রবীন্দ্রনাথ

৩:২০ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ওনাকে ভোলার আর কোন সুযোগই রাখলেন না এই পৃথিবীতে। ঢেউ ভাঙার মতো আছড়ে পড়ছে সকলে গীতবিতানের খোলা পাতায়। রবীন্দ্রনৃত্য ছাদ বাগানে খুলে দিচ্ছে লকডাউনের বাঁধভাঙা জ্যোৎস্না। এতো বিপুল রাবীন্দ্রিক কাল আগে কি কখনো এসেছে। মহামারীর হাত ধরে, চাল, মুড়ি, আটার হিসেবের সঙ্গে জানলার জং ধরা লোহার শিকে হাত রেখে রোগা মেয়েটিও গাইছে আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। ঘোলাটে স্ট্রীট লাইটে ধূসর জোব্বার দীর্ঘতম ব্যক্তিটি নির্ভীক ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রাণময় নিস্তব্ধ শহরে। তাঁর সৃষ্টি নিস্তেজ হয়নি এখনো, তাই তিনি ছায়া নন, বড়ো তীব্রভাবে বেঁচে থাকা বলিষ্ঠ কায়া।  
এবারের রবীন্দ্র স্মরণ ভোরবেলার লালমাটির রাস্তা। ভিজে আছে তার সকল পরিক্রমা রাত নিংড়ে নিঃসৃত স্তনধারায়। যে ছেলেটি বিষণ্ণ ছিল অমলের মতো,  সে এখন দীর্ঘ রাস্তা দেখতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে পৃথিবীর অসুখ। এমন অভিজ্ঞতা তার চির বিষাদ কেড়ে নিক। 
এই পঁচিশে বৈশাখে না হয় কুঞ্জে কুঞ্জে লোক সমাগম হলো না। মাইক বেজে উঠল না। বৈশাখে বর্ষার যে অনাঙ্খিত পদচারণ দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো এখন পর্যন্ত দুই লক্ষ সতের হাজার মানুষের অশ্রুজল। এবার ভাষণ হবে না। দার্শনিক  রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ক্ষুরধার বক্তৃতা থেকে বিরত থাকবেন রবীন্দ্র তাত্ত্বিক।
তিনি তর্ক বিতর্ক ছেড়ে গৃহ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিশোরীর পবিত্র অঙ্গুলীস্পর্শে। না জেনে কয়েকটি নষ্টনীড় তাঁকে রবাহুত মনে করছে। 
সভ্যতাকে মনে হচ্ছে ক্ষুধিত পাষাণের দমবন্ধ জীবন, এখানে  ভয়ের পদশৃঙ্গার চেপে বসেছে ভালোবাসার নারীদের হৃদয়ে।
মৃত্যু কখনো রবিকে থামিয়ে দেয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ তাঁকে স্তিমিত করতে পারেনি। প্রতিটি বিচ্ছেদ আর মৃত্যুশয্যা তাঁর    কলমে অনুবাদ হয়ে গেছে এজন্যই হয়তো আমাদের কাছে তিনি এতটাই নিবিড় ভাবে ধরা দেন। 
দুইহাজার কুড়ির এই কঠিন সময়ে তাঁকে নিয়ে কি লেখা যায়। 
কোন রবীন্দ্রনাথ আমার হৃদয়ে এইমুহূর্তে বাসা বেঁধেছে, আমি কি তাঁকে চিনতে পারছি। তিনি শব্দ ঝংকৃত নন। তিনি ছন্দ    আর লয়ের  সীমাানা ছাড়িয়ে অসীম হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে করে দিচ্ছেন নিরাভরণ। হৃদয়ে রাখছেন প্রগাঢ় উচ্ছলতা, বিষাদ কাটানোর ঝাড় লন্ঠন।
এই দানবিক প্রতিভার কাছে আমরা মাথা নত করে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যখনি যা করতে চেয়েছি, তার কাছ থেকে অফেরতযোগ্য ধার করেছি। স্রষ্টার কাছে যদি কষ্ট না থাকে, যদি তিনি মাঝে মাঝেই সম্পূর্ণ রিক্ত না হয়ে যান, অপমানের আশীর্বাদ যদি তাকে স্পর্শ না করে, প্রেমের ছেড়ে যাওয়া, বিরহের নন্দিত চলন যদি তার মনের সরণী বেয়ে না আসে, একটি যুদ্ধ ক্লান্ত, রোগজর্জর, মহামারীর ভয়, দুর্ভিক্ষের হাতছানি দেওয়া দুখী পৃথিবী তিনি যদি না দেখেন তবে সেই স্রষ্টা পূর্ণ হতে পারেন না। আর রবি এভাবেই নিজেকে পূর্ণ করেছেন। অসীম শূন্যতাকে তিনি স্বার্থপরের মতো আপন শিল্পকর্মে ঢেলে দিয়েছেন। এই স্বার্থপর, দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ আমার আশ্রয়। তিনি অকাতরে মানুষকে আজও অনুপ্রাণিত করেন, দেশপ্রেম আর ব্যক্তিগত প্রেমহীনতায় তিনি যে সফেন সমুদ্রের জন্ম দিতে পেরেছিলেন, সেই বেলাভূমির নক্ষত্রখচিত আদিমতা আমাদেরকে বাউল বানিয়ে দিতে পারে এক লহমার জন্য। চেতনার এই দীর্ঘ ধারাবিবরণীতে কোনদিন তিনি আমাদের ক্লান্ত করেননি। অপরিমেয় শৃঙ্গাররস ঢেলেছেন বাঙালীর সংস্কারে। যে মন ক্ষণে ক্ষণে নিরাশ্রয় হয়েছে, তাকে শিখিয়েছেন এ অন্যায় নয়, একে মানুষের সাধারণ জীবন বলে, সমর্পনের নাম ঈশ্বর অথবা প্রেম, এই দুই ভীষণ ঘোলাটে হয়ে বৈশাখের বিদ্যুৎচমক দিয়ে যাচ্ছে আজও। হাজার ভোল্টেজের আলোক পরিক্রমা মানেই রবি পরিক্রমা, সেই ভ্রমণ বাঙালীর কাছে অসম্পূর্ণই থাকে। মৃত্যু পথযাত্রী যেদিন হবো, সেদিনও যেন রবীন্দ্রগান শোনার অবসরটুকু থাকে, এই সুরটির কাছে পৌঁছুতে হলে সুরের যে প্রক্ষেপ জানা দরকার, তা আমার    নেই   , কিন্তু কেন যে রবি এই  গানের জন্ম  দিয়েছিলেন   , সেই  ব্যাখ্যা আমি খুব মিলিয়ে নিতে পারি। এটাই বোধহয় নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ, যাকে ঘিরে থাকে বিতর্ক আর প্রেমের ভাবানুবাদ।

@ চিরশ্রী  দেবনাথ
প্রকাশিত, স্যন্দন পত্রিকা ", ৮/৫/২০২০

0 মন্তব্য(গুলি):