ত্রিপুরার সাহিত্য : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার

৫:৫২ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

নীহারিকা বার্ষিক বক্তৃতা, ২০১৯


ত্রিপুরা সাহিত্য : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার 


চিরশ্রী দেবনাথ


তন্বী নদী গুঞ্জরিত, সবুজ অরণ্য মর্মরিত, নীল পাহাড়ে সমাধিস্থ, ঐতিহাসিক উপাদানে ঐশ্বর্যমন্ডিত প্রিয় ত্রিপুরার সন্তানবাৎসল্যে লালিত বিবিধ ঐতিহ্যের  সমাজচেতনাশ্রয়ী বৈভব, স্বাধীন চিন্তাধারায় বিশ্বাসী মানুষের কয়েক শত বছরের ধারাবাহিক লড়াই,  সংগ্রাম ও প্রবহমান সৃজনশৈলী  ত্রিপুরার ভাষা সাহিত্যকে  সমৃদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই ভাষা সাহিত্য ঠিক কতটাই সুপ্রাচীন, তা অবশ্যই এখনো অনুমান নির্ভর।

যেতে হবে, খ্রীস্টীয় দশম শতকে, ত্রিপুরার দক্ষিণাংশ সমতট বা চাকলা রোশনাবাদের অধীনে হরিকেল মন্ডল নামে একটি সামন্ত রাজ্যের অধীনে ছিল, যার রাজধানী ছিল পিলাক নগরী। পিলাক সভ্যতার আবিষ্কারের ফলে সেখানে যেসমস্ত ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে, তাতে পাওয়া গেছে পীরক নামাঙ্কিত মুদ্রা। এই মুদ্রায় বঙ্গলিপির ব্যবহারে মনে হয় ষষ্ঠ সপ্তশতক থেকেই পিলাকে বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল। ত্রিপুরার বক্সনগরে যে লিপিযুক্ত পোড়ামাটির সিলিং বা গোলাকার ফলক পাওয়া গেছে, তাতে বাংলা, সংস্কৃত ও পালিভাষার মিশ্রনে একটি বাক্য আছে। কিন্তু ত্রিপুরার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালায় পিলাক বা বক্সনগর সম্পর্কে কোন আলোচনা নেই। তাতে মনে হয়, মানিক্য রাজা এবং রাজমালার রচয়িতারা এই দুটো স্থান সম্পর্কে জানতেন না। সেজন্য একটি দৃঢ় ধারণার জন্ম হয়, ত্রিপুরার মাণিক্য পদবীধারী ত্রিপুরী বংশীয় রাজন্যবর্গের রাজত্বকালের আগেই ত্রিপুরা বৃহত্তর বঙ্গের ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিল। ত্রিপুরায় খ্রীষ্টীয় সপ্তম অষ্টম শতকেই বাংলা ও উপজাতীয় ভাষাচর্চা হতো, তখন ককবরক শব্দটির উদ্ভব ঘটেনি, সে শব্দের জন্ম বহু পরে।

মহারাজা প্রথম রত্নমাণিক্য বাংলা ভাষাকে রাজভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন।  তাঁর রাজত্বকাল, ১৪৬৪ থেকে ১৪৬৭ :তখনই বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যসমূহের সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে ত্রিপুরাবাসীর সাহিত্য সংস্কৃতির আদানপ্রদান শুরু হয়। ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কিরাত জনকৃতি গ্রন্থেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়। 

ত্রিপুরার বহু রাজা, পার্শ্ববর্তী মণিপুর রাজ্যের রাজকন্যাদের  সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং এরফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভাবের অন্দরমহলে ঢুকে পরে ললিতময়তার অন্যতম  সম্রাগ্রী মণিপুরী ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপরূপ নির্ঝর। 

তাই ত্রিপুরার ভাষা সাহিত্য মূলত বাংলা, ককবরক এবং মণিপুরী এই ত্রিধারার নন্দিত সঙ্গম। পাশাপাশি রয়েছে ত্রিপুরার বাংলা ভাষার ও জনজাতির নানা সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষায় বহু অলিখিত কাহিনি, কিংবদন্তি, লোকগান, ছড়া, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদি।

গ্রাম ত্রিপুরার অরণ্য, পাহাড়, আর জনপদ মুখরিত হয়েছে বাংলা ও জনজাতির লোকপ্রিয় সাহিত্য ও সংগীতে, আর রাজপরিবারের অভিজাত অন্দরমহল থেকে প্রবাহিত হয়েছে সমৃদ্ধ সাহিত্যচর্চা। এই দুই দ্বিমুখী সাহিত্যসত্তাই ত্রিপুরার প্রকৃত সাহিত্য প্রতিকৃতি এবং আত্মা। 

সেই বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে উত্তরপর্বের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকারী প্রজন্ম।

এ হলো গর্বিত উত্তরাধিকার। 

“যেকালে বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের প্রেমরসাত্মক পদাবলীর সুমধুর ঝংকারে বঙ্গদেশ মুখরিত হইতেছিল, সেইসময় ত্রিপুরার নিভৃত গিরিকুঞ্জে, চন্তাই দুর্লভেন্দ্র এবং পণ্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর রাজমালা রচনার কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। কৃত্তিবাসের রামায়ণও ইহার সমসাময়িক। “

(রাজমালা, প্রথম লহর, পৃঃ ৮২ )

এবং তাই  সর্বাপেক্ষা প্রচলিত মত, 

ত্রিপুরার সবচাইতে প্রাচীন গ্রন্থ, রাজমালা। রাজমালা গ্রন্থের রচনাকাল সম্বন্ধে মতবিরোধ রয়েছে।  ধারণা এই যে, রাজমালা পঞ্চদশ শতকে রচিত অর্থাৎ মহারাজা ধর্মমানিক্যের আমলে, ( ১৪৫৮ - ১৪৯০ )। রাজমালা যে পঞ্চদশ শতকের লেখা , তা রেভারেন্ড লঙ্ও তাঁর লিখিত রাজমালায় স্বীকার করেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর মত,

“we may consider this then as the most ancient work in Bengali that has come down to us, as the Chaitanya charitamrita was not written before 1557 and kritibas subsequently translated the Ramayana “.


রাজমালার বিষয়বস্তু সর্বজনবিদিত, কাব্যছন্দে রচিত ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত, কাহিনী এবং কিংবদন্তি।

পরবর্তীতে রাজমালা বাংলাভাষায় লিখিত হয়। 

বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তির দ্বারা  রাজমালা লিখিত হয়েছে। যাঁরা রাজমালা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে দুর্গামণি উজির, কৈলাস চন্দ্র সিংহ ও কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্তর নাম সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য। দুর্গামণি উজির, কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্ত ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রাজমালা পদ্যে ও পয়ার ছন্দে লিখিত। আর কৈলাসচন্দ্র সিংহ একটু আলাদা, তাঁর রাজমালা গদ্যাকারে লিখিত। কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্তের রাজমালা বর্তমানে বহুল প্রচলিত। এটি চারটি লহরে লিখিত। রাজমালার ঐতিহাসিক ঘটনার কিছু কিছু ত্রুটি থাকলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। মনে হয় প্রাচীন সংস্কৃত রাজমালা বর্তমান বাংলা রাজমালার মূল ভিত্তি, তাছাড়া লোকমুখে প্রচলিত জনশ্রুতিও রাজমালা রচনে কার্যকরী হয়েছে।

মহারাজা ধন্যমানিক্যের রাজত্বকালে (১৪৯০-১৫২০), তে উৎকল খন্ড, পাঁচালী যাত্রা ও রত্নাকরনিধি মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনূদিত হয়। তাঁর রাজত্বকালেই লেখা হয়, “বিদ্যাপতির পদাবলী “।মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৬৬০-১৬৭৬ ), বাংলায় অনুবাদ করা হয় বৃহন্নারদীয় পুরাণ। কৃষ্ণমানিক্যের আমলে নোয়াখালির বাসিন্দা শেখ মনোহর আলির লেখা গাজিনামা প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে রামগঙ্গা মাণিক্যের রাজত্বকালে। তাঁর রাজত্বকালেই “এজিদের পরী লুঠ “,নন্দকিশোর শর্মার “বরদামঙ্গল “সহ একাধিক গ্রন্থ। শেখ মহিউদ্দীন, কবি চম্পকরায়ের জীবণী অবলম্বনে “চম্পক বিজয় “রচনা করেন দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের রাজত্বকালে। দ্বিতীয় রাজধর মাণিক্যের রাজত্বকা“ কৃষ্ণমালা “রচনা করেন রামগঙ্গা বিশারদ। এই মহারাজার রাজত্বকালেই রাজকবি নরহরি চক্রবর্তী “গীত চন্দ্রোদয় “রচনা করেন। দুর্গা মাণিক্যের রাজত্বকালে ১৮১২ সালে যদুবন্ধু দাস রচনা করেন “শ্রী রাধিকার কলঙ্কভঞ্জন”। কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে “গীতকল্পতরু “,ভবানী দাশের ‘নৌকাখন্ড ‘(১৮৩২),গুণরাজ খানের ‘গোবিন্দ বিজয় ‘(১৮৩৬),দ্বিজ রতিদেবের লেখা ‘মৃগলুব্ধ ‘(১৮৫৯), প্রভৃতি গ্রন্থ লেখা হয়। ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের রাজত্বকালে শেখ সাদির লেখা “গদামল্লিক ‘( ১৮৪৯), নিমাই চান্দের ‘বারমাস ‘( ১৮৫৯) ও “সুধন্যার স্তব “ইত্যাদি। এছাড়া একটি বিশেষ পুঁথি, ১৪৭ টি বল্কলে লেখা হয়, অহম রাজা স্বর্গদেব রুদ্রসিংহের প্রতিনিধি রত্নকন্দলী শর্মা ও অর্জুন দাশ বৈরাগীর  অহমিয়া ভাষায়, “ত্রিপুরা দেশের কথা লেখ ‘,১৭২৪ সালে। 



চলে আসছি রবীন্দ্রচ্ছায়াচ্ছন্ন ত্রিপুরার সাহিত্যচর্চার বিপুল প্রসারিত ক্ষেত্রে। 

রবীন্দ্রনাথের “ভগ্নহৃদয় “কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সঙ্গে কবির পরিচয় হয় এবং এই পার্বতী রাজ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে এক দারুণ বন্ধন যা অন্তঃসলিলা হয়ে ত্রিপুরার সাহিত্য জগতে চির প্রবহমান। যে কয়েকটি তথ্য সর্বজন সুবিদিত তবুও উল্লেখ করতে হয়, তা হলো, ত্রিপুরার রাজা অমরমাণিক্যকে  নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেন মুকুট নামে গল্প, পরে তা নাটক আকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে, এবং মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যকে নিয়ে লিখেন ‘রাজর্ষি ‘উপন্যাস। যা বিসর্জন নাটক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ত্রিপুরায় অবস্থান কালে তিনি পাঁচটি গান লিখেন, যার মধ্যে আছে, “এসো আমার ঘরে “,যেন এই শ্যামল রাজ্যটিতে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন অতিথিদের আসার জন্য, দেখে যাক তারা এই নীলাভ দীর্ঘ পর্বতপ্রান্তদেশ, কিরাতভূমি। রবীন্দ্রনাথের পৌরোহিত্যে “ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনী “নামে সাহিত্য পরিষদের উদ্বোধন হয়। এ বিষয়ে তিনি অকুন্ঠ চিত্তে উল্লেখ করেছেন, “ত্রিপুরার রাজ পরিবারে বহুকাল থেকে বাংলা ভাষার সম্মান চলে আসছে। বস্তুত সকল দেশের ইতিহাসে স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের ভাষা কেবল মাতৃভাষা নয়, তা রাজভাষা। ...এই পরিবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ আমি দেখেছি। “

যেহেতু লিটল ম্যাগাজিন বা সাহিত্য সাময়িকী কে আধুনিক সাহিত্যের আঁতুরঘর ধরা হয়, এবং রবীন্দ্রনাথেরও এর প্রতি ছিল প্রবল পক্ষপাতিত্ব, আর এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায়, ত্রিপুরার সাহিত্যের ঐতিহ্য নিয়ে বলতে গেলে, সাহিত্য সাময়িকীর সূত্রপাতকে অবশ্যই যথাযোগ্য সম্মান দিতে হয়, এজন্য একদম প্রথম দিকের কয়েকটি সাহিত্যপত্রের নাম উল্লেখ করছি।  পরবর্তীতে এবং এখন ত্রিপুরার সাহিত্যজগতে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস, ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, এ ব্যাপারে তাই এই আলোচনায়  দীর্ঘ তথ্যের অবতারণা করছি না। লিটল ম্যাগাজিন  ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুতের মতো কেউ ঝলক দিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে, কোনটা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। 

অবিভক্ত ত্রিপুরায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা সাহিত্য সাময়িকীটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসময়কে ধারণ করেছে। ওখানে লিখেছেন জীবনানন্দ, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকরা, যখন তারা খ্যাতনামা হয়ে ওঠেননি। 

রাধাকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে, “বঙ্গভাষা মাসিক পত্রিকা “,”তরুণ “ পাক্ষিক, মহারাজকুমার মহেন্দ্র দেবর্মণ সম্পাদিত “ধূমকেতু “সাপ্তাহিক, ১৯০৫ সালে চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ সম্পাদিত, “অরুণ “।

এরমধ্যে কিশোর সাহিত্য সমাজ প্রকাশিত, “রবি “র কথা উল্লেখ করতে হয়। রবির প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ দেববর্মণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। রবিতে মূলত কবিতা ও প্রবন্ধের প্রাধান্য ছিল। মাত্র ছবছর আয়ুষ্কাল হওয়া সত্বেও ‘রবি ‘র কিরণরেখা ত্রিপুরার সাহিত্য ও সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

তাছাড়াও প্রাক স্বাধীনতা পর্বের আরো কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী, অজিত বন্ধু দেববর্মা সম্পাদিত পূবালি (১৯৩৪ ),’ক্ষণপ্রভা ‘(১৯৩৫ ),কানু সেন ও হীরেন সেন সম্পাদিত “আলো (১৯৩৭) “রবীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত “যাত্রী “(১৯৩৮), হীরেন্দ্রকিশোর দেববর্মার “সারথি “ইত্যাদি আরো বহু। ১৯৫৪ সালে জনশিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুধণ্বা দেববর্মা প্রকাশ করেন প্রথম ককবরক ম্যাগাজিন “কতাল কথমা “,স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৬০ সালে,পীযূষ রাউতের সম্পাদনায় কৈলাসহর থেকে প্রকাশিত হয় ‘জোনাকি “ ‘সাহিত্যপত্র। প্রায় পনেরবছর চালু ছিল জোনাকি। “গান্ধার “সম্পাদক কল্যান চক্রবর্তী ও অজয় রায়। এবং “নান্দীমুখ “,যার সম্পাদনা করেছেন স্বপন সেনগুপ্ত। ষাটের দশকে এই দুটি পত্রিকা ত্রিপুরার লেখালেখির জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। 



সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি সবকিছুতেই ত্রিপুরায় নবযুগ প্রবর্তনের সূচনাপর্ব এবং সন্ধিক্ষণ  হিসেবে ধরা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক। এই নবযুগের প্রবর্তক সুকবি, বৈষ্ণব সাহিত্যে সুপণ্ডিত, সংগীতজ্ঞ, গীতিকার, বাংলা এবং  উর্দু ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন, সুশাসক মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য।

এই পর্বে এসে আমি ত্রিপুরার সাহিত্য ইতিহাসের এই নব উন্মেষ যুগের কয়েকজন মাত্র কুশীলবের কথা উল্লেখ করছি। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী  এই অস্থির সময়েও যারা সাহিত্যের নন্দনকাননে বিচরণ করে সাধারণ পাঠকদের অনাবিল আনন্দ দান করেছেন, মানুষের ইতিহাসে তাঁরা দেবদূত। যে সমস্ত অজস্র সম্মানিত সৃষ্টির কথা, সৃজনীকারদের কথা এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলো না, তাঁদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। 


কাব্য, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের একটি রূপরেখা 


কাব্য

প্রথমেই কাব্যসুন্দরীর রাতুল চরণ স্পর্শ করে যাই। 

ত্রিপুরার রাজ আমলের আখ্যান কাব্যগুলো এক একটি ঐতিহাসিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে সময়কার ত্রিপুরার জীবন, যুদ্ধ, সংগ্রাম, ধর্মীয় আচার আচরণ, রাজ্যশাসন, রাজভক্তি ইত্যাদি নিয়ে চিরাচরিত কাব্যছন্দে, সম্পূর্ণ ভাবে স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত হয়েছে। ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটতে আরম্ভ করে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য এবং রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের পর থেকেই। বীরচন্দ্রমাণিক্য ছয়টি কাব্য রচনা করেন, ‘হোরি ‘,’ঝুলন ‘,’প্রেমমরীচিকা ‘,’অকাল কুসুম ‘,’সোহাগ ‘,’উচ্ছাস ‘।এসব কাব্যগুলো মূলত গানের সংগ্রহ। বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর বাংলার শেষ বৈষ্ণব পদকর্তা নামে অভিহিত হয়েছেন। ত্রিপুরায় আখ্যান ও পাঁচালি রীতির কাব্যের ধারা ভেঙে দিলেন কবি বীরচন্দ্র।

“মন্দ পওন  চুম্বত ফুল

     গন্ধ চহুদিশি ডারিয়া,

গুন গুন করু  মত্ত মধুপ 

পিউ পিউ বোলে পাপিয়া,

আমার গৌরকিশোর করু নবভাবে

   কতহুঁ নবীন ভঙ্গিয়া,

ঝুলতহি পহুঁ কতহুঁ ভাতি

সঙ্গে কতহুঁ সঙ্গিয়া “

বীরচন্দ্র মূলত ব্রজবুলি  মৈথিলি, ও বাংলাতেই তার পদগুলো রচনা করেছিলেন।

বীরচন্দ্র কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী।জন্ম আঠারশো চৌশট্টিতে।  তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, প্রথম কাব্য 'কণিকা ', দ্বিতীয় কাব্য 'শোকগাথা ' তৃতীয় কাব্য 'প্রীতি '।প্রকৃতির সঙ্গে আপন অনুভবের সংমিশ্রণের কাব্যময় প্রকাশ ঘটে তার লেখায়।  মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এই নারী ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাহিত্যচর্চা, শিল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে  মানসিকতা সমৃদ্ধ করেছেন , কবিতায় নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিক জগতকে খুঁজেছেন, সুললিত ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। আধুনিক আলোচকদের বেশীরভাগেরই অভিমত, রাজগী ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী। সমসাময়িক কবি, সভাকবি মদনমোহনমিত্রের কন্যা কুমুদিনী বসু, ছিয়াশিটি কবিতা নিয়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ “আভা” ঢাকা গেজেট ও সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিল। রাধাকিশোর তনয় নরেন্দ্রকিশোর দেববর্মণের ভাবসমৃদ্ধ কবিতা এবং সঙ্গীতও সুখপাঠ্য। অনঙ্গমোহিনীর কবিতায় কবিতা আস্তে আস্তে বাস্তবের জগতে পা বাড়িয়েছিল, চলে আসে চল্লিশের দশক, রাজ পরিবার থেকে সতন্ত্র কবিতাধারার সূত্রপাত। স্বাধীনতা পূর্বোত্তর ভারত, অস্থির সময় ইত্যাদি মিলেমিশে অনঙ্গমোহিনীর পরবর্তী কালে অনেকদিন ত্রিপুরার কাব্যজগতে তেমন কেউ আসেনি।

বা যারা লিখেছেন বেশীরভাগই গীতিকবিতার অনুসারী, ব্যক্তিগত বিলাপ কিংবা অলস মেদুর জীবনের হাতছানি। কিন্তু সেইসময় বাংলা কবিতার রূপ বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। অথচ ত্রিপুরা আধুনিক কবিতার সুর থেকে তখন পর্যন্ত ছিল  বিচ্ছিন্ন, তাই আধুনিক কবিতাচর্চার ইতিহাস ত্রিপুরায় খুব বেশী প্রাচীন নয়। বৃহত্তর বঙ্গসমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এইসময়ের ত্রিপুরার সাহিত্যে সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন আনে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বাঙালিদের ঢল। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপও ততটা প্রভাব ফেলেনি এ রাজ্যের অরণ্যলালিত নিস্তরঙ্গ অলস জীবনপ্রবাহকে। তবুও এই সময়ের কিছু দুর্বল কারিগর যা আধুনিক কবিতার বীজ ধারণ করতে শুরু করেছিলেন তারা হলেন অজিতবন্ধু দেববর্মণ, নুরুল হুদা, সমাচার চক্রবর্তী, বিধূভূষণ ভট্টাচার্য, মণিময় দেববর্মণ, অশ্বিনী আঢ্য, আব্দুল মতিন প্রমুখ। ষাটের দশক, রবীন্দ্রভাব, বৈষ্ণবকাব্যের ললিতময় বিভঙ্গ পেরিয়ে যে যুগসন্ধির কবিরা পদার্পন করলেন তাদের প্রচেষ্টার সফল রূপায়ন দেখা যায়, “প্রান্তিক “( ১৯৬২) ত্রিপুরার প্রথম কবিতা সংকলনে । রণেন্দ্রনাথ দেব, বিজনকৃষ্ণ  চৌধুরী, সলিল কৃষ্ণ  দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, প্রদীপ চৌধুরী, কিরণশঙ্কর রায়, অশোক দাশগুপ্ত, প্রবীর দাস প্রমুখ। ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় সলিকৃষ্ণ  দেববর্মণ, জোড়ালো সতন্ত্র স্বর। কবিতা তার কাছে সচেতন নির্মান নয়, তিনি কবিতাকে বলেছেন, “উদ্বুদ্ধ অবস্থার শব্দভাষ্য। ১৯৭৩ সালে, কবি স্বপন সেনগুপ্তের সম্পাদনায় বের হয়, গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্য সংকলন, “দ্বাদশ অশ্বারোহী “। 

ষাটের দশক থেকেই ত্রিপুরার বাংলা কবিতার নিজস্ব রূপটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এই সময়ে যারা বিশিষ্ট ভাবে নিজেদের চেনালেন, খুব অল্প কয়েকজনের নাম বলছি, কল্যানব্রত চক্রবর্তী, পীযূষ রাউত, শঙ্খপল্লব আদিত্য, স্বপন সেনগুপ্ত, নকুল রায়, দিব্যেন্দু নাগ,অসীম দত্ত রায়,  সমরজিৎ সিংহ,   প্রমুখরা।  মহিলাদের মধ্যে অপরাজিতা রায়, করবী দেববর্মণ, সুনীতি দেবনাথ, শক্তি দত্ত রায়।    কারো কারো কবিতা এইসময়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কখনো কখনো সে ব্যঞ্জনাহীন রাজনৈতিক বিবৃতি কিংবা প্রচার, আবার ঘৃণা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, প্রতিরোধ, স্থানিকতা  সমস্ত আবেগই তুমুল ভাবে চলে এলো ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় । ১৯৮০ র উগ্রপন্থী বিধ্ধস্ত ত্রিপুরা, দাঙ্গা, নকশাল ভাবধারা, প্রাপ্ত স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের হা ভাতে চেহারা, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে কবিতা চলতে লাগলো। এই সময়ের গ্রুপ সেঞ্চুরী কাব্য আন্দোলন,  হাংরি জেনারেশনের প্রভাব, ত্রিপুরার কবিতাকে বিভিন্ন রূপ ও সত্তা দেয়। সত্তর এবং আশির দশককে যারা কবিতায় ধারণ করেছেন তাদের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য কবি রা, হলেন, সেলিম  মুস্তাফা, অমিতাভ কর, যিনি লিখে আসছেন দীর্ঘ আশি দশক থেকে, তবে বই বের হতে দেরী হয়েছে, রয়েছেন,   রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, দিলীপ দাস,  কিশোররঞ্জন দে, সন্তোষ রায়, লক্ষণ বণিক এবং  আরো অনেক।

ভারতীয় পুরাণ, বেদ, দর্শনতত্ত্ব , চতুর শব্দ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার ইত্যাদির ঘনঘোর নিয়ে কবি মিলনকান্তি দত্ত, সমাজ সময়ের বিশ্লেষণ, পুঁজিবাদ, নিরাবেগ শৈল্পিক সুষমা, তীব্র শ্লেষ অথচ সুগভীর অনুচ্চ স্বর নিয়ে কবি পল্লব ভট্টাচার্য।  কবি মণিকা বরুয়া, পাঞ্চালী দেববর্মণ, মাধব বণিক, রসরাজ নাথ, সুজিত দেব, রত্নময় দে, প্রত্যুষ দেব, বিশ্বজিৎ দেব, হিমাদ্রী দেব,  সত্যজিৎ দত্ত, অলক দাশগুপ্ত প্রমুখ,তাঁদের লেখা অসংখ্য কাব্য গ্রন্থ এবং সংকলন আমাদের সম্পদ। 

নব্বইয়ের দশকে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা বিষয়ের বিভিন্নতায়, পরিবেশনের সৌকুমার্য ও তীক্ষ্ণতায় ছুঁয়ে গেছে মানব জীবনদলিলের সমস্ত সীমা এবং অন্তহীন পরিসীমার মেধাবী দিগন্ত। এই দশকের উজ্জ্বল নাম  অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, প্রদীপ মজুমদার, কাকলী গঙ্গোপাধ্যায়,   স্বাতী ইন্দু,  বিধাত্রী দাম, সুতপা রায়,  অশীন বর্মণ, জাফর সাদেক,আকবর আহমেদ  প্রমুখ।


ত্রিপুরার কাব্যের ঐতিহ্য, বক্তৃতার বিষয়বস্তুর উপর নজর রেখে, এতটুকুই রাখছি। পরবর্তী সময় তো উত্তরাধিকার পর্ব। 



 গল্প 


রাজন্যশাসিত ত্রিপুরায় উন্নতমানের গল্প, উপন্যাসের তেমন কোন উদাহরণ নেই, কয়েকটি নাটক আছে। সাহিত্যিক রমাপ্রসাদ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৩০ সালে “রবি “সাহিত্য পত্রিকার ষষ্ঠবর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত অজিতবন্ধু দেববর্মার লিখিত, “দায়মুক্ত “গল্পটিই প্রথম গল্প, আবার অনেকের মতে ১৯৩৩ সালে  অজিত বন্ধু দেববর্মারই লেখা ‘পরিচয় ‘ গল্পটি, এইগল্পটিও  “রবি “ সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হয়, এবং মনে করা হয়, এটিই ত্রিপুরার আধুনিক যুগে লেখা প্রথম গল্প। ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে সতীশ দেববর্মার “কেরাণীর অপরাধ “এবং বীরেন্দ্র ভট্টাচার্যের  “মায়াপুরী “ত্রিপুরার লেখা ছোটগল্পের ইতিহাসে আদিপর্বের দুটো গল্প। 


ত্রিপুরার ছোটগল্প প্রকৃতভাবে উঠে এসেছে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর, ছিন্নমূল অসহায় মানুষের আগমনে জনজাতি অধ্যুষিত এই রাজ্যটির পূর্ব পরিচয় হারিয়ে যায়। প্রবল জনস্ফীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নানা ধরনের মানুষের উপস্থিতি, তাদের ভাষার বিভিন্নতা, বামপন্থী আন্দোলন, জাতি উপজাতি দাঙ্গা, ভয়ঙ্কর সব রক্তক্ষয়ী দিন, মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, পার্বতী ত্রিপুরার দারিদ্র, জীবনসংগ্রাম  ইত্যাদি গড়ে তোলে  সার্থক গল্পের মৌলিক 

পটভূমিকা। গল্পগুলো হয়ে ওঠে ত্রিপুরার কথা, সময়ের দলিল।

রাজ্যেশ্বর মিশ্রের “স্যামসন বক্স “( ১৯৩৪ ),বিমল চৌধুরীর “জাগরণ “( ১৯৪৭),প্রথম দিকের দুটো উল্লেখযোগ্য গল্প। 

গল্পকার বিমল চৌধুরী তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে  লিখছেন। হরিদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ নুরুল হুদা,  সুবিমল রায়, সুখময় ঘোষ, আনন্দময় রায়, কার্তিক লাহিরী, কালিপদ চক্রবর্তী, ঋতেন চক্রবর্তী, বিমল সিংহ, মানস দেববর্মণ, দুলাল ঘোষ, প্রদীপ সরকার,  সদানন্দ সিংহ,  হরিভূষণ  পাল, কিশোররঞ্জন দে, দীপক দেব, সন্তোষ রায়, ননীগোপাল চক্রবর্তী, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী  এবং ত্রিপুরার অন্যতম সমাজ সচেতন গল্পকার ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, তিনি ত্রিপুরার জনজাতিদের অবহেলিত জীবনের গল্পের একটি সার্থক অক্ষররূপ দিতে পেরেছিলেন।

সুখময় ঘোষ এবং বিকচ কুমার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়, “ত্রিপুরার পাঁচ দশকের গল্প “,সাত ও আটের দশকের গল্পকারদের রচনা নিয়ে যেসব সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, “এই মাটি এই আকাশ “এবং 

‘ত্রিপুরার গল্প ….উত্তর সত্তর “। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ত্রিপুরার ছোটগল্প লেখকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান নাম মীনাক্ষী সেন। তাঁর গল্পের সংখ্যা সাতচল্লিশ।

“জেলের ভেতর জেল “ দুইখন্ডে প্রকাশিত এক অসামান্য সময়ের চালচিত্র , তাঁর গল্পগুলো সরাসরি রাজনীতি কে স্পর্শ না করে, সূক্ষ্ম সংবেদনশীলতায়, মানবের অন্তর্জীবনের একটি আবাদি ও অনাবাদি ভূমি তৈরী করেছে যা আমাদের রাজ্যের গল্পকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। 

জয়া গোয়ালা, ত্রিপুরার অনন্য গল্পকার। তাঁর ভাষা, মেজাজ, গল্পের বিষয়বস্তু কঠিন কঠোর বাস্তবের মাটিতে পাঠকের হ়দয়কে ধাক্কা দিয়ে বলে এটাই আমাদের রাজ্য, আজো যা বদলায়নি চরিত্রে, পরিবেশে, ভাবনায়। 

ত্রিপুরার  গল্পকাররা স্থানিক ভাবনায় পরিপূর্ণ, সমৃদ্ধ।সেইসাথে তাঁরা  অলৌকিকতা, কল্পবিজ্ঞান , প্রতীকনির্ভরতা, কখনোও সরাসরি রাজনৈতিক শাসন অনুশাসন, মানুষের অসহায়তা, উদ্বাস্তু মানসিকতা, চা বাগানের জীবন, শ্রমিকশোষন, আর অবশ্যই জীবনের অন্যান্য মানবিক দিকগুলো ছুঁয়ে গেছেন প্রবল ভাবে। এ রাজ্যের  উল্লেখযোগ্য  গল্পকার, দেবব্রত দেব কর্তৃক সম্পাদিত গল্পের লিটল ম্যাগাজিন “মুখাবয়ব “, ত্রিপুরা ছাড়াও উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং সমসাময়িক বাংলাদেশের গল্প প্রকাশিত করে একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। গল্পকার শ্যামল ভট্টাচার্য, শুভাশিস তলাপাত্র, অশোক দেব, বিমল চক্রবর্তী,  অশোক সিনহা,  সমরজিৎ সিংহ, শ্যামল বৈদ্য, দেবব্রত দেবরায়, সত্যজিৎ দত্ত, গৌরী বর্মণ,সুতপা দাস ,মাধুরী লোধ, সিক্তা চক্রবর্তী,  পদ্মশ্রী মজুমদার, নন্দিতা দত্ত এবং আরো বহু গল্পকার তৈরী করছেন সমৃদ্ধ গল্পবিশ্ব, যা ভবিষ্যৎ ত্রিপুরার গল্পের ইতিহাস তৈরী করতে মূল্যবান ভূমিকা পালন করবে। 


উপন্যাস 

যেকোন ভাষায় রচিত সাহিত্যের সার্থক বিচরণ ভূমি হলো সে ভাষায় রচিত উপন্যাস। আর তা যদি স্থান, কাল, পাত্র এবং একটি বিশেষ  সময়কে নিয়ে রচিত হয়, তাহলে কোন জাতির জীবনধারা, তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, কথ্য ভাষা, পেশা সবকিছুই ধারণ করে সেই সমৃদ্ধ উপন্যাস। 

প্রথম উপন্যাস “খাঁচার পাখী “১৯২৪ সালে সাহিত্যপত্র রবিতে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে 

এই কিরাতভূমিতে রচিত উপন্যাসের তালিকায় প্রথমেই আলোচিত হয়, বীরেন দত্তর ‘গ্রামের মেয়ে ‘, তারপরই ভীষ্মদেব ভট্টাচার্যের “অগরুগন্ধ্যা “,এই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট... দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়, যার আঁচ লেগেছে ত্রিপুরায়ও, আদিবাসী প্রজারা চাইছে রাজশাসন থেকে মুক্তি, গণমুক্তি পরিষদের জন্ম হয়েছে, পুরনো যুগের প্রথা পদ্ধতি, বিশ্বাসের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ, নতুন চেতনার স্পর্শ লেগেছে মননে। নন্দকুমার দেববর্মার “ ঠিকানা  কিরাতভূমি “( ১ম পর্ব, ২০০১ ), ত্রিপুরার আদিবাসীদের স্পষ্ট বয়ান, শ্রেণীবিভাজনগত দৃষ্টিভঙ্গীর সমকালের কথকতা। অনুপ ভট্টাচার্যের “প্রিয় ভূমি “(২০০১ ), ১৯৮০ সালের ত্রিপুরাকে যেখানে তুলে আনা হয়েছে। দুলাল ঘোষের, “অগ্নিসূত্র “,সত্তর আশি দশকের টালমাটাল সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক বাস্তবোচিত প্রখর নির্মান।

প্রদীপ সরকারের “তবুও মানুষ “,”অন্যপুরুষ “,”জনজীবনযুদ্ধ “,দেশভাগ, বাংলাদেশের নদী, গ্রাম নিয়ে লেখা জীবনযুদ্ধের এক অসামান্য মানবিক মুখ। 

শ্যামল বৈদ্যের, ‘বুনো গাঙ্গের চর ‘ ‘উজানভাঁটি “,সমরজিৎ সিংহের, “আলান “ , সত্যজিৎ দত্তের, “পোড়া পতাকা লাল পান্ডুলিপি “, জয়া গোয়ালার, “পার্বতীয়া “, উপন্যাসোপম, “মুর্গাঝুটি লালধূল “প্রভৃতি, মীনাক্ষী সেনের, “জেলের ভেতর জেল “গ্রন্থটি উপন্যাস কিনা এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকেই একে নির্দ্বিধায় উপন্যাস বলেছেন। 

মাধুরী লোধের উর্বর ছায়া, মুকুল খাসনবীশ এর, “পাঁচপুরুষের উপাখ্যান “,শ্যামল ভট্টাচার্যের, “বুখারি “, “লোদ্রভার কাছাকাছি “, পল্লব ভট্টাচার্যের “কমলিনীর উপাখ্যান 

“, শঙ্খশুভ্র দেববর্মণের, “ত্যুই “, ‘মেঘবতী “ইত্যাদি।  “ সুনন্দা ভট্টাচার্যের “অববাহিকা ‘, “বিপ্রতীপ “ইত্যাদি, “সুতপা দাসের, “সোনার দুয়ারী, রুপার দুয়ারী “, “ঈশ্বরী উপাখ্যান”, অশোক দেবের, “সদাপুরাণ, নন্দিতা দত্তের, “অমলিনের শিবাঙ্গী “, শিরোনামে সুধা, পদ্মশ্রী মজুমদারের “দেও নদীর জল “ অশোক সিনহার “তখন সেখানে “ আরো বহু।

স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিপুরার প্রায় সমস্ত ঔপন্যাসিকরাই ত্রিপুরার কথা মনে রেখে উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস করেছেন। প্রচুর আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ প্রয়োগ, ত্রিপুরার ইতিহাস, জনজাতিদের জীবন, রাজ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন, মহিলাদের লেখা কাহিনিতে নারীমুক্তি, সচেতনতা, আটপৌরে জীবন ও যাপন থেকে উঠে এসেছে শেষপর্যন্ত এই বৃষ্টিসিক্ত  পাহাড়ি মাটির গরম ভাঁপ, হৃদয়ের জমাট আগুনের ধোঁয়া।   


প্রবন্ধ 


রাজন্য আমলেই ত্রিপুরায় বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ রচনার সূত্রপাত হয়েছিল। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ যশশ্বী প্রবন্ধকার ছিলেন, কৈলাশচন্দ্র সিংহ। ১৯২২ সালে রচিত এবং দুই খন্ডে প্রকাশিত, কর্ণেল মহিমঠাকুরের লেখা, “দেশীয় রাজ্য “গ্রন্থটিতে মোট ষোলটি প্রবন্ধ আছে। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, “দেশীয় রাজ্যগুলোর অবস্থা সম্বন্ধে এরূপ সারগ্রাহী পুস্তক বাঙ্গালা কেন ভারতের কোন ভাষাতেই নাই। “ দেওয়ান বঙ্গচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত, “প্রবন্ধ রত্নাবলী “ও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পুস্তক, চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদের লেখা, “স্বাধীন ত্রিপুরার কলা বিদ্যা “মহারাজ ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মণের লেখা ত্রিপুরার মঠ ও মন্দির, রবীন্দ্র সান্নিধ্য, পণ্ডিত শীতলচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা, ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস, আদি আর্যভূমি, আর্য ও অনার্য জাতির ইতিহাসের মুখবন্ধ, চিত্রশিল্পী ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ দেববর্মার লেখা, “সংস্কৃতিগত ভবিষ্যৎ ত্রিপুরা, “ হসমভোজন “ ইত্যাদি ত্রিপুরার প্রবন্ধ সাহিত্যের কিছু উদাহরণ।

উমেশ বিদ্যারত্ন, দীনেশ চন্দ্র সেন, দীননাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্র বসু প্রমুখ উনবিংশ, বিংশ শতকের প্রথমদিকের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধকার। 

যখন এইসব প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, তখন উপাদান, সূত্র, তথ্য ইত্যাদি জোগাড় করা খুব কঠিন ছিল। প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথ্যের আদানপ্রদানও ছিল ভীষণ সময়সাপেক্ষ, তাই এইসমস্ত আকর প্রবন্ধ রচয়িতাগণ অত্যন্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন বিষয়ের একটি  ভিত্তি  নির্মান করে দিয়েছিলেন, যার ওপর নির্ভর করে আধুনিক ত্রিপুরায় বিভিন্ন গবেষণা, লেখালেখি করা হচ্ছে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও তাই হবে।  



ককবরক সাহিত্য


“পুস হুক হকয়া উারেঙসা থৗয়য়া

চিতর হুক সকয়া উারেঙসা খাময়া

বিসাক মায় বনইয়া মায় থাই কৗতৗকয়া।”


“বাংলা অর্থ ...পৌষ মাসে জুম কাটতে হবে, চৈত্র মাসে জুম পুড়াতে হবে এবং বৈশাখ মাসে ধানের বীজ বপন করার উপযুক্ত সময়। “ এটা ককবরক ভাষার একটি  লোকগীতি, মৌখিক সাহিত্য যার ককবরক পরিভাষা হল লুকু রৗচাপমুঙ। বর্তমানে এটাই যাদু কলিজা বা যাদুনি নামে পরিচিত। এইসব লোকগীতি, ধাঁধা, প্রবাদ প্রবচণ  পৃথিবীর সব আদিবাসী সমাজের মতোই ককবরকভাষীদেরও ধাত্রী স্বরূপা। পরবর্তীতে লিখিত হয়েছে অন্যান্য র সমৃদ্ধ সাহিত্য ভাণ্ডার । 

ককবরক শব্দের অর্থ হলো ‘মানুষের কথা ‘,কক মানে কথা, বরক মানে মানুষের। ত্রিপুরায় জনজাতি সমাজে আছে উনিশটি শাখা বা গোষ্ঠী। ত্রিপুরী, রিয়াং, জমাতিয়া, মুড়াসিং প্রভৃতি আট দফার জনজাতিভুক্ত মানুষের ভাষা ‘ককবরক ‘নামে পরিচিত। মগ, চাকমা, লুসাই, ত্রহালাম, কাইপেঙ, মলসম প্রভৃতি জনজাতির ভাষা ককবরক নয়। কোনো কোনো ভাষা বিশেষজ্ঞর মতে বারশো বছর আগে ককবরক ভাষা ডিমাছা ভাষা থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। কিন্তু এর কোন লিখিত রূপ নেই। 

পূর্বে ‘কলমা’ নামের একটি বিশেষ হরফে ককবরক লেখা হতো বলে জানা যায়। ত্রিপুরা মহারাজাদের বংশানুক্রমিক পরিচয় নিয়ে লেখা ‘রাজমালা’ নামের পুস্তকটি দুর্লভেন্দ্র চন্তাই নামের একজন পুরোহিত কর্তৃক কলমা হরফে লেখা হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্য-বা তথ্যাংশ থেকে জানা যায়। পরে শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর পন্ডিতদ্বয়ের মাধ্যমে এটি সংস্কৃত ও বাংলায় অনুবাদ করা হয়।


রাজমালার এই ককবরক কপিটি আবিস্কৃত হলে তা হতো ককবরক লিখিত সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন (শ্যামাচরণ ত্রিপুরা)। এই বাংলায় অনুদিত বা রচিত রাজমালাতেই উল্লেখ করা হয় যে, গ্রন্থটি পূর্বে স্থানীয় ত্রিপুর ভাষায় লেখা হয়েছিল। পরে সেই সময়কার পারিপার্শ্বিকতা বিচারে অধিকতর সভ্য সমাজের ভাষা বিবেচনা করে তা বাংলায় বা রাজমালার পরিভাষামতে ‘সু-ভাষায়’ অনুবাদ করা হয়। রাজমালার দ্বিতীয় খন্ডের ধর্ম মাণিক্য পর্বের ৬ নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে-

‘পূর্বে রাজমালা ছিল ত্রিপুর ভাষাতে
পয়ার গাঁথিল সব সকলে বুঝিতে
সু-ভাষাতে ধর্মরাজে রাজমালা কৈল
রাজমালা বলিয়া লোকেতে হৈল।’


ককবরক লিখিত রূপের প্রয়াস হিসেবে দুর্গাপ্রসাদ নারাণ কর্তৃক মহেন্দ্র মাণিক্যের (১৭১৩-১৪) জীবনী ও চতুর্দ্দশ দেবতার পূজার্চ্চনা বিষয়ক মন্ত্রাদি ককবরকে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। পান্ডুলিপিটি একসময় সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও কোন এক গুঢ় কারণে তা এখন দুস্প্রাপ্য।


ফ্রুং-আইসিরি বা প্রথম আলোর যুগ

আলো-আঁধারি পথ পাড়ি দিয়ে ককবরকের প্রথম প্রহরটি শুরু কিছু গুরুত্বপূর্ন সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। ত্রিপুরায় ককবরক সাহিত্যের ইতিহাসে রাধামোহন ঠাকুরের নাম স্মরণীয়। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাংলা বর্ণমালায় বা লিপিতে ককবরক ভাষায়, ‘ককবরক মা “নামে একটি পুঁথি রচনা করেন। এটিই সর্বপ্রথম ককবরক ভাষার সুংসবদ্ধ ব্যাকরণ গ্রন্থ। এর আগে ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে দৌলত আহম্মদ ককবরক ভাষায় ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়, কিন্তু সে পুঁথির অস্তিত্ব মেলেনি।
ঠাকুর রাধামোহন দেববর্মন ১৯০৬ সালে ‘ত্রৈপুর কথামালা’ নামের ককবরক-বাংলা-ইংরেজী ত্রিভাষিক অনুবাদগ্রন্থ, ১৯০৭ সালে ‘ত্রৈপুর ভাষাভিধান’, ১৯১৭ সালে ‘ত্রৈপুর ভাষাভিধান’ এবং ১৯১৯ সালে ‘ত্রৈপুর লোক গাথার সংকলন ও ত্রৈপুর কথামালা’ রচনা করেন। কিন্তু এসব উদ্যোগেরও আগে ককবরকে লেখালেখির তথ্য নানা অফিসিয়াল ও বিভিন্ন পর্যটকদের ভ্রমণ নথিতে পাওয়া যায়। ১৮৭৫-৭৬ খ্রীষ্টাব্দের দিকে যুবরাজ রাধাকিশোর দেববর্মা কর্তৃক ককবরকের অভিধান রচনার কথা জানা যায়। তৎকালীন ত্রিপুরায় অবস্থানকারী ব্রিটিশ পলিটিক্যাল এজেন্ট মি: টি.ই. কক্সহেড-এর প্রশাসনিক প্রতিবেদনে (নং ১৩৪ তাং- ২৬ জুন ১৮৭৬) এই তথ্যটি রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- The yubraj has moreover, at my suggestion, set about the compilation of a Tipperah vocabulary. He is perfectly acquainted with the vernacular of the hill people, and I am in hopes that the result of his undertaking will have some scientific interest. মি: সি. ডাব্লু বল্টনের প্রতিবেদনেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে, The yubaraj is stillengaged in the compilation of a Tipperah-Bengali Dictionary and lately he has become a member of the ASIATIC SOCIETY of Bengal.

প্রায় একই সময়ে জে ডি এন্ডারসনও ককবরক-বাংলা-চাকমা অভিধানের পান্ডুলিপি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তা প্রকাশিত হয়নি, যা বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়। তার কিছুকাল পরে বড়ঠাকুর সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন ‘য়েসিয়ার খাগরা’ নামের একটি বিয়োগান্তক ককবরক লোকগীতি স্বরলিপিসহ লিখে তাঁর সংকলিত ‘ত্রিপুরার স্মৃতি’ পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়।

কবি দৌলত আহম্মদ-এর আরেক কীর্তি ককবরক কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৮৮০ সালের দিকে, তাঁর যৌবনে। কিন্তু বইটির একটি কপি তাঁর নিকটাত্মীয়ের কাছে সংরক্ষিত ছিল বলে জানা গেলেও তার কোন কপি এখন আর পাওয়া যায় না। এই কপিটা পাওয়া গেলে ককবরক লিখিত রূপের আরেক দিক উন্মোচিত হতো।
কোন ভাষা সংরক্ষনের সহজতর উপায় হচ্ছে, সে ভাষায় প্রচলিত অলিখিত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। কারণ, একটি জাতিগোষ্ঠির ভাষা লিখিত রূপ করার প্রাক্কালে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, সেটি হলো লোকজ গান, ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচনসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ, যেগুলো সাধারণত মুখে মুখে প্রচলিত। তাই, ককবরক বা ত্রিপুরাদের ভাষার সামগ্রিক বিকাশ তরান্বিত করার জন্য প্রথমে এই জাতিগোষ্ঠির লোকসমাজে প্রচলিত নানা অলিখিত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা।

প্রায় ৫০০০ বছর ধরে ১৮৪ জন স্বাধীন মহারাজা বিরতিহীনভাবে ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে,  আদি অধিবাসীদের ভাষা ককরবক  অবহেলিত  রয়েছে । অন্যদিকে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের প্রেক্ষাপটে ১৯ শতকের শেষার্ধে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬) তাঁর মাতৃভাষা ককবরকের পরিবর্তে বাংলাকে রাজকার্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন বা গ্রহণ করেন। ফলে  ককবরকের চর্চা আরো দুর্বল হয়ে যায়।


আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ও স্বার্থগত দ্বন্দ্বময় সমাজ ব্যবস্থায় ককবরকের লিখিতরূপ দানের প্রক্রিয়াতে হরফ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব  থাকলেও বাংলা ও রোমান উভয় লিপিতেই এ ভাষার লেখক, গবেষকগণ লেখালেখি করে যাচ্ছেন। 


১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা হরফে দুর্গাপ্রসাদ নারায়ন ত্রিপুরা ককবরক ভাষায় মহেন্দ্রমাণিক্যের জীবনচরিত রচনা করেন। দেখা যাচ্ছে বাংলা হরফে ককবরক ভাষায় সাহিত্য চর্চার কাল তিনশ বছর অতিক্রম করেছে। রাজন্য ত্রিপুরায়, ককবরক ভাষার প্রতি ঔদাসীন্য থাকায়, ককবরকের নিজস্ব কোন লিপিও গড়ে উঠতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালাই ককবরকে ব্যবহার করা হয়। 

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পাহাড় অঞ্চলে সুধণ্বা  দেববর্মা, দশরথ দেব, হেমন্ত দেববর্মা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মিলে জনশিক্ষা সমিতি গড়ে তোলেন। সুধণ্বা দেববর্মা বাংলা বর্ণমালায়, ‘কৗতাল কথমা ‘নামে ককবরক ভাষায় যে সাহিত্যপত্রটি প্রকাশ শুরু করেছিলেন, তাতে দশরথ দেব, মহেন্দ্র দেববর্মা, রামচরণ দেববর্মা নিয়মিত প্রবন্ধ, কবিতা ও গল্প লিখেছেন, যা ত্রিপুরার ককবরক সাহিত্যে একটি গতিময়তার সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে ককবরক বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই ভাষায় সৃজনশীলতা বাড়ছে, সেইসঙ্গে গড়ে উঠছে নিজস্ব সমারোহ, ইতিমধ্যে বহু ককবরক শব্দ হারিয়ে গেলেও আমরা মনে করবো ভাষার জন্য নতুন শব্দ আহরণ করে গতিশীল রাখা এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হোক বর্তমান প্রজন্মের ককবরক সাহিত্যিকদের লক্ষ্য ও অধ্যবসায়, যে ভাষায় “চেথুয়াং “এর মতো নাটক লেখা হয়েছে, যেটি সর্বভারতীয় স্তরে আজ সমাদৃত। ত্রিপুরার প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেখানেও প্রচুর ককবরকভাষী মানুষ রয়েছেন এবং ককবরক সাহিত্য বলতে আসলে ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের উভয়ের ককবরক সাহিত্য, যেহেতু এই প্রাচীন জনগোষ্ঠী একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পর্যায়েই পরে।  সামান্য কিছু ককবরক সাহিত্যসম্পদের কথা উল্লেখ করছি। 

কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুধন্বা  ত্রিপুরার ‘জাদুনি খরাং’ ২০০০, নন্দ কুমার দেববর্মার আনি গানাঅ আং।  চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং-এর ‘হাপিং গাইরিংগ চিবুকসা রিংগ’ ও ‘কলমতৈ কিসি মৗখাং’ কাব্যগ্রন্থ এবং  ‘বলং কৗখ্রাং’(১৯৮৭)।



মণিপুরি সাহিত্য


মণিপুরিগণ ত্রিপুরায় আছেন দুশ বছরেরও বেশী সময় ধরে। অথচ ত্রিপুরায় এ ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সৃজনশীল  সাহিত্য বলতে, ১৯৫৫  সালে প্রকাশিত কৈথেল্লাকপম চন্দ্রকুমার সিংহের মর্ত্যগী পারিজাত লৈরাং নামে একটি নাটকের বই। এর আগে মণিপুরি ভাষা শিক্ষা জনিত কিছু বই প্রকাশ পেয়েছিল, যেমন ব্রজগোপাল সিংহের লেখা, “মণিপুরি ও কুকি ভাষা শিক্ষার সহজ উপায় (১৯১৬), কেথেল্লাকপম চন্দ্রকুমার সিংহের ‘ মৈতৈ’ লোন।  ১৯৪৭ সালে আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়, “খোঞ্জেল “নামে একটি মণিপুরি পত্রিকা। সম্পাদক রাজকুমার মাধবজিৎ সিংহ। পত্রিকাটি দীর্ঘস্থায়ী না হলেও এটিই ত্রিপুরায় মণিপুরি ভাষায় লেখালেখির সম্ভাবনাময়  যুগ সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৭ সালের আগে ত্রিপুরায় মণিপুরীদের আর কোন বই প্রকাশিত হয়নি। তবে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মরূপ নামে একটি মণিপুরি পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ময়েংবম নীলমণি সিংহ, রাজকুমার কমলজিৎ সিংহ, রাজকুমার কল্যানজিৎ প্রমুখ

সম্পাদকদের হাত ধরে দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়। এছাড়া মণিপুরি ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকা

“ত্রিপুরা চে “,”লমজেল “, “শরী “, “চিত্রাঙ্গদা “,’তখেল লৈরাং “ইত্যাদি। ত্রিপুরার মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ রাজ্যে মণিপুরি সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। মণিপুরি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বোদ্ধা এল বীরমঙ্গল সিংহ, তার লেখা একমাত্র “মৌলিক ছোটগল্প “সংকলন, “মকথরব আবীর “,ভ্রমণকাহিনি “চৎসি পুরী কোইরুসি “। ১৯৯৪ তে প্রকাশিত হয় ত্রিপুরার মণিপুরি কবিদের একটি কবিতা সংকলন, “কিরাত লৈপাকতা ঐখোই ‘।সম্পাদক ওয়াংখেম বীরমঙ্গল সিংহ। বিশিষ্ট মণিপুরি লেখিকা সরোক খাইবম গম্ভিনী, তার লেখা কাব্য সংকলন, “হংলক্কনু ওয়াহং অদো “। ত্রিপুরায় এখন পর্যন্ত কোন মণিপুরি উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি। এ রাজ্যে মণিপুরিতে লেখার প্রচেষ্টা ক্রমেই বেড়ে চলছে, সমৃদ্ধ মণিপুরি সাহিত্যের ভান্ডার গড়ে তুলুক এই ভাষার সৃজনশীল কারিগররা। 



চাকমা সাহিত্য 


ত্রিপুরায় চাকমা সাহিত্যের বিকাশ শুরু হয় ১৯৬৬ - ৬৭ সাল থেকে। এইসময় কবি পীযূষ রাউত কর্তৃক সম্পাদিত কবিতা বিষয়ক জোনাকি পত্রিকায়, বাংলা হরফে চাকমা ভাষায় জনেশ চাকমা  কবিতা লিখেন, সেটা একটি শুরু বা আধুনিক উৎসমুখ যা ক্ষীণ হলেও এর থেকেই জন্ম নেয় পরবর্তী ধ্যান ধারণা।  চাকমা ভাষার নিজস্ব লিপি এবং ইতিহাস আছে, যা বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী মানুষে মধ্যে ছড়ানো রয়েছে। ১৯৭০ সালে ফরা কিংকর চাকমার “তাবতিংশ স্বর্গ “,নামে বাংলা ভাষায় একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন, ষাটের দশকের শেষদিকে ত্রিপুর চন্দ্র সেন “গোজেন লামা “নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সে জনেশ আয়ন”গাকমা সাহিত্য নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই বছরে “ফলক “নাম দিয়ে আরেকটি চাকমা পত্রিকা বের হয়। ১৯৮৪ সালে নিরঞ্জন চাকমার সম্পাদনায় ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে ‘ত্রিপুরা সদক’ নামে প্রথমে পাক্ষিক ও পরবর্তী সময়ে মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৮ সালে সারা বাংলা কবি সাহিত্যিক সম্মেলন উপলক্ষে, ভারত ও বাংলাদেশের নির্বাচিত চাকমা কবিদের কবিতা নিয়ে ‘মাসিক সৈনিকের ডায়রী’ পর পর দুটি সংকলন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন নির্মল বসাক ও অভিজিৎ ঘোষ। তাঁদের এই উদ্যোগকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। ওই সনেই উত্তর ত্রিপুরা মাছমারা থেকে প্রকাশিত হয় গৌতম লাল চাকমার সম্পাদনায় ‘লুববুঅ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় বছরে একটি করে চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। একই সময়ে আগরতলা থেকে সনানী চাকমার সম্পাদনায় একটি ও ললিত চাকমার সম্পাদনায় ২টি সংখ্যা ‘নিজেনি’ প্রকাশিত হয়।

২০০৯ সাল থেকে ‘ত্রিপুরা সদক’ পত্রিকার সম্পাদনা করছেন গৌতম লাল চাকমা।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৮ সালে সারা বাংলা কবি সাহিত্যিক সম্মেলন উপলক্ষে, ভারত ও বাংলাদেশের নির্বাচিত চাকমা কবিদের কবিতা নিয়ে ‘মাসিক সৈনিকের ডায়রী’ পর পর দুটি সংকলন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন নির্মল বসাক ও অভিজিৎ ঘোষ। তাঁদের এই উদ্যোগকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।

 ১৯৮৯ সালে নিরঞ্জন চাকমার লেখা ‘প্রসঙ্গ চাকমা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ নামে একটি মূল্যবান বই আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫  সালে চাকমা ভাষায় প্রথম পঞ্চাঙ্ক নাটক, রচনাকাল ১৯৭৪ মোহিনী মোহন চাকমারচিত ‘শেষ বান্ন্যে বেড়া’ প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ্য ত্রিপুরা তথা ভারতে সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলনের ঊষাকালে এই নাটকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় সফল মঞ্চস্থ করে জন জোয়ারের সহায় করেছিল। যা জন জাগরণ বলা য়ায়। নাটকের এত শক্তি ‘শেষ বেন্ন্যা বেড়া’ তারই প্রমাণ। ত্রিপুরা তথা ভারতে চাকমা সাহিত্য সংস্কৃতির আলোর দিশারী ছিলেন মোহিনী মোহন চাকমা।২০১২ সালে চাকমা সাহিত্য ‘ফু’ প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন ‘চাবগি’ ও ‘ফু’ নামে সাহিত্য পত্রিকা। ২০১৩ সালে তিমির বরন চাকমার, চাকমা ভাষায গীতাঞ্জলির অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯৯৫ সালে চাকমা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত হয়  ‘রেগা’। ১৯৯৭ সনে কুসুম কান্তি চাকমা (সিনিয়র) সম্পদনায় আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয় ‘তুম্বাচ’। উপজাতি গবেষণা কেন্দ্র থেকে নিরঞ্জন চাকমার সংগৃহীত ‘চাঙমা পজ্জন’ নামে একটি লোককথার বই প্রকাশিত হয় এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে পান্নালাল মজুমদারের লেখা ‘The Chakma of Tripura’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ১৯৯৯ সালে ধর্মনগর ছাত্র জধার উদ্যোগে ‘বিঝুগুল’ এখনও প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে। শ্যামল চাকমার সম্পাদনায় একটি চাকমা গানের সংকলন প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বিমল মমেন চাকমার ‘রান্যাঘর’ নামে সাইক্লোস্টাইলে চাকমা লিপিতে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ২০০০ সালে ভবন্তু বিকাশ চাকমার সম্পাদনায় ‘দেড়গাঙ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার আত্নপ্রকাশ ঘটে। যা এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০২ সালে কৈলাসহর ছাত্র জধার উদ্যোগে ‘বড়গাঙ’ প্রকাশনার কাজ নিয়মিত চলছে। ২০০৩ সালে কুসুম কান্তি চাকমা (সিনিয়র) সম্পাদনায় সংবাদ সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘খাদি’ নিয়মিত কয়েক বছর প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে পেচারতল থেকে প্রকাশিত হয় ‘বড়পড়ং’ সম্পাদনা করেন প্রধীর তালুকদার। ২০০২ সালে গন্ডাছড়া থেকে প্রকাশিত হয় ‘বিঝুফুল’ সম্পাদনা করেন প্রদীপ দেওয়ান। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় চিত্তিগুল চাকমার সম্পাদনায় একটি কবিতা সংকলন। ২০০৬ সালে নিরঞ্জন চাকমার লেখা ‘অন্য চোখে রাজমালা’ নামে এক তথ্য ভিত্তিক গ্রন্থ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় সত্যপ্রিয় দেওয়ানের লেখা ‘দীঘোল রাজ পদেদি’ নামে একটি পঞ্চাঙ্ক নাটক। এই সনেই দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত হয় ‘হিল চাদিগাঙ-র লারমা-র বারমাস’ সম্পাদনা করেন সন্জীব চাকমা। উদয় জ্যোতি চাকমার সম্পাদনা প্রকাশিত হয় ‘তুদুং’।প্রকাশিত হয় যোগমায়া চাকমার ‘হলুদ চিঠি’ কবিতার বই; ও ২০০৮ সালে অপর কাব্যগ্রন্হ ‘হিল্লোবীর জুম্ম কধা’। ২০১০ সালে করুনালঙ্কার ভিক্ষু ও প্রজ্ঞালঙ্কার ভিক্ষুর ‘মনোগীত’ ও ‘ছদক’ প্রকাশিত হয় নিউ দিল্লী থেকে। ওই একই বছরে সঞ্জীব চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘গাওলী’। অরুন চাকমার কবিতা সংকলন ‘ইদোদর পললাপল্লিত্তুন’। ভারত ভুষণ চাকমার সম্পাদনায় কাঞ্চনপুর থেকে প্রকাশিত হয় ‘সাঙফুল’। ২০১১ সালে অরুন চাকমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে রবীন্দ্র রচনাবলীর নির্বাচিত কবিতা ও গল্প চাকমা ভাষায় অনুদিত গ্রন্থ।
‘নবভাজিত রবীন্দ্রনামা’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন নিরঞ্জন চাকমা ও গৌতম লাল চাকমা।
এইভাবেই ত্রিপুরায় চাকমা সাহিত্য ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের সংযোগ ঘটিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 


মগ সাহিত্য

ত্রিপুরার অন্যতম প্রধান আদিবাসী জনগোষ্ঠী মগ। মগ ভাষা সম্পর্কে বলা হয় মগ আরাকানি ভাষার কথ্যরূপ এবং একটি সংকর ভাষা। তিব্বতি-বর্মন গোষ্ঠীভুক্ত এ ভাষায় অস্ট্রো-এশীয় ভাষার প্রচুর উপাদান রয়েছে। চীনা, প্রাচীন বর্মি এবং মিজো ভাষার সঙ্গে এর সম্বন্ধ আছে। তবে বর্মি ভাষার সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মগ ভাষা আরাকানি ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রিত ভাষা। এক সময় ব্রহ্মদেশীয় রাজার অত্যাচারে দু-তৃতীয়াংশ আরাকানি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে মগভাষার উৎপত্তি হয়। এ ভাষার উৎপত্তিতে বর্মি ভাষারও প্রভাব রয়েছে, কারণ এক সময় হরফসহ প্রাচীন বর্মি ভাষা আরাকানে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে চালু ছিল। তাই মগভাষার প্রকৃত উৎস প্রাচীন বর্মি ভাষা বলে অনুমিত। মগবর্ণমালার নাম ‘ঝা’। বর্ণগুলো মানুষের কোনো-না-কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামে উচ্চারিত হয়। এর আকৃতিতে চীনা চিত্রলিপির ছাপ লক্ষণীয়। আরাকান ও বাংলাদেশে এক শ্রেণির মগ আছে, যাদের ভাষা বাংলা। বড়ুয়ারা মূলত মগ, কিন্তু বাংলাভাষী। পালি মগদের ধর্মীয় ভাষা। এ কারণে বহু পালি শব্দ কিছুটা বিকৃত কিংবা অবিকৃতভাবেই মগ ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন: ভিক্ষু, নিববান, বিহার, ভাবনা (ধ্যান), দুঃখ, বস্সা (বর্ষা) ইত্যাদি।
মগভাষায় সৃজনশীল সাহিত্য না থাকলেও লোকসাহিত্যের উপাদান আছে প্রচুর। এতে রয়েছে প্রবাদ, ধাঁধা, উপকথা, গীত, ভূতের গল্প, জাতকের গল্প, বৌদ্ধ রাজা-রানীদের কাহিনী ইত্যাদি। গল্পগীতিপ্রিয় মগরা অবকাশ মৌসুমে রাতভর গল্প শোনে, বাদ্যসহ নাচগান করে এবং বাংলা যাত্রা গানের মতো ‘পাওয়ে’ নামক এক ধরনের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে। কোনো কোনো গল্প আবার বর্মি অক্ষরে লিখিত।

ত্রিপুরায় মগ ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা

১)মোঃসক্ ক্রী:ক্রাইরী মগ চৌধুরী,কুঞ্জবন টাউনশিপ,আগরতলা ,পশ্চিম ত্রিপুরা।
২)সাংগ্রাইন:সইলাউ মগ,উষাদেন মগ,মংম্রাচিং মগ,ত্রিপুরা।
বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায় বর্ধন, লিখেছেন ত্রিপুরার মগ জন জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি। তারপর 

“ত্রিপুরার মগ জন জাতির ইতিহাস
সংস্কৃতি ও অভিধান “লিখেছেন ক্রাইরী মগ চৌধুরী।




লোককথা  ইত্যাদি

ককবরক ভাষায়, লোককথাকে বলা হয় কেরেঙ কথমা। কেরেঙ শব্দের অর্থ হলো অলীক এবং কথমা শব্দের অর্থ উৎস। অর্থাৎ অলীক কথার উৎস। ত্রিপুরা নামটির উৎসের সাথেই জড়িয়ে আছে জনশ্রুতি বা লোককথা, যার মধ্যে থেকে আংশিক ভৌগলিক কারণের একটি রূপও পাওয়া যায়। লোককথার মৃত্যু হয় না, ত্রিপুর দেশের অজস্র জনজাতির মুখে মুখে ঘুরতে থাকা এইসব অজস্র জনশ্রুতিকেই সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাজা ধর্মমাণিক্য।  

ত্রিপুরার লোককথার বৃহৎ ভুবনে চোখ রাখলেই কানে আসে  অজস্র জনজাতি রূপকথা, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি। যাদের এড়িয়ে ত্রিপুরার সাহিত্যকাল, তার ইতিহাস, ঐতিহ্য বা উত্তরাধিকার সবকিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রূপকথা আর কথাসাহিত্যের মধ্যে প্রধান পার্থক্য, রূপকথা দীর্ঘদিন দিন ধরে চলে আসা জনশ্রুতি, যা লোকমুখে ফিরতে ফিরতে অতিরঞ্জিত হয়। আর কথাসাহিত্য তো বিভিন্ন সময়কালে সৃজনশীলদের দ্বারা  লিখিত মৌলিক সাহিত্য। 

ত্রিপুরার  লোকগবেষক ডঃ রনজিৎ দে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মনে হয় চট্টগাম, নোয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলসমূহ সমুদ্র গর্ভ থেকে উঠে আসার পূর্বে সমুদ্রের বিস্তার এই পর্বতময় ত্রিপুরার পাদদেশ পর্যন্ত ছিল।‘ (রাজন্যশাসিত ত্রিপুরা ও চট্টগাম--- ডঃ রণজিৎ দে, পৃ ৪)। যারই উত্তরশ্রুতি হল মেঘনা-তিতাস অধ্যুষিত অববাহিকা জিলা ত্রিপুরা ও বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত নবপললভূমি বাইশটি পরগণা নিয়ে গঠিত চাকলা-রোশনাবাদের ত্রিপুরা রাজ্যের অঙ্গীভূত হওয়া। এ প্রসঙ্গে ত্রিপুরার রাজমালায় উল্লিখিত ত্রিপুরা সীমান্ত সম্বন্ধীয় বহু আলোচিত পংক্তিগুলো স্মরণ করছি ---

‘ত্রিবেগ স্থলেতে রাজা নগর করিল
কপিল নদীর তীরে রাজ্যপাট ভৈল
উত্তরে তৈউঙ্গ নদী দক্ষিণে আচরঙ্গ
পূর্বে মেখলি সীমা পশ্চিমে কাচরঙ্গ’


অর্থাৎ


কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগ নামক স্থান (বর্তমানে আসামের নওগাঁও জেলা), বরবক্র নদীর তীরে খলংমা নামক স্থান (বর্তমান কাছাড়), মনু নদীর তীরে শাম্বলনগর (বর্তমানে উত্তর ত্রিপুরা জেলা), রাঙ্গামাটি (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম) ইত্যাদি স্থানে বিভিন্ন সময়ে বসতি ও রাজ্যপাট স্থাপনের ইতিহাস জনিত জনশ্রুতি।

কাজেই একটা ভূখণ্ড ও জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের সঙ্গে যে কিংবদন্তীটি জড়িত আছে লোককাহিনীর উপাদান হিসেবে, তাও কম মূল্যবান নয়। স্থাননাম থেকে ঐ স্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নাম হওয়ার উদাহরণও প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়। আলোচিত কিংবদন্তী ‘ত্রিপুরা’ বা ‘তিপ্রা’ বা ‘তুইপ্রা’ জাতির প্রাচীন ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করছে।
ত্রিপুরা নামের উৎস হিসেবে লিখিত যে সাহিত্যিক উৎসটি পাওয়া যায়, তা মহাভারতীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত। 

মহারাজা যযাতির পুরু ছাড়া অন্য যে চারপুত্র তাঁর জরাভার গ্রহণ করতে রাজি হননি, তিনি তাঁদের শাস্তি দিয়ে দূর-দূরান্ত প্রদেশসমূহের দায়িত্বভার অর্পণ করে  নির্বাসন দণ্ড দিলেন। সেইমত দ্রুহ্যু ‘কিরাতদেশ’-এর অধিপতি হন এবং ‘ত্রিবেগ’ নামক স্থানে রাজ্য স্থাপন করেন। দ্রুহ্যুর পুত্র ত্রিপুর কিরাতভূমির রাজা হন। তিনি এত অত্যাচারী ছিলেন যে প্রজাগণ বিদ্রোহী হয়ে তাঁকে হত্যা করে। আবার একটি কিংবদন্তীতে দেখা যায় যে ত্রিপুর দ্রুহ্যুর পুত্র নন। জনৈক দৈত্য বা অসুরের পুত্র ত্রিপুর। তাঁর অত্যাচারে জর্জরিত প্রজাদের আকুল প্রার্থনায় মহাদেব ত্রিপুরকে বধ করেন। কথিত আছে, এই দ্রুহ্যুর পুত্র বা দৈত্যের পুত্র অহঙ্কারী ত্রিপুরের নাম অনুসারে ত্রিপুরা নামের প্রচলন হয়।


ত্রিপুরার লোককথা সংরক্ষণের ইতিহাস বেশী প্রাচীন নয়। লোককথার যেসব গল্প ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরী তাদের লোকপুরাণ বা মিথ নামে আলাদা করা হয়, বাকি অংশ জনশ্রুতি। ত্রিপুরার লোককথাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে 

 কুমুদ কুন্ডু চৌধুরীর সংগৃহীত ত্রিপুরার লোককথার সংকলন  ‘কেরেঙ কথমা’। 

বর্তমান লোককথার  গবেষক গন এটির উপর ভিত্তি করেই আরো গভীরে যাচ্ছেন ও বিশ্লেষণধর্মী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে ডঃ রণজিৎ দে এবং অশোকানন্দ রায় বর্ধনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  

লোককথা ছাড়াও রয়েছে, বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে প্রচলিত লোকগীতি, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদি। এসবও সংরক্ষণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন লোকসংস্কৃতির বর্তমান ধারক ও বাহকেরা । 



নাটক


মানুষের সঙ্গে সাহিত্যের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের অপর একটি মাধ্যম হলো নাটক। ত্রিপুরায় বাংলা, ককবরক, মণিপুরী, চাকমা ইত্যাদি অনেক ভাষায় নাটক লেখা হয়েছে এবং  হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিচ্ছিন্নভভাবে কিছু বলা হয়েছে। 

ত্রিপুরায় সংগঠিত মঞ্চ নাটকের সূচনা করে গেছেন বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য, মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সময়কালে। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে বীরেন্দ্র কিশোর প্রতিষ্ঠিত “উজ্জ্বয়ন্ত নাট্যসমাজ “এর ‘কল্যানী ‘নাটক দিয়ে ত্রিপুরায় আধুনিক মঞ্চ নাট্যাভিনয়ের যাত্রা শুরু। এর আগে ছিল লোকনাটক বা যাত্রা, অবশ্য রাজা দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের আমলে ‘কলিয় দমন ‘নামে একটি ধর্মীয় নাট্যপালা মঞ্চস্থ হয়েছিল আসাম থেকে আগত অতিথিদের সম্মানে, আনুমানিক  সময়কাল (১৬৮২)। তবে ১৮৯২ সালে রাজপ্রাসাদ থেকে যে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল, তা ঐতিহাসিক, পৌরানিক, গীতিকাব্যিক ইত্যাদি কাহিনীর মধ্যে দিয়ে  যেতে ত্রিপুরার রাজনৈতিক আন্দোলন, জনশিক্ষা আন্দোলন, জনজাতি জীবন, উপকথা, ইত্যাদিকে ধারণ করে ক্রমশঃ হয়ে উঠেছে ত্রিপুরার অন্যতম আত্মপরিচয়। খুব স্বল্প পরিসরে আমি প্রাচীন থেকে সাম্প্রতিক  সামান্য কিছু নাটকের কথা বলছি। ভক্তিবাদের উপ রচিত নাট্যকার দৌলত আহম্মেদের “জীবন ফান “,কালীপ্রসন্ন সেন রচিত, “বোধনে বিসর্জন “,১৯২৫ ..২৬ খ্রিস্টাব্দে “ত্রিপুর নাট্যসম্মিলনীর “নাট্যকার রচনা করেন ত্রিপুরার ইতিহাসকে ভিত্তি করে “জয়াবতী বা ত্রিপুরা সতী “।ষাট সত্তর দশকের একটি বিখ্যাত নাটক, “দেব না তিতুন “,রচনা করেন কমল রায় চৌধুরী। 

রাজকর্মচারীদের জিনিস পত্র বিনে পয়সায় বহন করতে হতো গরীব প্রজাদের। যাকে বলা হতো তিতুন প্রথা। এই প্রথাটিকে নিয়েই রচিত বিখ্যাত নাটক, “দেবো না তিতুন “, অগ্নিকুমার আচার্যের, “যাত্রা হল শুরু “,”মৃত সৈনিকের ডাইরী “,শিশু রাজার দেশ, ইত্যাদি প্রকাশিত। নিখিল ভট্টাচার্য, বামাপদ মুখার্জী, অজিত মজুমদার, মাণিক চক্রবর্তী, নৃপেন চক্রবর্তী, হারাধন দত্ত, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য,রতীশ মজুমদার, সরোজ চৌধুরী,   সুধন্বা দেববর্মা তাদের রচনাগুলো মুদ্রিত আকারে প্রকাশ পেয়েছে। জনশিক্ষা আন্দোলনের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা সুধন্বা দেববর্মার নাটক, “এগিয়ে চলো “তখন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অভিনীত হয়েছিল বলে শোনা যায়। উত্তর ত্রিপুরার রামকৃষ্ণ নাথ কর্তৃক আঞ্চলিক ভাষায় রচিত দুটো নাটক, “হকুনের ছাও “ এবং “তুলে মুলে বিনাশ “জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া বিখ্যাত কিছু পথনাটক, “তিনশো তিন হাড়িকাঠ “,কমল চৌধুরীর “বাঁচতে হলে “,তিলক রায়ের, “মহীতোষেরা মরে না “,অনুপম চক্রবর্তীর “শেষ বিচার “উল্লেখ করার মত। বিখ্যাত ককবরক নাটক, “চেথুয়াং “এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বর্তমান সময়ের প্রথম সারির নাট্যনির্মাতা, বিভূ ভট্টাচার্য, সঞ্জয় কর, সমীর রায়, কুমার শংকর পাল, কার্তিক বণিক, ননী দেব, পার্থ প্রতীম আচার্য, অমৃত শিব, অরুণ পাল, প্রমুখ ত্রিপুরার  নাট্যপথের নতুন সময়ের পথিক, তারাই ঠিক করবেন ঐতিহ্যের গাম্ভীর্য ধারণ করে কিভাবে তৈরী করা যায় এই বিকাশমান রাজ্যের সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের যথাযথ আত্মীকরনসমৃদ্ধ মেধাবী ও পরিশীলিত সার্থক নাটক । 







শিশু ও কিশোর সাহিত্য 


ত্রিপুরায় মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনী। ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনী সভায় সভাপতিত্ব করতে আসেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ এ উমাকান্ত একাডেমির এক সভায় প্রতিষ্ঠিত হয় কিশোর সাহিত্য সমাজ। তবে ত্রিপুরা শিশু কিশোর সাহিত্যের সূচনা হয় অনেক দেরীতে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় ত্রিপুরার প্রথম ছোটদের পত্রিকা, “কাকলি “,পারুল দাশের সম্পাদনায়, তিনি ত্রিপুরার বিশিষ্ট শিশু- কিশোর সাহিত্যিক চুনী দাশের সহধর্মিণী। অনঙ্গমোহিনী দেবী, গিরিজাভূষণ চক্রবর্তী বা কামিনীমোহন সেনের দু চারটি কবিতা ছোটদের কাছে বোধ্য হলেও মূলত শিশুসাহিত্য চর্চা শুরু হয় কাকলিকে ঘিরেই। ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি অপরাজিতা রায়ের একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ১৯৫০ সালের কাছাকাছি সময়ে জাগরণ পত্রিকায় প্রথম শিশুবিভাগ রাখা হয়। ছয়ের দশকের শেষে উদিতি, দ্যুতি, স্বাগতম ও রাণার পত্রিকায় শিশুদের কথা ভেবে আলাদা বিভাগ করা হয়। তারপর উল্লেখযোগ্য শিশু পত্রিকা ঝিনুক। সম্পাদক বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী। ঝিনুক প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। তিনি ত্রিপুরার বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক। শিশুদের জন্য অসংখ্য ছড়া, কবিতা, ছবি সৃষ্টি করেছেন। তার রচিত শিশুসাহিত্য ত্রিপুরার শিশুসাহিত্যের একটি বিরাট এবং উল্লেখযোগ্য সম্ভার। “ছড়ার ঘুড়ি “,”অল্প গল্প “, “ছোটদের নানা রঙের গল্প “, সম্পাদনামূলক কাজ, “দুইশ শিশুর কান্ড, “ছড়া আমার ছড়া তোমার “, “এক পৃথিবীর গল্প “

 ইত্যাদি। 

ত্রিপুরার কিশোর গল্প, সম্পাদনা করেছেন, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী এবং শুভব্রত দেব। কিশোরকিশোরীদের উপযোগী করে ত্রিপুরারার জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী বের করেছে বহু বিজ্ঞানভিত্তিক বই। 



তারপর বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে অধুনা লুপ্তও হয়ে গেছে। যেমন জ্ঞানাঙ্কুর, শাশ্বত, অর্ঘ্য, সুড়সুড়ি,  হাসির হুল্লোড়, কিশোরবার্তা, কিশোর সাথী ইত্যাদি। 

“জ্ঞানবিচিত্রা “,সম্পাদক দেবানন্দ দাম,  সেখানেও একটি কিশোর বিভাগ ছিল, সম্ভবত এখন আর নেই। তবে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে যেমন দৈনিক সংবাদ, স্যন্দন, ত্রিপুরা দর্পণ, 

প্রতি সপ্তাহেই শিশুদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকছে, বড়ো, ছোট উভয়েই তাতে লিখেন। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে অমলকান্তি চন্দ বের করছেন, ছোটদের পত্রিকা, “রসমালাই “। কবি 

তন্দ্রা মজুমদার, বের করেন শিশু পত্রিকা, “খেয়া “। অতি সম্প্রতি কিশোরী সম্পাদক, গৈরিকা ধর কর্তৃক বের হয়েছে, “দোলনা “।

ত্রিপুরার প্রকাশকরা ছোটদের বই বের করছেন, এরমধ্যে বিদেশী গল্পের অনুবাদমূলক ও মৌলিক গল্পও রয়েছে, রয়েছে ত্রিপুরার উপজাতিদের রূপকথা, ছড়ার বই ইত্যাদি। শ্যামল ভট্টাচার্য, শঙ্কর বসু, দেবব্রত দেব, নকুল রায়, মীনাক্ষী সেন, জয়া গোয়ালা, বিমল চৌধুরী, সত্যেন বন্দোপাধ্যায়, সন্তোষ রায় প্রমুখ শিশুদের জন্য লিখছেন। কবি চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং

এর ককবরক ভাষায় লেখা  একটি ছড়ার বই রয়েছে। 

 তবে ত্রিপুরায় এই বিষয়ের গুরুত্ব কম, শিশুদের গল্প আসলে কিশোরমনস্ক গল্পই, আর বর্তমান ত্রিপুরায় শিশু সাহিত্যের জনপ্রিয়তাও কম, দিন দিন এই জনপ্রিয়তা আরো কমছে, কারণ বাংলায় লেখা এসব গল্প, ইংরেজী মিডিয়ামে পড়া ছাত্রছাত্রীদের বেশি আকর্ষণ করতে পারছে না, শুধু  শিক্ষামূলক বা উপদেশমূলক গল্প শিশু বা কিশোররা খুব বেশী পছন্দও করেন না। কারণ মনের রসদ তারাও খুঁজেন। সেজন্য রহস্য, কল্পবিজ্ঞান, হাস্যরস এগুলো সুপরিকল্পিত ভাবে শিশু এবং কিশোরমননের সঙ্গে মিশিয়ে, সেই বই বাচ্চাদের হাতে তুলে দিতে হবে। ত্রিপুরার বিশিষ্ট  কথা সাহিত্যিকরা যদি মনোযোগের সঙ্গে কিশোর সাহিত্য রচনার রসদ তৈরী করতে পারেন, তবেই শিশুকিশোর সাহিত্যের উত্তরাধিকারপর্ব সমৃদ্ধ হবে, না হলে ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে।  



কমিকস ও গ্রাফিক্স নভেল


ত্রিপুরায় সবচেয়ে কম চর্চিত হয়েছে সাহিত্যের যে ধারা, তা হলো, কমিকস এবং গ্রাফিকস নভেল। ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের বিশেষ কোন সীমারেখা এই বিষয়ে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না। ত্রিপুরার প্রথম কমিকস্ সাহিত্য সম্ভবত, সত্তরের দশকে, "চাঁদের দেশে সার্কাস ", সৃজন করেছেন স্বপনকৃষ্ণ মজুমদার। তারপরই যিনি এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা করেছেন তিনি, অলক দাশগুপ্ত। ২০০৩ এ বেরোয় অলক দাশগুপ্তের কমিকস, ত্রিপুরার রাজন্য  ইতিহাসের চরিত্র সেনাপতি রায় কাচাগ নিয়ে সৃষ্ট, "সেনাপতি রায় কাচাগ ",প্রথম সংস্করণ। তার দুদিন পরেই দেবায়ন তরফদার কৃত আরেকটি কমিকস বই, “UPA”। " অলৌকিক রাতে "অলক দাশগুপ্ত কৃত বড়দের জন্য গ্রাফিক্স নভেল। যদিও এটি কলকাতা থেকে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত হয়েছে। তিয়াসা দাশগুপ্ত, কমিকস সাহিত্যে ত্রিপুরার তরুন কুশীলব। পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী সম্পাদিত, "চাঁদের পাহাড়ে "তার লেখা এবং আঁকা তিন চারটি কমিকস গল্প প্রকাশিত হয়েছে। “অভিশপ্ত রাজকুমার “, “জামিছলঙ “,”জাদু আংটি ছিরাঙগতি “

প্রভৃতি।  শ্যামল ভট্টাচার্যের গল্প “ছয় পোনার কান্ডের” চিত্রনাট্য অলক দাশগুপ্ত, কমিকস রূপদান তিয়াসা দাশগুপ্ত ।
আশা করব এই মজাদার, সংবেদনশীল, শিশুকিশোর এবং বড়দের জন্যও আকর্ষক সাহিত্যের জনপ্রিয়তম ধারাটি আমাদের রাজ্যে  আরোও চর্চিত হোক।




আমাদের বর্তমান প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ  ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল থেকে পড়াশোনা করছে। তাদের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত আছে মাতৃভাষার পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিন্দি।  তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাহিত্যচর্চায় অবশ্যই ইংরেজি এবং হিন্দিতে রচিত কথাসাহিত্য উঠে আসবে বা ইতিমধ্যেই উঠে আসছে। ইংরেজি ও হিন্দিসাহিত্যের চর্চা ত্রিপুরায়  বহুদিন ধরেই আছে। বের হচ্ছে, ইংরেজী কবিতার বই, মৌলিক গল্প গ্রন্থ ইত্যাদি। 

আগামীতে এ বিষয়ে প্রচুর সুপাঠ্য  গ্রন্থ লেখা হবে এই সম্ভাবনা নিশ্চিত এবং ত্রিপুরার সাহিত্য

 হবে আরোও অনেকবেশী সমৃদ্ধ, কারণ যত ভাষা, তত মৌলিক রচনা, তত ঐতিহ্যের চিরাচরিত সম্প্রসারণ।  






উত্তরাধিকার 



উত্তরাধিকারী ছাড়া শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য ম্লান হতে হতে হারিয়ে যায়। কখনোও ঐতিহ্য দুর্বল হতে পারে, কিন্তু উত্তরাধিকারী যদি মেধাবী এবং সৃজনশীল হোন তবে সেই দুর্বল ঐতিহ্যও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। ঐতিহ্য রক্ষার জন্য চাই যোগ্য উত্তরাধিকারী, উত্তরাধিকারীর জন্য ঐতিহ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু, সে আপন শ্রমে তাৎক্ষণিক ভান্ডার রচনা করতে পারে সেজন্য তার কাছে বহির্বিশ্বের উপাদান রয়েছে যথেষ্ট।

কাব্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক সমস্ত কিছুই সৃজন করছেন উত্তরসূরীরা। আগামীর  পাঠকসমাজ বলবে এইসব সাহিত্য মৌলিকত্ব এবং হৃদয়ের ভালোলাগার মানদন্ডে কতটা সময়োত্তীর্ণ হতে পেরেছে। 


বর্তমান সময়ের কথাসাহিত্যের উত্তরাধিকারীদের উপর একটি দায় আছে। জনপ্রিয় সাহিত্য রচনার দায়। না হলে দিন দিন  পাঠকের সংখ্যা  আরোও কমবে। 

 নানানরকম পরীক্ষানিরীক্ষা তো সৃজনশীল মানুষেরা করবেনই, গবেষণা হবে তা নিয়ে। কিন্তু অধিক ভার সাধারণ পাঠক নিতে অক্ষম। স্থানিকতা, ভাষার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য, ভাবালুতা ইত্যাদি ছাড়িয়ে বৃহত্তর পাঠক সমাজ একটি নিটোল জীবনের গল্প খুঁজে, মনকে ছুঁয়ে দেওয়ার কথা ও কাহিনী, উত্তরাধিকারীদের এই বিষয়ে আরো কঠোর আত্মসমালোচক হতে হবে । একটি সাহিত্যকর্ম বিপুল পরিমান জনমনে না পৌঁছুতে পারলে, তা কোনদিনই দেশ কাল সময়ের সীমারেখায় নিজেদের মিশিয়ে দিতে পারে না। 


উত্তরাধিকার দুইভাবে তৈরী হয়। বিনির্মান এবং নবনির্মান। দুটোই সমান গুরত্বপূর্ণ এবং স্বাগত ও সমাদৃত। সৃজনশীল সাহিত্য সবসময় সেই উত্তরাধিকারীকে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত করে যে ভাষায়, বিষয়বস্তুতে, আঙ্গিকে নতুন কিছুর জন্ম দিতে পেরেছে। আর ঐতিহ্যের বিনির্মাণ তো সবসময় চলতেই থাকবে, এজন্য সুযোগ্য গবেষকরা আছেন, আছেন লেখকরাও যারা ঐতিহ্যের ধারাকে আপন করে নিয়ে নতুনতর করে তুলতে চান তাদের সৃষ্টিকে, এইরকম লেখকের সংখ্যাই বেশী। স্থানিকতা একটি জাতির সম্পদ ও অস্তিত্ব, আর স্থানিকতার সঠিক ব্যাপ্তি সৃজনশীল মানুষের বহির্নয়ন, যা সূদূর প্রসারী করে রাখতে হয়, একজন সাহিত্যিক যাতে সর্ব সময়ের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আধুনিক লেখক হয়ে উঠতে পারে, এটাই  যোগ্য উত্তরাধিকারীর প্রকৃত প্রাপ্তি ও স্বীকৃতি । তাই স্থানিকতা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ সমস্ত কিছু নিয়ে ত্রিপুরার  সাহিত্যের কুশীলবগণ রচনা করুক অন্য পৃথিবী, যে পৃথিবীর হরিদ্রাভ পান্ডুলিপি অরণ্যজলপাথররৌদ্রনক্ষত্র খচিত।


নমস্কার, ধন্যবাদ সকলকে। 


যতন ‘হামবাই। 


 



0 মন্তব্য(গুলি):