চারটি কবিতা ও তাদের জন্মদাগ
চিরশ্রী দেবনাথ, চারটি কবিতা ও তাদের জন্মদাগ
মধুর হননে
................
তবে একটি মুহূর্তের জন্ম হোক
আত্মহনন নয় শুধু হননসময়
... সবকথা লিখে ফেলার পর দীর্ঘ নিঃসঙ্গতা, অনিয়মকাল, ডিপ্রেশনের অন্ধকার।
ট্রেন থেকে দেখা দূর জনপদের সন্ধ্যার হাট,
মৌচাকের জীবন লাগা বিন্দু বিন্দু আলো,
পঞ্চায়েত রাজনীতির হুল লাগানো প্রবল বেঁঁচে থাকা,
এখান থেকে মধু আসে, মোটরবাইকের হর্ণ, উদ্ধত চোয়াল আর যাযাবর হৃদয়ের তাবৎ উশৃঙ্খলতা
রাত্রিলাগা তরমুজের ক্ষেতে জেগে ওঠে একটি আলো ঘর ,
চিনেবাদামের খোলসটির দিকে চোখ পড়ে
দুটো বাদামচিহ্ন ... সুনিশ্চিত প্রত্যাবর্তন, একটুও অসুখ হয়নি তাদের কোথাও,
যেন বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছে জোনাকির দল, শিশুরা মাঝখানে।
কবিতাটির জন্মদাগ
কবিতাটির জন্ম স্টেটব্যাঙ্কে বসে থাকা কিছুক্ষণ সময়কে মনে করে। বসে আছি, টোকেন জমা দিয়েছি।
এক যুবক এলো। ঘামে, তেলে উগ্র । কড়া জিন্স, সানগ্লাস। কর্কশ গলার স্বর। বিষয় লোন। কথাবার্তায় বুঝলাম, কাছাকাছি কোন গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে এসেছেন। আরেকজন যুবকও সাথে। বিভিন্ন রেষারেষি, পোলট্রি, ফিসারী, রাবার বাগান এবং কোন একটি মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ, পণ ইত্যাদি নিয়ে ধুরন্ধর আলোচনা চলল, মুখের অভিব্যক্তিতে সন্ধি ও শত্রুতার দহনঢালা তীব্র জীবন। কোন দার্শনিকতার স্থান নেই। একটুও কবিতা নেই।
আমার ডাক এলো, কাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে একটি লাল বাইক দেখলাম। ধরে নিলাম এটি তারই। আমার কানে বাজতে লাগলো অস্থির হর্ণ। নিজেকে মনে হলো ট্রেনে। ট্রেনে উঠলেই কেমন যেন দার্শনিকতা গ্রাস করে। মনে হয় দূর থেকে দেখছি বাকি সব, আমি দর্শক শুধু। খর দুপুুুরে সন্ধ্যা হলো হৃদয়ে। গ্রামের হাট। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা অনেক দূরে বাল্বের মিটমিটে আলো। লাল ধুলো ওঠা রাস্তা। গ্রামের পাশে শুয়ে থাকা তরমুজের ক্ষেত, জোনাকি জ্বলছে ... এইসমস্ত কিছু মনে জেগে রইলো, অনেকদিন পর এই কবিতা, চিনেবাদামের খোসায় এক নিশ্চিন্ত প্রত্যাবর্তন, জীবনের নিশি ডাক।
ব্যক্তিগত কলাম
.....................
একজন শঠ বসেছে সত্য কথা লিখবে বলে
তার কলম বন্ধ হলো না, ঘাম জাগলো না
পাতার পর পাতা লিখে গেলো শঠতার বর্ণনা
হিমভেজা দিন পেরিয়ে গভীর গরমকাল এলো
দিনে দিনে দাঁড়ি, গোঁফ, হৃদয় ভরে আশকারা জমলো
পিঁপড়ের দল ভিড় করে দেখছে তাকে, কবে লেখা শেষ হবে
অথচ পৃথিবী সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে,
জ্বলে উঠছে সার সার এলি ডি লাইট, শোকচিহ্ন মহাকাশের
অবশেষে সশব্দ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সব লাইন
একটি একটি বহুতলের পাজরে পাজরে
আশ্চর্য ! সে কী শুনছে না?
নাকি তার শুনলেও কিছু এসে যায় না
এতোটাই মৃত্যুবাঁশি অগোচরে বেজে উঠছে শুধু
কবিতাটির জন্মদাগ
ছোটবেলায় মাঝে মাঝে ডাইরী লিখতাম। কিছুই লেখা হতো না তাতে। কি করলাম, কি খেলাম এইসব টুকিটাকি। ভেতরে যা মনে হতো তা কিছুই লিখতাম না, যদি মা পড়ে ফেলে, বা অন্য কেউ, কি হবে, কি ভাববে ইত্যাদি। এই লেখা না
হওয়া বাক্যবন্ধ, শব্দগুলো আমার মধ্যে ঘুরতে লাগলো। চাপা খেতে খেতে তারা আরো প্রবল হলো দিনে দিনে। কি হয় তাতে ? পৃথিবীর বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ ডাইরী লেখে না। কিন্তু বাদবাকি মানুষগুলো তো লেখে। গা ঢাকা দিয়ে লিখে, একদম সত্যি কেউ লেখে না। কাকে মনে মনে কত গালাগাল দিলাম, কাকে অঝোরে ভালোবাসলাম, কার প্রতি আগ্নেয়গিরির মতো রাগ উঠেছিল। কাকে চরম অশ্রদ্ধা করি, কেবলি ক্ষোভ মনের ঢাল বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তার প্রতি।
নিম্ন মধ্যবিত্ত মানসিকতায় এসব লেখা যায় না। তাই মনে হয় শঠ হয়ে যাচ্ছি দীর্ঘ দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে। মরে গেলে আমি আমার সমস্ত নিয়ে মরবো। তুচ্ছতর সবকিছু। তবুুুও ভয়ের তীব্র অম্লস্বাদ প্রতি শ্বাসে বয়ে বেড়াই। কেন নির্বিকার হওয়া যায় না !
পৃথিবীর সেই মানুষটি একদিন নির্বিকার হয়েছিল, লিখেছিল পাতার পর পাতা, মৃত্যুদ্রষ্টা হলেই বোধহয় এমন হওয়া যায়।
এটাই ভাবনা, এটাই কবিতাটির ছল।
সমাপতন
বিকেলের রাস্তায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে কত আয়না জেগে উঠেছে
...দেখছি।
এইমাত্র একটি মেয়ে তাতেই মুখ দেখে চুল ঠিক করলো
আর তক্ষুণি একটি গাড়ি এলো, দুর্বার চাকা, আয়নাটি গেলো ভেঙে
....আহা, কি ধ্বংসনিনাদ বাজলো আমার
শুনছো কি মেয়ে? এই মেয়ে ! সমাপতন জানলে না তুমি !
কবিতাটির জন্মদাগ
একটি ধূসর বিকেল। মেধাবী। ধূসর মাত্রই মেধাবী। জটিলতার অমসৃণ কারুকাজ তাকে শুধু অস্পষ্ট করে। তার ওপর বর্ষার আসা যাওয়া। ছাই বর্ণের প্রসাধন।
বৃষ্টির দাগ মেখে মন খারাপ করে বসে থাকা। এসব সময়ে সূর্য থেকে যে রঙ ছড়ায়, সারাদিনের সংঘাত তাতে গলে গলে পড়ে, মানুষের মেধার আর পরিশ্রমের, তারপর ফিরে আসে ভালোবাসার ধূূূসর আবহ। পাখিরা ঘরে ফেরে। তরুণীরা উজ্জ্বল পোশাক পরে বিকেল দেখতে বেরোয়। মফঃস্বলের রাস্তা। পিচ একটু ভেঙেছে কোথাও, তাতেই আকাশ ঢেলেছে কয়েক গ্লাস জল। সেখানে একটি নিটোল অজুুুুহাত, নিজেকে দেখার। দু এক কুচি চুুুল সরাবে এদিক
ওদিক, কয়েক দাগ পড়ন্ত সূর্যরশ্মি তার গালের পাশে লেগে থাকবে অস্থির হয়ে। দেখা শেষ হল। আমার আর সেই বিকেলদেখা মেয়েটির। একটি গাড়ি । ঝকাস্ ঝকাস্ জল ছড়ালো। দুরন্ত চাকা আয়নাটি দিল ভেঙে , মুখর ছবিটি ব্যথার মতো ছড়িয়ে গেলো। আহা ! সদ্য পুুুুকুর বোজানো, আধাশহরের পাড়ায় এখনও তরুণেরা ফুটবল খেলে। তরুণীদের দেখে। হইহই করে। নিভৃত হৃদয়টির একটি কোণ ভেঙে ত্রিভুজ পেতে রাখে রাস্তায়। আর এসবই আমি ভাবছিলাম শুধু ... একটি ছোট্ট ঘরের জানলায় বসে।
সেখান থেকেই এই সাধারণ কয়টি লাইন।
ডাহুকদের কথা
একটি ঘাট সূর্যের আলো পড়ে দু ফাঁক হয়ে গেছে,
গল্প করছে দুই কুমারী
তাদের প্রেমের গল্প ভাগ করে নিচ্ছে একলাটি সেই পুকুর
দূর থেকে এ দৃশ্য দেখবো বলে মাঝে মাঝে দুপুরের পর বিকেলের আগে বেরোতে ইচ্ছে করে
তারপর প্রতিদিনই মেঘ করে আকাশ, আমি ভেতরে ফিরে যাই, জল টলমল, গল্প ভাঙছে শব্দ পাই।
কবিতাটির জন্মদাগ
শান্ত পুকুর আছে, ঘাট আছে, দুজন তরুণী, তাদের প্রেমের গল্প এবং একটি ক্ষয়লাগা দুপুর আছে। কিন্তু এই লাইন কটি এসব কোনকিছু থেকেই মনে আসে নি।
খুব সকালবেলা উঠেছিলাম সেদিন। গ্রীল খুলে বাইরে বেরুলাম। বাড়ির ছোট্ট পুকুরটির ঘাটে দুজন ডাহুক।
সূর্য তখন সবে স্পর্শ করছে পাতার মুখ। মৃদু স্বরে পাখি দুটো ডাকাডাকি করছে। আসলে গল্প। শিকারের নয়, ভালোবাসার। এই স্তব্ধ সকালের আয়েশ যৌথভাবে মেখে নিচ্ছে দুজনা।
যদিও ধরে নিয়েছি তারা স্ত্রী পুরুষ, কিন্তু লাইনগুলোতে দুজন তরুণীর কথাই মনে হয়েছে। যেন শরৎকাল। মা আসছেন। একটি মেয়ে হলুদ আরেকটি মেয়ে কচুপাতা রঙের এর শাড়ি পরে পরম নিশ্চিন্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে তাদের কুমারী জীবনের
টক ঝাল মিষ্টি।
জল বয়ে নিয়ে যায় কথার টুকরো গভীরে আরো গভীরে। অবলীলায় সেইসব যাবতীয় কথা আমার হয়ে যায়। ভেতরে একটি ভাঙনের শব্দ শুনতে পাই। কিশোরীকালের দুর্বল বাঁধ। তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ রোদ। অজস্র অজস্র তুচ্ছ সুখবাহার।
0 মন্তব্য(গুলি):