গ্রীষ্মের কবিতা
চূর্ণগ্রীষ্ম
এক
দহনে জাত দিনটিকে মনে হয় সবুজ মোম
গলে গলে গর্ভে ধারন করছে শ্যাওলাসুখ, গুল্মসঙ্গম, শুধু কিছু অবান্তর ছেঁড়া বৃষ্টি হোক
বেড়ে উঠবে পত্রবিতান, বানানো গল্পগাছা
গ্রীষ্মের এই সন্ন্যাসীজীবন আসলে তার শাপগ্রস্থ যক্ষ্মা কাল
সব প্রাচীন কবিরা হাতে তুলে নিয়েছে যন্ত্রকলম
ছিটকে ছিটকে পরছে পুরাতন গ্রীষ্মশরীর
ঢুকে যাচ্ছে সব আসন্নপ্রসবা মায়ের গর্ভকুটিরে
চন্দনবর্ণের পুরুষেরা জন্ম নেবে, ছেয়ে যাবে সুগন্ধি গরম ...
দুই
বৈশাখকে আজ নেমতন্ন দিলাম
নীল নীল আঙরাখা তার পৌরুষকে ঢেকে দিল
আমার বিস্বাদ নেমতন্ন উপেক্ষা করে
কুলফি বিকেলে সে জানিয়ে গেলো
কোথাও, অন্য কোথাও তার বৃষ্টি হয়ে ঝরার কথা....
তিন
রুক্ষ পাহাড়ের গোপন বুকে
একটি বিন্দু বিন্দু ঘামের সরণী বয়ে যায়
যেসমস্ত খুনীদের... আরো... আরো গভীর পাপীদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল,
তারা সেখানে গান গায়,খুনীর গান, পাপীর গান,
সে সব সুর তাল লয় মাটির গর্ভ থেকে উঠে আসে
সুরের সঙ্গে মিশে থাকে সদ্যজাত শিশুর নাড়ি রক্ত,
ফাঁসির দড়ি গুলোতে কি দারুণ পাপ সমারোহএকটি রূপোর থালায় গ্রীষ্মের ফুলসব খুনীদের চোখে শ্বেতপাপ চলকে চলকে উঠেকত পাপ শেষ হলে তবে তারা দেবশিশু হবে
পারিজাতগন্ধ মা পাবে তারা, গর্ভে জ্বলে উঠবে বিদ্যুৎ জন্ম পাহাড়ি বীর্যে জারিত হচ্ছে গজলসুর ,বিশুদ্ধ লোকগাঁথা ,
পাপ বলে আর কিছু থাকবে না আসন্ন পৃথিবীতে।
চার
গ্রীষ্মের গোধূলিকে মৃত্যুর কাছাকাছি প্রবলভাবে
জেগে থাকা মানবী বলে মনে হয়
তার রক্তচাপ আসন্ন বিভাবরী
দমকে দমকে ভেতর থেকে
উথলে আসে চিরজীবনের নদী
সে শুধু আসন্ন, শুধু কাছাকাছি হয়ে থাকে
পরন্ত ফলের মতো একটু দুরে মৃত্যু
তার চিবুক নিয়ে খেলতে থাকে, খেলতেই থাকে...
পাঁচ
দীর্ঘ গরমে ক্লান্ত হয় না এ পরিব্রাজন
আমি ঘড়া ঘড়া ফলস্বাদ জমিয়েছি প্রাঙ্গনে
ভুলে যেতে চাও যদি আভূমি মুকুল বিকেল
বরফকুচি সন্ধ্যে স্নান, পাটি কথা
বৈশাখে ঘন হয়ে থাকা সেদিনের সূর্য গ্রহন
তবে জানা আছে এসব একার ছিল না কখনো
পৃথিবী সেজেছে গুচ্ছ কথায়
ঘরের মেঝেতে ধানক্ষেত ডুবে আছে, আলপথ মেয়ে আমি
ধুলো মাখা পায়ে পৃথিবীর সব শ্রমবালিকারা
হেঁটে যাচ্ছে যে শস্যপথে
এখানেই মিশে আছে আমার অহং গ্রীষ্ম ...
ছয়
ভেবেছিলাম নিজস্ব ট্রেনটিকে নিয়ে
আজ সন্ধ্যায় গরম মাখবো গায়ে
আস্তে আস্তে তাওয়ায় ফুটবে ফুলবন
রাতের রুটি হাওয়ায় মুখভার করতেই থাকবে
বড়ো অবাধ্য এই দিন মেখে আসা ট্রেনটি
এক গার্ডহীন পাহাড়ী স্টেশনের বারান্দায় থেমে গেলো
আমাকে না মেনে চলতেই তার আনন্দ
হাজার বছরের অভ্যাস আমি তার
ট্রেনটির শরীরে ছড়িয়ে রয়েছি চটচটে বকুলগন্ধ
হয়ে
আমার মেঘে মেঘে তার স্নান! ....দম আটকে আসে যে
পুরোনো হয়ে যাওয়া এইসব বৈশাখী মেয়েদের
কথা বয়ে নিয়ে গেছে জৈষ্ঠের শেষ ডাকঘর
খনিজ গন্ধ মেখে তারা মাটির ফাটলে চুঁইয়ে দেবে লেবু স্নান
গ্রীষ্ম যে কত সুন্দর তা জানে শুধু কৃষকের মেয়ে
লেবুগন্ধের সোনালী ভাতে খুঁজে পাবে সে তার সব ভীড়ে ঠাসা কামরা ...
সাত
ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে দাঁড়ানো একটি ধূসর ট্রাক গা থেকে ঝরে যাচ্ছে খেয়ালী গ্রামের কিশোর সন্ধ্যা ।
ট্রাক বোঝাই বাঁশী,
ট্রাকের ড্রাইভারের ঝুলন্ত গোঁফে রাজকীয় অন্ধকার,
চোখ মেলে তাকিয়ে এক জাতিস্বর জনপদ
তারা সবাই সুর ভুলে যাওয়া গতজন্মের বংশীযুবক
আসন্ন খরায় তাদের ঠোঁটে জেগে উঠবে গ্রীষ্মসুর বিক্রি হয়ে যাবে একটি ...একটি... বাঁশি
নির্বিকার হাইওয়ের ধূসর ট্রাক চলে যাবে
হাজার হাজার বাঁশী নিয়ে তাকে পেতে হবে
আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট
আরো ...আরো জন্মান্তর মনে রাখা শহর
সেইসব শহরের রূপময় যুবকদের ঠোঁটে মুছে গেছে মেয়েরাত্রি
বাঁশির ফুটোতে ভিজে থাকা অন্ধকারে বালি নূপুর
যেন ভীড় করে আসছে হাজার হাজার মিছিলের পা, জলযুদ্ধের রাসায়নিক ছাই...
আট
গভীর দুঃসময়ে ষ্টেশনের দিকে চলে যাওয়া
রাস্তার দুপাশে বেড়ে ওঠে সুখগাছ
শিস্ দেয় লালপাখি
বিষাদের গোকুল সন্ধ্যা কেটে কেটে যায়
ষ্টেশন চত্বরে খবরের কাগজ বিক্রি করে
এক আরণ্যক মানুষ
তার ঝোলায় গাছেদের ডাইরী
অন্তর্মুখী আর যাপিত হরফের মেয়েরা
সুখগাছের ছালে লিখে গেছে তাদের নক্ষত্রসময়,
ছাল খসাবার কালে
গাছ শুষে নিয়েছে সেইসব শুকনো ব্যথা ঠাসা মুকুলে, ফলের জমিনে
লেখা হবে শুধু সুখযাপনের পিচ্ছিল প্রবাল কথা ...
নয়
ধূ ধূ ডুবন্ত ফসলের মাঠের পাশে
একলা এক চায়ের দোকান
মনে হয় পৃথিবীর বাইরে এক ঘর
এক এলিয়েন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঢেলে দিচ্ছে কসমিক রে
কাপের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে তেঁতো তামাটে বিস্ফোরণ
গ্রহান্তরের হিসেব রাখছে তার কটা চোখের বউ
ভেসে ভেসে আসছে সবুজ ছেলেমেয়েরা
হাত জোড়া সোনার মতো ভুট্টো সেদ্ধ
কাপ কাপ চা ঢালতে থাকে ক্ষয়াটে এলিয়েন ...
কাছাকাছি পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত নেমে আসার আগে
তাকে কিছু টাকা পেতেই হবে
কিনতে হবে ঝড়ো আবেগ, বরফ মিথ্যে
আর জমাতে হবে জলছাপ মোহর কেবল নিজের জন্য ...
দশ
বসন্তের চলনে একটিই রাগ...পরকীয়া
মুহূর্ত ধুয়ে, নুয়ে জলপান
ধুলো গেলা, শ্লেষ ঢেলে ঢেলে স্নান
এ তোমার ইচ্ছে লোপাট, বেনামে নিজেকে খোঁজা, কালবৈশাখী তে তোমার বড়ো ভয় ...
এগারো
তুমি ভাবো এ তোমার বৈরাগ্য, বিষাদ হীনতা
ছবির পাহাড়ে এ তোমার আকুল মিথ্যে
দগ্ধ দিনে মাঠের শেষে যে কুটির
তার আশপাশের সব জল শুকিয়ে আছে
এক নবীন কন্যা আসছে ধীরে...ধীরে
তার অবাধ চরণ মেঘলালিত
বৈরাগ্য ধোবে না সে
নিরন্তর স্বপ্নবাহিত হয়ে... হয়ে
তার হৃদয় আজ অলকানন্দা ...
বারো
দীর্ঘ হয়ে জ্বলতে থাকা এক গ্রীষ্মতরুণী
ক্লান্ত হওয়ার জন্য এ জন্ম তার ছিল না
পিচের রাস্তায় বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে
পড়ে খই ঘাম
অসময়ের পদাবলীই তার অভ্যাস
এতটাই ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে তার যাপন
দূর, বহুদূর পর্যন্ত ফুটে নেই একটিও শান্ত, লঘু ঝড়...
তের
বৈশাখ কে পরিতৃপ্ত করে গেছে
মিথ্যে, স্থায়ী নিতান্তই ভেষজ এক বসন্তবাঁধ
জলাধারে এতো জল!
ডুবে যায় অনুরাগী জমিন
একটুখানি, আধচরণ বেলীগন্ধ
দূষনের মতো শিরায় এঁকে দিয়েছে
নিরাভরণ আকাশ, গোত্রহীন মেঘবালিকার শন চুল
এখন আর একটুও সময় নেই
বিদ্যুত পরিবাহী সব তার ছিঁড়ে আছে সদ্য কালবৈশাখীতে ...
থাক, থাক এই অন্ধকার
অন্ধকারে কতদিন দেখিনি দুজন দুজনকে ...
চৌদ্দ
বৈশাখ নিজেকে ভাবে সম্রাটের মতো
মনে করে এই গন্ধদহন, উষ্ণ কাঁচা শাল্মলী
এই রঙ পুড়ে যাওয়া ক্লান্ত চোখ, কেবলি তার
শাণিত অধিকার তবে থাক তোমারি রাজা !
আমি তো বহনে, গহনে ছুঁয়ে থাকা গ্রীষ্ম রাত...
ভাবতে পারো দেবী ! সূর্যমন্দিরে আজন্ম সহবাস
জেনে নিও, মেনে নিও,
শুধু কবিতার জন্য এই গমনাগমন...
পনেরো
বের হও, বের হও
এই শরীর সরোবর ছেড়ে
হংসপ্রলাপ, অবগুণ্ঠিত কারণবারি
ছাড়ো ছাড়ো সবই ...
রোদ আর রোদ
রোদে ঝলসে নাও গতজন্মের ঋতু...ঋতুক্ষরণ...
ষোল
সুমঙ্গলী গ্রীষ্ম...
পাখিরা বলে গেছে এখন অপেক্ষা শেষ
খরে ছাওয়া মৃদু ঘরে ডিমের বেঁচে থাকা ফুরিয়ে গেছে
চুপ করে আছে ব্রতকথা,
হাট থেকে ফিরে আসা বটফল
গ্রীষ্ম দিয়েছে উপবাসের সুখ
জামের রঙে ভিজে থাকা পার্বণের ছল, টানা দুপুর ...
সতেরো
মিশ্র গ্রীষ্ম এবারের মতো
ধনুক রূপ আর তোমার দেখিনি
দ্রিমি দ্রিমি মাদল বাজালে
ঘুমিয়ে গেলাম আমি
উড়ে উড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
বাতাসের টুকরো গছিয়ে দিলে লবনের পুতুলে
আর্দ্রতা আর জমে না কোথাও
গ্রীষ্ম রাত শুধু একটি কাটাকুটি ভরা নোটবুক...
আঠারো
এক এক করে জমবে ঘামফসল
সব রোদজ্বলা দুপুর তার সহজ যাত্রী
আমি তাদের সঙ্গী নই
আমার আয়নায় জলছোঁয়া মেয়ে রোদ
বিচূর্ণ ফুলসম্ভারে সাধিকা যাপন
উষ্ণতা ভিজিয়ে দেবে ওষ্ঠ কথকতা
প্রিয় চা গন্ধে ডুবে থাকা নতুন সময়ে
একটি উদাসীন মাল্যগ্রন্থি ...
যে নরম পলির মতো রঙ্ বসন্ত ফেলে গেছে
চিনে নেই, ছুঁয়ে দেখি
তুলে রাখবো ধুয়ে, শুকিয়ে...
গহন গভীর গ্রীষ্মে...
ঊনিশ
নিভে যাওয়ার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তুমি জ্বলতে চাও
আমি নিভে যাওয়ার একটু আগে সরে যাই
কিছু দহন জ্বলতে থাক, জ্বলতেই থাক ...
অশ্রান্ত গ্রীষ্ম এভাবেই তুমি আমার ...
0 মন্তব্য(গুলি):