৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ বিল ও নারীর ক্ষমতায়ন 

৫:১০ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ 

 ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ বিল ও নারীর ক্ষমতায়ন 
................................................

২০১৯ লোকসভা ইলেকশনে মহিলা প্রার্থী ছিলেন মোট ৭১৫ জন, পুরুষ প্রার্থী ছিলেন ৭৩৩৪ জন।
ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে মহিলা প্রার্থীর পার্সেন্টিজ ছিল ৫%, বর্তমানে ১৪%।
বেড়েছে বৈকি। তবে খুবই ধীর গতিতে। ২০১৪ সালে ৬২ জন মহিলা প্রার্থী জিতে এসেছিলেন, এবার ৭৮ জন। এর মধ্যে অনেকেই পুনর্নিবাচিত হয়ে এসেছেন ।  কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলা সাংসদ তাদের ব্যক্তিগত ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৯ এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তবুও ৭৮ জন মহিলাপ্রার্থী আরোও বেশী করে নিশ্চয়ই এবার ৩৩% মহিলা রিজার্ভেশন বিলের জন্য সরব হবেন। 

১০৮ তম সংবিধান সংশোধনী বা ৩৩% মহিলা সংরক্ষণ বিল একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বিতর্কিত বিষয়।      
১৯৯৬ সালে প্রথম এই বিলটি লোকসভায় আসে। তখন থেকেই চলছে চাপান উতোর। সেইসময় পরপর তিনবার লোকসভার পতনের কারণে বিলটি পাস হতে পারেনি। 
২০০৮ সালে ইউ পি এ সরকারের আমলে বিলটি আবার নতুনরূপে সংসদে আসে এবং ২০১০ সালে রাজ্যসভায় পাস হয়, তবে লোকসভায় নয়। 
বিলটির পক্ষে ভোট পরে ১৮৬ টি। সমর্থন করে প্রধান বিরোধী পার্টি বি জে পি এবং ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল। 
কিন্তু  বিলটির বিরোধিতা করেছিল লালুপ্রসাদ যাদবের দল এবং  মুলায়ম সিং যাদবের স .পা।
তারা এর প্রতিবাদে ইউ পি এ সরকারের ওপর থেকে  সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকিও দেয় যেহেতু তারা বাইরে থেকে সরকারকে সমর্থন করছিল। 
মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টি এবং পশ্চিমবঙ্গে মমতা 
ব্যাণার্জীর তৃণমূল কংগ্রেসও এই বিলটির স্বপক্ষে ভোটদানে বিরত থাকে।
তাদের বক্তব্য ছিল এতে সংখ্যালঘু এবং দলিত মহিলাদের জন্য আলাদা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, না হলে সেইসব মহিলারা  বঞ্চিত হবেন। এতে লাভবান হবেন শুধু শহুরে শিক্ষিত মহিলারা। 
 ২০১৪ সালে সংসদে যখন বিলটি পুনরায় উথ্থাপিত হয় তখন সোনিয়া গান্ধী সহ অনেকেই বিলটি দ্রুত পাস করানোর জন্য দাবী জানান , তবে সোনিয়া গান্ধী বিলটির সংশোধন চেয়েছিলেন, কারণ এতে বিজেপি শাসিত বিহার এবং রাজস্থানে  নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য মহিলাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দেওয়া হয়, এর ফলে তিনি মনে করেন তফসিলি জাতিভুক্ত অনেক মহিলাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, কারণ তারা লেখাপড়ায় অনেকটাই পিছিয়ে আছেন।
শেষপর্যন্ত সতেরতম লোকসভা নির্বাচন শেষ হলো। কেন্দ্রে এখন নতুন সরকার। বিরোধী পার্টি হিসেবে কোন দলই স্বীকৃতি পাওয়ার মতো পজিশনে পৌঁছুতে পারেননি। তাই থাকছেন না কোন বিরোধী দলের সর্বজনসম্মত নেতা। শাসকপার্টি এখন সহজেই বিলটি পাস করিয়ে নিতে পারেন। 

৭৩ তম  সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতে চালু হয়েছিল
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। জনসংখ্যার অনুপাতে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে এবং  মহিলাদের জন্য প্রতিস্তরে এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
 ফলস্বরূপ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা অনেক মহিলা প্রার্থীকে পাচ্ছি। তার ফলও মিলছে। শিক্ষায় অনগ্রসর, অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া কোন গ্রামীণ এলাকা থেকে যখন ভীষণ সাদাসিধে একজন মহিলা হঠাৎ করে রাজনীতির বিরাট মঞ্চে  আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষুদ্র আসনটুকু খুঁজে পান, তখন তার চোখমুখ খুলে যায়। তার মধ্যে সঞ্চারিত হয় আশ্চর্য এক শক্তি। আত্মবিশ্বাসের গল্প প্রবাহিত করতে থাকেন আশেপাশের আরো অনেক মহিলার মধ্যে। তবে তা অবশ্যই নির্ভর করে
সেই মহিলাটি তার পরিবারের কোন পুরুষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন কিনা। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই  পিতা, স্বামী, শ্বশুর, ভাই এর অলিখিত প্রতিনিধি হয়েই মহিলাটি রাজনীতিতে আসেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলা সংরক্ষিত আসনটির জন্য। তখন পরিবার এবং রাজনীতি দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে পুরুষ সদস্যটির নির্দেশমতো চলতে গিয়ে তারা আর স্বাধীন মতামত দিতে পারেন না। এর ফলে বহু সমস্যার সমাধান নিজের যুক্তি এবং বুদ্ধি অনুসারে   হয় না। গ্রামগুলোতে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা চোলাই মদের ঠেক, নেশাগ্রস্ত স্বামীদের নিত্য নৈমিত্তিক মারপিট ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন হরিয়ানার মির্চ গ্রামের এক মহিলা সরপঞ্চ মঞ্জুদেবী, তিনি বলেছেন এ বিষয়ে তার পরিবার তাকে সাপোর্ট করেছে। তেমনি আরো অনেক সমস্যা যেমন পণপ্রথা, প্রেমঘটিত বিবাহসমস্যা, জাতপাত ইত্যাদি সমস্যা নিরসনে মহিলা প্রধানরা অনেকবেশী সহায়ক এবং সহানুভূতিশীল প্রবণ বলেই আমার ব্যক্তিগত মত, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। 
ভারতের রাজনীতিতে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ খুব কম এখন পর্যন্ত। কেউ কেউ কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলাচ্ছেন এটাও একটা ঘটনা কিন্তু, স্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়।
যতদিন পর্যন্ত রাজনীতিতে  মহিলাদের অংশগ্রহণ, জিতে যাওয়া,  একটি বিশেষ ঘটনারূপে চিহ্নিত করা হবে, ততদিন পর্যন্ত বলা যায় সংসদ এবং বিধানসভায় মহিলাদের সমানাধিকার  প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আর যখন পুরো প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক, সর্বরকম চাপমুক্ত একটি সাধারণ ঘটনায় পরিনত হবে সেইসময়ই  বোঝা যাবে দেশের ৪৭% জনগন যারা, তারা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন হয়েছে। 

আজকাল  বিভিন্ন স্তরে মহিলারা যখন পুরুষদের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে কাজ করতে চাইছেন, তখনও খুব অশোভনীয় উক্তি তাদের শুনতে হয়। আম আদমী পার্টির তরুণী এম এল এ
অলকা লাম্বা মনে করেছিলেন, তিনি রাজনীতিতে এসেছেন যখন সব কাজ পুরুষদের সমকক্ষ হয়েই করবেন, এজন্য রাত বিরেতেও কোথাও কোন অসুবিধে হলে বেরিয়ে পড়তেন। তার ফল হল এই যে, বিধানসভায় বিরোধী পক্ষের এক বিধায়ক তাকে সম্বোধন করলেন বাজারু ঔরত বলে, যে নাকি রাতবিরেতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। পরে অবশ্য এইধরণের বক্তব্যের জন্য তিনি একবছরের সাসপেন্ড হয়েছিলেন সম্ভবত। এখন প্রশ্ন হলো মেয়েদের সম্পর্কে আদি ধারণার কোন পরিবর্তন হয়নি আজ পর্যন্ত, পুরুষ কিংবা অপর কোন নারী কারোও মনেই।
নিঃসন্দেহে কোন পুরুষ বিধায়ক এই কাজ করলে তুমুল হাততালি আর প্রশংসা পেতেন, মেয়ে বলেই অসম্মানিত হতে হলো।      
দক্ষিণ এশীয় অনেক দেশ যেমন দক্ষিণ সুদান, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতও জাতীয় রাজনীতিতে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ভারতের থেকে বেশী। 
বাংলাদেশও তাদের দেশে মহিলাদের জন্য  সংরক্ষণ বিল পাস করিয়েছে। কিন্তু ভারতের মতো একটি দ্রুত উন্নয়নশীল, রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত সচেতন দেশে রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা এখন পর্যন্ত এই বিলটি নিয়ে একটি ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারছেন না। 
রুয়ান্ডা, আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ। কিন্তু মহিলাদের জন্য  জাতীয় রাজনীতিতে ৩০ পার্সেন্ট সংরক্ষিত । সারা পৃথিবীতে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশী। নেপালে ২৯%, পাকিস্তানে ২৮%, আফগানিস্তানে ২০% মহিলা সংরক্ষণ প্রবর্তিত হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। 
অথচ ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকটাই  মহিলা হলেও, জন প্রতিনিধিত্ব করছে খুব কম। মেয়েদের প্রতিনিধিত্বের অনুপাত বেশী হলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা বাড়বে, আমি মনে করি। । 
যাই হোক দীর্ঘদিন কেটে গেছে, আগামী অধিবেশন গুলোতে আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় নির্বাচন এবং বিধানসভা নির্বাচনে মহিলাদের জন্য ৩৩% রিজার্ভেশন বিলটি লোকসভাতেও সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে যাক, এটাই চাই। হিন্দীবলয়ের এবং অন্যান্য জায়গার 
পুরুষ রাজনীতিকদের অনেকেরই মনে একটি ভীতি আছে, নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, তাদের প্রভাব কমে যাবে।  এটাই আসলে মোদ্দা কথা । মহিলা প্রতিনিধিকে সামনে রেখে পেছনে সমস্ত সুতো নিজেদের হাতে রেখে দেবেন সেটা আর হবে না। 
  হয়তো তারা ইনসিকিউরিটি অনুভব করছেন।  একটু ভাবুন শুধু... আসলে দুপক্ষই সমান, ঈশ্বরের সমান সৃষ্টি । 

 সমদৃষ্টি এবং সমমনোভাব এই সাধারণ
কথাগুলো প্রকৃতপক্ষেই খুব সাধারণ। তাই সরলভাবেই নিন মেনে। মনে খুব বেশী ইগো প্রবলেম হলে তা থেকে সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরই নিজেদের মুক্ত করা  উচিত রাজনীতির খোলা ময়দানে। সর্বোপরি সমস্ত মহিলা প্রতিনিধিরা একজোট হয়ে সমর্থন করলে, ভারতীয় রাজনীতি আরোও সুদৃঢ় পথে এগোবে, একথা ভাবতেই ভালো লাগে।

0 মন্তব্য(গুলি):