দু বিন্দু শাপগ্রস্থতা, কবিতা গদ্য

১২:৫৯ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ

দু বিন্দু শাপগ্রস্থতা

কাল রাতে ঘুমোবার সময় সাত আটটা লাইন লিখেছিলাম, ঐ যাকে আমি কবিতা বলি, সেভ করে ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল বেলা যখন মোবাইল খুললাম, প্রথমেই হাত গেল সেই কচি কচি সদ্যজাত কয়েকটি লাইনের ওপর। প্রথমে একটি শব্দ বদলে দিলাম, তারপর আরেকটি, তারপর একটি লাইন, দুটো লাইন, তিনটে লাইন, আধঘন্টার মধ্যে সবকিছু বদলে গেলো। গতরাতের একটি অক্ষরও না। এখন যেটা হলো সেটা কি নির্মান। এইসমস্ত পংক্তি কি সত্যিই আমার, না কাল রাতে যেগুলো লিখেছিলাম সেগুলো আমার ছিল। এই বহতা দিনটি কি আমার?  না পেরিয়ে আসা সেই নির্জন অন্ধকারতম দীঘির ঘাটটি । কোনটি?
মনে হলো বিনির্মিত হয়ে যা এসেছে সেটাই সুন্দর। কিন্তু বন্যতা নেই।
কবিতা তো ঐ বন্য হরিণশিশুটি যে এক ফুট দূরে বসে ঝকঝকে ডোরা কাটা লাল হলুদ ব্যাঘ্রশিশুটিকে পরম কৌতূহলে দেখতে থাকে। বাঘের বাচ্চাটিও কাছে আসে, হরিণবালিকাটিও। আচমকা বিদ্যুৎ পতন হয়, দুজনে বড় হয়ে যায় এক মুহূর্তেই। হরিণ দৌড়ে পালায়, সামনে ঝর্ণা, ঝর্ণা পেরিয়ে পাহাড়, সেখানেই  তার বাড়ি, ফলের গাছ, অজস্র ছাতিম ফুল। ব্যাঘ্রশিশুটির সঙ্গে আর তার সারা জীবনেও দেখা হয় না। বাঘ বড়ো হয়, শিকার করা শেখে। হরিণের মাংস খুব প্রিয় তার। টক টক, গরম, নরম।
খাওয়ার পর হুংকার দেয়, হুংকারে জঙ্গল কেঁপে ওঠে। চোরা শিকারীর দল বন্দুক হাতে ছুটে আসে। তারপর কি হয়?

নাহ্ কবিতায় আর বলতে নেই। জন্ম, দহন, কাম, ক্ষুধা, মৃত্যুভয়। ব্যস্ এতটুকুই। কামড়ে ধরো কবিতার নরম চাদর।
জন্ম হোক তরুণতর কবির। সে আর কোনদিন খালি চোখে একা একা ঝড়, চাঁদ, নদী, পাহাড়, সমুদ্র, নারী, পুরুষ দেখবে না। সবকিছু দেখবে অক্ষরের চোখ দিয়ে। ঘোরের মত ।  পদাবলী গায়কের মতো। তার অন্তরে থাকবে গোপীভাব। পেশীতে যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারার ব্যর্থতা। চাটুকারিতার অন্তর্দহ। আলোকিত মঞ্চ ছেয়ে থাকা দুধঘাস, শারদসংখ্যা, বইমেলার অজস্র চোখে ঈর্ষা দেখতে চাওয়ার ব্যাকুলতা।
তরুণ কবি যাকে দেখতে ভালো লাগে  তাকে দেখে না, জলধারা পতন দেখে।
বৃক্ষ ফুলশোভিত হওয়ার মধুক্ষণ দেখে, শিশিরের মতন যে জীবন, কবিতার স্পর্শে আগুনের মতো জ্বলতে থাকে।
তখন ভেতর থেকে বলি আগুন নিভে যাক।
সংসারী হও। সুন্দর করে রান্না করো। নুন, হলুদ, লঙ্কা, তেল ঠিকঠাক। মুখের ভেতরের স্বাদকোরকগুলো বিস্ফারিত হোক। কবিতা গলা  থেকে , আঙুলের ডগা থেকে নেমে যাক, দুফোঁটা শান্তির জীবন দাও এই বেজন্মা আত্মাকে। ঘুমোতে দাও। ঘুমের ঘোরে বারান্দার রেলিং ভেঙে একান্ত অমাবস্যার এই আনাগোনা বন্ধ  হোক। চুরমার হোক চরাচরের বিষণ্ণতা। রাতের পাখিরা ঘর খুঁজে নিক।
মায়ের মৃত্যুর পর একবার ঊনকোটি গিয়েছিলাম, কয়েকবার দেখা ক্ষীণ ঝর্ণাধারা, নীচে সীতাকুণ্ড। সীতাকুন্ডের জলকে একটু ছুঁয়ে দেখলাম, ঝট করে মনে হল মায়ের মৃতহাত, ঠান্ডা। বহুদিন ঊনকোটি নিয়ে কিছু লাইন লেখার চেষ্টা করেছি। অনেকবার দেখা জিনিসকে নিয়ে কিছু লেখা যায় না।
আবছা করে আঘাত দিয়ে যায় যে মানুষ, যে বন্ধু, যে প্রেম, যে নদীর শরীর, দ্রুত চলে যাওয়া কোন স্টেশনের সাইনবোর্ড, এক ঝলকের জন্য দেখা কুটির প্রাঙ্গনে দড়িতে ঝোলানো হলুদ শাড়িটি অনেক বেশী কবিতাসূত্র দেয়।
যার কাঁধে মাথা, যার সঙ্গে মিশে আছি দিনরাত, কবিতা তাকে ভয় পায়।
চুপি চুপি ডাকে। বলে বাইরে আয়। বিরহী জোনাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে আলো জ্বেলে, কি অভিশাপ তার বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন দেখলি, তারপর আরো কাছে আসে, ফিসফিস করে বলে দেখ্,

"মাইমুখ তলে রাসবালিকা, রত্নবিধুরা পলয় গোধূলি
রাজনিয়ম তুলহ কন্যা, কন্ঠে এনে বলিছ  আজো
মানি নি, মানি নি, মানবো না ।”

বলে , আত্মগত হও।
অজস্র কবিতার টুকরো মাথায় ঘুরতে থাকে। এইসব টুকরোগুলো বিখ্যাত। তারা বাংলাকবিতার রূপক, পরিচয়, বাহক। ঐ মুহূর্তটি কেমন ছিল, যখন কবি সেইসব পংক্তিমালা লিখতে পেরেছিলেন। আকাশে কি তখন এক হাজার শঙ্খচিল উড়েছিল, পৃথিবী কি সন্ধ্যা নামার আগে চুপ করে দুদন্ড  সময় দিয়েছিলেন কবিকে, নদীর বুকে কি ঠিক সেইসময় সারি সারি নৌকা যাচ্ছিল রূপকথার দেশে। যাদের সাদা সাদা পালগুলো বাতাসে এমনভাবে ফুলে উঠেছিল যে মনে হচ্ছিল গর্ভবতী অহংকারী নারীর দল !
এই অপরূপ প্রকৃতি তখন কবিকে বলছিল নিত্য প্রসবিনী হও …

আমি বসে আছি, কাণের পাশের চুল সরাচ্ছি, টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা আছে সাদা কাগজ। হাত চালালেই হলুদ অসুখে ভরা অক্ষর নেমে আসবে। নেড়েচেড়ে ভাবি স্কেচ আঁকবো অনুভবের। জটিল বাঁকানো শরীরের রেখা বলে দেবে ধুলো উড়েছিল। অবিশ্বাসী চোখ না দেখে বুনে গেছে পোকামাকড়ের বাসভূমি ।

কবিতা হয়তো এভাবেই আসে ধুলো উড়িয়ে, গোধূলিআক্রান্ত জাহ্নবীর রঙ মেখে, বড়ো শুদ্ধ সে, মন থেকে সোনা বের করে আনে।

এরকমই হঠাৎ খুব  পরিচিত ঊণকোটির ভাস্কর্যের কাছে এসে মনে হল,

"ঊণকোটিকে নিয়ে বেশী কিছু বলতে পারি না,
এ ভূমি শিল্পীর খেয়ালে রচিত, রাজাদেশে নয়। "

তারপর আমার দিকে ছুটে আসে দিগন্তরেখা, বলে পৃথিবীর শেষ এখানে, কি চাও বলো,  স্বর্গ, সুখ অনন্ত, তৃষ্ণা নেই!

দুহাতে ঠেলে ঠেলে দিগন্তরেখা সরিয়ে দিই। আবার স্পষ্ট হয় কাদাজল, ধানক্ষেত, কচুপাতা, লাউডগা সাপ, নেরী কুকুর, পলা পরা রোগা হাত, এই হাতটি কবিতার,  হাতটি সেই মেয়ের যে কোনদিন চিবুকে জ্যোৎস্না গুছিয়ে রাখতে শেখেনি।
ভেঙে ভেঙে  মহাজাগতিক কণা হতে চায়। তারপর  ঘনীভূতকরণ, সঠিক বিক্রিয়ায় তার চাই বিস্ফোরণের নির্ভুল ক্ষমতা।
তারপর হাসি আসে। সত্যিই কি কবিতা লিখতে এতো কিছু লাগে ! একটি আসা এবং ফিরে যাওয়ার মধ্যেই তো এককোটি কবিতা। যা এখনো লিখে শেষ করতে পারেনি পৃথিবীর কোন কবি।

আবার আজ সকালের ঘটনায় আসি,  খুব চেষ্টা করলাম, যাকে বলে মেধাবী এবং সিরিয়াস চেষ্টা।
কিন্তু কাল রাতে লেখা  মুছে যাওয়া সেইসব লাইনগুলোকে মনে করতে পারি না। অথচ তারা অশ্বারোহী। মালভূমির পর মালভূমি পেরিয়ে যাচ্ছে। সরাইখানা, লাস্যমন্ডপ, ভগবানের দুয়ার কোথাও থামছে না। ভেতরের কবি যেদিন মরবে সেদিন লাফাতে লাফাতে আমার আগে তারা চিতায় উঠবে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকবো আকাশের দিকে তাকিয়ে। হেমন্তের গৃহমুখী শেষ বৃষ্টিপাতের জন্য। দু ফোঁটা জল ঠোঁটে পরবে। অভিশাপ শেষ হবে আমার। কবিতাগ্রস্থতার অভিশাপ।
খেয়ে নিয়েছে জীবন বাকি, পুননির্মানের ঘরে মুঠো মুঠো বালি দিয়েছে। দশ মিনিটে ধসে গেছে একটি পর একটি ঘর।

0 মন্তব্য(গুলি):