যুদ্ধ, জীবাণু ও মানুষ
যুদ্ধ, জীবাণু ও মানুষপৃথিবীতে যখন পেনডেমিক শুরু হয়, তখন তার চারপাশে যুদ্ধের দামামাও বাজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লেগ, কলেরা রোগগুলিও কেড়ে নিচ্ছিল হাজার হাজার প্রাণ। আমাদের এই পৃথিবীরই দু একটি দেশ,
অন্যান্য দেশে প্লেগের জীবাণু ছড়ানো, নদীতে, জলাশয়ে কলেরার জীবাণু ফেলা, যুদ্ধবন্দী মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে নৃশংস সব পরীক্ষা নীরিক্ষা করা, হ্যাঁ সবকিছু মানুষই করেছিল, এইসব নৃশংসতার বর্ণনা আগে পড়তাম না, এখন মাঝে মাঝে পড়ি, হৃদয় এখন অনেকটাই শক্ত, পড়তে পড়তে দেখি মানুষের হাত কোনকিছুতেই কাঁপে না, ক্ষমতা আর টাকার জন্য, বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্য কায়েমের জন্য মানুষ সবকিছুই করতে পারে।
১৭৬৫ সালে, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর প্রভুত্ব করার জন্য ব্রিটিশ সেনার সর্বাধিনায়ক স্যার আমহার্স্ট নাকি কোন এক চুক্তি অনুযায়ী তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কম্বল ও রুমাল, যেগুলোতে আসলে দেওয়া ছিল ভয়ঙ্কর স্মল পক্সের জীবাণু। যার ফলে ভয়াবাহ মহামারীতে প্রাণ হারায় প্রায় ষাটলক্ষ রেড ইন্ডিয়ান।
আমরাও কোন না কোনকিছুর বিনিময়ে এসবের স্বীকার হচ্ছি নাতো?
আলজেরিয়ায় লেখক আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগ বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাসটি কয়েকদিন ধরে পড়ছিলাম, একটি অসুন্দর শহরে তার বাস। শহরটির নাম ওরাওঁ। যেখানকার প্রকৃতি রুক্ষ, শীত গ্রীষ্ম দুটোই প্রবল। ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। ফরাসী ঔপনিবেশে থাকা এই লেখক একটি মহামারীর শহর, তার লকডাউন, তার নিঃস্তব্ধতা সবকিছুর নিঁখুত আর বিষণ্ণ বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটিতে হঠাৎ করে একটি, দুটি করে, তারপর কাডবোর্ডের বাক্স ভর্তি করে ইঁদুরেরা মরতে আরম্ভ করল। একদিন সারারাত সেই শহরটি শুনল শুধু হাজার হাজার ইঁদুরের মৃত্যুক্লান্ত ডাক, পরদিন রাস্তাঘাট, বাড়ি ঘরে তাদের লাশ, মুখের কাছে ফুলের মতো জমে আছে তাজা রক্ত, শক্ত হয়ে আছে নিহত প্রাণীগুলি। শহরের সমস্ত মানুষ সেদিন বিষাদাচ্ছন্ন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ডাক্তার বার্ণাড রিও এবং শহরের প্রধান পাদ্রী আলোচনা করছেন নির্বিকার হয়ে, একে অপরকে জিজ্ঞেস করছে কি ভাবছেন বলুন তো। পাদ্রী অদ্ভুত সুরে বললেন মহামারী হবে।
সেই মহামারীর সঙ্গে নির্বিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন ডাক্তার রিও, আশাবাদী ছিলেন তিনি। শহরের ফটক বন্ধ প্রায়।
ভেতরের মানুষ গুলো বিচ্ছিন্ন পরস্পর থেকে। একই সঙ্গে বেকারত্ব, গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি, গণহত্যা, স্টেটস এথিইজম, মনে হয় ধীরে ধীরে আমরা ঢুকে যাচ্ছি ২০২০ এর করোনা বিশ্বে। আবার পরমূহূর্তেই প্রকৃতিকে মনে করাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ প্রকৃতি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওরাওঁ শহরের মানুষগুলো যখন কোয়ারেন্টিনে আছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, কাছের মানুষ চলে যাচ্ছে, তখন নিসর্গ হাসছে। আজ যখন দুপুরবেলা বর্ষার অমলবাতাস, আর ঝাঁক ঝাঁক বৃষ্টিকণা জোরে ছুটে আসছিল রোদে পোড়া, পশমের মতো ঘাস বিছানো গরম মাটির বুকে, মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতেই তো আজ আমাদের দেশ সংক্রমণে সর্বাধিক।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর রোমান্টিকতার আংশিক পদচ্ছায়া ছুঁয়ে, আস্তে আস্তে ওরাওঁ শহর থেকে
হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুুর পর একসময় চলে যেতে থাকে মহামারী। অন্যসময় হলে এ উপন্যাস আমি পড়তাম না। ভালো লাগে না আমার। একটু অগভীর, রোমান্টিক টাইপের উপন্যাস আমার পছন্দ। অধিক টানাপোড়ন দেখলেই ছুটে পালাই সেই লেখা থেকে।
কিন্তু এমন একটি সময়ে খুঁজে খুঁজে মানুষের নৃশংসতা, মহামারীর বর্ণনা পড়তেই মন চাইলো। জীবন্ত মানুষের শরীরে প্লেগের জীবাণু ঢুকিয়ে সেই অবস্থাতেই তার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে কিভাবে জীবাণু গুলো মানুষকে মারছে সেটা দেখাও ঘটে গেছে আমাদের পৃথিবীর গবেষনাগারে আরো প্রায় ষাট সত্তর বছর আগেই।
কোভিড ১৯ এর জন্য যে দুই তিনটি বন্যপ্রাণীকে মনে করা হচ্ছে প্রধান উৎস, তারা হলো বাদুর, প্যাঙ্গোলিন এবং সিভেট কেট বা গন্ধগোকুল ।
প্যাঙ্গোলিনের মাংস চীনে খুব জনপ্রিয়, শুধু মাংস নয় তার চামড়া থেকে আঁশ সবকিছুই। অজস্র প্যাঙ্গোলিন এই
এশিয়ার অরণ্য থেকে ধরতে ধরতে তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন। হাজার হাজার সিভেট কেট কে হয়তো হত্যা করা হতে পারে করোনার সম্ভাব্য বাহক ও ধারক হওয়ার দোষে। মানুষ প্রজাতির পর প্রজাতি ধ্বংস করে নিজে বাঁচতে চাইছে, সে বুঝি প্রজাতি নয়, এই ধারণা থেকে পেরিয়ে, নৃশংসতার হাতগুলো খুলে রেখে আর তলে তলে জীবাণুযুদ্ধের পরিকল্পনা থেকে
থেকে যদি পৃথিবীর রাজারা বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে আসন্ন আরোও পেনডেমিকের ভয়াবহতা আর অজস্র আর্থ -সামাজিক সংকটের মধ্যে তিলে তিলে মরার হাত থেকে হয়তো একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারে আমাদের পরের কয়েকটি প্রজন্ম।
0 মন্তব্য(গুলি):