নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯

৬:৫৩ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

CAB / ক্যাব / উত্তাল ভারত 

CAB বা সিটিজেনশিপ এমেন্ডম্যাট বিল বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে উত্তাল ভারতবর্ষ। 
সরকারের বক্তব্য, মুসলিম প্রধান বিদেশে যেসব সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় কারণে হিংসার শিকার হন তাঁদের নাগরিকত্বদানই এ বিলের লক্ষ্য।
এ বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরকিত্ব দেবার জন্যই এই বিল। অন্যভাবে বললে, ভারতের প্রতিবেশী মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির অমুসলিম অভিবাসীদের সহজে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবার জন্য এই বিলের অবতারণা। 
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য  ১১ বছর ভারতবাস জরুরি ছিল। এবারের সংশোধনীতে দ্বিতীয় অংশে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। উপরোক্ত দেশগুলি থেকে আনা নির্দিষ্ট ৬টি ধর্মাবলম্বীদের জন্য ১১ বছর সময়কালটিকে নামিয়ে আনা হচ্ছে ৬ বছরে।
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের আওতায় ভারতে বসবাসকারী কোনও ব্যক্তি অথবা যাঁর বাবা মা ভারতীয়, অথবা যিনি ভারতে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল জুড়ে বাস করে এসেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার যোগ্য।
বেআইনি অভিবাসীরা ভারতের নাগরিক হতে পারে না। এই আইনের আওতায়, ১) যদি পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া কেউ দেশে প্রবেশ করে থাকেন অথবা ২) বৈধ নথি নিয়ে প্রবেশ করার পর নির্দিষ্ট সময়কালের বেশি এ দেশে বাস করে থাকেন, তাহলে তিনি বিদেশি অবৈধ অভিবাসী বলে গণ্য হবেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  রাজ্যসভায় বুধবার ক্যাব পেশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যেসব মুসলিমরা এদেশে ইতিমধ্যেই বাস করছেন, তাঁদের উপর এ বিল কোনও প্রভাব ফেলবে না। 
 ভারতে বসবাসকারীদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনও রকম বৈষম্য নেই।” তবে সরকারের বক্তব্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলি থেকে পালিয়ে আসা মুসলিম নাগরিকদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়।
বিলের সপক্ষে ছিলেন ৩১১ জন, বিপক্ষে ৮০, 

যে জায়গায় বিরোধ, তা হলো, 

ভারতের সংবিধানের তৃতীয় খণ্ডের ১২ থেকে ৩৫ নং ধারায় রয়েছে মৌলিক অধিকার। যা প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। এবং এই মৌলিক অধিকারগুলি ভারতীয় নাগরিকদের জন্যই সংবিধান কতৃক সুরক্ষিত। কিন্তু এই মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রম রয়েছে। ভারতের সংবিধানের ১৪ নং ধারাটিও সেরকমই ব্যতিক্রমী চরিত্র বহন করে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিভাগে থাকা সত্ত্বেও এই ধারা শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিক নয় বরং ভারতে বসবাসকারী বা ভারত ভূখণ্ডে থাকা যে কোনও ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। আইনের চোখে সমানতার অধিকার (ইকুয়ালিটি বিফোর ল) এই (১৪ নং) ধারাটিতে ভারতীয় নাগরিকদের পাশাপাশি ভারতে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তির অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। জন্মস্থান, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, কিংবা বংশপরিচয়ের ভিত্তিতে ভারতীয় আইন কারও সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না এমনই নির্দেশ রয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারায়। এখানেই মোদী সরকারের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯-এর সঙ্গে সরাসরি বিরোধ ঘটছে ক্যাব-এর। 

তবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে ‘চিন্তিত’ মুসলিমদের আশ্বাস দেওয়া হয় এই আইনের ফলে মুসলিমদের কোনও ভয়ের কারণ নেই।  মুসলমানদের একত্রিত করে বিলের বিপক্ষে সুর চড়ানো হচ্ছে, কিন্তু পড়শি তিন দেশ থেকে যদি কোনও ‘সজ্জন’ মুসলিম নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তবে অবশ্যই তা বিবেচনা করা হবে। তবে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে আগত এই সম্প্রদায়কে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।

নাগরিকত্ব বিল নিয়ে কংগ্রেসকে আক্রমণ করা হয়েছে, বলা হয়েছে “গোটা বিলের নেপথ্যে রয়েছে মহম্মদ আলি জিন্নার তত্ত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের দেশভাগকে সমর্থনের রাজনীতি। ১৯৫০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাঁরা কিন্তু ভারতে সুরক্ষিতই ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানে তাঁরা নির্যাতিত হয়েছিলেন। 

“শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। এই বিলটি শরণার্থীদের জন্য। এই বিলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবার কথা বলা হয়েছে। সরকারের মতে এই তিনটি দেশে সংখ্যালঘুরা সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত।
এই আইনে বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছয়টি রাজ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু রাজ্যে রয়েছে ইনার লাইন পারমিট বা ILP, সহজ করে বলতে গেলে, আই এলপি হল এমন একটি বন্দোবস্ত যার সুবাদে  ও যার আওতায় ভারতীয় নাগরিকরা একটি রাজ্যে বসবাস করতে পারেন। আজকের দিনে এই বন্দোবস্ত চালু রয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্য- অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে। ওই রাজ্যের মানুষ না হলে কোনও ভারতীয় নাগরিক এই রাজ্যগুলিতে যেতে পারেন না, এবং আইএলপি-তে উল্লিখিত সময়সীমা পার হয়ে যাবার পর সেখানে থাকতে পারেন না।
এই ধারণা এসেছে ঔপনিবেশিক এলাকা থেকে। বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ মোতাবেক ব্রিটিশরা নির্দিষ্ট এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। ভারতীয় কেউ যাতে ব্যবসা বাণিজ্য করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়, সে কারণে এই ব্যবস্থা। ভারত সরকার যখন এই আইন চালু রাখে, তখন তার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে ওই এলাকার আদি বাসিন্দাদের সুরক্ষাপ্রদান।
ইনার লাইন পারমিট প্রদান করে সংশ্লিষ্ট সরকার। অনলাইনে বা হাতে হাতেও এই পারমিট মেলে। এখানে ভ্রমণের তারিখ লেখা থাকে, রাজ্যের ঠিক কোন কোন এলাকায় ভ্রমণ করতে পারবেন ওই ব্যক্তি, লেখা থাকে তাও।

ক্যাবের সঙ্গে আইএলপি-র যোগাযোগ হলো, 
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের লক্ষ্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম উদ্বাস্তুরা যাতে সহজে এদেশের নাগরিকত্ব পান তার ব্যবস্থা করা। যদি আইএলপি ভুক্ত এলাকা ছাড়া অন্য জায়গার জন্য ক্যাব লাগু হয়, তাহলে ক্যাবের আওতায় এঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পেলেও ওই তিন রাজ্যে বসবাস করতে পারবেন না। বাস্তবত, এই নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় নাগরিকদের জন্য লাগু হবে।
অরুণাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ড বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের জন্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মিজোরামের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। যে তিন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি অভিবাসন ঘটেছে, সেই আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ে আইএলপি ব্যবস্থা চালু নেই।
মেঘালয় আইন সংশোধন করেছে বটে, তবে একথা স্পষ্ট নয় যে ঠিক কোন আইনের আওতায় পড়বেন বহিরাগতরা। এবং সরকারি ভাবে একথা জানানোও হয়নি, যে এ আইন আইএলপি-র প্রতিলিপি।

উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি যেমন ত্রিপুরায়,  এ বিলের ফলে বহুসংখ্যক বেআইনি বাংলাদেশিরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন বলে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পাল্টে যাবে জনবিন্যাসের ধরন, কাজের সুযোগ কমবে, এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ক্ষয় হবে।

কিন্তু তা ঠিক নয়, সেখানে এ ডি সি এলাকায় সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী যে নিয়মনীতি চালু আছে জনজাতিদের জন্য, CAB চালুর পর সেসবের কোন পরিবর্তন হবে না।

 অর্থাৎ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলো CAB  এর বাইরে থাকবে।  তাই জনজাতিদের এই নিয়ে ভয় পাওয়ার কোন কারণ  নেই। 
 সবশেষে, CAB চালু হয়ে গেলে,
বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু ২০১৪ সাল পর্যন্ত মূলত আসাম এবং উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে চলে এসেছেন, তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবেন।

এবং তারপরও সুপ্রীম কোর্টে এই অ্যামেন্ডম্যান্টের বিরোধিতা করে যে কেউ যেতেই পারেন, সেখানে পরবর্তী বিচারপদ্ধতি অনুসারে হয়তো সদ্য পাশ হওয়া আইনটি বাতিল হয়েও যেতে পারে।

তবে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো যেন সঠিক পদ্ধতিতে এগোন এবং দেশে শান্তি বজায় থাকে সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটাই আমার ( আমাদের)  চাওয়া।

চিরশ্রী দেবনাথ

0 মন্তব্য(গুলি):