গোল্ডেন ডাক

৮:৫৬ AM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

 চিরশ্রী দেবনাথ

গোল্ডেন ডাক 

অজিতেশ দেব বড়ো বুদ্ধিমান মানুষ এবং ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা। অবশ্য বুদ্ধিমান হলেই ক্রিকেট প্রিয় খেলা হবে এমন কোন কথা নেই, কিন্তু অজিতেশ বাবু যখন থেকে ক্রিকেট খেলা দেখছেন তখন থেকে মনে হয়েছে, জীবন একটি ক্রিকেট খেলার মাঠ এবং তিনি একজন উইকেট কিপার। ব্যাটসম্যান বা বোলার না হয়ে উইকেট কিপার কেন সেটারও একটি কারণ আছে, তার মতে উইকেট কিপারই, টিমের প্রধান রক্ষক, তার সতর্কতা এবং পারদর্শিতা টিমকে টিকিয়ে রাখে, টিম অর্থে এখানে তার পরিবার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিয়মকানুনকে তুড়ি মেরে তার চারখানা ছেলেমেয়ে। দুজন পুত্র এবং দুজন কন্যা ও একজন সুন্দরী, রন্ধনশিল্পে নিপুণা, পরচর্চা ও পরনিন্দায় পারঙ্গম পত্নী নিয়ে তার ছয়জনের টিম। আয়কর দপ্তরের অফিসার হওয়ার এতজন সদস্য নিয়েও তিনি দারুণ বুদ্ধিমত্তায় সচ্ছলভাবে সংসার পরিচালনা করেন। দুই কন্যাকে উচ্চশিক্ষার পরপরই, তার দপ্তরে সদ্য চাকুরিপ্রাপ্ত দুজন তরুন অফিসারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন এ হলো তার টিমের দুটো শ্রেষ্ঠ ওভার বাউন্ডারী। 

অবসর নিয়েছেন। এখন  নিজেকে ভাবছেন ওপেনার ব্যাটসম্যান। সারা জীবন ঘর রক্ষা করেছেন, এবার রান তুলবেন, সোনালী ফসলে গোলা ভরবেন, আর হাততালি কুড়োবেন।  

ছেলেরা একজন ডাক্তার এবং একজন প্রোফেসর। প্রোফেসর হয়েছে ছোট ছেলে এবং সে বিয়ে করেছে সদ্য। অজিতেশ বাবুর স্ত্রী অনুপ্রভা দেবী বিস্তর আপত্তি জানিয়েছিলেন, কারণ পাত্রী পুত্রের স্বনির্বাচিত, সুন্দরী কোনভাবেই বলা যায় না, কালো, মোটা এবং কর্কশ কন্ঠ, শুধু বিদ্যেধরী, পি এইচ ডি করেও আবার পড়ছে, ছেলের চাইতেও বেশী পড়াশুনো, একই কলেজে চাকরী করে তারা। এক্ষেত্রে অজিতেশবাবু স্ত্রীর তীক্ষ্ণ বোলিং এর জন্য  এল বি ডাব্লিউ হলেন।  ছোট ছেলে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানের মতো ছক্কা হাঁকালো  এবং বিয়ে করে বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেলো । দূরদর্শী কোচের মতো তিনি স্ত্রীকে লুকিয়ে ছোট ছেলের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন এবং বুঝেছেন, বউমার মতো গুণী মেয়ে পাওয়া দুর্লভ, যেমন সুন্দর ব্যবহার তেমনি সংসারী, শুধু তার স্ত্রী প্রথম থেকেই এতো বিরোধিতা করেছে যে, ওদের বড়ো আত্মসম্মানে লেগেছে। তাই আলাদা। অথচ এই বউ বাড়িতে থাকলে লক্ষ্মী এবং লক্ষ্মীশ্রী দুটোই বজায় থাকতো। এতো টাকা বেতন, সংসারে সুসার দিতো, কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। তবুও তিনি ছোট ছেলের আশা একেবারে ছাড়েননি, বয়স হচ্ছে, আস্তে আস্তে ছেলেদের ওপর নির্ভর করতে হবে, এখন খামোখা এতো রাগ দেখালে চলে  ! 

আজ সকালে অজিতেশবাবু চা খাচ্ছেন, গভীর চিন্তামগ্ন, বড়ো ছেলের ব্যাপারে। চাকরী করছে ডাক্তারীর। প্রচুর মেয়ের বাবারা   রীতিমতো পেছনে লেগে আছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। বড়ছেলের বিয়ের সাকসেসফুল মিশনে অনুপ্রভা দেবীই প্রধান  নির্বাচক।   অজিতেশ বাবু বাধ্য হয়ে মিডল অর্ডারে আছেন  আপাতত।  প্রতিদিন বেশ কয়েকটি করে মেয়ের ছবি দেখা হচ্ছে এবং বাতিল করা হচ্ছে। দিনরাত ফোন আসছে ডাক্তারের মার কাছে এবং নির্বাচকের কঠোর মনোভাবের কারণে কোন অলরাউন্ডার কন্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

এভাবে প্রায় একমাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে অজিতেশ বাবুর মোবাইলে টুং করে মেসেজ এলো। ইদানীং ঘুম ভালো না হওয়ায় তিনি আধা জাগ্রতই ছিলেন।  বড়ছেলে পাশের ঘর থেকে মেসেজ করেছে, "বাবা একটু এ ঘরে এসো, জরুরী কথা আছে, মা যাতে কোনমতেই না জাগে ", ওহ্ এই না হলে ডিজিটাল ইন্ডিয়া। অতএব অজিতেশ বাবু উঠলেন এবং পা টিপে টিপে বড়ো ছেলের ঘরে এলেন। ছেলে ল্যাপটপ খুলে বসে আছে এবং সেখানে এক উচ্ছল জিনস পরিহিতা বয়কাট চুলের ভারী লেন্সের চশমা পরা তরুণীর ছবি। অজিতেশ বাবু যা বোঝার বুঝে গেলেন, বুঝলেন তাকে এখন পিচে টিকে থাকতে হবে, শুধু  টুক টুক রান তোলা, নো বাউন্ডারী, নো ওভার বাউন্ডারী, কোন রিস্ক নেওয়া চলবে না।  আস্তে আস্তে ম্যাচকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনতে হবে। এই কন্যাটি আবার পাঞ্জাবী, বড়ো ছেলের সঙ্গে দিল্লীতে একই হসপিটালে ইন্টারশিপ  করেছে, তখন থেকেই "বোল্লে বোল্লে ",  অজিতেশবাবু চোখ বন্ধ করে দম নিলেন,  তিনি বড়ো ছেলেকে কিছু বলবেন না,খুব বাধ্য ছেলে তার, দারুণ ছবি আঁকতো, গান করতো ,কিন্তু সবকিছুর শখ  ছেড়ে  সারা জীবন বাবার কথা শুনে ঘাড় গুঁজে পড়াশুনো করে ডাক্তার হয়েছে, একটু প্রেম ট্রেম তো করতেই পারে, মেয়েটিও  ডাক্তার, তায় আবার পাঞ্জাবী, তিনি নিজে কপিল দেব রামপাল নিখাঞ্জকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করেন।  এখন অবশ্য  শচীন ভাবছেন নিজেকে , সামনে শ্যেন ওয়ার্নে হলেও কুছ পরোয়া নেহী।  তবে নির্ভুল  ছক সাজাতে হবে ।  মেয়ের বাবার  ফোন নাম্বার নিয়ে, কথা বলে নিলেন, বুঝলেন মেয়ের বাবাও একজন রানার্স টিমের ক্যাপটেন ।

অনুপ্রভা দেবী দীর্ঘদিন ধরে নার্ভের যন্ত্রণায় ভুগছেন। ছেলে ছুটিতে বাড়ি এসেছিল, এখন দিল্লীতে কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে। বড়োছেলে মাকে বলল, মা চলো দিল্লীতে কিছুদিন থেকে ট্রিটমেন্ট করাবে, অনুপ্রভা বললেন আগে তোর বিয়ে হোক তারপর যাবো, অজিতেশ বাবু বললেন, ছেলের বিয়েতে খুব খাটাখাটনি হবে, চলো আগে ডাক্তার দেখিয়ে আসি। অনুপ্রভা অবশেষে নিমরাজি হলেন।  অতঃপর দুজনে মিলে ছেলের সঙ্গে দিল্লী গেলেন। ছেলে অর্থোপেডিস্ক, দিল্লীতে ফ্ল্যাটে থাকে।  একটি বিশাল  বেসরকারী হসপিটালে আপাতত কাজ করছে, মাকে সে নিয়ে গেলো সেখানকার নিউরোলজিক্যাল বিভাগে, খুব সহজ সরল দেখতে একজন দীর্ঘাঙ্গী জুনিয়র লেডী ডাক্তার  অনুপ্রভা দেবীকে প্রথমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলো, এতো সুন্দর হিন্দিতে কথা বলে মেয়েটি, অনুপ্রভা দেবীও বাংলা হিন্দি, ইংরেজী সব মিলিয়ে দারুণ ভাবে নিজের প্রবলেম গুলো বললেন। তারপর বিভিন্ন টেষ্টিং চলতে লাগলো, এই হাসিখুশি জুনিয়র ডাক্তারটি তাকে দিব্যি মম্  বলে ডাকে, কাছে এসে হাসিমুখে সব জিজ্ঞেস করে, একদিন অনুপ্রভা আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, তুম কোনসা কাস্ট কা হো বেটী, অজিতেশ বাবু চমকে উঠলেন, প্রথম বাউন্ডারী এতো অনায়াসে আসবে ভাবতেই পারেননি। মেয়েটি শান্ত ভাবে বলল, " আই এম্ ফ্রম পাঞ্জাব মা,  এন্ড আই এম এ পাঞ্জাবি গার্ল ", অনুপ্রভা কিন্তু চমকালেন না, দিব্যি হাসিমুখে চেয়ে রইলেন এক জোড়া ভারী চশমার নীচে একটি মায়াবী চোখের দিকে। বাড়ি এসে, অজিতেশ বাবুকে হিন্দিতে বললেন বাত্ চালাও, মুঝে ইস ডাক্তার বেটীকো পুত্রবধূ করনা হে।

রেলের অবসর প্রাপ্ত অফিসার জগজ্জীবন কাউর  তার ধর্মপত্নী মনোপ্রীত কাউরকে নিয়ে এসেছেন দিল্লী, স্থুলকায়া মনোপ্রীত হাঁটুর যন্ত্রণায় কাতর, অথচ সার্জারীতে ভীষণ ভয়। মেয়ে প্রীতম সদ্য ডাক্তার হয়ে কাজ করছে দিল্লীর একটি বড়োসড়ো হসপিটালে, সেখানেই এসেছেন দুজন, নরমসরম দেখতে, একটি লম্বা শ্যামলা বাঙালী জুনিয়র ডাক্তার মনোপ্রীতকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে খুব ভালোভাবে বোঝালো কেন হাঁটু অপারেশন করতে হবে, না করলে কি হবে ইত্যাদি, মনোপ্রীতের ছেলে নেই, এই বাঙালী ছেলেটিকে দেখে শুধু মনে হতে লাগল এ যেন তরুন কৃষ্ণ ভগবান , মনোপ্রীত রাজী হয়ে গেলেন। পাঁচজন ডাক্তারের একটি টিম তার হাঁটুর সফল অস্ত্রোপচার করল।

একমাস পর, মনোপ্রীত কাউর আর অনুপ্রভা দেবী একসঙ্গে বসে, চা খাচ্ছেন অনুময়ের ফ্ল্যাটে বসে। সামনের মাসে দিল্লীতেই বিয়ে হচ্ছে, অর্থোপেডিস্ক অনুময় দেব এবং নিউরোজিস্ট প্রীতম কাউরের। পরে  যে যার বাড়িতে গিয়ে পার্টি দেবে। দু পরিবারই আর দেরী করতে রাজি হন। বিশেষ করে অজিতেশ বাবু একটু ক্লান্ত বোধ করছেন , মনে হচ্ছে ক্রমাগত চার মেরে মেরে তিনি হাঁফিয়ে উঠছেন এখন দরকার লাঞ্চ ব্রেক।

দুটো টিকেট কেটেছেন, সিঙ্গাপুরের,  ছেলে আর ছেলের বউকে হানিমুনে পাঠাবেন, টিকিট দুটো ফুলশয্যার দিন অনুপ্রভা দেবীকে দিয়ে ছেলের বউকে উপহার দেবেন। এটা অজিতেশ বাবুর স্পেশাল ছক্কা, এখান থেকেই যেন, নতুন ব্যাটিং বাকি ম্যাচ টেনে নিয়ে যেতে পারে। বিয়ে হয়ে গেলো ধুমধাম করে।  বিয়েতে অজিতেশ বাবুর দুইমেয়ে জামাই, ছোট ছেলে আর বউ এসেছে। প্রীতমদেরও ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় স্বজন এবং  প্রীতমের ছোট বোন অমৃতা এলো। বাঙালী আর পাঞ্জাবী মিলেমিশে একাকার।

অনুষ্ঠান শেষে, অজিতেশ বাবু  স্ত্রীকে যখন একথাটি বললেন, অনুপ্রভা হঠাৎ পুরনো মেজাজে ফিরলেন, মাত্র বিয়ে হলো, এখন একটু ঘরকন্না করুক, বাঙালীর আদবকায়দা শিখুক, এখনই পঁচিশদিনের এই লম্বা ট্যুরের কি প্রয়োজন? ছেলেকে পটিয়ে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অজিতেশ বাবু বুঝলেন খেলা আবার শুরু, আর ব্যাটিং পারছেন না, এখন ফিল্ডিং, যথা সময়ে ক্যাচ তুলে ফেলতে হবে হাতে, স্ত্রী কে বোঝালেন সে তো সারাজীবনই করবে, কিন্তু এসময়টি তো আর আসবে না ওদের জীবনে, অবশেষে মনে ক্ষোভ আর মুখে চওড়া হাসি নিয়ে অনুপ্রভা ছেলের বউয়ের হাতে টিকিট দুটো তুলে দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রীতম আই লাভ ইউ মম, ইউ আর সো গ্রেট বলেই অনুপ্রভাকে জড়িয়ে ধরলো, অনুপ্রভার মনে হলো তিনি কি যেন একটা পেয়েছেন মনের মাঝে,  যা কখনো হারাবে না।

অনুময় আর প্রীতম হানিমুন থেকে ফিরে এসেছে, মা বাবাদের জন্য প্রচুর উপহার। বিশেষ করে, অনুপ্রভা দেবীর জন্য প্রীতম এনেছে মুক্তোর চোখ ধাঁধানো সেট, আরো এটা সেটা। অজিতেশ বাবু মিটিমিটি হাসছেন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আর নিঃশব্দে ক্যাচ তুলছেন।

প্রীতম রান্নাবান্না  কিছুই জানে না, তবে বুঝিয়ে দিলে সিরিয়াস স্টুডেন্টের মতো খুব তাড়াতাড়ি সব  শিখে নেয়। অনুপ্রভা মনে মনে ভাবলেন বেশ ভালোই হলো, নিজের মতো করে নেওয়া যাবে। দিন দিন শাশুড়ী বউ বন্ধুর মতো হয়ে যেতে লাগলেন, প্রীতমের সারল্য অনুপ্রভাকে আস্তে আস্তে দখল করতে লাগলো।

মাস চারেক হয়ে গেলো।   এবার, বাড়িতে গিয়ে একটি পার্টি দিতে হবে ধুমধাম করে, দিন ঠিক হলো, আগামীকালের ফ্লাইটে সবাই মিলে রওনা দেবেন বাড়িতে। রাতে হঠাৎ অজিতেশ বাবু প্রচন্ড বুকে ব্যথা অনুভব করলেন, সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোম, আই সি ইউ ,  , নাহ্, অলরাউন্ডার অজিতেশ বাবু এই ইনিংসের শুরুতেই গোল্ডেন ডাক মারলেন এবং আউট। শুধু যেতে যেতে দেখলেন প্রীতম দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে অনুপ্রভা দেবীকে। 





0 মন্তব্য(গুলি):