রৌপ্যনগর ডিটেনশন ক্যাম্প

৫:১১ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments


বাইশে ফাল্গুন, চৌদ্দশ পঁচিশ। আজ হোলি। বসন্তের বাতাসে রাজপথ থেকে মানুষের পায়ের ধুলো আর আবির একই সঙ্গে উড়ছে।
রবীন একজন উজ্জ্বল মেধাবী তরুণ। আইটি সেক্টরে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার।
এই বাংলা তারিখ দেখে, আজ সে তার আই টি সেক্টরের চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছে। রবীনের মতো একজন স্মার্ট শহুরে ছেলের বাংলা তারিখ দেখে চাকরি ছাড়ার কোন কথা নয়। কিন্তু ঘটনাটির হোতা একটি বাংলা ক্যালেন্ডার।
গতবছর নববর্ষের সময় আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সুন্দর ছবি এঁকে এইসব ক্যালেন্ডারগুলো বিক্রি করছিল বৈশাখী মেলায়, অফিসফেরত পথে সেও একটা কিনে আনে, ছবিগুলো খুব শৈল্পিক আর অপরূপ, তাই খুব মনে ধরেছিল।
ক্যালেন্ডারটিতে  শুধু রকমারি ছাতার ছবি। অনেকগুলো ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা সেই ছাতাগুলো ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ থেকে নামছে রঙীন জল। দোলের রঙ।
জাস্ট  সিনেমাটিক, যাকে বলে ইউনিক ভাবনা।
কিন্তু আসলে যেন  ছবিটা একটি ধাঁধা । একটি চক্রান্ত। 

মাঝে মধ্যে মনে হয়, ছবিতে ঝড় উঠেছে। এলোমেলো বাতাস দিচ্ছে। কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে সবকিছু জীবন্ত লাগে। শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কিছু ছেলে মেয়ে, মাটি নেই, আকাশ নেই। শুধু ছাতা আর ছাতা। দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে শিশুগুলো এইসব রঙীন ছাতাকে। 

 ছবিটি সম্মোহন জানে। রবীনের ভেতর আস্তে আস্তে ঢুকে পরছে ছবিটি।  যেন সে ছবিটির একটি অংশ।
সেদিন  ক্যালেন্ডারটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে  ঘুমিয়ে পরেছিল। তখনই স্বপ্ন দেখে, তাকে অনেক মানুষ ডাকছে, তার বারান্দায় পরে আছে পলাশ ফুলের  মতো অজস্র চিঠি, চিঠিগুলোর রঙ লাল হলুদ।
সমস্ত চিঠি এসেছে রৌপ্যনগর থেকে ।
দিনটি ছিল কুুড়ি ফাল্গুন।
স্বপ্নটি যেন শুদ্ধ বাংলায় লেখা।
রৌপ্য নগর কোথায় জানা নেই। ভারতবর্ষের বিশাল মানচিত্রের কোন জায়গায় ঘাপটি মেরে এই গ্রামটি বা শহরটি ঘুমিয়ে আছে সেটাও অজানা। কিন্তু সেই থেকে এক ঘোর এসেছে। মনে হচ্ছে রৌপ্যনগর ডাকছে তাকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাই আঠাশ বছরের রবীন তার রেজিগনেশন লেটার সাবমিট করলো।


বস জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? রবীন বললো যেতে হবে। খুব তাড়া। তাই বলে চাকরি ছেড়ে দিলে! কতদিন থাকবে সেখানে? রবীন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।  কিছুই বলতে পারল না।
বাড়ি এসে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছে সে কোথায় যাবে। ম্যাপে এই নামে কোন জায়গা  খুঁজে পায়নি।
রাতে আবার স্বপ্ন, পথে বেরোও, আপনি খুঁজে পাবে ঠিকানা। অতএব কিছু নগদ টাকাপয়সা, এ টি এম  কার্ড, টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস কিটব্যাগে নিয়ে, রবীন স্টেশনে এলো। তখন রাত নটা। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে, তন্দ্রা এলো চোখে।
কে যেন ফিসফিস করে বলে গেলো, এখন না, এখন না, ভোরের ট্রেন, বসন্ত এক্সপ্রেস, টিকিট কেটো সাড়ে তিন নম্বর কাউন্টার থেকে।
ধড়মড় করে উঠে বসল রবীন, মোবাইলে দেখল রাত তিনটে। হালকা কুয়াশার চাদর ফাল্গুন মাসের শরীরে।
একটা কাউন্টারে হলদে লাইট জ্বলছে। সে গিয়ে বলল, একটি টিকিট দিন, ভোরের ট্রেন, বসন্ত এক্সপ্রেস।
সরু সরু আঙুলের মাথা একটু দেখা গেলো, টিকিট এলো, ভোর চারটার ট্রেন।
কি হচ্ছে কিছুই জানে না রবীন। ভোরের দিকে ট্রেনের শব্দ , প্ল্যাটফর্মে থামলো একটু, টুপিতে মুখ ঢাকা এক ট্রেনযাত্রী একটি কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে। রবীন ছায়ার মতো ঢুকে গেলো ট্রেনে, রৌপ্যনগর লাস্ট স্টপেজ।
কোথায় চলল ট্রেন, পাহাড়, নদী, সেতুর পর সেতু পেরিয়ে !  মনে হচ্ছে, অনেক মানুষ এই ট্রেনে, অন্য অন্য কামরায়।
মাঝখানে ধোঁয়া ওঠা ভাত নিয়ে এলো একটি ছেলে, কয়েকটি টাকা বের করে দিতেই হাওয়ায় উড়ে গেলো যেন সব।
ট্রেনখানি থেমেছে। চারদিকে মসৃণ পাহাড়, পাহাড়ের পাশ দিয়ে  বয়ে চলেছে হলুদ নদী ।
একটিও সাইনবোর্ড নেই আশেপাশে, জেলা, মহকুমা, পিন নাম্বার ইত্যাদি  কিছুই বোঝা গেলো না। মনে হয় পৃথিবীর বাইরে কোথাও। ইটের রাস্তা। দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ। লতানো ফুল নেমে এসেছে গাছের গা বেয়ে। দুটো মেয়ে আসছে সামনে থেকে। শাড়িই তো পরেছে ওরা।
চুলে পলাশফুল গোঁজা।
তার সামনে এসে বলল, চলুন, আপনিই তো রবীনবাবু, পৃথিবী থেকে এসেছেন ! যাচ্চেলে, এটা কি সত্যিই  পৃথিবীর বাইরে তবে? একটু এগিয়ে যেতেই রবীন আঁৎকে উঠল।
ছোট্ট ছোট্ট অসংখ্য তাঁবু। সমুদ্রের হাজার হাজার ঢেউয়ের মতো ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেছে। এখানে থাকে কারা? বাঁ পাশের গমরঙা মেয়েটি বলল, "মানুষ "।
কি নাম এই দেশের? ডান পাশের সর্ষেরঙের মেয়েটি বলল, জানবেন। বলছি, অপেক্ষা করুন। 


একখানি শক্তপোক্ত ঘর। সবুজ রঙের ছাদ, লাল রঙের মেঝে। রবীনকে মেয়েদুটো সেখানে নিয়ে এলো। তিনদিকে ব্ল্যাক স্ক্রিন। একপাশের দেয়ালে অসংখ্য বোতাম। একটি মেয়ে বলল, এসব আপনি ব্যবহার করবেন, আপনি যা জানতে চাইবেন, মুখে বললেই স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। আমাদের কম্পিউটার সব ভাষা জানে। সময়মত খাবেন, বিশ্রাম করবেন, সে দায়িত্ব আমাদের।

রবীন অধৈর্য হয়ে বলল, আগে বলুন কি কারণে আমাকে এখানে আনা হয়েছে   ?
আপনাকে একটি বিশেষ কারণে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আপনি একজন  বুদ্ধিমান সফটওয়ার ইঞ্জিনীয়ার। রাশি রাশি প্রোগ্রাম বানান। আমাদের কাছে অনেক কাগজ আছে জানেন? পৃথিবীতে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষায় লেখা।
ভয় নেই, আপনি একা নন। পৃথিবীর সব দেশ থেকে অনেক মেধাবীদের সম্মোহন করে আনা হয়েছে এখানে। নিরাপদে থাকবেন। অর্থও পাবেন। কাজ শেষ হলে  পৌঁছে দেবো আমরা।
আপনাদের কাজ  ঠিকানা বানানো । গমরঙা মেয়ে বলে উঠল।
অনেক অনেক নির্ভুল ঠিকানা। প্রপিতামহ, পিতামহ, পিতা এবং বর্তমান প্রজন্মের আদিবাড়ি, তাদের পেশা, বিবাহ ইত্যাদি সমস্ত কিছু নিয়ে একটি একটি সঠিক পরিচয়পত্র। যা তাকে পৃথিবীর যে কোন দেশে স্হায়ী ভাবে বাস করার সুযোগ করে দেবে। কেউ তাকে কোথাও অনুপ্রবেশকারী বলে বের করে দিতে পারবে না। আপনাকে পারতে হবে।

রবীন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, কেন এখানকার মানুষগুলোর কোন ঠিকানা নেই?
না নেই।
এখানের সবাই অনুপ্রবেশকারী।
পৃথিবীর কোন না কোন দেশে বাধ্য হয়ে বসবাস করতে হয়েছে তাদের।
বার বার তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কখনো কখনো পেয়েছে রিফিউজি কার্ডের তকমা। আমরা সবাই তাই বিশুদ্ধ এবং স্হায়ী ঠিকানা চাই। যেকোন ভাবে। সৎ বা অসৎ।  


তার মানে কি হলো? রবীন অস্ফুট উচ্চারণ করলো।  

এতো কিছু কে করছে, আপনারাই তো অনেক বড় সায়েন্টিস্ট, আমাকে কেনো নিয়ে এলেন।

আপনারা এখানেই থাকুন না কেন?  


আমরা একটি জায়গায় এসে  আটকে গেছি, তাই আপনাদের দরকার। কিছুতেই আলাদা করতে পারছি না, কারা রিফিউজি এবং কারা নয়। একপক্ষের জন্য যদি সব পারফেক্ট করা হয়, তাহলে অপর পক্ষের কি হবে। একটা সমরৈখিকতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা পৃথিবীর বর্তমান চিন্তাভাবনার সঙ্গে মিলছে না। দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ হচ্ছে, ফলত আমরা নিঁখুত ম্যাপ তৈরী করতে পারছি না, তাই দরকার আরোও মেধা, আরোও বুদ্ধি। সেজন্যই ক্যালেন্ডারগুলো  কায়দা করে পাঠিয়েছিলাম বিভিন্ন মানুষের কাছে, এগুলোতে ধরা পড়েছে বিশেষ মেধার অপরিসীম কল্পনাশক্তির মানুষেরা। তারমধ্যে আপনি আছেন।

আর এখানে থেকে যেতে বলছেন আমাদের!  

তা কি করে সম্ভব। এটা তো বাস্তব নয়।

মানুষের যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে পুতুলের মতো করে দেওয়া হয়েছে কিছুদিনের জন্য । তৈরী করা হয়েছে গ্রেট ইলিউশন ঝড়।
মেয়ে দুটোর গলা চিরে খুব শীতল একটি চিৎকার বেরিয়ে এলো, এই যে ধূ ধূ তাঁবুর সারি দেখছেন, আমাদের বর্তমান আস্তানা। পৃথিবীর বাইরে। মহাশূন্য।
এর নাম, "রৌপ্যনগর ডিটেনশন ক্যাম্প "।
বসন্ত এক্সপ্রেসে আসতে হয়। পৃথিবীর কোন ঋতু তাদের শস্যক্ষেত্র দেয়নি, আবির দিয়েছে, বিদায় জানাবার।

0 মন্তব্য(গুলি):