ছিটমহল

৫:১৯ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

একুশে জৈষ্ঠ্য, পাঁচ জুন, দুইহাজার পনেরো।

.......চিরশ্রী দেবনাথ।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসছে ছোট্ট একটি ভূখেন্ডর বুকে  নাম তার লতামারী।
লতামারী? এ আবার কোন দেশে? নাহ্ সে
কোন দেশেরই নয় সে ছিটমহলের। প্রায় শতায়ু এক বৃদ্ধ বসে আছে মাটির দাওয়ায়।
তার ছেলেরা ক্ষেত থেকে ফিরে আসছে। গোয়ালঘরে গরু বাঁধছে। ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক সেইসঙ্গে বৃদ্ধের পূএবধূ তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে উদ্বিগ্নমুখে বৃদ্ধের পাশে এসে দাঁড়ালো, গমগমে গলায় বৃদ্ধ বলল বসো আমার পাশে, চিন্তা করো না ভগবান আছেন, বধূটির কন্যা সন্তানসম্ভবা, সে শুধু বলল বাবা আমাদের কেন কিছু নেই? বৃদ্ধ হেসে বলল এসো তোমাকে আজ গল্প বলি, .......সে অনেকআগে মোগলসম্রাট সাজাহাঁন আর তখনের কোচবিহারের রাজা প্রতাপনারায়নের সঙ্গে বার কয়েক যুদ্ধে আদান প্রদান হয়েছিল  ছোট ছোট গ্রামের,পরবর্তী রাজাদের আমলেও  কখনোও শিকারের প্রতিযোগিতায় কখনো ও বা নিছকই পাশাখেলায়, বাজি রাখা হতো এই ছোট ছোট ভূখন্ডগুলোর,  সাদা কাগজের ছিটে লেখা থাকতো জায়গা গুলোর নাম, হয়তো বা সেই থেকে জায়গাগুলোর নাম ছিটমহল। মানুষগুলো জানতোও না তাদের ঠিকানা বদল হবার কাহিনী। আসলে এ হলো একদেশের কিছুজায়গা অন্য দেশের মধ্যে ঢুকে যাওয়া।
সমস্যা র সৃষ্টি হয় সাতচল্লিশে, ব্রিটিশ তো দেশ ভাগ করে দিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু এ সমস্যার কোন সমাধান করলো না, আর কোচবিহারের তৎকালীন মহারাজাও চাইলেন স্বায়ত্তশাসন। পরবর্তীতে  রেডক্লিফ সাহেবের নেতৃত্বে রেডক্লিফ মিশন। না ..হলো না সমাধান। ভারতের  এরকম একশো একান্নটি ছিটমহল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে যার আয়তন প্রায় সতেরো হাজার একশো আটান্ন  একর এবং একান্নটি ছিটমহল যার আয়তন নয় হাজার একশো দশ একর ভারতে আছে। এরই একটির বাসিন্দা আমরা। ঊনিশোচুয়াওরে ইন্দিরা মুজিব চুক্তি, ঊণিশোবিরানব্বইে তেভাগা ভূমিখন্ডের ব্যবহার করতে দেওয়া, দুহাজার
এগারো সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহনসিং এর সঙ্গে বৈঠক, আবার চোদ্দ তে ভারতের সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী র বৈঠক সবমিলিয়ে প্রায় দুইশো সতেরটা বৈঠক হয়েছে। শেষপর্যন্ত দুইহাজার পনেরোর মে তে ভারতের পার্লামেন্টে পাশ হলো স্হলসীমান্ত আইন। মাঝে ঘোর অনিশ্চয়তায় কেটে গেলো  সাতষট্টি বছর ধরে প্রায় দেরলক্ষ মানুষের জীবন। তাই তো রে মা আমাদের ভুল পিতার নাম দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, মৃত্যুপথযাএী রোগী কেও ছিটের বাসিন্দা বলে
হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নাম আছে, কিন্তু কখনও আমাদের নামে কোন চিঠি আসে না। বিশাল স্হল সমুদ্রে আমরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় শুধুই ভেসে চলেছি, কোন বন্দর নেই আমাদের। আগামীকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসবেন বাংলাদেশে, চুরান্ত হবে স্হলসীমান্ত চুক্তি।
তন্ময় হয়ে বধূটি শুনছিলো শ্বশুরমশাইের কথা, হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে খবর এলো মেয়ের প্রসবব্যাথা উঠেছে, ধাএীকে খবর দেওয়া হলো। অবশেষে রাএি প্রায় শেষে পূর্ব আকাশে যখন সবেমাত্র নূতন ভোর,জন্ম হলো একটি শিশু কন্যার। বৃদ্ধ বললেন নিয়ে এসো এ শিশুকে বাইরে, সকালের আলো য় তিন প্রজন্ম একসঙ্গে দাঁড়াই, এ মেয়ের নাম হোক মৈত্রী ঘর থেকে অর্ধঅচেতন মা কল্পনায় দেখতে পায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে মৈএী স্কুলে যাচ্ছে, প্রার্থনার লাইনে সেও গাইছে তার নিজের দেশের জাতীয় সঙ্গীত।

.....আজন্ম উদ্বাস্তু মানুষ আজন্ম ঠিকানালোভী। ঠিকানার গ্রন্হি সে তুলে দিতে চায় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে কিন্তু সেই গ্রন্থি র রাশ যে থেকে যায় রাষ্ট্রের হাতে,তাই রাষ্ট্রনেতারা আপনারা কি পারলেন না আর একটু দ্রুত হতে, সমস্যা সমাধানে আর একটু আন্তরিক হতে, তাহলে আরোও অনেক আগেই ছিটমহলের নরনারী পেতো একটি নিজের দেশ, এই পৃথিবীর বুকে শিশিরভেজা, বৃষ্টি ধোওয়া একটি নিজের উঠোন, সন্ধ্যার কীর্ত্তন আর মসজিদের আজান মিলেমিশে একটি আপন পরিচয়।

0 মন্তব্য(গুলি):