বসন্তের কবিতা, চিরশ্রী দেবনাথ

১:৫৬ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

বসন্ত ধুলো 

এক

এক প্রগলভা মেয়ের ঘরে 

শুধু ডানা মেলছে গুটি বসন্ত

ঘাম, ফোস্কা, জ্বর, তাপপ্রবাহ

তার বিরাগ প্রেম, নৌকাভ্রমণ

আকাশ ভূমিকায় বিদ্যুৎ ট্রাফিক

বসন্তকালীন রঙধোঁয়ায়  বিজাতীয়, 

শরীরী গন্ধ দেশী ভাষায় মা কে ডাকে

ব্যর্থতার ইতিহাস শোনানোর জন্য

সেই তো মৃতা মাকেই রাত জেগে শিয়রে থাকতে হয়...



দুই

সমুদ্র ও বেলাভূমির মাঝে একাকী এক যৌনতট

এখানে হেঁটে বেড়ায় বৃহন্নলা  ঋতু জীবনেরা

ছটফটিয়ে উঠে তাদের আঙুলের মাথা

বাঘিনী নখে যেন বিষাদ বসন্ত

সব বসন্তে হিজরেরা মাতাল হয়

ছোট ছোট গ্লাসে ঈশ্বর তাদের শৃঙ্গার দিয়েছেন

ছোবলের নকল স্বাদ

আর কচি পাতায় মোলায়েম বিদ্রুপ ...


তিন

কতো তীব্র এই বসন্তযাম.! 

গন্ধরাজ গ্লাসে উপচে পড়ে ক্ষরণ

আর কত,  আর আর .....

সব শৌখিন শব্দ, মুখোশ যাপন আসলে যন্ত্রনা

নিভে যেতে হবে, হয়তো কিছু সময়

সব মুকুল ঝরে ঝরে পরে যাক

জোৎস্নায় দেখি সারা পৃথিবী, ঘুমোক তারা 

এই অশান্ত সময় আমাকে শুধু শব্দ কণা দিও ...


চার

এখন দিন ও রাতে

বসন্তকালীন পেঁচকেরা ডেকে যায়

তারা ভুলপথে ঢুকে যায় মালভূমি শরীরে

জ্বলজ্বলে সোনালি পালক ভাসিয়ে দেয় রক্তখাতে

উদভ্রান্ত এক শালবন আমার ভেতরে

ডানার ঝাঁপটায়, অস্থিমজ্জায় কি পাগল বসন্ত

রাত্রি ডেকে ডেকে ক্লান্ত পেঁচকেরা

আমার চোখেই সমুদ্র খোঁজে, সৈকতে নবকুমার

ঝিনুকপথে তার অবিরাম রক্তক্ষরণ ঘটছে

কোনদিনই সে পথ হারায়নি

পাঁচ

যদি হারতে হয় ঋতুরাজ.! 

একই সঙ্গে হারবো

হারের সঙ্গে মিশে যাবে শুকনো বাগিচা

দুর্বল মরশুমী ফুলের শুদ্ধতা

যদি ডুবতে হয়, এক সঙ্গেই ডুবব

দুর্দান্ত প্রিয় একটি নদীকে পাঠাবো নিমন্ত্রণ

চন্দনবন ডুবিয়ে এসেছে সেই নদীজল

ঢেউয়ের মাথায় চর্চিত চুম্বনক্ষণ....

হেরে যাওয়া, ডুবে যাওয়ার আকন্ঠ স্বাদটুকু অন্তত দিও .........


ছয়

.... .........................

ভীষণ ভালো লাগছে "এই ক্রমাগত না ভালো লাগা "


গুচ্ছ গুচ্ছ প্ল্যাটফর্ম 


দূরপাল্লার ট্রেনের পাদানিতে কিছু সমুদ্রের ধুলো


ছুঁয়ে, চেটে, লুটেপুটে খাবে তারা আমার রঙ্


সমুদ্রবালিতে রঙ দিতে ভুলে গেছে ছবিওয়ালা...

সব প্ল্যাটফর্মে আমি তাই  একাই  এখন রঙ শ্রমণী 


ট্রেনের দরজায় সবার পায়ে   কাঁচা রঙ...

কামরায় কামরায় চায়ের সকাল

ছাঁকনিতে ছেঁকে ছেঁকে উঠছে


শুধু দুধ দুধ "না ভালো লাগা "

নেশা ...নেশা....  ... মহুয়াদিন ...




সাত

.........

বালিশ, বিছানা এবং কিছুটা 

একান্ত মনখারাপ ছেড়ে

জানালা খুললো বেত্রবতী

বসন্তকালীন রোদ ঢেকে দিল

তার ছোট স্তন,  খড়খড়ে কালো গাল, 

শুকনো ঠোঁট, আর ঝড়ো চোখকে।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগে 

বেত্রবতীর এই শারীরিক রাজ্যপাট

নিগূঢ় বসন্তে অভিমানী থাকে....

বেত্রবতীর সব ব্রণ দাগ রেখে গেছে অবেলায়, 

কৈশোর আছড়ে পরে বারংবার

নিঃসার একান্ত অভিসারে তারা সমুদ্র শুশুক..

বেত্রবতীর দিন ভালো লাগে না

রাত কেবলি রাত কেন হয় না এ জীবনে..

দীর্ঘ এক সানাই কেন বেজে যায় না নহবতে

তার সব নিজস্ব প্রেমেদের স্বয়ম্বর হতেই থাক্..

গায়ে মাথায় মুখে বেত্রবতী মেখে নেয় অলীক সুখ

বিবাহিতা কেবলি বিবাহিতা তার এই অবৈধ বিলাস। 

কারা যেন আঁশটে মুকুলগন্ধ লিখে যায় 

ঋতুর ঘাটে ঘাটে পাত্র চাই বিজ্ঞাপনে,

  দিনশেষের রজঃস্বলা,  এই বসন্তযাপন 

গা কুটকুটে অসহ্য ব্যথা, তাকেই কেন শুধু? 

কিছু শিমূল, কিছু আবির বেত্রবতীর ঠোঁটে

একটি কামড় রেখে যাবে, 

কথা হয়ে উড়ে গেছে সাতজন্ম পরে..

তাই দীর্ঘ, দীর্ঘ এই সব রাত

বেত্রবতীকে জেগে থাকতে হয়, 

রূপং দেহি, রূপং দেহি, রূপং দেহি...

বেত্রবতী মা হয়, তার সব সন্তানেরা অযোনিসম্ভূত।

কুৎসিত ছোপ ছোপ দাঁতে, গিলে ফেলে মুকুল মদিরা 

কষা স্বাদে চোখ বন্ধ হয়ে আসে 

একান্ত একান্ত এই সুখবিলাস 

তাম্রবরণা বসন্তে বেত্রবতী ফুটতে থাকে

নিখাদ কালো দহন হয়ে... 

জানালা বন্ধ করে দেয় বেত্রবতী

জন্ম, জন্ম এবং আরো

সাতজন্ম পর সে প্রিয়া হবে....



আট

মাংস কাটার দোকানের কাছে বসে আছে

এক পরিযায়ী বেহালাবাদক

ছাল উঠছে, রক্ত ঝরছে টুপটাপ

বেহালায় জোৎস্না সুর,চোখ বন্ধ

পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাংস কাটার গান

ছাল উঠছে, রক্ত ঝড়ছে টুপটাপ

বসন্তের পশুরা সার সার গান শুনছে 

ঝরে ঝরে পড়ছে লোম, পোকা

সোনালি মাংসে ভেসে যাচ্ছে  ফুলভূমি

সোনালি ছাল জমছে আর জমছে

বেহালার সুরে এবার শুধু

  ঘুমিয়ে পড়ার গান, ঝরা লোমের গান.....


নয়

শ্রেণীসংগ্রাম, শ্রেণীহীন সমাজ

সবই যেন ধোঁয়া ধোঁয়া ভাসন্ত রোদ

ধানের শীষের মতো ভরন্ত এই তরুন

দুরন্ত সিগারেটের রোমান্স ...ফুঃ

ডুবন্ত রোদ জমতে থাকে 

বোকাদের মিছিলে

তরুণের হাতের তালুতে সোনালি ঘাম

কফির কাপে জমতে থাকা 

বিশ্বাসী হাইড্রোডায়নামিক্স

ঘাসের মতো বিনয়ী

একটুকরো ভঙ্গুর প্রেম, নাহ্

ওসব অবয়বে সে কোনদিনই

জারিত হতে চায় না

বছরশেষে কলেজের গেটে 

উড়তে থাকে কিছু পতাকা, 

সমুদ্র ঘেঁষে যেন একতারা শ্লোগান

ধেয়ে ধেয়ে আসে লোহিত কণা

তরুনের সবুজ ধমণী ফিরিয়ে দেয়

এইসব অবিশ্বাসী কাচ তরল

বহুদিন ধরে রক্তকে

নীল করার  গবেষণা

তাকে আন্তর্জাতিক করেছে

তবুও অসাবধানে বেড়ে ওঠা

কিছু আগাছা  মুহুর্ত তাকে 

নরম নরম গভীর সুখ দেয় 

কোন এক বসন্ত হয়তো তাকে ডাকবে ! 

এই ডাক অজানা হোক

নীরব হয়ে চিড়ে দিক তাকে

ডলারের সঙ্গে রচিত হোক স্বাদু ধোঁয়া, 

ধ্বস নামার আগে পাহাড় চুড়োয় হাত রাখতে ভালোই লাগে .....

গুঁড়ো গুঁড়ো পাথরে তরুণের ভয় নেই 

ফুৎকারে  উড়িয়ে দেবে তরল কাঞ্চনজঙ্ঘা .....

দশ

............................

রাতের আকাশ ভেঙে,

মাঝে মাঝে ঝরে পরে,

দু এক টুকরো কথা, শ্বাস......

তাদের গায়ে যৌনস্বাদ, অন্ধকারের আদর,

আমি তাদের জন্য শিমুল তুলোর বালিশ দিই

কোথাও বসে ঢুলতে থাকে  এক কথকমশাই,

মহাভারতের অধ্যায় থেকে

নেমে আসে দ্রৌপদীসখা, হাতে ময়ূরপালক, 

কৃষ্ণবরণ মেয়ে বসে থাকি আঙিনায়,

সত্তায়  শুধু নারীর গন্ধ,

ক্যানভাস চিড়ে যাওয়া রঙের নদী, 

আমার আলাদা রঙ চাই,

বিষাদের রঙ, উষ্ণতার রূপময়তা,

ময়ূরকন্ঠী রঙটি, কৃষ্ণ !

আমার একার হতে পারে না?

শুধুমাত্র একটি রঙ,  নিজস্ব, আর কারো নয় .....



এগারো

আমার আঙুল সমুদ্রবাহী 

পায়ের নখে জমে আছে রাশ রাশ সমুদ্রবালি

এতো দূর ঠেলে ঠেলেএসে দেখি

সব সংঘাত, আগেই লেখা হয়ে আছে 

সন্ত্রাস, আধপোড়া মনুসংহিতা কিছু আত্মহত্যা

কয়েকটি স্রোত থেমে গেছে

পূঁথি, পুরান আর মাদক হয়ে 

ফিরে যাই তবে কোন পুরোনো বসন্তে

ছোট্ট একটু সন্ধ্যা আছে রুমালে

রঙহীন, সাদা আলো ঢেলে দিই, ঢেলে দিই...

আগুন রঙে ফুটতে থাকা সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন,  সময়ে...




বারো


ধুলোতে আমি শুধু শ্মশানের গন্ধ পাই

মাঙ্গলিকতায় ভাসিয়ে দাও সব শবস্বপ্ন

শবসাধনা আমিও করি, চারপাশে সব জীবন্ত শব 

তারাও আমারি

চৈত্র দিনে তারা সমকামী 

ঝড়ের মতো ঝড় হওয়ার আগেই  লুটিয়ে পরে





তেরো


পাখিবসন্তে  সব বসতবাটিতে প্রদীপ জ্বলে


অন্ধ বাতাস চিনে নিও তোমার  ঈশ্বর আবছা আলোয় ...


নাভিমূলে রোপন করো একটি নাগার্জ্জুন গাছ


যেখানে বেঁধেছে বাসা সেই সব পাখিরা


যাদের ঠোঁটে থাকে 


নগ্ন লাল, নিষিদ্ধ ফল, অবৈধ সঙ্গী 


মিত্রবাঁশীতে বেজে ওঠে যুদ্ধশিষ 


আনমনা বনে  বনজ শয্যায় রমণীয় এক ব্যাধ


ভুলে গিয়ে তার যাবতীয় ব্যাধি, রঙিন অসুখ 


সাঁজিতে তুলে নেয়  সেইসব মৃত পাখিদের 


যাদের কোনদিন কেউ অনাঘ্রাতা ফুল ভেবেছিল ...



চৌদ্দ

.........

অহম্, 

নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং

আমায় গ্রহন করো না

এই নক্ষত্র কালীন কবিতারা বৈধ ছিল না 

অহম্

নান্ত্যপর্বতনামিকাম্

পাহাড় স্পর্শ করে আছি,  আমি  অকাল মেঘ

বর্ষনে আমি নোংরা হবো, এ আমার অহংকার

গ্রহন করবে এ সাধ্য কি? 

অহম্

পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং 

পাখীর মতো হালকা উড়ান, আকাশই আমার অকাল মেঘদূত

গ্রহনে সঙ্গমে ঝলসে যাওয়ার বধিরতা 

যাক তবে যাক .....

অহম্

  ভীষণনামিকাম্,

পৃথিবীর সব  নারীই কখনো কখনো রাক্ষসী, 

গ্রহন ডুবে ডুবে এই সরোবর, তাই রক্তাক্ত পলাশ ...




পনের

শ্যাওলা প্রহর, নক্ষত্রের মাঠ

উল্কার গুঁড়োতে ডুবে যাওয়া পায়ের পাতায়

আমার জীবন্ত  উচ্ছাস .....

পড়তে চেয়েছিলে, দিলাম। 

সাম্রাজ্যে  অন্যকেউ

তার সঙ্গে আমার অবৈধতা 

বসন্ত জোৎস্নায় নিবিড় অরণ্যবিলাস

তাকে ব্যবহার করি

যখন তখন নিজের মতো করে

কি সুখ ! 

স্বার্থপর বারুদের মত, চেখে দেখি, ছুঁয়ে থাকি

বিস্ফোরণ ঘটবে কোনদিন  !  বলছো?  হাসালে .....


ষোল

আমার ছাপোষা কেরানি জাতীয়

এই নিম্ন মধ্যবিত্ত লাইনগুলো...

আমার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা শিকড়বাকড়

আয়ুর্বেদিয় কটু গন্ধে বেড়ে ওঠা আগাছা

এরা প্রেমজ নয়, শরীরি ভূতগ্রস্থ রাত্রিময়

বসন্তময় ছায়াবিতানে ঘুরে আসার সাধ হয়

কবিতা গন্ধ ছড়িয়ে আছে অপুষ্ট ফুলে 

ঋতুবদলের এই কঠিন সময়ে এসবই 

এই জ্বররোগীর অস্ফুট  বিকার...








0 মন্তব্য(গুলি):