লাটাইের মা ও স্বাধীনতা দিবস।

১২:৩৩ AM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

রঙমশাল বস্তিতে স্বাধীনতা দিবসঅনুষ্ঠানের দায়িত্বে লাটাইের মা। এরকম আর্টিস্টিক নামের বস্তি  খুঁজে পাওয়া বোধহয় বেশ কঠিন।  আধা শহর এই  জায়গাটিতে একটি খাল আছে, এটি খালপাড় নামেই সবাই চিনত টিনত, একটি বটগাছ, শিব মন্দির এবং আশেপাশে নীচু মাঠ  নিয়ে অনেকখানি জায়গা। একখান উঁচু পাথর আছে খালপাড়ে, আশেপাশে আরো ছোট, বড় কয়েকটি, হলো  কিছু ছেলে ছোকরাদের আড্ডার জায়গা, এখানে এলে মনে বেশ দার্শনিক ভাবের উদয় হয়, শুধু মনে হয় আহা জীবন  প্রেম ইত্যাদি! তাই কবি কবি ভাবের ছেলেরা খাতায় কিসব লেখে, আর যে উলুঝুলু চুলের কিছু ছেলে থাকে যাদের চোখ দেখলে মনে হয় তারা তোমায় নয়, তোমার ভেতরের গাছ, পাথর, আকাশ, পাহাড়নদী সব দেখে নিচ্ছে তারা ছবি আঁকে। 
লোকে বলে বখে যাওয়াদের আড্ডা।  বছরখানেক আগে কোথা থেকে দুটো পরিবার এখানে ঘর বাঁধে, তারপর আরোও কয়েকটি, এভাবে যখন উনুনের ধোঁয়া বাড়তেই লাগলো, অন্যদের চোখ জ্বালা করা শুরু হলো,   উৎখাতের প্ল্যান  হতে লাগলো, কিন্তু তখন এইসব কাজ নাই তো খই ভাঁজ কবি শিল্পীরা কি করলো কে জানে, কোথায় কোথায় ডেপুটেশন ইত্যাদি ইত্যাদিআর তার শেষ ফল হলো এই মানুষগুলোর ঠিকানা প্রাপ্তি এবং কবি আর শিল্পীরা মিলে নাম দিলো রঙমশাল ",বস্তির লোকগুলো জানে ছবি আঁকতে রঙ লাগে তাই আধা নাম বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু মশাল কেন, তখন নেপোর বউ লাটাইের মা উপরে তাকিয়ে প্রণাম করে বলল কবিরা হলো গে ভগবানের দূত আর তাই তারা মশাল জ্বালিয়ে ভক্তদের রক্ষা করে, ঠিকানা পাওয়ার এই অগাধ সুখটুকুর জন্য লাটাইের মার কবি ভক্তি অসাধারণ। বটগাছের সঙ্গে  একটি সুন্দর সাইনবোর্ড "রঙমশালবাসী গণ " আজকে রঙমশালে প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে, আইডিয়া ছেলে ছোকরাদের, লাটাইের মা স্বঘোষিত লিডার। একটা অনুষ্ঠান হবে, সবাই যে যা পারে করবে, লাটাই এর দিদি বুল্টী টেনে পড়ে, পাবলিক স্কুলে, গান শুনে শুনে বেশ গাইতে পারে, সে গাইবে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, লাটাই টুতে পড়ে, ব্যা ব্যা ব্ল্যাক সিপ ছড়া বলবে, এক্ষেত্রে বুল্টী তাকে গম্ভীর ভাষন দিয়েছিল, ইংরেজ শাসন থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি এইদিনে ইত্যাদি, এটা বলিস না, তবে লাটাই স্পষ্টবাদী ছেলে,   সে এটাই বলবে। একজন ছোকরা বলল অনুষ্ঠানটি হবে একদম অকৃত্রিম, যার যেরকম খুশী ...।লাটাইের মা চার বাড়ীতে কাজ করে। আজ   ছুটি নিয়েছে। তার একটি তাঁতের শাড়ি আছে।  আর লাটাইের বাবার একটি সাদা পাঞ্জাবি। দুটোই  বেশ পুরোনো। লাটাই মা দুটোতেই খুব শক্ত করে ময়দার কলপ দিয়ে, ইস্ত্রি করে এনেছে মোড়ের মাথার দোকান থেকে। এবার শাড়ি পরতে তার খুব অসুবিধে হচ্ছে, যারপরনাই ফুলে রয়েছে শাড়ি। যাহোক। লুঙ্গীর ওপর লাটাইের বাবাকে পাঞ্জাবি পড়ানো হয়েছে। নেপো ভীষণ বিরক্ত। খুব খোঁচাচ্ছে পাঞ্জাবিটা। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে লাটাইদের বাড়িতে। ওনলি খিচুড়ি। আর কিছু যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। সামনের শনি মন্দির থেকে লাটাইের মা একটু চন্দন বেঁটে এনে সবার কপালে লাগিয়ে দিলো, নেপো  বলল এতো বেশ কীর্ত্তন কীর্ত্তন লাগছে। লাটাই মা ঝামটা দিয়ে  বলল এতো পূজোই ..দেশের পূজো, বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে, কড়কড়ে তাঁতের শাড়িতে হঠাৎ নিজের বউকে একটু অচেনা লাগলো বটে! পতাকা উঠলো, জনগণ মন গাওয়া হলো, এক কবি বেশ খানিকটা বক্তৃতা দিলো, ছড়া গান সব চলতে লাগলো, শুধু নেপোর গলা শুকিয়ে কাঠ, সকাল থেকে একটুও ধোঁয়া ছাড়া যাচ্ছে না।তাই চুপি চুপি সে বেরিয়ে  যাচ্ছে, যেতে যেতে শুনছে লাটাইের মাকে সবাই কিছু করতে বলছে। লাটাইের মা একটু মুশকিলে পড়লেও,দেখা গেলো বেশ স্মার্ট, তার মনে হলো সে আগে এক মেসে রান্না করতোসেখানে প্রতিদিন একটি গান বাজবেই ....".বারান্দায় রোদ্দুর,আমি আরাম কেদারায় বসে দু পা নাচাই রে "শুনতে শুনতে তার শেখা হয়ে গিয়েছিল , গানটাই লাটাইের মা গাইতে আরম্ভ করলো। শিবমন্দিরের পেছনে নেপো এলো, এসে দেখে তার মেয়ে প্রেম করছে, মানে সবচাইতে হারগিলে, চোখে মোটা চশমাওয়ালা ছোকরাটি কিসব হাবিজাবি পড়ে শোনাচ্ছে, বুল্টী ছলছলে চোখে শুনছে। তখন নেপো যা ভাবল, তা তার ভাষায় ট্রেনশ্লেট করলে দাঁড়ায় "ইতা ওইলো হুদ্দামিছা কস্ট পাওোইন্যা পীড়িত, হারা জীবন দইরা খুঁচাইবো "তবু কেনো জানি নেপো অন্য পাশে গেলো, এখান থেকে খালটা দেখা যায় খুব সুন্দর আর রাস্তার পাশে নেপোর টং দোকানটাও। আজ বন্ধ। পাঞ্জাবির পকেট থেকে নেপো একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলো, আজকের বিশেষ দিনের জন্য, বিড়ির বদলে সিগারেট।  এবার পাঞ্জাবি টা খুলে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলো, বাপরে বাপ যা খোঁচাচ্ছিল। আয়েশ করে সিগারেট ধরিয়ে টান দিলো।  খালপাড়ের হাওয়ায় স্বাধীনতা দিবসের সাদা পাঞ্জাবিটা দুলতে লাগলো......

© চিরশ্রী দেবনাথ

0 মন্তব্য(গুলি):