রবীন্দ্রনাথকে
প্রিয় রবি,
বহু কথা জমিয়া আছে। কোথা হইতে শুরু করিব বুঝিতে পারিতেছি না। ইত্যবসরে প্রকৃতির কোন দোষ নাই। সে সকল প্রকার ফুল প্রস্ফুটিত করিয়া, দিকবিদিক আমোদিত করিয়া আপনার জন্মদিবসের জন্য তাহাদের পরিপূর্ণ অর্ঘ্য সাজাইয়া বসিয়া আছে। বৈশাখ তাহার গর্ব অক্ষুণ্ণ রাখিয়া প্রায়শই বজ্র বিদ্যুৎ সহ বিরহকাতর প্রেমিকের ন্যায় ধরার বক্ষে আছড়াইয়া পড়িতেছে। কচি আম্র শাখা চ্যূত হইয়া গড়াগড়ি যাইতেছে। উহাকে তুলিয়া আনিয়া লবন সহযোগে খাইবার কথা মনে করিলেই অম্লস্বাদের কল্পনা করিয়া জিহ্বাগ্র অসুখ শেষে রুচি ফিরিয়া পাইতে আশা করিতেছে। নিতান্তই নগন্য হইলেই বলিয়া রাখি, এইক্ষণে বিদ্যুত চলিয়া গেছে। আমি সামান্য তরিৎআধান পুষ্ট মুঠোযন্ত্রটিকে সম্বল করিয়া একবিংশ শতকের একটি বৃষ্টিমুখর মধ্যাহ্নের ধারা বিবরণী লিখিতেছি যা আপনার সাধারণ মেয়েরা করিত। তাহাদের সুতোর কাজ করা শাড়ির ফলসাবরণ অলস পারে লাগিয়া থাকিত পিতৃগৃহ ছাড়িয়া আসার এক দীর্ঘ বেদনা। পৃথিবীতে মহামারী চলিতেছে। আমি আপনাকে সঙ্গীতে স্মরণ করিতেছি। ইহাকেই সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত বলা হয়, যাহা আপনি তীব্র দাবদাহ ক্লান্ত বৈশাখী দুপুরে, উচ্ছসিত প্রনয়িনীর তীব্র অভিমানের মতো শ্রাবণ সন্ধ্যায়, নীলম্বরী শাড়ি পরিহিত অকাল বোধনে, হেমন্তের কামনা প্রিয় বৃদ্ধ জোৎস্নায়, শীতঋতুর ধুলো ধূসরিত পত্রবিতানে তেজবিহীন সূর্যালোকের অলস প্রত্যাগমনরত গোধূলিতে কিংবা বসন্তের শুষ্কতায় চরাচর প্লাবিত এক নিরন্তর অপেক্ষার কথা মনে করিয়া একান্তই আমার জন্য লিখিয়া ছিলেন। বহির্জগৎ হইতে একপ্রকার বিচ্ছেদ যখন আমাদিগের অন্তস্থলে সপ্তরঙ ঢালিয়া দেয়, তখনি নাকি প্রকৃত কবিতার জন্ম হয়, বিদ্বজ্জনে কহে আপনি পাশ্চাত্য কবি শেলির দ্বারা কোথাও কোথাও প্রভাবিত। তাহার সমস্ত চিন্তাই আপনার মধ্যে পরিস্ফুট আর রঙের ওপর রঙ ঢালিয়া ক্রমশ সকল রেখাচিত্র বিলুপ্ত করিয়া অস্ফুট চিত্ররূপের আলোকময় বিস্তারের যে শিল্পরীতি শেলির মধ্যে ছিল আপনিও তাহার অনুসারী, এইসকল বিদগ্ধ অনুসরণকে অবলম্বন করিয়া আমার মনে হয় সকল প্রভাব, প্রভাব বিস্তার করিতে সমর্থ হয় না, যাহা হয় তাহাই রবীন্দ্রনাথ নহে , বস্তুত এইসব তর্কাতর্কি পড়িতে ভালো লাগে, ইহা আমার সাধারণত্বকে আরোও তুচ্ছ করিয়া দেয়, তরুঘেরা গ্রাম হইতে উথ্থিত একাকী ধূমলেখার মতো আমার মনে হয়, পৃথিবীতে অহংকার শব্দটি বড়ই সরস ও কৌতুকময়। প্রকৃতপক্ষে আপনাকে আমার বলিবার কিছুই নাই, ইহা হলো নিতান্তই গল্প করিবার ছুতোমাত্র। যে গল্প করিবার জন্য দুজন প্রিয় মানুষের একটি আধার প্রয়োজন হয়, গল্প অমনি অশ্বথ্থ শাখার মতো ডালপালা বিস্তার করিয়া একটি আয়োজন গড়িয়া তোলে, ইহা অপেক্ষা সুখকর কিছু নাই। এই নিরন্তর অস্থিরতার মধ্যে একটি নিখাদ গল্প অবসর খুঁজিয়া লইতে মানুষের কত ছল করিতে হয় তাহাই মনে হইতেছে। মনে হইতেছে একটি কল্পিত ছায়ানুবাস খুঁজিয়া লইতে জগতের নারী পুরুষগন কাঞ্চনবর্ণ আগুন জ্বালাইয়া প্রমত্ত সন্ধ্যার অপেক্ষা করিতে করিতে মিশরীয় মমির মতো রাজকীয় হইয়া ওঠে, আর পৃথিবী বহিরঙ্গে স্খলিতকিংশুক সাথে উৎসবমুখরিত জনপদ রচনা করিতে মনপ্রাণ ঢালিয়া দেয়।
আজ রাখিলাম এইখানেই ,
ইতি চিরশ্রী।
© চিরশ্রী দেবনাথ
0 মন্তব্য(গুলি):