প্রেমে সন্ত্রাসে, আলোচনা, কবি সেলিম মুস্তাফা

৭:৩৮ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

০২.০৭.২০১৮

“...কৃষ্ণবরণ মেয়ে বসে থাকি আঙিনায়
সত্তায় শুধু নারীর গন্ধ...”

এ পংক্তিগুলো তাঁর, যিনি ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-প্রেম-পরিহাস-নারীবাদ নিয়ে স্মৃতিমেদুর ও গভীরসঞ্চারী কবিসত্তার এক নারী-কম্যাণ্ডো । কবি চিরশ্রী দেবনাথ । কবিতার জগতে পদার্পণের মাত্র দুই-তিন বৎসরের মধ্যে তাঁর আগ্রহ আর গতি চোখে পড়ার মতো ।

এ পর্যন্ত তাঁর তিনখানা গ্রন্থ প্রকাশিত । “জলবিকেলে মেঘের ছায়া” (ফেব্রুয়ারী ২০১৬), “ঋতুক্ষরণের রোদ চশমায়” (ডিসেম্বর ২০১৬) এবং “প্রেমে সন্ত্রাসে” (ডিসেম্বর ২০১৭) । আমি আজ “প্রেমে সন্ত্রাসে” পড়ব । তবে তিনখানা বই-ই আমি পড়েছি । প্রথম বইটি কবি নকুল রায়ের নজরদারীতে বেরিয়েছে “স্বতন্ত্র মেধা” থেকে, তাই এতে বানানের ত্রুটি থাকাটা ভালো লাগেনি । দ্বিতীয়টি বেরিয়েছে  “স্রোত” প্রকাশনা থেকে । এতে এতোবেশি বানানের ত্রুটি রয়েছে যে একখানা শুদ্ধিপত্রও জুড়তে হয়েছে শেষ পৃষ্ঠায়, এবং সেটাও নির্ভুল নয় ! তৃতীয়টিতেও রয়ে গেছে দুয়েকখানা ত্রুটি । এটা প্রকাশ করেছেন “নীহারিকা” ।
আশ্চর্য !! কবিতার বইয়ে কটা শব্দ আর থাকে ?
এই কথাগুলো আমি না-বললেও পারতাম ।

  

তবু বলা এজন্য যে, লেখক স্বয়ং ভুল করলেও প্রকাশকের তা মেনে নেয়া উচিত নয়, কারণ বইটা তার সংস্থার একটা সম্মান ও বিশ্বাসবাহী একটি প্রকাশ । নির্ভুল বই প্রকাশ করেন এমন প্রকাশক যে ত্রিপুরাতে নেই, এমন নয় । বানান ভুল থাকতেই পারে যেকোন কারোর অনবধানবশত, কিন্তু সেটা পাঠকরা ঠিকই বুঝে নিতে পারেন । টক-দই আর পোকায় কাটা বেগুনের বিশেষ কিছু খরিদ্দার আছেন বটে, কিন্তু বইয়ের বেলায় তা খাটে না ।

আমরা কবিতায় ফিরে আসি । কবিতা ছাড়া কে আর মলম লাগাবে ? কবিতা আশ্রয় । কবিতা পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্ম ।

“...যারা মানুষ খুন করবে বলে নেমেছিল
তাদের প্রেমেরা ঘাতকের হাসির মতোই শীতল
মাটির রঙ খুঁজে পেতে, এইসব মানুষেরা
রক্ত দিয়ে ধুয়ে দেয় ভুল প্রেম, ভুল সন্ত্রাস
জমাট বাঁধা নারীর মতো হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে সময়...”  (প্রেমে সন্ত্রাসে / পাঁচ)

একজন কবি নাকি সারাজীবন একই কবিতা লিখে যান । খণ্ডে খণ্ডে রঙে রঙে । তাই হয়তো প্রকৃত কবিতা কখনো সাজানো চমকের ডালি বা শেষ পংক্তিতে কোন বিস্ময়ের সাজানো হোঁচট নিয়ে আসে না । চিরশ্রীর কবিতার কোন নাটকীয় ‘সমাপ্তি’ তেমন একটা লক্ষ করা যায় না । এটা অত্যন্ত শক্তিশালী আত্মবিশ্বাসের নজির তো বটেই । কবির স্বাতন্ত্র্য তাঁর ‘দেখা’-কে নিজের মতো করে রূপদান করাতেই । আর এই কাজটায় এই কবি যথেষ্ট আন্তরিক । এই কবি একজন নারী, কিন্তু তাঁর নারীবাদ চিরন্তন ‘নারী’কে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত রেখে এবং মুষ্টি-তোলা সস্তা ও উগ্র প্রতিবাদের অসারতাকে মনে রেখেই আঁকা বা বলা, যাকে ডিঙানো অসম্ভব । “জমাট বাঁধা নারীর মতো হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে সময়...”  এই পংক্তিতে সময় ও নারীকে একাকার  করে দিয়ে তিনি যেন ছুঁড়ে দিলেন তাঁর প্রথম তাস ।

“ভীষণ গভীর রাতে
মধ্যবিত্ত শহরের খোলা ছাদগুলোতে
জমা হয় শহরের সব বিশ্রী মেয়ের প্রেম

তারা রঙ মাখে, চুল বাঁধে, চুলে দেয় গুলঞ্চ ফুল
সেইসব প্রেমেরা গুছিয়ে বসে ফিসফিস করে

শহর জেগে গেলেই আবার তারা
ঢুকে যায় ঘুপচি মনের গহবরে
প্রতিরাতে এভাবে তারা বুড়ো হয়
তারপর এক গরীব দুপুরে
মেয়েরা তাদের প্রেম বেচে দেয়
সমাপ্তি সঙ্গীত গায় একটি মেয়ে
বাকি মেয়েরা দেখে দিনে দিনে
শেষ হয়ে আসছে গুলঞ্চ ফুলের ঝোঁপ”  (গুলঞ্চবেলা)

কোন তীব্রতা ছাড়াই, সমাজের ব্যাকগ্রাউণ্ডে ক্ষয়ে যাওয়া নারীত্বের এই উপস্থিতি ঘোষণাই এক গম্ভীর প্রতিবাদ, যা মোটেই নালিশ নয় । নালিশ দিয়ে কবিতা হয় না । নালিশ আর প্রতিবাদ যে এক জিনিষ নয় এটা অনেক ‘বিগ’ কবিরও মাথায় ঢোকে না, এমন আমরা প্রায়শই লক্ষ করি । কবির কাছে কেউ অন্ধতা  চায় না ।

আমার কখনো মনে হয়েছে কবি চিরশ্রী দেবনাথ একটু কথাপ্রবণ । মনে হয়েছে প্রথম দুটি গ্রন্থের সেই ঝর্ণা পাহাড় কন্দরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে এখন সমতলের জনপদ ঘেঁষে পূর্ণ মাত্রায় কল্লোলিনী, যা ক্রমে আরও গাম্ভীর্যে আরও এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে যাবে ।

কাঠের বাংলোয় নবদম্পতির হানিমুন রাত কাটানো, বৃক্ষের জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে যাবার অভূতপূর্ব অনুভূতি...
“...কেয়ারটেকার বলে যায়
এই পুরো ঘর কেবল দুটো সেগুন গাছের
পাশাপাশি ছিল বহুকাল, বাংলোটি এ জায়গাতেই
তাদেরই দেহে সাজানো আসবাব...
...খণ্ডিত আসবাবের শরীরে জেগে ওঠে অসমাপ্ত
ফিসফাস...”      (হানিমুন বাংলো)

নারীসত্তাকে যেকোন অবস্থায় মহত্ব প্রদান করতে তাঁর অসংকোচ কলম বিন্দুমাত্র কাঁপেনি কোথাও । এর প্রমাণ আমরা আগেও পেয়েছি ।

“মেয়েরা বড়ো অস্পষ্ট হয় নিজের কাছে
তার ইচ্ছা, গোপন গোলাপ, সোনালি চুমু
উল্টানো সঙ্গম, হাত ছুঁয়ে রাখা ডিনামাইট
কোনটাই তার নিজস্ব নয়...
...তার চোখে, ঠোঁট, জিহ্বা
পোড়া কফির গন্ধ মেখে মেখে
লম্বা দীঘল পা ফেলে, পুরুষের চোখে মুগ্ধতা খোঁজে
মৌমাছির আঠালো রসের সৌখিন রসকলি যেন
একটা চোখ, কিছুটা মন, অসংলগ্ন কাম
তার নিজের হওয়া দরকার...”       (মথগন্ধা)

আরও পড়া যাক—

“যুদ্ধক্ষেত্রে আমি বেট রাখি
গভীর হয়ে আলিঙ্গন করি অস্ত্র সম্ভার
কেমন ঠাণ্ডা অস্ত্রের ত্বক, স্তব্ধ হৃদয়, আগুনে ভরা
আমার হৃদয়ে জমানো ত্রাস
জলবিহীন মৃত্যুতে আমি হারাব একান্ত সেই যোদ্ধাকে”  (বেট / চার)

কিংবা

“... এই বেটে নিজেকে রেখেছি গুহাচিত্রে, ভেষজ রঙে
জিতেছি আমি বেহাগে, শ্রাবণে, নিঃশেষে”           (বেট / পাঁচ)

এই জয় দাঁড়িয়ে আছে  “নিঃশেষে” শব্দটির দারুণ ব্যবহারে ।

“আমার শাড়ি বালিকারা” কবিতায় কবি বলেন—

“আমার শাড়িগুলো সব বেলাভূমির মতো
প্রত্যাখ্যান মেলে দিয়ে ছড়িয়ে যায় আধবুড়ো জ্যোৎস্নায়...”

এখানে ‘প্রত্যাখ্যান’ শব্দের প্রয়োগ অত্যন্ত সুন্দর এবং যথাযথ ।

একসময়, যখন থেকে কবিতা শ্লেষ বিদ্রুপের তির্যক কথায় ক্রমশ জটিল, সংক্ষেপ ও তীব্র হয়ে ওঠার প্রবণতা নিল, তা আশ্রয় করলো বিশেষ ভাষাপদ্ধতি, যাতে প্রবলভাবে দেখা দিল সমাসবদ্ধ (সমস্ত)পদের ব্যবহার । হাংরি আন্দোলনের বিশিষ্ট কবিদের একজন শৈলেশ্বর ঘোষ । তাঁর কবিতায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পাঠে, প্রথম লক্ষ করলাম তাঁর নবীন বয়সের কবিতায় সমাসবদ্ধ পদের বাহুল্য । পরবর্তীতে তিনি এই ব্যবহার কমিয়ে আনেন । বর্তমানে ত্রিপুরাতে অন্তত দু-জন কবির মধ্যে এই প্রবণতা এখনো বর্তমান রয়েছে খুবই তীব্রভাবে ।
জীবনানন্দের বহুব্যবহৃত “মতো” শব্দটি সকল কবিই খুব সচেতনভাবে এড়য়ে চলতে চান, তাঁর প্রভাব এড়ানোর জন্য । এটা বালখিল্য যুক্তি, এতে কোন সন্দেহ নেই । সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করলে  এই “মতো”-টাকে কমবেশি এড়িয়ে যাওয়া যায় । সম্ভবত এ কারণেই একসময় কবিতায় এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় । দুটো শব্দ জুড়ে দিলেই হলো, এতে কবির সপ্রতিভতা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, তীক্ষ্ণ কটুবাক্য ইত্যাদির রেসিপি খুব সুন্দর হয়, ফলে অটোমেটিক-কাব্যও হয়ে যায় । অবশ্যই সীমিতভাবে এর ব্যবহার কবিতার দিগন্ত প্রসারিত করে ।
কবি চিরশ্রীর প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এই প্রবণতা লক্ষ করেছি খুবই বেশি মাত্রায়, যা আলোচ্য গ্রন্থে প্রায় নেই বললেই চলে । তাঁর এই পরিবর্তন তাঁর ভাষাচর্চার অগ্রগতিকেই সূচিত করে । আমার বলার উদ্দেশ্য এটাই যে, আমার বিশ্বাস অনুযায়ী ভাষার পরিণতি ক্রম-সরলতার দিকেই যায় । একজন সাহিত্যিকের, বিশেষ করে একজন কবির পক্ষে তাঁর ভাষার নিজস্বতা অর্জনই সবচেয়ে বড় কথা, অর্থাৎ নিজের ভাষা আবিষ্কার । কারণ আমি বিশ্বাস করি, একজন কবি তাঁর সমস্ত রচনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই রচনা করেন, নিজেকেই আবিষ্কার করেন, তা তিনি যা-ই লিখে যান না কেন । কবির সততা, অর্থাৎ রচনায় তাঁর উপস্থিতি, তাঁর অস্তিত্বময়তাই তাঁর নিষ্ঠার প্রমাণ । চিরশ্রী ক্রমশ গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব ভাষার ইমারত আর পাঠককে দিচ্ছেন সেখানে প্রবেশের অবারিত দ্বার । অর্ধেক আকাশের পুরোটাই তাঁর, এক চুলও কম নয় ।

“দু’কাপ চা তোমার আমার
খানিকটা চিনি...প্রথম বৃষ্টিপাত
উষ্ণ গাভীরস,
একটিই চামচ সেখানে
নাড়তে থাকে তোমাকে আমাকে ।”  (চা)

একটি অসাধারণ জৈব কবিতা, জীবনবাদী কবির কবিতা, জীবনের কবিতা, যেখানে অর্ধেক বলে কিছু নেই, পূর্ণতায় ঈশ্বর হয়ে আছে ।

তাঁর “বয়ঃসন্ধির ত্রিপুরা” নামক কবিতা থেকে কিছু কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি যা তাঁর বাস্তবতাকে কল্পনার রসায়নে জারিত করার নমুনা—

“বেতলিং শিবের চূড়োয় দাঁড়িয়ে
আমার পুরুষ ধনুকে ছুঁড়েছিল তির
এ তির বর্ষণোন্মাদ, অভ্রখাদক
ঝরে ঝরে পড়ছে কাচঝর্ণা, শামুকবাহার
ক্ষীণতনু শরীরী আহ্বানে জেগে যাওয়া জুমপ্রেম
সঙ্গমে সঙ্গমে মুছে দিতে চায় জাতির আগে ‘উপ’...  ( বয়ঃসন্ধির ত্রিপুরা )

কিংবা

“...একটি মনখারাপ পরিযায়ী পাখি
বাস্তু খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনে
ডম্বুরের মেঘমন্দ্র ডুবন্ত কান্না......

আমায় দিও তুমি চূর্ণ খারচি মন্ত্র, একটু দেবী-রঙ
পৌষের ব্রহ্মচারী সকালে
কিছু রোদ রেখো শিবকুণ্ডলে
পিতলের পাত্রে জমুক
তোমার আমার পবিত্র তীর্থমুখ......

স্তনভারে ফুটে আছে জম্পুই-র কমলা ভোর
মনু নদীর শীতচরে, পা মেলাচ্ছে মামিতাং দুপুর
উষ্ণ ঝর্ণায় গা ভিজিয়ে মা গো আমিই তোমার
বয়ঃসন্ধির গণতান্ত্রিক জুমিয়া মেয়েটি ।”        (ঐ)

কোন কোন কবির মতে কবিতায় স্থানিকতার প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন । কিন্তু বিশ্বসাহিত্য ঘাটলে লক্ষ করা যায়, তাদের বেশির ভাগই স্থানিকতা-সমৃদ্ধ, যা সকলের আপন হতে কোনই বাধা ঘটেনি । উপরন্তু, একজন লেখক, তা তিনি কবি হোন আর ঔপন্যাসিক বা গল্পকারই হোন, স্থানিকতা তিনি এড়াবেন কী করে, আর কেনই-বা এড়াবেন ? তাহলে তো তাঁকে তাঁর মাতৃভাষাও এড়িয়ে যেতে হয় ! যা নিয়ে একজন কবি/লেখকের লেখক বা কবি হয়ে ওঠা, সেই মানুষ, সমাজ, সেই প্রতিবেশ যদি তিনি এড়িয়েই যান, তাহলে লিখবেন যা, তা তো অশ্বডিম্ব বা সোনার পাথরবাটি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না ! অধিকন্তু, লেখক স্বয়ং একটি স্থানিক অস্তিত্ব ছাড়া আর কী ? যাক, প্রসঙ্গান্তরে আর না যাওয়াই ভাল । পাঠক অবশ্যই লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন আর অনুভূতিশীল । এ বিতর্ক আর ভালোলাগা না-লাগার ব্যাপারটা তাদেরই এক্তিয়ারে থাকুক । আবার কবিতায়, আমার ভালোলাগায় আসছি ।

নির্ভয়াকে নিয়ে অন্য ধরণের প্রতিবাদ, বা দেখনধারী প্রতিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এবং সেই সঙ্গে এক নারীর প্রতি আরেক নারীর বা নিজেরই নারীসত্তার প্রতি সুগভীর মমতা আর সম্মান, যা  কবি প্রকাশ করেন ক্ষোভের মোড়কে—

“...নিষ্ঠুরতার গাঢ়তায় পৃথিবী
যোনি ছেঁড়া রক্ত মেখে নেয়,
শুধু সবার পাশে নির্ভয়ার মতো প্রেমিক থাকে না
এ পৃথিবী যেন ভরে যায় শুধু নির্ভয়ার প্রেমিকে
কতোকাল বাঁজা হয়ে আছে আছে এ মাটি
ধর্ষণ হয়তো তাকে এনে দেবে জলভরা সম্মান ।”   (নির্ভয়ার প্রেমিক)

এমনি অনেক কবিতার কথাই বলা যায় । আমার কথা বেশি হয়ে গেলে পাঠক বিরক্ত হবেন, তাই আপাতত থামছি । অনুমান করছি কবি শীঘ্রই নেবেন আরেকটি বাঁক । কারণ কোথাও কোথাও বিষয়ের ভারে কবিতার মেরুদণ্ড ন্যূব্জ হয়ে পড়েছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা । কবির রচনাশৈলীতে এখন পর্যন্ত শুধু বিষয়েরই পদচারণা, যা চেপে রেখেছে তাঁর আঙ্গিকগত সিগনেচার টোন । বিষয়কে গুছিয়ে অন্তরালে রাখার যে কাব্যিক কৌশল বা দক্ষতা তা হয়তো খানিকটা এখনো অনুজ্জ্বলই রয়ে গেল বিষয়েরই প্রবল তাড়নায় । অবশ্য তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় দীর্ঘকবিতার একটি ব্যাপ্তি খুবই প্রবলভাবে উপস্থিত । মিতায়তন কবিতা রচনায়ও যে তিনি  কম পারদর্শী নন, এটার প্রমাণ তাঁর “চা” কবিতাটি । তবু, যে কথা বলার, তা বলতে না-পারলে লেখালেখি করারই-বা অর্থ কী ?
শেষ করার আগে কয়েকটি বিশেষ পংক্তি উল্লেখ না করে পারছি না—

“...রুদ্রসাগরের বুকে নরম কুয়াশা কেমন বেদুইন হয়ে ওঠে...”   (নীরমহল)

“...পৈত্রিক ভিটেয় আকাশ থাকে হলুদ রঙে ভরা
নীল আঁচলের মতো নেমে আসে ঘরের দেয়াল...”   (পূর্বজা)

“...ধর্ষণের পর থেকে এক ছবি মেয়ে
শুধু সঙ্গমের ছবি আঁকে
মোহ, সাপ, কলা, রস, ছোঁয়াচে অসুখ
ছড়িয়ে ছড়িয়ে আঁকতে থাকে বাৎসায়ন...”   (ছবি মেয়ে)

“আমি তোমার শার্টের বোতাম ঘরগুলো পুনর্নির্মাণ করি
ফাঁকে ফাঁকে ভরে দিই আমার দ্বীপ ও সমুদ্র...”   (বোতাম ঘর)

“...প্রবল জ্বরের দিনে
যেন হারিয়ে যায় থার্মোমিটার
তোমার হাত রেখো আমার বাহুবলয়ে...”   (থার্মোমিটার)

“...শিলং-এ খুব ঠাণ্ডা নয় এখন, তবুও রাস্তা খুব ভেজা ভেজা
ভিজে থাকে তোমার হাতের তালু যেমন সারাক্ষণ...”   (শিলং পাহাড়ে)

“...একটি প্রেমের কবিতা লিখতে বড় ভালো লাগে
মনে হয়  প্রান্তরে বসে আছি ধানের মতো
আমার থুতনিতে লেগে আছে কয়েক ফোঁটা সন্ধ্যা...”   (এসো হত্যা)

কবি তাঁর রচনায় কোথাও কোন উপদেশ বা দার্শনিকতার অবতারণা করেননি । যা তাঁর মনোবাঞ্ছা, তা অন্তঃসলিলাই রয়েছে । এটাও তার ‘কবি’-সত্তার আত্মবিশ্বাসকেই সূচিত করে ।

কবির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি । তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রতীক্ষা থাকবে । ধন্যবাদ “নীহারিকা”-কে কবিতার অন্যমুখ দেখাবার জন্য । প্রচ্ছদ করেছেন ধর্মনগরের আরেক সুকন্যা মিতালী দেবনাথ । তাঁকে আমার অভিনন্দন ।

0 মন্তব্য(গুলি):