চলে যাওয়া ২০১৯

৩:৫১ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments



যে মানুষ কখনও রাজনীতি করেনি, রাজনীতির ঘোর প্যাঁচ কিছুই বুঝতে চেষ্টা করেনি, যাদের কাছে ভারতের সংবিধান একটি দুর্বোধ্য গ্রন্থ মাত্র, সেই ভারতের হাজার হাজার মানুষ আজ পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধানটি নিয়ে একটু মাথা ঘামিয়েছেন, বাধ্য হয়ে শুনতে চেয়েছেন, অন্ততঃ কিছু একটা জানতে চেয়েছেন। ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত এই ধারণা থেকে মুক্ত হয়েছি আমরা, দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে দুই হাজার উনিশ পেরিয়ে এসেছি, দুইহাজার কুড়ি কি হবে জানা নেই। 
দুই একটি দশক ধরে মূলত কয়েকটি ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে, মাঝে মাঝে তাতে শান দেয় তাৎক্ষণিক কিন্তু আসলে তাৎক্ষণিক নয় তেমন কিছু ঘটনা। এই বছরের শুরুতেই আমরা বহুকথিত একটি কঠিন সমস্যার কালো ছায়া দেখেছি, যার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জড়িত। সমস্যাটির নাম জল। ক্রমেই কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। শুকিয়ে যাচ্ছে ভারতের বড় বড় নদীগুলোর জলধারা। এক অভাবনীয় জলসঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ভারতের অন্যতম মেট্রোপলিটন সিটি চেন্নাই। আশংকা করা হচ্ছে অন্যান্য বড় বড় শহরগুলোও সম্মুখীন হবে জল সমস্যার। চারশ টাকা পাঁচশো টাকা লিটার হয়েছিল জলের দাম। বিশাল ভারতবর্ষের খাদ্য  শস্যের একটা বড় অংশ আসে পাঞ্জাব থেকে। সেই পাঞ্জাবের ভূগর্ভস্থ জলের পরিমান অনেকটাই নীচে নেমে গেছে। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষ অচিরেই জল নিয়ে বিরাট সমস্যায় পড়বে। 
সেইসঙ্গে গোটা পৃথিবী সাক্ষী থাকল পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত আমাজনের হাজার হাজার একর বনভূমি, পশুপাখি পুড়ে যাওয়ার এক নারকীয় দাবানলে। দুই হাজার উনিশ বলে দিয়ে গেলো পরিবেশ নিয়ে ভাবো সারা পৃথিবী, সারিয়ে তোলো কার ক্যান্সার।
আমাদের দেশে অবশেষে তিন তালাক নিষিদ্ধ হলো। ভালো জিনিসকে স্বাগত জানালাম আমরা। কিছু বিরোধ এবং পাল্টা যুক্তি তর্ক চললেও বলা যেতে পারে এটা অবশ্যই আলোর ঝলক।
আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়লেন উনিশলক্ষ মানুষ। একত্রিশে আগস্ট ঘোষিত হলো ফাইনাল লিস্ট। দেশহারা মানুষদের নিয়ে সারা দেশ যখন উদ্বিগ্ন, বিচলিত, আন্দোলনতৎপর, পক্ষে বিপক্ষে আইনি বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসা নিয়ে  নানা মুণির নানা মত, তখনই স্বাধীনতা লাভেরি অনেকগুলো দশক পেরিয়ে কাশ্মীর থেকে অবশেষে উঠিয়ে নেওয়া হলো ৩৭০ ধারা। একটি দেশে দীর্ঘদিন ধরে যখন কোন নিয়ম চলতে থাকে তখন হঠাৎ করে সেই নিয়ম ভঙ্গ হলে লোকে ভয় পেয়ে যায়। দীর্ঘদিন কাশ্মীরবাসী ইন্টারনেট পরিষেবা পাননি। কাশ্মীরের বাইরের মানুষ জানতে পারেনি ঠিক কি ঘটছে কাশ্মীরে। তবে আগামীদিনগুলোতে ভারতের অন্যান্য রাজ্য গুলোর মতোই কাশ্মীর একটি স্বাভাবিক  রাজ্য হিসেবে তার অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের  হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে সবাইকে আরোও বেশি আকর্ষণ করুক তাই চাই। 
৩৭০ ধারা যদি একটি দেয়াল হয় তবে সব অর্থেই তা ভেঙে ফেলা হোক, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ থেকে বেরিয়ে আসুক আমার দেশ।

একশ তিরিশ কোটির স্বপ্ন নিয়ে ২২ শে জুলাই পৃথিবীর চতুর্থ 
 দেশ হিসেবে চাঁদের মাটিতে এবং পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশ্যে শ্রী হরিকোটা থেকে রওনা দিয়েছিল ইসরোর তৈরি চন্দ্রযান ২। ৯৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতের এই প্রকল্প শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সাফল্যের  মুখ দেখতে পায়নি। চাঁদের মাটিতে সঠিক অবতরণ হয়নি ল্যান্ডার বিক্রমের । কিন্তু চন্দ্রাযান -২ উৎক্ষেপণ নিয়ে জনসাধারণ বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেখা গেছে প্রবল এক মহাকাশ উন্মাদনা। ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা সমস্ত খবর নিয়ে  ছিলেন আপ টু ডেট। গ্রামের স্কুল থেকে শহরের স্কুল সবজায়গায় আলোচিত হয়েছে দুই হাজার উনিশের  চন্দ্রাভিযান। চন্দ্রযান -২  এর এই সাফল্যটিও কিন্তু কম উল্লেখযোগ্য নয়। 
একটি মন খারাপ করা খবরের পাশেই আসে ভালো খবর। আমরা যেমন পেলাম অর্থনীতিতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের যৌথভাবে নোবেল প্রাপ্তি। 
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করেছিল, ১৯৯০ এ চরম দারিদ্রে বাস করেছে ১৭৫ কোটি মানুষ, ২০১৫ তে তাদের সংখ্যা ৭০.২১ কোটি। এই অতি দরিদ্রদের এক বড় অংশ প্রায় অর্ধেকের বসবাস পৃথিবীর মাত্র দুটি অঞ্চলে নিম্ন সাহারা এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। কয়েক দশক আগেও বড় অর্থনীতিবিদরা এইসব ছোটখাটো কোন দেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, তারা জানতে চাইতেন " বিগ পিকচার ",তারপর উন্নয়ন সম্পর্কে নানান তত্ত্ব উঠে আসত এইসব ম্যাক্রো অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে। ২০১৯ এ অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন যে ত্রয়ী, তার মধ্যে রয়েছেন  অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, ওনার ফরাসী পত্নী এন্থার দুফলো। উন্নয়ন ও দারিদ্রমোচনের বড় প্রশ্নগুলোকে তাঁরা ছোট ছোট ভাগ করে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেরিয়েছেন, এইসব ভ্রমণবৃত্তান্ত ও গরীবমানুষের জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে অভিজিৎ ও দুফলো লিখেছিলেন তাদের বিখ্যাত বই, "পুওর ইকোনমিক্স ",২০১১ তে, তারো আগে ২০০৩ এ তারা গড়ে তুলেছিলেন, "আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব, যেখানে আপাতত চারশো অর্থনীতিবিদ কর্মরত। এই অধ্যাপক দম্পতির নতুন বই 
" গুড ইকনমিকস ফর হার্ড টাইমস্ ",বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে তারা কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যেখানে ভারত সম্পর্কে লেখকদের মন্তব্য, ভারতের মতো দেশের পক্ষে যা কাম্য তা হলো, "সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রকল্প "বা " Universal Ultra Basic Income "। 
যাই হোক নোবেলজয়ীদের মূল কাজ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশীরভাগই সঠিকভাবে অবগত নই। আমরা ভাসলাম আমাদের আবেগ নিয়ে, বাঙালীয়ানা নিয়ে, তার খাওয়া, থাকা, হবি এমনকি ওনাদের ব্যক্তিগত  জীবন নিয়ে রসালো আলোচনা করে। কোন কোন বছর আমাদের হাতে যখন এরকম একটি মূল্যবান, গর্ব করার মতো বিষয় উপহার দেয় তখন একটু সংযত আচরণ হলে হয়তো মূল বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত হওয়ায় পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

0 মন্তব্য(গুলি):