আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে

৩:১৯ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments




আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম জনগোষ্ঠীরও একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সেই ভাষাটিই তার মাতৃভাষা, হৃদয়ের শ্রেষ্ঠতম আবেগটিকে সে মাতৃভাষাতেই প্রকাশ করে। ঠিক এ জায়গাটিতেই মাতৃভাষা জিতে যায় বাদবাকি যেসমস্ত ভাষা সে শিখেছে জীবনধারনের জন্য, বেঁচে থাকার সংগ্রাম করার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলা ভাষার জন্য যারা  শহীদ হয়েছিলেন, তাদের প্রতি সম্মান জানাতেই সারা বিশ্বে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। বাংলাকে অতিক্রম করে আজ এই দিনটি হয়ে উঠেছে যার যার মাতৃভাষার দিন।
বিপন্ন অথবা বিলুপ্ত হওয়ার পথে ৪০ টিরও বেশি ভারতীয় ভাষা৷ কারণ মাত্র কয়েক হাজার মানুষ এখনও এই ভাষাগুলি ব্যবহার করেন৷জনসংখ্যা দফতরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২২ টি নির্ধারিত ভাষা ও ১০০ টি অনির্ধারিত ভাষা রয়েছে৷ এক লাখ অথবা তার থেকেও বেশি মানুষ এই ভাষাগুলি ব্যবহার করেন৷মোট ১২২ টি জনপ্রিয় ভাষা ছাড়াও আরও ৪২ টি ভাষা রয়েছে৷ যেগুলি দশ হাজারেরও কম মানুষ ব্যবহার করেন৷ তাই এই ভাষাগুলিকে বিপন্ন মনে করা হয়৷  এই ভাষাগুলি বিলুপ্তির পথে পা বাড়িয়েছে৷ এই বিলুপ্তপ্রায় ৪২ টি ভাষা অথবা উপভাষার একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছে ইউনেস্কো৷ইউনেস্কোর তালিকা অনুসারে যেসব ভাষাগুলি বিলুপ্তপ্রায়, তাদের মধ্যে রয়েছে আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জের ১১ টি ভাষা (গ্রেট আন্দামানিজ, জারওয়া, ল্যামংসে, লুরো, মুয়োট, অনগে, পু, সানেনো, সেন্টিলিজ, শম্পেন এবং টাকাহানিনিং), মনিপুরের ৭ টি ভাষা (আমল, আকা, কইরেন, লামগাং, লাংগ্রং, পুরম এবং তারাও) এবং হিমাচল প্রদেশের ৪ টি ভাষা (বাঘাতি, হান্দুরি, পাঙ্গভালি এবং সিরমাওদি)৷ রয়েছে ত্রিপুরার উপজাতিদের বেশ কয়েকটি ভাষা । 
অন্যান্য বিপন্নপ্রায় ভাষার মধ্যে রয়েছে, ওড়িশার মান্দা, পারজি ও পেঙ্গু, কর্নাটকের কোরাঙ্গা ও কুরুবা, অন্ধ্রপ্রদেশের গাদাবা ও নাইকি, তামিল নাড়ুর কোটা ও তোদা, ঝাড়খণ্ডের বিরহোর, মহারাষ্ট্রের নিহালি, মেঘালয়ের রুঘা এবং পশ্চিমবঙ্গের তোতো৷ একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অধীনে মাইসোরের দ্যা সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এইসমস্ত বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলির সুরক্ষিত ও সংরক্ষণের কাজ করছে৷ যেসব ভাষা দশ হাজারেরও কম মানুষ বলেন সেই ভাষাগুলির ব্যকরণগত বিবরণ, একবচন, দ্বিভাষিক অভিধান, প্রথম ভাষাগত পাঠ্যপুস্তক, লোককথার রচনাসমূহ, সব ভাষায় বিশ্বকোষ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হচ্ছে৷নির্ধারিত ২২ টি ভাষা ছাড়াও আমাদের দেশে আরও ৩১ টি ভাষা রয়েছে৷ যাদের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দ্বারা সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ জনসংখ্যার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মোট ১৬৩৫ টি পরিচিত মাতৃভাষা ও ২৩৪ টি অপরিচিত মাতৃভাষা এবং ২২ টি মুখ্য ভাষা রয়েছে৷
কিন্তু এসব আসলে শুধুই পরিসংখ্যান। সারা ভারতবর্ষে এখন একটিই সর্বগ্রাসী, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ভাষা সেটি হলো ইংরেজী । অন্যান্য মুখ্য ভাষাগুলোও ইংরেজীর কবলে  আজ চরম বিপর্যস্ত। 
বলব বাংলা ভাষার কথা। আজকের এইদিনে আমার মাতৃভাষা বাংলাকে মনে হয় এই ভাষাতেই তো আমার সকল আত্মক্ষরণ।  পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ,  মধুরতম আর সমৃদ্ধ ভাষা হলো বাংলা। 
কিন্ত ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বহুদিন আগে থেকেই ক্রমহ্রাসমান ।  শুধু বাংলা নয়, ভারতের সব কটি মুখ্য ভাষাই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অথবা বলা যায় সংগ্রামও করছে না, হাল ছেড়ে দিয়েছে। কার কাছে হাল ছেড়েছি আমরা না বললেও সবাই বুঝতে পারি, ইংরেজীর কাছে। মাত্র ছাব্বিশটি আলফাবেট হারিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বহু ভাষাকে। আমাদের দেশে তার ওপর আছে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার একটি রাজনৈতিক এবং জাতীয় প্রচেষ্টা। নিজ নিজ ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার যে ইচ্ছে এবং চেষ্টা সেটাই এখন করা যাচ্ছে না। একদম বুনিয়াদি স্তরে চলে যেতে হবে, যেখানে এখন প্রতিটি বাচ্চার শিক্ষা শুরু হয় নার্সারিতে, মূলত ইংরেজি বর্ণমালা এবং শব্দ শেখানোর মাধ্যমে, হয়তো বাংলাও থাকে পাশাপাশি, আমি বাংলার কথাই বলছি, অন্যান্য ভাষার কথায় পরে আসছি। সেই বাংলা স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ আত্মস্থ করতে এবং করাতে শিশুদের এবং তার অভিভাবকদের মধ্যে একটি প্রবল দ্বৈরথ দেখা যায়। পাশাপাশি দুটো ভাষা শেখা চার পাঁচ বছরের বাচ্চাটির কাছে খুব কঠিন, কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বলছে তাই শিখতে হবে। ফলে  একটি ভাষা অবহেলিত হয় এবং সেটি বাংলা বা অন্য যেকোন মাতৃভাষা । 
শুনেছি দক্ষিণভারতীয়রা নিজেদের মাতৃভাষাকে সজীব ও বহমান রাখতে ভীষণ তৎপর । ভারতের বিভিন্ন কসমোপলিটান শহরে বসবাসরত সেইসব দক্ষিণভারতীয়রা, নিজেদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যাতে বিদ্যালয়ে তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি বা হিন্দি শিখতে বাধ্য থাকলেও সেখানে এসে মাতৃভাষার চর্চা চালিয়ে যেতে পারে। তবে আমরা বাঙালীরা আমাদের ভাষা নিয়ে আবেগপ্রবণ হলেও কার্যক্ষেত্রে সঠিক বাংলা না জানাকে মোটেই অক্ষমতা মনে করি না। এটাই বাঙালীদের কাছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। 
কিন্তু সবক্ষেত্রেই আশার আলো জাগিয়ে রাখতে হয়। সমস্ত নেতিবাচক  চিন্তাভাবনার পাশাপাশি, ইতিবাচক চিন্তাই  আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তখনই প্রশ্ন ওঠে, এ প্রজন্ম কেন বাংলা পড়বে না এবং এ প্রজন্ম কেন বাংলা পড়বে না। 
  এ প্রজন্ম বাংলা পড়বে না, কারণ বাংলা তার কাছে খুব বেশী প্রয়োজনীয় নয়। আমাদের জায়গায় এইসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মোটামুটি তিনটি ল্যাঙ্গুয়েজ পড়ানো হয়, ইংরেজি ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ , তারপর কেউ ইচ্ছে করলে হিন্দিকে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ করতে পারে, বাংলা তখন হবে থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা সেকেন্ড, হিন্দি থার্ড, ক্লাস এইট পর্যন্ত এই নিয়ম। তারপর সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে হয় হিন্দি না হয় বাংলা। তখন বহু স্টুডেন্ট হিন্দি নিয়ে নেয়, অর্থাৎ বাংলা ক্লাস এইট পর্যন্তই শেষ। তার মানে বলা যায় বাড়িতে যদি বাঙালি মা বাবারা আর কোনরকম বাংলা বই  সরবরাহ করে তার জ্ঞান বৃদ্ধির চেষ্টা না করেন, তবে সেই ছাত্রটি বাংলাভাষা সম্পর্কে সামান্য অক্ষর জ্ঞান মাত্র প্রাপ্ত হলো, বা রিডিং পড়া শিখলো। আস্তে আস্তে সে এইসমস্তও ভুলে যাবে পড়ার চাপে। সরকারি স্কুল গুলোতে এখন উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা আর বাধ্যতামূলক নয়। কেউ চাইলে মাধ্যমিকের পর বাংলা নাও পড়তে পারে সে সায়েন্স অথবা আর্টস যাই পড়ুক না কেন।
এখন কেন ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াই, তার কারণ ভবিষ্যতে তাকে হাজার হাজার স্টুডেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় বসতে হবে, রেফারেন্স বইগুলো  ইংরেজীতেই বেশী ভালো, প্রশ্ন বোঝা সহজ, পরবর্তীতে পড়া সহজ ইত্যাদি বাস্তবোচিত কারণ।
যে ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার বই খুব একটা নেই এবং এই চর্চাগুলোও ইংরেজিতেই প্রায় বাধ্যতামূলক, কারিগরী বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার বই সবই ইংরেজিতে তাহলে সে ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিখুক  , আমাদের সময় এতো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল না , এখন আছে , তাহলে তাকে একসঙ্গে তৈরী করে দেওয়াই ভালো।
খুব সহজ ভাবে বলা যায়  মাতৃভাষায় ঝগড়াঝাটি, প্রেম, কথাবার্তা,  খিস্তি এইসব করা ছাড়া বাংলাভাষা ছেলে বা মেয়েটির  কাছে আলাদা কোন মূল্য রাখে না। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ থাকলে সে ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়বে, কি আছে তাতে।

তবুও বাঙালিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাংলা পড়বে।
তার পেছনে মূল ভূমিকা থাকবে কবি ও গীতিকারদের এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষা চর্চার উত্তোরত্তর বৃদ্ধি।
বাঙালিরা ছড়া, কবিতা, সঙ্গীত প্রিয়। এর থেকে বাঙালি তরুণ তরুণীদের মুক্তি নেই। আর একটি মুখ্য কারণ বাঙালিরা জাত বুদ্ধিজীবি এবং  সমালোচক। এই সবকটি শাখায় প্রাণখুলে তাকে কিছু করতে হলে, তার প্রথমে বাংলা ভাষাটা জানতে হবে। অল্প জেনে মাঠে নামবে। গোওওওল খাবে। আরো পড়বে, কি করে বেস্ট বুদ্ধিজীবি হওয়া যায়, জানতে জানতে ক্রমাগত বাংলাসাহিত্যের ভিতরে ঢুকে যাবে।
বাঙালির সর্বকালের সেরা বুদ্ধিজীবিগণকে খুঁজে পাবে, তখন আর ফিরে আসার পথ নাই। সামনে বাংলা বই, উপন্যাস, গদ্য, পদ্য, কিছু না পড়তে চাইলে, সমালোচনামূলক সাহিত্য তো পড়তেই হবে তাকে। অতএব আত্মপ্রশংসালোভী বাঙালি শিকড়ের কাছে ফিরে আসবে।
বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলা সাহিত্য। আর কোন কিছু নয়।
এখন কথা হলো সাহিত্য কতজন পড়ে। খুব কম। তাহলে বাকি অংশ। বাকি অংশ বাকি অংশই। একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারে সেই ভাষায় চর্চাকারী সামান্য কিছু মানুষই, বাকিরা কিছুদিন পর তাদেরই অনুসরণ করে, এটাই যুগের রীতি, ভাষার শক্তি।  আর বাংলাভাষার মতো আকর্ষণকারী ভাষা পৃথিবীতে খুব কম।
যেহেতু পজিটিভ আলোচনায় বিশ্বাস করি, তাই এক্ষেত্রেও তাই করলাম। একটা ধনাত্মক চিন্তার প্রতিফলন অনেকদূর যায়।
এই ভাষায় আরো প্রচুর বই হোক, লেখালেখি হোক।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই  বিশ্বাস রাখলাম বাংলাভাষা কোনদিনও তার বহমানতা হারাবে না। 

0 মন্তব্য(গুলি):