুকের শব্দ? / ..'জিরাফ 'কবিতাটিতে
"মত্তনীল ডানায় চড়ে একা জিরাফ/আজ বইমেলায় /গলা উঁচিয়ে হাঁটে / কবিতার কথা নিয়ে হাঁকে /তোরা আরো দীর্ঘ হয়ে ওঠো আমার মতো। /
সত্যিই কবি আমরা যেন এভাবেই দীর্ঘ একটি কবিতা হয়ে উঠতে পারি। কবি সণ্জিত বণিকের কাছে আরোও এমনি আগামীর প্রত্যাশা করবো, হৃদয় স্পর্শ করা আরো অনেক কবিতার জন্ম হোক তার পালক কলমে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৮
কাব্যগ্রন্থ ...চন্দ্রাহত
লেখক ...দেবলীনা সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ শুভজিত পাল
প্রকাশক ভিকি পাবলিশার্স
মূল্য আশি টাকা
"এখানে মেঘেদের কোনো গর্ব নেই
নেই অহমিকা বা ছল চাতুরি
এখানে মেঘ নত হয়ে পাহাড় ছোঁয়
ঘন কুয়াশায় মমতায় ঢাকে পাহাড়ের মুখ "
এমনই মায়াবী সব লাইনে আমি দেবলীনা সেনগুপ্তকে খুঁজে পেয়েছি তার চন্দ্রাহত কাব্যগ্রন্থে।
"কোজাগরী রাতে
কেউ কি জেগে থাকে আর একা চাঁদ ছাড়া?
নির্জন প্রদীপের মতো
অলক্ষ্যে থাকে বিষণ্ণ অঙ্গীকার। "
এই পৃথিবী ব্যাপী বিষাদের পেছনে কবিদের জীবনভর ছুটে ছুটে চলা। কবিতার মুক্তি অথবা গুমড়ে থাকা।
"আমি এখন লুইতের জল ছুঁয়ে বসব।
শুনব সপ্তসিন্ধুর কলতান
স্রোতের বহে চলায়
লালন গীতিকথায়
হাসনের সুরে
আঁকব নিজ আশ
মনের মতো স্বদেশ ও সহবাস। "
লুইতের মেয়ে, লোহিতের মেয়ের কবিতায় থাকবে না
শ্রাবণসিক্ত ব্যথা, তা কখনো হয় না।
"ভালোবাসার শবদেহ
বহনে ক্লান্ত কবি
খুঁজে বেড়াচ্ছেন
একফালি নাবাল জমি,
যেখানে গাছের ছায়া
ঝুঁকে থাকে রোদ মেখে,
বৃষ্টির জলধারা পরিখা আঁকে
নিশ্চিন্ত ভরসার
নিবিড় আলোর তৃষায়,
জেগে থাকে রাতের আঁধার। "
কবিদের স্বপ্নে এপিটাফ। মৃত্যুর পর কোথায় পুড়ে যাবো জানি না, তবুও নিজের মৃত্যুর স্বপক্ষে কিছু লাইন লিখে যাননি কোন কবি, এটা ভাবা যায় না।
"বিষণ্ণ প্রয়াসের মতো সন্ধ্যা নামে
মেশে অন্তরযামে।
প্রান্তর রেখায় পাণ্ডুর রং
দিনলিপির কথকতা
মগ্ন অন্বেষণে
শিকড়ের চিহ্ন দাগ।
জন্মতিলকের মতোই অনিবার্য সে ছাপ। "
মন বলতে চাইছে আহা আহা। কিন্তু বলব না। যা বলব তা হলো কবিদের জন্মতিলক পূর্ব জন্মের অগ্রন্থিত পাপ, এই জন্মে তারা যেন শুভ্র ফুল হয়ে ওঠে, বেদনায় ঈষৎ পাণ্ডুর।
"এখন চলে যেতে বাধা নেই
আলোরা সবুজ সংকেতে
লিখেছে গভীর চলে যাওয়া
এখন বাধা নেই চলে যেতে
নিশ্চুপ ঝরে পড়া বৃক্ষশাখ হতে
অথবা মসৃণ অপসারণ
জলপদ্মের পাতা ছুঁয়ে থাকা
বারিবিন্দুর মতন
চলে তো যাওয়াই যায়
সেই দূরদেশে
সমস্ত ভালোবাসা গেছে চলে যেইখানে অভিমান শেষে। "
তারপরে আর কথা নেই। কবি সব কথা বলে গেছেন।
তবুও বইটির শেষ কবিতায় তাকে পড়ে নিই, আরো একটু অনন্ত জাগুক মনে, তৃষাতুর থাকি তার প্রতি,
"ক্রুশ ও পেরেক যথাযথ
বদলে যায় মুখ ও অবয়ব
প্রতিটি ক্ষমার শেষে
প্রতিটি প্রেমের পাশে
সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে এক নিজস্ব ক্রুশকাঠ " ...
পাঠ প্রতিক্রিয়া ৯
কাব্যগ্রন্থ ...পঁচিশ কবি ও বৈশাখ
লেখক ...নীলদীপ চক্রবর্তী। আসাম।
নীলদীপ চক্রবর্তীর বই, "পঁচিশ কবি ও বৈশাখ ",প্রকাশিত হয়েছে, ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি থেকে, চৌদ্দশ চব্বিশ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। রবিকে নিয়ে পঁচিশটি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের আশ্রয়। সুখ, দুঃখ, মান, অভিমান, প্রেম, বিরহ, অপমান সবকিছুতেই তাঁর কাছে যাই, তিনিই চির গন্তব্য। কবি নীলদীপ চক্রবর্তীও সেই তাঁকেই উপলব্ধি করেছেন জীবনের চলার পথে। সেখান থেকেই অনুভবের কোমল ও তীব্র জারণে কবির কবিতা জারিত হয়েছে।
এই কাব্যগ্রন্থটি নীলদীপ চক্রবর্তীর দ্বিতীয় কবিতার বই। পঁচিশটি উজ্জ্বল কবিতায় তিনি বলেন,
"কবিকে কি বলা যায়, "আপনার কবিতা আমি খুব ভালোবাসি "।
কারণ এরপর আর তৃতীয় সংলাপ থাকে না।
তারচেয়ে ভালো অন্ধকারময় ব্যথায় কবির
প্রথম সংকলনের শেষ কবিতা পড়া। "
কখনো বলেন,
"কী আশ্চর্য চাঁদেও তোমায় দেখি
ক্যানভাস ছাড়া শ্বাশ্বত এক "রবি "।
জীবন্ত তুমি নামক গানের সাথে
দেওয়ালে ঝোলে তেলরঙে মৃত ছবি! "
রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে কবির মনে হয়,
"টিপং কলিয়ারি থেকে যখন কালো ধোঁয়া সরে
সেইসঙ্গে সাইরেন বাজে পঞ্চম তীব্রতায়
তখনই সকাল। সূর্য পাখি সবাই জাগে
লিডু থেকে ছেড়ে যায় শহরমুখী গাড়ি
পাহাড়ি ছায়ায় ডিহিঙের কোলে ভাসে
টিরাপ জাগুন "।
আমরা কেন যাই, রবির কাছে,
"গীতবিতানের পাতায় পাতায় এক প্রশস্ত পথে
সোহাগি ঝর্ণা পলাশ আর স্বজনেরা সেথা আছে
গীতবিতানের পাতায় আলোক কি রহস্য কি জ্যোতি
সব ঝঞ্ঝার চাবিকাঠি আছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। "
আর সবশেষে সব কবিই যখন চিরাচরিত অস্তিত্বহীনতায় বার বার নিজেকে ভাঙেন আর লিখেন,
"কারা শুয়ে আছ, কারা আছ শুয়ে
এই জোৎস্না অন্ধকারে
কারা নিঃস্ব হয়, উজাড় হয় প্রতিদিন
কে ভাঙে বারে বারে? "
মূল্য ...আশি টাকা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১০
গল্পগ্রন্থ ..."নৈঃশব্দ্যের কোলাহল "
লেখক ...সন্তোষ রায়
প্রচ্ছদ ...কৃষ্ণধন আচার্য্য
মূল্য ...100 টাকা
প্রকাশকাল ....২০১৮
মোট চারটি গল্প আছে বইটিতে, "দেখা "ভূষণমাষ্টার ",উদ্ধার ","আলোকের এই ঝর্ণাধারায় "।
ছোট গল্প অদ্ভুত এক স্বপ্নের মতো। স্বপ্নটাতে ঢুকে যেতে পাঠককে বাধ্য করতে হবে এমনভাবে যে, শেষ করা না পর্যন্ত বেরিয়ে আসা যায় না। তবে তারও আছে নানান শৈলী। স্হান, কাল, পাত্র, সংলাপ সবকিছু মিলিয়ে একটি নিটোল উপস্থাপনা। এই গল্প গুলো পড়তে গিয়ে ভীষণ বাস্তব কিছু চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।
প্রথম গল্প "দেখা "
........................
প্রধান চরিত্র তিনটি। সুশান্ত, সুকোমল, তন্ময়া। সুশান্তবাবু একজন ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। যখন ঘুমোন তখন তিনি বাস্তবের সঙ্গে সম্প়ৃক্ত হোন। স্বপ্নে এমনসব কথা বলেন, যা জেগে থাকলে মানুষ বলে। আর যখন জেগে থাকেন তখন নেশাগ্রস্ত, পাগলপ্রায়, সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন একটি লোক। তার নিজস্ব কিছু লেখালেখি আছে, যাকে গুছিয়ে ওনার স্ত্রী বই করতে চান, সেই দায়িত্বই নিতে চায় সুকোমল । কিন্তু তারপরই খাদের অন্ধকার শুরু হয়, তিনটি জীবনই আরো অস্থির এবং দিকশূন্য হতে থাকে। তথাকথিত সমাজের চোখে ক্রমাগত অশরীরী হয়ে ওঠে তারা।
দ্বিতীয় গল্প "ভূষণ মাষ্টার "
....................................
ভূষণ মাষ্টার গল্পটির ধারক ও বাহক। ত্রিপুরার অস্থির সময়ের গল্প। ভূষণ মাষ্টারের মুখে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, খুব প্রাঞ্জল, সংবেদনশীল, বুকে ঘা মেরে যায় । অনিন্দ্য ও শৌনক বহিরাগত। একটি সময়কে চিহ্নিত করা হলেও, আসলে এই গল্প বলার ধরনটি একটি দুঃসহ রূপকথা সবসময়েরই। পাহাড়ি মানুষের সহজ সরল জীবনের মধ্যে যখনই বিষ ঢুকে যায় তখনই রক্তপাত, শ্মশানভূমির অশনি সংকেত। কয়েক দশক পরপরই এই শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার একটি চেষ্টা মানব জীবন ও জমিনকে তছনছ করে দেয়। এর থেকে কোনদিনই আর মুক্তি নেই।
তৃতীয় গল্প "উদ্ধার "
.....................
বইটির চারটি গল্পের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগা গল্প আমার।
বুড়ো বয়সের অসহায়তা। আর যারা গৃহসহায়িকা হয়ে আসেন তাদের বুদ্ধিমত্তার ঠাস বুনন। এই ভীষণ মানবিক সমস্যার কাছে সত্তার আলো কে হেরে যেতে হয় শেষবয়সে। "না ভালো লাগাকে", আঁকড়ে ধরতে হয়। গৃহকর্ত্রীকে দেখতে হয় সবচেয়ে কাছের জন কত সহজে গৃহরাজনীতি করছেন। দীর্ঘদিনের দাম্পত্য কচলে কচলে পাঁক উঠছে, সেই মুহূর্তে মনে হয় সবই সম্ভব জীবনে। অসম্ভব শব্দটিই বেমানান । নীরব বাবু, মানসবাবু, সুলতা, বাসন্তী প্রত্যেকটি চরিত্রকে আমিও যেন খুব ভালো করে চিনি।
চতুর্থ গল্প, "আলোকের এই ঝর্ণাধারায় "
...............................................
মানুষ বদলে যায়। কৈশোরে যাকে আদর্শ করে বড়ো হতে হয়, যৌবনে এসে সেই মানুষটির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, এতো সেই জন নয়। ত্বকের নীচে রক্তের রঙ ফ্যাকাশে দানায় ভরে গেছে। আদর্শের সঙ্গে কখনো দেখা না হওয়াই ভালো। কাছে এলে, বেশী করে জানলে বিষণ্ণ হতে হয় শুধু।
তাই সুপ্রকাশ স্যানাল আর তাঁর ছাত্র আলোকের পুনর্মিলন না হলেই বোধহয় ভালো হতো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১১
গল্প সংগ্রহ
পালিয়ে যাওয়ার অ আ ক খ
লেখক কিশোর রঞ্জন দে
প্রচ্ছদ মিলনকান্তি দত্ত
সৈকত প্রকাশন
মূল্য ১৫০ টাকা
কোন কোন লেখকের গদ্য এতটাই দ্রুত আর সাবলীল থাকে যে পাঠক কখন সেই গল্পের আবহে ঢুকে গল্পটির চরিত্রগুলোর সঙ্গে বসে গেছে, তা সে বুঝতে পারে না। পালিয়ে যাওয়ার অ আ ক খ তেমনই একটি বই। এতটাই বাস্তব তার চরিত্র অংকন আর কথা বলার আবেদন, যে মনে হয় আমার পাশের বাড়ি। আসলে তা নয় ভেতরে গোপনে ঢুকে পড়ছে অজস্র পাহাড়ী নদী, গম্ভীর পাহাড়ী সন্ধ্যার ডাক। "সৃজার পরিত্যক্ত মোবাইল "গল্পে, একটি মোবাইল ফোনের ভেতরে গল্পকার ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনটি প্রজন্মকে। সেখানে বদলে যাচ্ছে চ্যাটের পরিভাষা, জীবনের পালাবদল ঘটছে। একটি একটি মেসেজ বলে দিচ্ছে জীবন বদলে যাচ্ছে তাদের ক্রমাগত।
"মৃত্যু ও আত্মজ " গল্পে একাকী এক বৃদ্ধা নার্সের মৃত্যু, যার ছেলে বিদেশে থাকে, দুদিন পর জানা গেলো তিনি বেঁচে নেই, নীরবে মরে গেছেন বিশাল বাড়িতে একা একা। সেটা বিষয় নয়, বিযয় হলো বর্ণনা, এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত ঘটনাগুলো বলা হয়েছে যে, আমার গায়ে লেগে থাকা শ্মশানের গন্ধ যেন তা থেকে পাচ্ছিলাম।
হোয়াটস্ এপে আমরা আজকাল নানান মেসেজ পাই। অনেক মেসেজই থাকে খুব সুন্দর, আমাদের ভাবিয়ে তোলে থমকে দেয়। বাবা ও হোয়াটস্ এপের মেসেজ এমনই একটি গল্প। ব্যস্ত জীবন সংগ্রামের নীচে বয়ে যাওয়া চিরায়ত ভালোবাসার চোরা স্রোত।
শঙ্খধ্বনি নীরব ভালোবাসার গল্প। গল্পের চরিত্র ধনঞ্জয় আর পাঞ্চালীর মধ্যে খেলা করছে এক অদৃশ্য টানাপড়োন। একসময় শেষ হয়, মঙ্গল শঙ্খের মানস উদযাপন শুরু হয়।
গল্পগুলো সহজ, সরল আর বাঙ্ময়। শুরু করলে শেষ করতে হবে, একটি আবহ তৈরী হয়, যার ভেতর আপনিও গল্পটির মৌণ চরিত্র হয়ে ওঠেন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া, "উড়াল অন্তহীন "১২
লেখক ... অভিজিৎ চক্রবর্তী
মূল্য ...১০০ টাকা
সাতদিন প্রকাশন
অভিজিৎ চক্রবর্তীর নতুন কাব্যগ্রন্থ, "উড়াল অন্তহীন ", পড়ছি, আরোও পড়বো কয়েকদিন পর আবার। কবিতার বই একবার পড়ে রেখে দেওয়ার নয়। বার বার পড়ে পড়ে কাছে আসতে হয় কবিতার। এই কবিতাগুলোর উড়ানও তেমনি। কখনো স্নিগ্ধ, কখনো প্রখর, কখনো গুহার ভেতর পথ হারিয়ে ফেলা। কবিতার প্রধান গ্রামার, "স্পর্শ " সেই স্পর্শ যার জন্য এতো আয়োজন, যুদ্ধ, শাসন আর পরাজয়।
একটি ভালো কবিতার কাছে দীন হয়ে বসে থাকতে বড়ো ভালো লাগে। অভিজিৎ এর এই কবিতার বই থেকে, তেমনই কিছু কবিতার অংশ ....
" জানাই ছিল না কেন হাড়খানি বাজে
হাড়ের ভেতরে কথা যাদুকরে লেখে "
"সারাটা বসন্ত শুধু ফসলের স্মৃতি
এত যে বড় হবে বিষয়
জানিনি ; একটা কথা বলতে গিয়েই হল হাজার হাজার
নতমুখে দাঁড়িয়েছি ধুতুরার ফুল
কেউ বলে এ মাতাল
কেউ বলে কথার ভারে দাঁড়িয়ে আছে বাচাল "
"একই নারীর কাছে প্রেম
ভঙ্গিমা এক, নিবেদন এক
কবি বলে হাঁসফাঁস
কবি বলে দুখ
শব্দে শব্দে মন তো সর্বভুক "
"তুমি কে হে কোন জাহাজের সওদাগর
ভোর পেরিয়ে উঠে আসতে সন্ধ্যারাত
নোনাজলে সাঁতরে সাঁতরে দিবস কাটাও
গলির মুখে ঝোলাখানি উল্টে ধরো "
"আবার শ্রাবণমাস কালসাপ আমাদের ঘরে
আবার শ্রাবণ মাস কালনাগে দংশেছে লখিন্দরে
মঞ্চের কবিরা চুপ করো, দেখো তোমাদের চারিদিকে জল
ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা নিয়ে গোল হয়ে গাঁয়ের বধূরা
পাঠ করে পুঁথি কবিদের মনসামঙ্গল "
এবং
"যদি ভালোবাসা, খোঁজো বিশ্বাস কোথাও
তারপরও ভরসাই যদি রাখো,
মাটির গভীর থেকে শোনো বলে কারা
এই পৃথিবীর নাম হোক, "আনোয়ারা "
আরোও অজস্র মনিমুক্তো ছড়ানো আছে বইটিতে।
খুব ভালো লাগলো অভিজিৎ, "উড়াল অন্তহীন "
তোমার পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৩
কাব্য গ্রন্থ : ভুসুকুর পদ
লেখক : অভিজিৎ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ : বাপ্পা চক্রবর্তী
প্রকাশক : স্রোত
মূল্য : চল্লিশ টাকা
"শহরের সব রাস্তা বিক্রি করে দেব
যেই পথে রাত হলে বাড়ি যেতে হয় " আবার, "মানুষ গেলে কী থাকে মানুষই জানে, একটু ব্যথা কি জাগলো না মনে! জানে মানুষই জানে - কোণে তার ছিঁড়ে গেছে, সঙ্গোপনে পাখিরও যে বেদনা আছে ", অভিজিৎ চক্রবর্তীর এই আত্মগত সুরই ধীরলয়ে বেজে গেছে, বারটি কবিতার এক ফর্মার বই, "ভুসুকুর পদ "এ। কবি এখানে আবরণহীন, সহজ সরল পদাবলী লিখে গেছেন তন্ময় হয়ে। প্রথমবার পড়ে মনে হয় সাধারণ, তারপরই আবার পড়ার সাধ জাগে, তখনই খুঁজে পাওয়া যায় লাইনগুলোর গভীরতা। এক ফর্মার বইটি সার্থক হয়েছে এই নিবিড় তন্ময়তায়। অবলীয়ায় তিনি বলে গেছেন,
"শিল্প শিল্প বলে চাবকায় দিন
নেশা তো কাটেনা খালি বেড়ে যায় ঋণ " কিংবা,
"ফের সন্ধ্যারাত, তুমি প্রার্থনার মতন নবীন
আমিও বসেছি চুপ মুখোমুখি অভিযোগহীন "
কবি সরলভাবে বলেছেন,
"কত কিছু লাগে একা বাঁচতে গেলেও
পা মোছা পাপোশটিও চাই অন্ধকারও
আলনার পিছে, শূন্য ফুলদানি আর
মশলার কৌটোটি ও হাতপাখা চাই, "
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৪
কাব্যগ্রন্থ "রূপকথার ক্যারাভেন
লেখক রাহুল সিনহা
প্রচ্ছদ পুষ্পল দেব
অক্ষর প্রকাশন
কবি রাহুল সিনহার বই "রূপকথার ক্যারাভেন "তিপ্পান্নটি কবিতার রূপকথা, আসলে বিন্দু বিন্দু বাস্তব, এ হলো কবির বাস্তবতা, যেখানে অন্যরা গোধূলির ছায়া দেখেন, কবি রাহুলের কাছে তা হলো
"যে গল্পগুলো খুব অনায়াসে শোনাতে চাই
মাঝপথে তার দরজায় উঁকি মারে অন্য ছবি। "
এসব গল্প আমাদের কাছে আছে, আমরাও খুঁজি,
"মেলার ভিড়ে খুঁজতে থাকো
চাবির গোছা, স্মৃতির কোলাজ
ক্যানভাসে যে ছবিই আঁকো
সেই ছবি মিলবে না আজ "।
একটি লাইন যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায় আপাদমস্তক
"প্রত্যাখ্যানের মন্ত্র শিখে নেওয়ারও জরুরি
গ্রহণের মতোই দরকারি ফিরিয়ে দেওয়াও, "
আমরা কি সত্যিই কাউকে ফিরিয়ে দিই, একচিলতে অনুশোচনা ফেলে রাখি মনের অন্দরমহলে।
"সব মিছিল কেন অভিসারে যায় না "
হয়তো কবির কাছে আসে সেই মিছিল বৈরাগ্য নিয়ে, তাই অভিসারের পথ ভুলে যায়। সত্যিই বড়ো হিংসে হচ্ছে, কবি, এ লাইনগুলো কেন আমি লিখতে পারলাম না। এই হিংসা ই কি কবির প্রাপ্তি, তা অন্যরাও বলবেন।
এরকম আরো অসংখ্য মণিমুক্তো ছড়ানো "রূপকথার ক্যারাভ্যানে ",শুধু মনে হয় এসব কথা আমরো হয়তো আমাদেরো, ঝকঝকে ছাপা, বইটিকে আরোও সুন্দর করেছে।
অতল জলেও বেঁচে থাকার মতো প্রাণবায়ু দিলে
ডুবসাঁতার শেষে তোমারই চির অতিথি হবো,
বড়ো গভীরভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কথাগুলো, প্রতিটি কবিতাই একটি একটি আবিস্কার, পাঠকের কাছে, কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। এটি তার প্রথম বই, অপূর্ব সুন্দর প্রচ্ছদটি করেছেন, আমাদের রাজ্যের শিল্পী, পুষ্পল দেব। বইটি প্রকাশ করেছে, অক্ষর পাবলিকেশনস্।
আরো একটি লাইন সবশেষে,
"সন্ধ্যার সঙ্গীরা বিদায় নিয়েছে,
অর্জিত স্বভাবে একা রাত জাগি।
সন্ধ্যাস্তোত্র নিশ্চুপ হলে শোনা যাবে
নিজস্ব উচ্চারণ, যদিও অপরিচিত,
কারণ রোজ একান্তেই বদলে ফেলি কন্ঠস্বর। "
আপনিও কি তাই নন …
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৫
কাব্য গ্রন্থ: মধ্যরাতের পিং
লেখক : মৌলিক মজুমদার
নীহারিকা প্রকাশনা
প্রচ্ছদ
মূল্য
" রাত রেখে গেলাম
হাত রেখে গেলাম
রাত নিয়ে নেড়োচেড়ো
হাত নিয়ে নেড়োচেড়ো
বন্ধু!
ক্লান্ত এসময়,
রাতে হাত
হাতে রাত
নষ্ট করা ঠিক হবে না ..."
মধ্যরাতের তীব্রতা গুলো শুরু হয়েছে এই স্তবক গুলোর মাধ্যমেই।
আমরা যে কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো আসলে নিজেদের থেকে
অনেকটাই দূরে বাস করি, হয়তো সেই দূরাগত আলো কোথা থেকে এসে একাতিত্বের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে।
২
" হায় পুস্তকমেলা,হায় কিরাত দেশ,
উন্মুক্ত বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়েছিলাম ...
শিকার হয়ে যাবো এই আশা নিয়ে ...
কিন্তু … তখন …
হরিণীরা সব পলাতকা
গায়ে চেয়ে দেখি ডোরা কাটা "
সুন্দরীরা শেষ পর্যন্ত কবির কবিতায় বাঘিনী হয়ে গেছে, যেন তাদের প্রসাধনগুলো ডোরাকাটা দাগ। ভালোবাসার আশাকে বিদ্রুপ করে কবি হেসেছেন, ভেতরে একটি
নির্বিকার ভাব আছে তার, আসলে যেন তিনি এসব কিছুই আশা
করেন না, তবুও কৌতুক করেছেন একটুখানি।
৩-----------------------------
"চলো দুজনে ভাসি
নোঙর হোক কিছু জোনাকি
রাজধানী থেকে ফেরা,
অকিঞ্চিৎকর ডানায়
যারা ভরে এনেছে
তিমির রাত্রি কথা ।"
"নোঙর হোক কিছু জোনাকি ", এই ধরনের পংক্তি পড়ার জন্যই
কবিতার কাছে আসি।
৪
মাছেদের বৈরাগ্য আসে
জলাশয় ভরভরন্ত হলে,
দুকূল ছাপানো প্লাবনে
নিরুপায় মেটায় ওরা
মাৎস্যন্যায় ক্ষুধা ।
৫
প্রেমে অবিচল মুর্তিটি এক গাছের,
ঝাঁঝরির নাম বিবেক, তাতে সিঞ্চন করি জল,
গাছের পিপাসা আছে
প্রেমের আর্তি আছে
শীতের রোদে রাস্তায় ওড়ে ধুলো
বাস ট্রাক চলে গেলে,
ঝাঁঝরি হাতে রাস্তায় …
তৃষ্ণার জল নয় …
এ উদ্ভিদের রূপটান
৬
গুটি গুটি শামুকের খোল থেকে
বার হয় মাথা,
মাংস ছড়িয়ে পড়ে
যেভাবে আমার পাড়া ছেড়ে
ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্বৎজনেরা
রাষ্ট্রময়।
শহরে এখন শুধু তুমি
আর শুধু আমি
আর আমাদের দুইজোড়া চটি।
৭
হলিউড সিনেমায় দেখেছি
যুদ্ধের আলোকময় আকাশের নীচে
হেঁটে গেছে বিস্রস্ত নারী
কোলে শিশু নিয়ে।
আমার শহরও আজ দাবার চৌষট্টি খোপ,
জেগে আছে বুকে নিয়ে
বুক ফুটো করা বুলেটের খোল,
অফিস থেকে ঠিকঠাক ফিরো "
সব মানুষের একটি ফেরা থাকে, কেউ কাজ থেকে ফিরে আবার কাজে ফেরে, কেউ প্রিয়জনের কাছে ফেরে, কেউ এমন এক জায়গায় ফেরে যেখানে তার ফিরতে ভালো লাগে না।
কেউ গানের কাছে, কেউ কবিতার কাছে, কেউ নাটকের কাছে,
সিনেমার কাছে, এসমস্তও ফেরা। কারণ মানুষ ভুলে যেতে ভালোবাসে তার এই আদিগন্ত একঘেয়েমি, আর একমাত্র সৃষ্টিই মানুষ কে কখনো ফেরায় না,
এখানে অফিস থেকে ঠিকঠাক ফিরো, মানে এক টুকরো আশা,
নৈরাশ্যের মধ্যে কবি গুঁজে দিয়েছেন একটি রক্তিম পলাশ, ভালোবাসায় ভেজা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৬
কাব্যগ্রন্থ "লোহার পোশাক "
লেখক ... চিত্তরঞ্জন দেবনাথ
প্রচ্ছদ পুষ্পল দেব
নীহারিকা প্রকাশনা
মূল্য
তরুণ কবি, লেখাটি ঠিক নয়, কবিরা চিরতরুণ, শুধু তারা তাদের অনুভবে অভিজ্ঞতার পালক যোগ করেন। কিন্তু কবি চিত্তরঞ্জন সত্যিই তরুণ, তার কবিতা খোলা দরজা। কবিতা সবসময়ই উন্মুক্ত অনুভব, তবে তাতে অনেক সময়ই পর্দা ঝোলে, চিত্তরঞ্জন এই পর্দাটি ছিঁড়ছেন। কবিতারা হাঁটতে শুরু করেছে, সামনে অনেক সময়, অনেক উঁচুনীচু কবিতা হবে,এ আমার বিশ্বাস।
বইটির নামের সঙ্গে কবিতাগুলোর একটি গেরস্থালি সম্পর্ক। কবিতাগুলো দৃঢ়বিশ্বাসে সিক্ত। কবি ভীষণ সিরিয়াস। আন্তর্জালে প্রায়ই তার কবিতা পড়ে শাসিত হচ্ছি। অনেক শুভেচ্ছা. চিত্তরঞ্জন, খুব লিখো।
এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে, ত্রিপুরার "নীহারিকা পাবলিকেশনস " থেকে, দুইহাজার সতেরোতে।
"রিয়েল টাইমে আমরা সবাই গর্ভবতী
ক্ষণিকেই প্রসব করছি
নীল নীল লেজওয়ালা বিদঘুটে
এলিয়েন শিশু "
নতুন পথিকের নরম, উষ্ণ লাইনগুলো, পাঠকরা কিনে পড়বেন, এই ইচ্ছে রাখি।
কবি তার কবিতায় শব্দের বিস্তার ঘটাননি, টেনে টেনে
লাইনের পর লাইন সাজাননি, শক্ত করে আবেগ পুঁতেছেন, মাটির কাছাকাছি, ঘষাঘষি তাকে আরো সবুজ করুক, আশা রইলো আমার, অপেক্ষা পরের বইয়ের।
"লোহার পোশাক "এর অনবদ্য প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী পুষ্পল দেব।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৭
কাব্য গ্রন্থ। আত্মগুঞ্জন
প্রচ্ছদ
লেখক অভীক কুমার দে
স্রোত প্রকাশনা
মূল্য
অভীক কুমার দে, এক উজ্জ্বল তরুণ, বেশ কিছুদিন ধরে লিখছেন। ত্রিপুরার স্রোত প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে, তার দুটো কবিতার বই। দ্বিতীয় বইটির নাম "আত্মগুঞ্জন "। কবির চিন্তাভাবনায়, অস্থিরতা, প্রতিবাদ, কখনো দ্রোহের নীচে একটি পেলব মন উঁকি দেয় তারুণ্যের স্পর্ধায়। অভীকের কবিতা বহুমাত্রিক। নানা দিকে তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে অন্তঃস্থল, তাই তার সব কবিতাই আত্মগুঞ্জন।
অভীকের মনে হয়,
"ছোট পরিবারের মত ঘনবসতি ছড়ায়,
গায়ের আঘাত গায়েই মাখি;
বাড়ন্ত অত্যাচারে বিভাজিত হই আমিও....।
তবুও শেষ নেই ?"
এতো সবে শুরু, শেষ কোথায়, কবে, এটাই এখন আত্মকথা,অগোচরে আমিও তার অধিবাসী।
"যেখানে নদীটা খরস্রোতা নয়,
নয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী, কোমল পলির বুক ধুয়ে শুধু বয়েই যাওয়া.... অথচ 'ছায়া- ছবি' আগে থেকেই পলি মেখে কাকতাড়ুয়া ! "
শ্লেষটুকু মাখলাম আমিও।
"আমার গ্রামে তোমার শহুরে- শৈশব, তারপর খুঁড়িয়ে চলা আর কুড়িয়ে যাওয়া.... !"
কুড়িয়ে যাচ্ছি, অভীকের কথার টুকরো।
."কিছু দৃশ্য মনের আকাশে ভাবনার মেঘ- ছবি
কিছু ছবি জীবনযুদ্ধে সারথির চিন্তন, কিছু ছবির জল-ছায়া জাগে চেতনায় আর পতাকার দোলন বাড়ে।
.
সময় পেরিয়ে পতাকার দোলন আবারও বাড়ছে,
কতগুলো নথিভুক্ত নাম একের পর এক রোদ- বৃষ্টি- বাতাস- ছায়া ঠেলে পত -পত শব্দ,
নিয়মের কৌশলে নির্জীব প্রবাহ এগিয়ে চলেছে ---"
একটি প্রশ্ন, নির্জীব হলেও ঘুমের মধ্যেও জেগে রইলো মনের কোণটিতে ইর্ষা ও অহংকার নিয়ে।
"একদিন আবার বৃষ্টি হবে,
ধুয়ে যাবে স্তরে স্তরে জমে থাকা সব কালো,
শিকড়ে শিখরে জাগবে শৈশব,
থেমে যাবে বিষাক্ত পোকার নড়াচড়া।
দলবদ্ধ শাল- দেহে যৌবন এলেই কথা হবে রোদ্দুরে,
হয়তো সেদিন আমার শেষ তোমার প্রথম,
তবুও মুক্তি হবে মৃত্তিকায়।"
আমাদের সকলের মুক্তি মৃত্তিকায়, কত সহজে বলা, এই মুক্তির জন্যই কি কবিতার জন্ম হয় না? হয় তো হয়, কবির আত্মগুঞ্জন এজন্য বার বার পড়লাম, তারুণ্যের গন্ধ, দ্রোহের রাত মিলেমিশে একটি উষ্ণ সম্ভাবনার নরম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলো অভীক।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৮
বইয়ের নাম..."তারা দেখার পাপ "
লেখক...সুমন পাটারী
নীহারিকা প্রকাশনী
মূল্য...১৩০ টাকা
প্রচ্ছদ ...চারু পিন্টু
"কবিতা লিখলে কেউ ফিরে আসে না জেনেও
চিঠি ..কবিতা লিখেছে কবি।
কবিতা পড়ে কেউ কখনো কবিকে দেখেনি
কবিতায় নিজেকে খুঁজে নিয়ে
পাঠক চলে গেছে মাথায় হাত বুলিয়ে।"
এই শ্লেষ, এই মোদ্দা কথা বোঝার পরও একজন তরুণ কবি কলম আঁকড়ে বসে থাকেন। এটাই বোধহয় কবিতার জয়।
"দিদি, আমাদের তিনজনের বড়ো,
একটি মুরগীর মতো পালকের ভিতর
আগলে রাখতো সারা শীতের রাত। "
বড়ো মধুর আর নির্মেদ লাইন। দিদিরা এমনই হয় আর ভাইরা এমনি বোঝে তাদের।
"কেউ কারো নয় একা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে যাওয়ার পরও
আমি ক্ষান্ত হইনি নরম মাংসল বুক খোঁজা থেকে
বুকের মাঝে বুক ডুবিয়ে মরে যাওয়া :
এই এক নেশা শুধু যৌবন বয়ান করতে পারে। "
এই উক্তিটি তীব্র বৈরাগ্যের দিক নির্দেশনা, কবি যৌবনের কথা বলেছেন, আসলে তিনি ভিতরে এক গৃহবিমুখ সন্ন্যাসী, এটা তাই বিদ্রুপ এবং অন্তরের অসহায়তার বয়ান।
"বাবার লাল চোখ দেখে সেদিন
দৌঁড়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম খাটের নীচে।
চোখ বন্ধ করে শুনেছিলাম বাসন বাজনা।
বাবা চলে যাওয়ার পর বাইরে এলে
মায়ের দীঘি চোখ বলতো বড়ো হয়ে বাবা হোস না!
উদ্যত শাসন ...দন্ডে এখন
আমিও সেই রক্তচক্ষু, এক বাবা! "
কবির এই কবিতার সঙ্গে একজন কবিতাপ্রেমী পাঠক নিজেকে সহজেই রিলেট করতে পারবে। তাই এই কবিতা বাস্তব এবং পাঠকের নিজের কবিতা।
"কখনো এমন ছিলো ...
ছোট বোন ছোট বলে ওর কাপড় লাগতো না,
বড় বোন বড় বলে ওর ক্ষুধা হতো না,
চারজন সন্তান বলে শেষের দুজনের অন্নপ্রাশনের শুভ অনুষ্ঠান হয়নি,
.
.
.
আজ বিশ বছর পর
বোনের জন্মদিন, ধুমধাম করে পালন হলো, প্রথমবার,
খুব হেসেছে সে
বাবাকে কাঁদতে দেখিনি খুব কাতরতায়,
আজ কেঁদে উঠলো চোখ,
জল দেখে মনে হলো এখন বেশ ভালো আছি "
একজন সদ্য যুবকের বলিষ্ঠ বুকে এভাবেই সঞ্চিত হোক জীবনের নরম পলি।
"কখনো কথা বলতে শিখিনি
তাই লিখছি আমার মতো
লিখছি আর লিখছি।
একদিন বন্যা আসবেই,
মুছে যাবে দিনে তারা দেখার পাপ "
কবির অন্তর্নিহিত তারার খোঁজ কে পায়। এ এক দুর্বার এবং দুর্বল সত্তা, যাকে ব্যক্ত করার জন্য আছে অন্য বোধের মানবিক এবং অমানবিক অজস্র পংক্তির ক্রমাগত বিকিরণ।
কবি ভাই সুমনকে দিদির অনেক শুভেচ্ছা রইলো। আরো ভালো লিখো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১৯
কাব্যগ্রন্থ "মাটি মানুষ ",
লেখক সুমন পাটারী।
প্রচ্ছদ
স্রোত প্রকাশনা
মূল্য
একজন উজ্জ্বল অভিমানী তরুণ, কবিতা ভালোবেসে,
কবিতা লিখতে এসেছে।
মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে কলম। কখনো প্রেম, কখনো ঘেন্না, রাগ, আবেগের বাড়াবাড়ি একজন তরুণ কবিকে কবিতা শেখায়, সুমন সেই ছেলে। তারমধ্যে আগুন আছে, তাপ লাগতে শুরু করেছে। গভীরে যাচ্ছে সে, যে যাওয়ার শেষ নেই। লেখালেখি একটি খাদের মতো। নিজেকে খোঁড়া প্রতিদিন, এই খোঁড়াখুঁড়িতে কখনো দামী আকরিক উঠে আসে, কখনো আসে না। আসা না আসার দ্বন্দ্বে কেটে যায় কবির জীবন, সুমন এসে গেছে এই দ্বন্দ্বে। তার কবিতার লাইনগুলো চমকে দিচ্ছে আমাকে। আরো অনেক লিখবে সুমন। দুর্দান্ত সব কবিতা, এই আশা আমার, নিছক শব্দকল্পদ্রুম নয়, শব্দের বাসা, ছায়া, আসবাব, হৃদয় সব উঠে আসবে তার কবিতায়।
কবি লিখেছেন, "তোমার খোঁজে একদিন শহর হয়েছিলাম "
মনে রইলো, গুণগুণ করলাম।
"ফলন্ত মাঠে আগুন দিয়ে নদীচরে একবিঘা জমি
রাতের বালু শীতলতায় শব হবো "
ভালো লাগলো খুব।
একটি কবিতা, "পাথুরে রাত ", ভাবিয়ে দিলো, নাড়িয়ে দিলো। আরো যত্ন নিয়ে লিখতে থাকো তরুণ কবি, ঝলসে দিও, এই প্রতিশ্রুতি চাই।
বইটি প্রকাশ করেছে, ত্রিপুরার, "স্রোত প্রকাশনা "। প্রকাশিত হয়েছে, নয় ফেব্রুয়ারি, দুইহাজার সতেরো।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২০
গোবিন্দ ধরের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
"শ্রী চরনেষু বাবা",
লেখক গোবিন্দ ধরের একটি বই। লঘু এবং গম্ভীর স্মৃতিচারণ। টুকরো টুকরো কথা। কবিতার আঙ্গিকে ছোট ছোট ভার মন থেকে লাঘব করেছেন অনায়াস দক্ষতায়।
"নিজের শিকার করা মাছ
আমাদের পাতে তুলে দিতে পেরে
তোমার সেই তৃপ্তি উজ্জ্বল মুখ
আমার বুকে গেঁথে রেখেছি
একজন পিতার প্রকৃত মুখ বঁড়শির মতো। "
একজন লেখককে তার লেখার মাধ্যমেই পড়া হয়। লেখার মধ্যে এসেই ভীড় জমায় সাধারণ রোদ, বাতাস, মেঘ, দৈনন্দিন যাপন।
"একটা পদ খরচা করে তুমি বলতে
'যা বাড়ি দিয়ে আয় '।
বাজার থেকে বাড়ির পথে একটা বটগাছ ছিল।
সাথে মসজিদ ও মক্তব।
এখানে এলে আমার গা কাঁটা দিত।
তবু, তোমার আদেশ ...'যা, দিয়ে আয় '
আজ অব্দি পালন করে চলেছি।"
এসবই খুব বোঝা যাচ্ছে, কোন আঁতাত নেই স্পষ্ট এবং অস্পষ্টতার মধ্যে। ভীষণ সরল লাইন। তবে কেন লেখা।
কারণ নিজেকে হালকা করা। আমার কিছু কথা ছিল বাবার সঙ্গে। আমি কি তাকে দুর্ভ্যেদ্য বর্ম পরাবো না বাতাস দিয়ে ধুলো মুছে দেবো, এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মত।
"কৈলাসহর চেকপোস্ট হয়ে বার বার
ও - পারে গেছেন ...বয়স খুঁজতে।
বয়স তিরতির মনুর জল হয়ে মিশে গেছে
বঙ্গোপসাগরের নুনে।"
বোঝা গেলো দেশভাগ। এই ছাপ থেকে ভুক্তভোগী কোন লেখকই নিজেকে আলাদা করতে পারেনি।
"তারপরও বাংলাদেশ যাইনি।
শ্রীহট্টীয় ঘ্রাণ বাবার শরীর
থেকে আমার শরীর ছুঁয়ে
পাচার হলো আত্মজের শরীরে।"
চেনা সমীকরণ। দেশ থেকে দেশ বদলে গেলো কলমের আঁচরে ।
"বাবা শিখিয়েছেন
করুলের চচ্চড়ির কী স্বাদ।
এখন আমি গোদক খাই
খারপানির আনন্দে নেচে উঠি "
এই সহজ প্রতীকান্তর একটি মিশে যাওয়ার ইঙ্গিতই বহন করে।
খুব সহজ সরলভাবে বয়ে গেছে এই লাইনগুলো।
"বাবার প্রলম্বিত ছায়া
জমানো স্বপ্ন
এবং সমস্ত ঋণ
পুষে রাখি
যেন গায়ে সাঁটা
পাঞ্জাবি
বাম অলিন্দে। "
পিতৃতর্পনের মতোইই লেখা হয়েছে তার এই পিতৃপরিক্রমা।
"সূর্য সেন লেন " আরেকটি কবিতার বই।
"জলকাতর বালকেরা
জলে জল খোঁজেন
জলতেষ্টায় উঠে আসে আর্সেনিক "
"প্রতিদিন একটু একটু পুড়ি।
প্রতিদিন
পূব -পশ্চিম ঘুরি
প্রতিদিন মরুমায়ায় হাঁটি
প্রতিদিন কামড়ে ধরে মাটি "
"মাটির গভীরে যেতে চাই
গভীরে কেঁচো থাকে
থাকে সাপ
গভীরতম থেকে
উঠে আসে সর্পপুরাণ "
এগুলো এতটাই তাৎক্ষণিক সরলতায় লেখা যে এর মধ্যে থেকে খুব কিছু তুলে আনতে হয় না, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে চারপাশে লাইনগুলো ঘুরপাক খায়।
"মনসুন মাছি " আরেকটি বই। অনু কবিতার।
"উড়তে উড়তে মাছিরা
আকাশে ওড়ে
আকাশের নীলিমা ...তারা জানে না "
মাছিদের আড়ালে এ যেন মানুষের অবনমন ক্রিয়াকাল। নীল আকাশের কাছাকাছি পৌঁছুতে না পারার ব্যর্থতার মানবজমিন।
"মাছিদের বৈরিতা
যে কোনো সময় ঠোঁটে
মনসুন অসুখ পাঠায়। "
আমার মনে হল এই লাইনটি এক প্রায়ান্ধকার অসুস্থতার দুর্বল শরীর। হতাশা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির গলিঘুঁজিপথ।
"তামাদি হয়নি যে ভালোবাসা ", শিমুল পারভীন এবং গোবিন্দ ধরের যৌথ কবিতা সংকলন।
"যখন রাজনীতি করেন, আপনাকে চিনি না।
যখন শত্রু হয়ে যান, আপনাকে বুঝি না।
যখন ভালোবাসেন, আপনাকে পর মনে হয়।
যখন বুদ্ধিজীবী, আপনাকে বোকা মনে হয়।
যখন সরল হন, আপনাকে সাধারণ লাগে।
যখন বিজ্ঞাপিত হন, আপনাকে পুতুল দেখি।
যখন প্রশংসা করেন, তখন সন্ধি বিচ্ছেদ ঘটে।
তখন আপনি আর আমি তো দ্বন্দ্ব সমাস "
"চল্লিশ বছর বয়স অর্ধেক জীবন
এই বয়সেই স্বীকৃতি দরকার আর নয়
পথ পাল্টে অন্যপথেই হাঁটুন "
এখানে কবি নির্দেশ দাতা। স্পষ্টবাদী এবং রাজনৈতিক। যখনই কবিদের মধ্যে এই রাজনৈতিক শ্লেষ চলে আসে, তখন তার কবিতা অজান্তেই নির্দেশ, আদেশ, শ্লোগানধর্মী হয়ে ওঠে।
"মেয়েরা পাখির মতো স্বাধীন
নাকি পাখিরা মেয়ের মতো পরাধীন
প্রতিদিন মেয়ে আর পাখিদের গমনাগমন হৃদয়ে দাগ কাটেে। "
"তক্তপোষের দুদিকে দুজনে
অসুস্থ
কারও কাছেই চিকিৎসাবিদ্যা জানা নেই।
অথচ এভাবেই গড়ে ওঠে বিবাহোত্তর হাসপাতাল। "
"তোমার শহরে আমি সুপার মুন
আলোকিত করি রাজ্যপাট "
"ভালোবাসলে মুখের দিকে চাওয়া কঠিন।
মুখোশ নিয়ে আসতে পারিনি "
"বিন্দু দিয়ে অসংখ্য রেখা টানো
যার একটাও
আরো একটার সাথে
কখনো মিলবে না।
প্লীজ মেলাতে যেও না "
পাঠকরা এভাবেই তাকে চিনুক, সরলরৈখিক সাদা আলোতে।
তিনি আরো অনেক লিখুন, এই শুভকামনা থাকলো।
"পরম্পরা থেকে হৃদয়পুর অনেক দূর
মাঝে কোন ষ্টেশন নেই
শৈশব থেকে ট্রেন ছুটছে
দুরন্ত এক্সপ্রেস "
এভাবেই লেখকের যাত্রা সুন্দর হয়ে ফুটে উঠুক স্তবকে স্তবকে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২১
কাব্যগ্রন্থ ..."ভালোবাসার পাথরকুচি "
লেখক ...অমলকান্তি চন্দ
স্রোত প্রকাশনা
মূল্য ১৫০ হাকা
অমলকান্তি চন্দের, কবিতার বই "ভালোবাসার পাথরকুচি " শুভেচ্ছা উপহার পেলাম । বই এর প্রথমে একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় কবি মিলনকান্তি দত্ত। এটাই গ্রন্থটির প্রাণভোমরা। আমি তো সামান্য ঘুরে বেড়ালাম অনেক ভালোলাগা পংক্তির কাছে। সেরকমই কিছু নির্যাস রইল এখানে,
"দু হাতে মুঠো মুঠো অঞ্জলি
ছড়িয়ে দিতেই দেবাসনে,
শত শত পাপ ধুয়ে মুছে গেল বিল্বপত্রে "
"বাঁকা কাস্তের গল্প বলেন ঠাকুরদা
দাঁতে দাঁত চেপে এতোটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পাশাপাশি হেঁটে "
"কোনো কিছু পরখ করে নিতে গেলে
চোখের পাশাপাশি হাতদুটো চলে আসে অভিসারে
খুঁটে খুঁটে দেখে নেয় ত্বকের জালিকা আস্তরণ "
"নদীভাঙনের শেষে গড়ে ওঠে কলোনি
পীরের তকিতে সুতো প্যাঁচ
আর সোনামুখি সূঁচ
শরীরে বিঁধে গেলে রজস্বলা হও তুমি "
"একফোঁটা বিষ
দাঁতের ফাঁকে সরু নালীতে
নিংড়ে নিয়ে সারারাতে
আমার সংসার ডমরুর তালে তালে
বৈরাগী তিলক কাটে প্রশস্ত কপালে। "
অমলকান্তির কবিতা সহজ, সরল, সুন্দর, যাপিত জীবন ও জায়গার সঙ্গে মিলে মিশে উঠে এসেছে শব্দ এবং পংক্তি মালা। অনেক শুভেচ্ছা রইল তাকে। তিনি কবিতায় থাকুন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২২
বইয়ের নাম : মন্দারবৃক্ষ, গল্প সংকলন
লেখিকা : অর্পিতা আচার্য
প্রচ্ছদ : বৃষ্টিপ্রিয়া সরকার
প্রকাশক : তুলশী পাবলিশিং হাউস
মন্দারবৃক্ষ মোট চৌদ্দটি গল্পের অপূর্ব একটি সংকলন। আমি অর্পিতা আচার্যের কবিতাই পড়েছি এর আগে। ওনার লেখা গল্পের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। এখন গল্পগুলো পড়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেছি। বার বার মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের দর্পহরণ ছোটগল্পটির কথা। আমরা অনেকেই যখন গল্প লিখতে গিয়ে একটি অপরিচিত পৃথিবীর সন্ধান করি, সেখানে অর্পিতা আচার্য ভীষণ সাধারণ জিনিস থেকে অসামান্য গল্প তুলে এনেছেন। প্রথমে বইটি খুলেই মাঝখানে একটি গল্প পেলাম ভেটকির মাসি। গল্পটি পড়তে পড়তে শেষ লাইনে আমি কেঁদেই ফেললাম। আমাদের বহু মানুষের জীবনেই এরকম একজন পরম প্রিয় ভেটকির মাসি আছে। বাপের বাড়ি, গল্পটি অসামান্য নিপুণতায় এঁকেছেন তিনি। মন্দারবৃক্ষ, ওরা দুজন এবং অনেকে, কাচের জানালা, দ্বিতীয় পৃথিবী ইত্যাদি সবগুলো গল্পই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে । তিনি সামাজিক সমস্যা, সংকট, প্রেম সবই লিখেছেন কিন্তু প্রকট নয় কোনকিছুই। এখানেই লেখিকার মুন্সিয়ানা। পরিমিতি বোধ আর আবেগের যথাযথ মিশ্রণ গল্পগুলোকে টানটান রেখেছে।
চরিত্র, চরিত্র অনুযায়ী ভাষা, পারিপার্শ্বিক সবকিছু নির্মানে নির্ভুল লেখিকা।
কোন গল্পেই বিশেষ সাংঘাতিক কোন ক্লাইম্যাক্স নেই। কিন্তু শুরু করলে শেষ করতে হবে।
বইটিতে বানানভুল নেই। ঝকঝকে ও যত্নসহকারে ছাপা।
অর্পিতা আচার্যের, ভেটকি মাসি গল্প থেকে একটু অংশ,
"আজ খুব মনে পড়ে সেইদিন। এখন ভেটকি মাসির ছেলের চালের আড়ত। আমরা পাঁচ ভাই অনেক লেখাপড়া শিখে বড়ো বড়ো চাকরি করি। মা কোথায় কোন্ তারার দেশে। ভেটকি মাসিও মায়ের পাশাপাশিই কোথাও আছে। দুজনে মিলে অনেক গল্প করছে। মুড়ি ভাজছে ভেটকি মাসি। তেল চুকচুক করে মায়ের চুলে বিনুনি পাকিয়ে দিচ্ছে। কাজকম্ম হয়ে গেলে গরম গরম ভাত বেড়ে মা বসেছে।
ওরে সীমু, আর একটু দেই ডাঁটা শুঁটকির চচ্চড়ি?
ঝালের চোটে ভেটকি মাসির চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
লোভীর মত নাকের জল চোখের জল আঁচলে মুছে বলছে,
হইব নি তুমরার? আইচ্ছা আর একটু দেও তো সুরমা দি। বড় ভালা রান্ধ তুমি শুঁটকির চচ্চড়ি।
সারা মুখ হাসিতে ভরে গেছে তার। "
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৩
বইয়র নাম ..."বাউন্ডুলে পাখি
লেখিকা, মৌসুমী মন্ডল দেবনাথ
নীহারিকা প্রকাশনা
মূল্য ১৫০ টাকা
" শিশির পতনের সময়েই ফুটবে কিছু লাল গোলাপ
যদিও শহর জুড়ে সরব তুষারপাত।
এভাবেই শুরু হোক শীতের সকাল,
কুয়াশা ভেজা রূপান্তরকামী মেয়েবেলা "
এই কবির পংক্তি মালা এক অন্যরকম বৈশিষ্ট্যে সিক্ত থাকে। অজস্র চিত্রকল্প ছড়ানো তার প্রতিটি লেখায়।
"যে কোন বিদ্যুতের শেষে, জানাতো সে বৃষ্টি চরিত্র।
নদীর বুকেই নীলের বাড়ি, ঢেউ গুনে যায় অরিত্র।
ঘোর কাটিয়ে পিয়ানোতে ক্রিস্টোফেরির তুমুল আগুন।
দস্তানাতেই তুষার ছিল, রকসঙ্গীত ফাগুন।
মাঝবয়েসী চশমা খোঁজে চড়ুইভাতির আলো,
মেরুন ট্রেনের অপেক্ষায় অনেকই তো হলো।
বরফকুচির ফেরিওয়ালার ঘর বাঁধা আর হলো না।
এসব সবই বাসিখবর, মোমের পাখিই উড়লো না। "
"কৃষ্ণ প্রহর " কবিতা থেকে,
"এখানে এই হরিণরঙা মাটির 'পরে রাখো মোহন বাঁশি
অনঙ্গঅর্ধনম সুরে ছুঁয়েছো আমার দীর্ঘ বিষাদ রাত "
ওহে বাউন্ডুলে পাখি " কবিতা থেকে
"এখন রাঁধতে বসেছি
রান্নার ঘর জুড়ে মেঘ থৈ থৈ
কড়াইয়ে তপ্ত তেলে কইমাছের জান
হলুদে, লবণে মাখামাখি মৃত্যু রান্না করি
দুপুরের রোদে পুড়ছে আমার সময়,
কাঁপছে অধরা বৃষ্টি
আমার ক্লান্ত রূপোর নথে
মশলা মাখা হাতে,
অথচ এমন বিবস জন্ম ছিলো না আমার "
"দম্পতি " কবিতায়,
"চলোনা দুজনে ছুঁয়ে আসি আদিগন্ত তিসি ক্ষেত
আজ চলো নদীর পোশাকে মালভূমি পার করি
বাহুতে এঁকে নিও অ্যাফ্রোদিতির অসতী দেবীমুখ "
তিনি লিখেছেন,
"সব অপ্রিয় গল্পই বছর গেলে মধুর হয়ে যায়
পুরস্কৃত বিকেলের গন্ধরা তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে থাকে "
কবির সব লেখাই বড়ো মেদুর, প্রকৃতি থেকে একটি একটি কণা এনে তিনি তার কবিতার লাইনগুলোতে ঢেলেছেন।
"ভালোবাসি তোমার সব বিভাবরী জনপদ,
কৃষ্ণ ছলাকলা, অহরহ
তোমার সুরের কিঙ্খাবে দিও
দোয়েলের মেঠোরঙ, বিষণ্ণ পালক। "
আর একটি কবিতা,
"পৃথিবীর যাবতীয় দৃশ্যরা আমাকে খুঁজছে
শিশুখুনের রক্ত হিম করা দৃশ্য
বধূহত্যার আগুনের দৃশ্য
অরণ্য হারানোর দৃশ্য
সর্বহারা মানুষের বুক চাপড়ানোর দৃশ্য,
যুদ্ধের দৃশ্য
আমি আজন্ম খুঁজে যাচ্ছি
একটি প্রেমের দৃশ্য,
ভালোবাসার দৃশ্য "
আর নয়। পাঠকেরা কিনে পড়বেন, তার লেখা এইসব অপূর্ব চিত্রকল্প, শব্দের মায়াবুনন।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে, নীহারিকা প্রকাশনা দশ ফেব্রুয়ারি।
পাওয়া যাবে আসন্ন আগরতলা বুক ফেয়ারে, নীহারিকার স্টলে।
পাঠ আনন্দ ২৪
কাব্যগ্রন্থ ..."কবিতাসংগ্রহ "১
কৃত্তিবাস চক্রবর্তী
প্রকাশক ...নীহারিকা প্রকাশনা
মূল্য ...৩৫০ টাকা
শ্রদ্ধেয় কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তীর কাছ থেকে স্নেহ উপহার পেয়েছি, ওনার, "কবিতাসংগ্রহ " ১, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের সংকলন। "পোড়ারুটির মানচিত্র ",অতলান্তর দুদিক, রূপসরোবর, উৎস অন্তহীন পথে, পদচিহ্ন পড়ে আছে একা, দাগ, এই দলিলজীবন এবং অগ্রন্থিত কবিতা।
আমি আলোচনায় যাবো না। একজন মানুষের পরিক্রমা পড়েছি। সেই কাব্য পরিক্রমা থেকে পেলাম প্রচুর ভালোলাগা স্তবক আর পংক্তি, কখনো সম্পূর্ণ কবিতা।
তারই সামান্য কয়েকটি লিখছি এখানে।
উৎসর্গ পত্রটি
মা ..বাবা
আজও যাঁদের পাঁজর ফাটিয়ে ডাকি
মাকড়শা কবিতায়
"বাহির বাড়িতে জল ভাঙার শব্দ, ভেতরে শব্দ হাড় ভাঙার
ওপরে জাল বোনার শব্দ
নিজের খোলস ফাটিয়ে চারপাশে ঘিরেছেন নিজেকেই "
"পাথর শরীর ভেঙে বেরিয়ে এল শহীদ
বলল "আমি আবার যুদ্ধে যাবো,
অন্তত আরেকবার
তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাকে মরতে দাও
আমি মিথ্যা মর্মর হতে চাহ না। "
"আকাশ দেখে আমাদের ছাতা বদলের অভ্যেস
ঋতুর রঙে পোশাক
গোপনে এক দুর্বিনীত ইঁদুর, পোশাকের রঙে ঘষে দাঁত
সূর্য উঠলে এসব ভাস্বর হয়
আমরা গর্ত খুঁজি আর
ইঁদুর দখল করে আমাদের আশ্রয় "
"পাতা ভরানো শব্দের নাচ
আর মনে ঠাসা অকথ্য কথন
এই নৃত্যের কাহিনি আর কাহিনি নৃত্যে
ভৃত্য বনে আছি। "
"ফাইলের হাসি শুনেছেন কেউ?
আমি শুনেছি, ঠিক হায়েনার মতো
ফাইলের দাঁত হায়েনার দাঁতের মতো জোরালো ও ধার
চিবিয়েতো খায়ই, খায় চেটেপুটেও। "
"সাদা পৃষ্ঠা থেকে যখনই উড়ে গেল হাঁসদুটি
তার ছায়া পড়েছিল নদীর জলে, রানি দেখল
তারই পোষা হাঁসদুটো উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে
শারদ আকাশে তখন আর কিছু নেই, দুটো রোদের টুকরো
আসলে আমার খাতার পাতায় ওরা বন্দী ছিল যাবজ্জীবন "
"এই দেখো, আবার বোকা ভাবছে। বলেছি তো, হুমকি দেবেন না স্যার! ওসব ভয় টয় পালিয়েছে অভিধান থেকে। এখনকি আর কেউ রাগ করে কবিতা লেখে?
এখন সব আস্তে, প্রথমে আলতো ছুঁয়ে, আস্তে চাপ, তারপর আরও দূরে ...মনে হবে সময় থমকে আছে। মনে হবে সব বন্ধ্যা। এখন এই থমকানো অবস্থা। এটা খুব সুখির নয় স্যার! "
আর একটি স্তবক,
"সেদিন, ওই ওই যে দেখছেন গোল হয়ে বসা লোকগুলো ...ওখানকার একটা মেয়ে নির্জন সাইনবোর্ডে ঝুলে গেল।
আশ্চর্য! পালালো মেয়েটা! "
দেখলাম, সবই মুছে গেছে সাইনবোর্ডটার। শুধু কি একটা শব্দ তুমুল যুদ্ধের পর আবছা ভেসে উঠছে রঙের তলা থেকে। কী একটা শব্দ ...অ ধি ..."
কবির কাছ থেকে সবসময় অনুপ্রাণিত হই, উৎসাহিত করেন। ওনাকে আমার শ্রদ্ধা ও নমস্কার রইল। সুস্থ ও আনন্দময় হোক তার সারাবেলা।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৫
কাব্যগ্রন্থ : ভালোবাসার অম্ল রোদ্দুর
লেখকের নাম : আশিস ভট্টাচার্য
মূল্য :১০০ টাকা
স্বাগতম প্রকাশনী, আগরতলা
বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী নামে চেনা রচনাগুলিতে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের যতরকম আয়োজন, ঠাট -ধমক, সবকিছুর মধ্যেই রক্তমাংসের কবির কন্ঠস্বরই যে শুনতে পাওয়া যায়, সেকথা তো বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রেমিক প্রেমিকার নানা রঙের ছবি বৈষ্ণব পদাবলীর অক্ষরে অক্ষরে।
জ্ঞানদাসের একটি পদে রাধার ব্যাকুলতা :
"দেখিতে কি সুখ উঠে কি বলিব তা।
দরশ দরশ লাগি আউলাইছে গা "।
অনেকটা এরকমই আর্তি ও আকুলতা মিশ্রিত আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটি।
কবির কাব্যগ্রন্থের, শুরুতেই একটি কবিতার শেষ পংক্তি,
" জ্যোৎস্নার জন্য রচিত প্রতিটি শব্দ আমি
ভী - ষ - ণ ভালোবাসি । "
জ্যোৎস্না ঘাটতে পৃথিবীর শিল্পীরা কখনো ক্লান্ত হোন না, ঠিক যেমন ভালোবাসা ক্লান্তিহীন, প্রেম শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রার্থিত এক অপার্থিব অনুভব।
এই বইটিও একটি ভালোবাসার কবিতার বই। ভালোবাসার কবিতা না লিখে খুব কম কবিই কবিতার সংশয়াদীর্ণ পথে পা রাখেন। আশিস ভট্টাচার্য্যও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি প্রচুর সরলতা নিয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছেন। কবিরা কিন্তু ততটা সরল নন। তাদের হাতে থাকে অস্ত্রসম্ভার। তা দিয়ে তারা কাব্য পংক্তিগুলোকে যুদ্ধে পাঠান। এই যুদ্ধ প্রান্তরের কোন সীমা পরিসীমা নেই। যুদ্ধের জয়পরাজয় নির্নায়ক হচ্ছে সময়।
"স্বর্ণালী পরিবেশ তুমি বুঝলে না হায়,
এ আঘাত মুছে দিতে পারবে না
হাজার ফোঁটা চোখের বারিও
প্রিয়ভাষিণী, সকল অবয়বে ভক্তি আসে না। "
কবিমন যতদিন আঁটঘাঁট না বেঁধে কবিতা লিখতে চান তখন
কবিতায় আকুতি থাকে, যা মন থেকে কোন বাঁধা না পেয়ে চলে আসে সরাসরি সাদা পাতায়।
আশিস ভট্টাচার্যের কবিমনও এই সরলতা জারিত। হয়তো ওনাকে আরো বহুদূর দেখতে হবে, কিছুদিন পর তিনি এই আকুতি থেকে ফিরে আসবেন, তখন তাতে জঞ্জাল মিশবে মেধার, বোদ্ধারা বলবেন কবিতা মেলেছে উষ্ণ ডানা।
আমিও বোদ্ধা নই, তিনিও ধূর্ত রহস্যের মায়াজাল থেকে দূরে, তাই আমরা জলপানের মতো এইসব কবিতা পড়ি।
"বিশ্বাস করো,
নিঃশ্বাস থাকতে কোনও প্রেমকে
কবি অন্তত ঘৃণা করে না,
বরং সমাদরই করে, বোঝে না সবাই। "
কবিরা ব্যাধের মতো। স্বার্থপর শিল্পীদের হতে হয়। প্রতিটি অনুভবই তাদের কাছে লেখার উপাদান, হয়তো অনুভবপ্রদানকারীরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ থাকেন না শেষপর্যন্ত ।
এখানেই স্বার্থের সংঘাত।
"যে দুখণ্ড জমি তোমাকে উৎসর্গ করেছি বধূ
তাতে একখানা কুঁড়েঘরও যদি নির্মান করি কোনোদিন
নাম দেবো মানসী। "
এই মানসীর সঙ্গে বধূর দুরন্ত সংঘাত। মানসী ও বধূ এক নন।
চিরন্তন দ্বৈরথের নাম সৃষ্টি করার নীল অসুখ।
"কবিতায় মগ্ন বলে ফুলের কাছে যাই,
কেউ কেউ গোপন কাঁটায় বড্ড আঘাত করে,
সবাই তো আর তোমার মতন
কন্টকহীন সহজ - সরল সুগন্ধি ফুল নয় "
কবির মানসী কন্টকহীন। এতো কন্টকহীনতাও ঠিক নয়। ব্যথা না পেলে সৃজন যে হয় না।
কবির কবিতায় একই শব্দের বার বার ব্যবহার মাঝে মাঝে একঘেয়েমির সৃষ্টি করে। আগামী বইতে কবি আরোও চেতনামুখর হোন। তার সৃষ্টি হোক বৈচিত্র্যময়, বহুমুখী।
সবশেষে বইটি থেকে আর একটি ভালোলাগা লাইন,
"প্রেম আছে বলেই তো বিরহ,
বিরহ আছে বলেই
আমি ফুটে থাকি,
তোমার গোপন সংগ্রহে '
আশিস ভট্টাচার্য শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। জীবনের অপ্রাপ্তিকে তিনি সৃজনশীলতায় প্রবাহিত করেছেন, তাকে শুভেচ্ছা, তিনি আরোও লিখুন সতেজ মনে, প্রাণের শুদ্ধ আবেগে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৬
বইয়ের নাম ...জেগে থাকে পান্ডুলিপি
লেখক ...নবীনকিশোর রায়
নীহারিকা প্রকাশনা
মূল্য..১৩০ টাকা
"কতবার ভাগ হলে
কতবার হারালে ...
বলতে পারি একদিন
স্বাধীন ছিলাম! "
আমি যখন কবিতার নতুন কোন বই হাতে নিই, একদম চোখবুজে একটা পৃষ্ঠা খুলি, সেখান থেকেই শুরু করি, এ বইটিও এভাবে খুলতেই, একটি কবিতার প্রথম স্তবকটিতে চোখ আটকে গেলো, কবিতার নাম মাতৃভূমি। সেই কবিতা থেকেই প্রথম স্তবকটি।
এইরকম ভাগ হওয়া আর হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ভোগ করতেই হবে, তা সামগ্রিক দেশ ভাবনায় হোক কিংবা নিজের অস্তিত্বের সুতীব্র সংঘাতে হোক।
"অজান্তে খোলা থাকে দরজা
যদি ডাক আসে,
ঘুমের ঘোরে বিছানায়
উঠে পড়ে হাত মোবাইল সেটে।
না সত্যি বা মিছিমিছি
কোনো ডাক নেই,
ভিতরের বাক্স খুলে দেখি
বার্তাশূন্য একরাশ ইচ্ছে "
কবিতার প্রধান সৌন্দর্য তার সারল্যে, তার অকপটতায়। মানুষ কবিতায় কবির মধ্যে মিশে থাকা
নিজেকে খোঁজেন। এই কয়টি লাইনে অনেক পাঠকই নিজেকে পাবেন। এটাই এই সরল স্তবকটির জোড়ালো আঘাত।
"আশা আর আসা ...যাওয়ার মুহূর্তগুলো সংকেতহীন
তোমার অপেক্ষায় প্রহরগুলো বদলে গেছে অন্য বৃত্তে। "
বৃত্ত খুব তাড়াতাড়ি তার কেন্দ্রস্থল বদলে ফেলে। কবি হয়তো নিজের অজান্তেই এই লাইনটি লিখেছেন।
ক্রমাগত মুখোশে ঢেকে ফেলা এই জীবনে বার বার কেন্দ্র বদলাতে বদলাতে , শেষ পর্যন্ত কবি বা সাধারণ মানুষ নিজের কাছে ছোট হয়ে যান। তারপরও কবি কলম ধরে থাকেন, কারণ এই মৃত্যুও তাকেই লিখে যেতে হবে।
"যোগ ..বিয়োগ অসমাপ্ত ফলাফল,
প্রতিপক্ষের লাথির আঘাতে
এ কোর্ট থেকে সে কোর্টে...
অবশেষে, ডাস্টবিনে পড়ে থাকে
বহু কৌশুলী খেলোয়াড় ...
বসে গেছে ঘরের মাঠে ।
প্রতিকিস্তি জয় নিশ্চিত করে
প্রাক্তনরা এখন বিস্মৃত প্রায়। "
জীবনের কথা বলেন কবি। জীবন এক বিস্মৃতির নাম। বিস্মৃত হয়ে যাবেন জেনেই বেশীরভাগ মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন, লড়াই করেন, ঈর্ষা করেন, বদলে ফেলেন নিজেকে। এটাই নিরন্তর ক্ষয়। এই ক্ষয় কাউকে হয়তো কবি করে কাউকে নেতা, কাউকে দৃঢ় গাছের মতো সর্বংসহা...
"দেহ বৃক্ষরূপ
পাতায় ঢাকা শরীর
খসে পড়লে
ব্যথায় ভরে বুক।
দেহ শবে মিশে যায় নিঃশব্দে। "
শবের মতো ঠান্ডাই তো বেঁচে থাকা, হতাশা কবিদের অন্যতম আশ্রয়, হতাশা ছাড়া কি কবিতা হয়?
"কোলাহল নেই, পিছুটান নেই,
সায়াহ্ন সংগীত সমাপনী আয়োজন
অস্তরাগে জাগে অদৃশ্য অসীম "...
উপলব্ধির শেষতম ডেফিনেশন হচ্ছে পিছুটান না অনুভব করা । কবিতা এভাবেই জীবনদর্শনকে প্রতি শব্দে ব্যখ্যা করে। দর্শনের জটিল প্রয়োগবাদ কবিতার অন্যতম শ্লাঘা এবং দার্ঢ্য।
কবির কলমে হলাহল এবং অমৃত একইসঙ্গে পুঞ্জীভূত হোক।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৭
কাব্যগ্রন্থ : দ্বিতীয় সরণি
লেখিকা : দেবাশ্রিতা চৌধুরী
প্রকাশক : নীহারিকা পাবলিশার্স
মূল্য : 130 টাকা
"এই যে তুমি বসে আছো পাশে
ইচ্ছে হলেই ছুঁতে পারি তোমাকে
করতল ঘষলে আগুনও জ্বলে যাবে
তবু মাঝে এক বায়বীয় পর্দা দোলে বারবার
দেওয়াল গড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ সুরকি,"
কবি দেবাশ্রিতার কবিতা খুব সহজ সরল। তিনি তন্ময়তা নিয়ে লিখে গেছেন। তার কবিতা মানে জলের কাছাকাছি বসে থাকা। শান্ত হয়ে। উনি জীবনের যে পর্যায়ে আছেন, সেই পর্যায়টিই তার দীর্ঘ কবিতা। অন্দরমহল, হৃদয়ের এবং বাহ্যিক দুটোই ছুুঁয়ে গেছে তার মননকে এবং সেখান থেকেই নিঃসৃত হয়েছে কবিতাগুলো।
কয়েকটি ভালো লাগা কবিতাংশ রইল পাঠকদের জন্য ।
"এ শহরে মৃতের মিছিলে
ক্যারোলের সুর বাজে।
এ শহর আজ বহন করে
অজ্ঞাত পেরেক রাশি।
এ শহরে মোমবাতি রেসে
মৃতেরা আলোক ধরে। "
"জীবন্ত লাশেরা ফেসবুকে কবিতা
লিখে যাই আরো ...আরো ...আরো
সীমারেখা অতিক্রমণ সিলেবাসে ছিল না "
"ভিজতে চাইনি অনিচ্ছার শ্রাবণে
তবু ভেজা হলো আশরীর
ডুবতে চাইনি অগভীর সাগরে
গভীরতা বাড়ায়নি তার হাত।
তাই নোনাজলে আজীবন খোঁজে
মুক্তো, ডুবুরিমন আজও অকারণে
সোনার খাঁচায় প্রহরীর তত্ত্বাবধানে। "
"চলে গেছে বহুদিন ...তবু
আরো একবার যায় নাকি ফেরা?
চলো ফিরে যাই আমাদের
নিজস্ব গোপনে "
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৯
কাব্যগ্রন্থ : মেঘজ্যোস্নার ছায়াযুদ্ধ
স্বপ্না নাথ
স্রোত প্রকাশনা
"সব মিথ্যাকে আমি
অন্ধকার বলে মানি না
কত মিথ্যা যে আলোর সহযোগী "
"কত সত্য যে অশুভ অন্ধকার
গোলাপের গায়েও রক্ত ঝরায় "
"মিথ্যাকে পৃথিবীর
প্রথম ও আধুনিক শিল্প বলে মনে হয় "
খুব কঠিন করে এসমস্ত কথা বলেছেন লেখিকা স্বপ্না নাথ, তার "মেঘজ্যোৎস্নার ছায়াযুদ্ধ " কাব্যগ্রন্থটিতে ।
এতটাই স্থির সেইসব প্রত্যয় যে মনে হচ্ছিল কোথাও কি কবিতা বাস্তুচ্যুত হবে না, তিরতির করে কাঠামোটি ভাসিয়ে দিয়ে দুহাতে গাল ঢেকে বন্যা দেখবে না,
"মেঘেরা বন্য হলে
নেমে আসে অসমতল রাত
হঠাৎ গার্হস্থ্য পৃথিবী এক অন্ধকার দীঘি
তখন প্রেম বড় প্রাকৃতিক "
আহা এই তো কবিকে পাচ্ছি, অন্ধকার গহ্বরটির মুখে সেই কম আলোকিত দীপ,
"রোদের পতনের শেষে
যখন বৃষ্টি আসে
বিশাল এক নির্জন দ্বীপে
রূপালি গির্জার মতো ফুটে ওঠে পৃথিবী "
অসাবধানতাবশত যেন এই মিলন, কবির সঙ্গে পৃথিবীময় একাকী গির্জার, আরেকটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় আস্তিকভাব কবিকে প্রবলভাবে ছুঁয়ে আছে, বইটির বহু কবিতাই ভালোবাসার সাঁকো একটুখানি স্পর্শ করে, নিয়ম নীতি ও ঈশ্বরের মধ্যে সরবে লীন হয়েছে।
"প্রতীক্ষা শেষে রাত এলে দেখি
আকাশটাও সাহারার মরুভূমি
মাঝে রূপবান চাঁদের আলো
যেন এক বাটি শিশিরের জল "
ভীষণ ভালো লাগলো এই স্তবকটি। তাই তাকে নিয়ে কিছু বলব না, কবিতার ভালো স্তবকের কাছে চুপ করে থাকতে হয়, কথা বলাকে বাচালতা মনে হয়।
তিনি সরল হয়েছেন,
"এখন একটা মানুষের মুখ দেখেই
গবেষকের মতো কাটিয়ে দিতে পারি বর্তমান।
আসলে কিছু কিছু লজ্জাকে
অতিক্রম করলে মানুষের সঙ্গে
মানুষের দূরত্ব বেশ কমে যায় "
"সমস্ত আবেগরাশি
আপাদমস্তক আমাকে অকবি
থেকে কবিতাজীবী করে তোলে
উভচর আমি হঠাৎই শিখে ফেলি
কবিদের বীক্ষণীয় শিষ্টাচার "
"বস্ত্রহীনকে দাও এক চিলতে আশ্রয়
দরকার হলে নানা পরিধেয়
এবার তাকে বলো ...গো অ্যাজ ইউ লাইক "
"শীতবাড়িতে গ্রীষ্ম ঢুকুক ...এও তো চাইনি
সহ্য করে চলি শীতের সংযম "
"যুবকের বিধুর প্রত্যয়
নুড়ি পাথরেই অবিরাম
সাজায় প্রথমার ছায়ানট "
"বুক পকেটে ভরে নিয়ে এসো
সব অর্জিত সমুদ্রসুখ
ছেঁকে নেব সব নোনাপলি
অসম্ভব জেনেও মন দেব না শিক্ষিত বিভাজনে "
"হাততালি শিখিনি এখনো
ব্যঞ্জনায় আয়াসলভ্য ভাব "
এইসব পংক্তিমালায় কবিতার সুখ, অসুখ পাঠক হয়ে পাঠ করলাম, খুব সামান্যই বললাম, কবি স্বপ্না নাথকে অনেক শুভেচ্ছা রইল আগামীর জন্য।
তার লেখা একটি কবিতা স্তবক দিয়ে শেষ করছি
"অনেক সময় কবি সম্মেলন
যেন দাতব্য চিকিৎসালয়
কবিতার পান্ডুলিপি
পুরনো প্রেসক্রিপশন
.
.
অপরিহার্যতা নেই,
নামের তালিকার পাশে তবু
লেখা আছে সর্বশেষ আহ্ববান "
পাঠ প্রতিক্রিয়া ২৮
কাব্যগ্রন্থ ..."হাসমতি ত্রিপুরা "
লেখক ...হারাধন বৈরাগী
স্রোত প্রকাশনা
প্রচ্ছদ
মূল্য
...............
লেখক হারাধন বৈরাগীর বই, "হাসমতি ত্রিপুরা "
প্রকাশিত হয়েছে স্রোত প্রকাশনা থেকে, দুইহাজার সতেরো সালে। প্রচ্ছদ শিল্পী বাপ্পা চক্রবর্তী।" হাসপতি ত্রিপুরা ",একটি কবিতার বই। কবিতার মায়াময় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে কবি লিখেছেন নিজস্ব কিছু দিনযাপন। হাসপতি কল্পিত একজন নারী অথবা কবির মনে মিশে থাকা উজ্জ্বল বাস্তবতা, যাকে ঘিরে শব্দ, বাক্যবন্ধ ক্রমাগত সৃষ্টি করে গেছে বনের একলা বিকেল, জ্যোৎস্না পাহাড়, অন্ধকার বনজ রাত। কবিতাগুলো পড়লে ত্রিপুরার উপজাতি জনজাতির প্রেম, ক্ষুধা, সংঘাত আর শ্রমের একটি কথকতা বেজে ওঠে, মনে হয় কেউ বলছেন, কেউ পড়ছেন, কেউ শুনছেন, কেউ এই রোদমেঘভরা জীবনে যাপন করেছেন আর আমি পাঠক ডুবছি কোন এক নীল পাহাড়ের লুকনো গিরিখাতে। সমস্ত কবিতাতেই অজান্তে রচিত হয়েছে একটি মৌলিক দীর্ঘসুর, যা লেখককে বিশেষ ভাবে চিনিয়ে দেয় যে তিনি ত্রিপুরার কবিতা জগতে অন্য একজন, যার দায়বদ্ধতা আছে এই মাটির কাছে।
কবি বলেন,
"জঙ্গলের কোন দুয়ার নেই
চোখ নেই বসতবাড়ির মতো "
গন্ডাছড়ার ধলাইজেলার জগবন্ধু পাড়া, তার এই কবিতার বইয়ের উৎসভূমি।
তিনি লিখেন,
"জঙ্গলের মাঝে বাস
ঝুঁকে আছি আজন্ম জঙ্গলেরই উপর।
চুয়াকের ইশারায় দেই ডাক ...
এর বেশি আমি সামাজিক নই "
কখনো তিনি, জিজ্ঞাসা করেন,
"তোমাদের ধনসম্পদ কতো?
এইতো, দুএকটি ওয়াক, ডজনখানেক তক,
জনাকয় চিকলা চিকলি
ধান তিল মামরা চিমরা ..."
আমাদেরো এর বেশী কিছু নাই, এভাবেই বাঁচি, রহস্যের মৌতাত মেখে মেখে।
ওয়াক...শুকোর
তক...মোরগ
চিকলা চিকলি...যুবক যুবতী
মামরা চিমরা...শসা জাতীয় ফল
স্রোত ওয়েবসাইটের জন্য স্রোত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বই এর পরিচিতি
রবীন্দ্র -সূক্ত
লেখক মিলনকান্তি দত্ত
প্রথম প্রকাশ :জানুয়ারি 2011
ISBN :978-81-907097-7-4
মূল্য ...একশ টাকা
স্রোত প্রকাশনা
ভীষণ মূল্যবান একটি বই। কবি মিলনকান্তি দত্ত ওনার প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের অমূল্য স্বাক্ষর রেখেছেন এই রবি অধ্যয়নে। রবি পাঠ শেষ হবার নয়, এ এক মহাসাগর, আর এই মহাসাগর থেকে মুক্তো আহরণ করেছেন সন্ত কবি মিলনকান্তি দত্ত "রবীন্দ্র - সূক্ত "বইটিতে। কবি মিলনকান্তি, সংকলকের কথায় বলেছেন, এই বই শুধু রবীন্দ্রনাথের সু-উক্তির সমাহার নয়, একে রবীন্দ্রোপষিনদ বললে খুব একটা বাহুল্য হবে না। কারণ উপনিষদ শব্দের অর্থ রহস্যবিদ্যা, আর রবীন্দ্র - বচনে রয়েছে অতলান্ত ভাব রহস্য, রয়েছে শান্তি ও গভীরতা, ব্যাপ্তি ও ধ্রুবত্ব।
রবি গভীরে যারা স্নান করতে চান তাদের জন্য বইটি সংগ্রহে রাখার একটি অন্যতম উপাদান।
"কবির কাছে আছে " নকুল রায়
" কবির কাছে আছে " কবি নকুল রায়ের বই। স্রোত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত। ফেব্রুয়ারি, দুইহাজার ষোল। এই বইটি বহু মূল্যবান আলোচনার সমাহার। কবি এখানে নিজেকে উন্মুক্ত করেছেন নানা ভাবে। অসামান্য কিছু স্মৃতিচারণ, গল্পের মতো কিন্তু গল্প নয় এমন কিছু লেখা, সময়ের দলিল হয়ে থাকবে। কবি নকুল রায় কিছু কবিতা এই বইটিতে একত্রিত করেছেন , যা স্বদেশ এবং বিদেশের যেকোনো অপশাসিত অঞ্চলের কবিতার ভাষেকে প্রতিনিধিত্ব করে।
বইটির মূল্য দেড়শত টাকা
ISBN :978-93-80904-73-3
ত্রিপুরার প্রথম কবিতাপত্র
'জোনাকি সমগ্র '
সংকলন ও সম্পাদনা গোবিন্দ ধর
প্রথম প্রকাশ :জানুয়ারি 2011
ISBN : 13-978-81-907097-4-3
মূল্য : তিনশ টাকা
তেরশো সত্তর বাংলা (1960 খ্রীষ্টাব্দ) সনের পঁচিশে বৈশাখ তারিখে ত্রিপুরার মহকুমা কৈলাসহর থেকে 'জোনাকি 'নামে কবিতা - সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছিল। এর সম্পাদক ছিলেন পীযূষ রাউত। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী বিমল দেব। পত্রিকাটি ছিল হাতে লেখা। অবশেষে 1963 এর মে মাসে ত্রিপুরার প্রথম
কবিতাপত্র 'জোনাকির 'মুদ্রিত প্রকাশ ঘটল। প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকের প্রতিবেদনের পরিবর্তে কৈলাসহর রামকৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সচ্চিদানন্দ ধর সম্পাদকীয় লিখে দিয়েছিলেন, যেখান থেকে জানা যায় এভাবে "শনিবারের বিকালে কয়েকজন যুবক কবিতার আলোচনা করতে একত্র মিলিত হতো, নিজেদের হাতে লিখা পত্রিকা 'জোনাকি 'নিয়ে "।
মোটামুটি ভাবে ষোল বছর ধরে জোনাকি প্রকাশিত হয়, সময়ের ধারাবাহিক ব্যবধান বজায় না রেখে এবং আরেকটি পঁচিশে বৈশাখে এসে জোনাকির যাত্রা শেষ হয়। জোনাকির প্রতিটি সংখ্যাকে একত্রিত করে এই সংকলন প্রকাশ করেছে 'স্রোত প্রকাশনা। সেইসময় ত্রিপুরা, আসাম পশ্চিমবঙ্গের বহু লেখক লেখিকার
সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে এই সংকলনটি ত্রিপুরার সাহিত্য জগতের একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে।
তোমার কথা আমার কথা
"তোমার কথা আমার কথা " জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তিথি দেববর্মনের লেখা। এই বইটিতে একই সঙ্গে লেখিকার রবীন্দ্র বিষয়ক, স্মৃতিচারণামূলক ও সমাজ সমস্যামূলক তিন শ্রেণীর রচনা পরিবেশিত হয়েছে। লেখিকার সত্ত্বায় রবিঠাকুর মিশে আছেন, তার গানের সাধনা, উপলব্ধি এই প্রবন্ধগুলোকে বহতা নদীর মতো নিয়ে গেছে আশ্চর্য সুখপাঠ্যতায়।
প্রকাশকাল :ফেব্রুয়ারি 2015,
ISBN :978-93-80904-49-8
"বাউল মলিকিউলস "
কবি শুভ্রশংকর দাশ
প্রকাশকাল :জানুয়ারি 2015
ISBN : 978-93-80904-43-6
স্রোত প্রকাশনা
কবি শুভ্রশংকর দাশ সাম্প্রতিক কবিতার জগতে একটি অতিপরিচিত ও প্রশংসিত নাম। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার "বিনয় পদক "।মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা রয়েছে বইটিতে।প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই একটি তীক্ষ্ণতা অথবা শ্লেষ বিদ্ধ করে যায় আমাদের। এই বইয়ের একটি কবিতা "মিরর - ম্যানিয়া "
কবিতাটির শেষ স্তবকে
"সে বলে - ধুর্ আমি পার্টি করি না।
পার্টিতে দেখি
ভরা গ্লাসে আঙুল চুবিয়ে
চুল ঠিক করে নেতাজী "
সুন্দর কাজ করছেন ❗ কিন্তু ১) বইগুলোর প্রচ্ছদ সঙ্গে থাকলে ভালো ছিল৷ ২) আলাদা আলাদা পোষ্ট করে প্রতিটি পোস্টে অন্যগুলোর হাইপার লিঙ্ক দিলে ভালো হত৷ হাইপার লিংক ব্যাপারটা আমি শেখাতে পারি৷
উত্তরমুছুনসুন্দর কাজ করছেন ❗ কিন্তু ১) বইগুলোর প্রচ্ছদ সঙ্গে থাকলে ভালো ছিল৷ ২) আলাদা আলাদা পোষ্ট করে প্রতিটি পোস্টে অন্যগুলোর হাইপার লিঙ্ক দিলে ভালো হত৷ হাইপার লিংক ব্যাপারটা আমি শেখাতে পারি৷
উত্তরমুছুন