আজাদি

৩:৫০ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ

আজাদি

স্বাধীনতার সত্তর বছর পর ভারতের বুকে একটি শ্লোগান উঠেছে, "আজাদি "। শ্লোগানের গুরুত্ব অপরিসীম। মৃত্যু পথযাত্রী সৈনিক, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করে,
" বন্দেমাতরম ", তার দেশ মা কে শেষবারের মতো ডেকে যায়। এই ডেকে যাওয়ার মধ্যে গৌরব আছে, আছে মৃত্যুর মুহূর্তে   নিজের মাটিকে রক্ত দিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়ার আত্মতৃপ্তি। সেই সৈনিক জানে এটাই তার দেশ ছিল আমৃত্যু। ব্রিটিশ আমাদের জন্য একটি গোলমেলে স্বাধীনতা রেখে গেছে। বিভক্ত ভারত। তার মধ্যে অনেক রাজ্য, স্থানীয় রাজা "কারো কারো জন্য আলাদা আইন। লিখিত হয়েছে পৃথিবীর ব়ৃহত্তম সংবিধান। বহু বার সংশোধিত হয়েছে সে। সংবিধানের ৪২ তম  সংশোধনের দ্বারা ১৯৭৬ সালে, ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত  হয়, তখন থেকে ভারত হলো সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেছে কি করেনি, সে প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই মনে আসে। কোনটা ভালো? কোন একটি বিশেষ ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশ না ধর্মনিরপেক্ষ দেশ? পৃথিবীর বেশ কিছু দেশই কোন একটি বিশেষ  ধর্মকে প্রাধান্য  দিয়ে তৈরি হয়েছে। একটি দেশের আত্মা তিল তিল  করে গড়ে ওঠে মানুষের মনন আর আচরণ দ্বারা। জন্ম থেকেই আমি এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিক। আমার আত্মাও তাতেই বিশ্বাস করে এবং ভারতবর্ষের এই ধর্মনিরপেক্ষতা যে কখনো বদলানো যাবে না আজকের ভারত তারই প্রমাণ। 
দুইহাজার উনিশের ভারত, NRC ,NPR, CAA, নিয়ে উত্তাল।   দেশের বুকে গুঞ্জরিত একটি শ্লোগান। দীর্ঘ লিরিক্স। টগবগে, তাজা, গরম রক্তে রাঙানো। 
 শ্লোগানটির প্রকৃত কোন রাজনৈতিক সত্তা নেই। আবার বলা যায় এই সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই একটি সুতীব্র রাজনৈতিক শ্লোগান। ভারত মাতা কি জয়, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বন্দেমাতরম, এই সবকটি শ্লোগানই প্রচণ্ড শক্তিধর। সময়ে সময়ে তারা বদলেছে ইতিহাস।
 আর এখন, 
“…ভুখমারি সে, আজাদি / হাঁ ভেদভাব সে আজাদি / হাম লেকে রহেঙ্গে, আজাদি / তুম কুছ ভি করলো, আজাদি / হাঁ পুঁজিবাদ সে, আজাদি / হাঁ মনুবাদ সে, আজাদি…” এই শ্লোগান এই মুহূর্তে সারা ভারতে শ্লোগান হিসেবে ভাইরাল। হয়ে উঠেছে ভারতব্যাপী সরকার-বিরোধী তারুণ্যের একমাত্র সর্বজনীন অ্যানথেম।"
এখানে কিন্তু NRC, CAA, NPR এর কথা বলা নেই। বলা হয়েছে মূল কিছু জাতীয় সমস্যার কথা। যা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক নিম্নগতি, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদির দিকে দিকনির্দেশ করে। এই শ্লোগান প্রবর্তিত হয়েছে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। মানুষ এর সঙ্গে আরো অনেককিছু জুড়ে দিচ্ছেন। রাজ্যে রাজ্যে শ্লোগানটি দীর্ঘায়িত হয়ে স্থানীয় সমস্যাকে নিজের করে    নিচ্ছে। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেটাও একইভাবে।
 এর বহুমাত্রিক তেজ শাসকশ্রেণীকে বাধ্য করছে অন্য পথ অবলম্বন করতে।
যুবপ্রিয় এই শ্লোগান এখন তারুণ্যের ভাষা।
ভারতে   প্রবর্তিত  "আজাদি ", শ্লোগান    আমাদের    ব্যর্থতার পরিচায়ক। বেশ আয়েকটি  আইন  মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে যা আস্তে আস্তে  আমাদের সমাজতান্ত্রিক তকমাটির ওপর অশুভ প্রভাব ফেলছে।
নাগরিকত্ব আইন ভারতের প্রকৃত নাগরিকদের চিহ্নিত করবে। আর যারা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস্ কালেক্ট করতে পারবে না, তাদের হবে নির্বাসন, জায়গা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে   ।
ভারতের মতো একটি বিশাল দেশের কোটি কোটি মানুষকে এখন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করার কাজে নেমে পড়তে হবে। লোকটির জন্মস্থান যদি ত্রিপুরার কোন একটি গ্রামে হয়, আর সে ব্যক্তি ধরা যাক দিম্লীতে চাকুরি করছে, এখন তাকে জন্মস্থানে এসে  বার্থ সার্টিফিকেট বা স্কুল সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হবে। অথচ সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যের কথা এইসব মানুষদের দেওয়া ভোটেই প্রতিটি গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে নাগরিক পঞ্জী কোন নতুন বিষয় নয়। অনেক দেশেই আছে। একটি দেশের নাগরিক পঞ্জী থাকা বাধ্যতামূলক, না হলে দেশের বেকারসংখ্যা, কৃষি, শিল্প কোনকিছুরই সঠিক পরিমাপ পাওয়া যাবে না। ভারতবর্ষের সীমান্তে রয়েছে সাতটি দেশ। অসংখ্য মানুষ নানান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই দেশে প্রাণ বাঁচাতে, ধর্ম বাঁচাতে, নারীদের সম্ভ্রম বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে। যারা মিশে গেছে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে। প্রতিবছর ভারতে ভয়ংকর বন্যা হয়। ঘরবাড়ি ভেসে পায় মানুষের। হারিয়ে যায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ডকুমেন্টস। এধরনের নানান পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে জাতীয় নাগরিকত্বপঞ্জী, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, দেশে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। মূল সমস্যা থেকে মানুষের চোখ সরে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক নিম্নগতি অব্যাহত। কারখানা বন্ধ হচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণ শোধ করতে না পেরে। তখনই মনে হয় এই আজাদি ঝুটা হে। শ্লোগান ওঠে আজাদির। স্বাধীনতার সত্তর বছর পর, মধ্যবিত্ত ছাত্রসমাজ নিজেদের যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে প্রশ্ন করে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকে। এদের পায়ের তলায় মাটি আছে। অনেকের মা বাবাই সরকার  চাকরির প্রচুর সুবিধা ভোগ  করেছেন। কিন্তু এখন ক্রমাগত কমে আসছে সরকারি চাকরির নিরাপত্তা, কঠিন প্রশ্নের মুখে বেসরকারি চাকরিও।
 এভাবেই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে নাগরিকত্ব আইন।
তরুণদল প্রশ্ন করতে শিখেছে, শ্লোগানে এসেছে প্রাণ, মিলে গেছে আসমুদ্র হিমাচল, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে দু  তরফই বোঝানোর চেষ্টা করছে। ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়, ডি ভোটার হওয়ার ভয়, এসবের পাশাপাশি আমি শুধু, শ্লোগানটির মধ্যেই দেখতে পাই উজ্জ্বল এক ভারতবর্ষের ছবি, যার চোখে প্রতিবাদ ও  স্বপ্ন আছে, দশক শেষে এই তো  প্রাপ্তি। 



0 মন্তব্য(গুলি):