উড়িয়ে দিও, চিরশ্রী দেবনাথ
বইয়ের নাম
উড়িয়ে দিও
আমার কথা
মধ্য রাতের রূপ লেখার মতো, চারদিকে ফিসফিস, গুঞ্জন !
এরা সবাই চরিত্র। ক্ষুধা, অতৃপ্তি, লোভ আর কান্না নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। মহানাগরিক। আইকার্ড বদলে দিই । আমন্ত্রণ রেখেছি, বৈধ সবাই।
সপ্তর্ষিমন্ডলের অলঙ্কার বানালাম, গোপন বাক্সে রাখা। তাপ লাগে পরলে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছ্যাঁকা নিই। দ্বিতীয় প্রহর, তৃতীয় প্রহর। তারপর চরিত্র গুলো ভেঙে যায়। অসহায়ত্ব , অভিযোগে জেরবার। তখনই ঘুম, অথচ জেগে থাকা, এতো কাছে তবু কতটাই দূরে দূরে আলোক কেশর ...
প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ
জলবিকেলে মেঘের ছায়া
ঋতুক্ষরণের রোদচশমায়
প্রেমে সন্ত্রাসে
শুভ দ্বিপ্রহর
ঝাউবন ও জ্যামিতি বাক্স
ধুলোবালি সিরিজ শুরু হলো
১
অধিকার বোধ হারিয়ে গেছে নিজের ওপর
গাছ, লতাপাতা, জঙ্গল, গজিয়ে উঠছে অকাল বর্ষণে
নরম মাটিতে, সুলভ ছত্রাক ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে
এ কি সকালের চেরাপুঞ্জি, কিছু মেঘ যার হেরে গেছে সবখানে
আমার আছে অনেক ঋণ, অনেক ক্ষমা চাওয়া
সেইসব অদ্ভুত, অপাপদের আমি কোথায় রাখি
গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিই ধুলোতে
যদি তাদের পায়ে লাগে কখনো
যেন তারা ক্ষমা করে দেয় আমাকে, গ্রীষ্মবাতাসের ছলে ...
২
আমি চাই তুুুমি শুধু বলো " চলে যাচ্ছি "...অনেকবার
আর একটি একটি যাচ্ছির নীচে
আমি জমাবো হেমন্তের পাতা
নত চোখে লিখে যাবো একান্ত শীতের চিঠি
৩
এসব ভালোবাসায় আমি তোমার কাছ থেকে
কেবল দূরে চলে যাই
৪
তত কাছাকাছি কি বসেছি কখনো
পাশে থাকা গাছ থেকে ফুলদল যেন একই সঙ্গে পড়ছে মাথায়
এতখানি সময় আসলে অপেক্ষাই করিনি
কত তাড়া আমাদের, কোথায় যেন যাবার আছে শূন্যতায়
৫
আমি শান্ত হয়ে আছি
কারণ ঠিক এই মুহূর্তে আমি ভালোবাসছি
কারো হাত, কারো শ্বাস কোনকিছু নেই আমার চারপাশে
আমি একা একা নিঃশব্দ,
জমে আছে রক্ত, জমে আছে জল টলটল আমার ভিতর
এখন বৃষ্টিপাত নেই, পথ নেই, বৃক্ষ নেই, ছায়া নেই
আমি চুপচাপ হৃদয় ছুুঁয়ে দিচ্ছি নিজের,
আবার সরিয়ে নিচ্ছি স্পর্শ, যেন বিচ্ছেদ হলো
নীচের দিকে নামিয়ে আনছি মুখ, চোখের পাতা ঝরছে
আকাশ থেকে সূর্যটাকে খুলে নিয়ে সব আলো খেয়ে ফেলছি,
দিকচক্রবাল নেই, মিশে গেছে আমার ভেতর,
আর আমি ভালোবাসছি।
৬
গোধূলি কেমন নির্বিকার
তোমার তাকানোর মতো
এর আগে দূরত্বকে তেমন করে চিনিনি
৭
খুব কিছু দ্রোহের কথা লিখতে হয় এমনি অশনি দিন ছিল সেদিন
নিউজফিডেও চাপ চাপ রক্ত, দমবন্ধ ব্যর্থনামা
নিজের মধ্যে মিছিলের পা, শিশিরের ভীতু শ্লোগান
তারপর দেখি খালি খালি বেঞ্চ রেখে বিকেল বেরিয়ে যাচ্ছে পার্ক থেকে
সঙ্গে করে নিয়ে গেলো ভেসে থাকা সমূহ মধুর সংলাপ
আবছা স্ট্রীট লাইটের আলো বুকে তুলে নিচ্ছে ঘাসে পড়ে থাকা শিশুদের পায়ের ছাপ
একটি গভীর ষড়যন্ত্র আসলে,
চুপি চুপি এসব তারা ছড়িয়ে দেয় বিষণ্ণ শহরে, জানা ছিলো নাতো !
তারপর আর দ্রোহ আসে না, বিরোধাভাষ কাকে বলে জানি না,
আবার ফিরে আসি পলকা গুহায়, সেই অপরিসর বারান্দা,
অসংলগ্ন সম্পর্কগুলোর ধূপগন্ধা কাগজ, কেমন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে ।
আশ্চর্য ! কিছু থেকেই কি একেবারে বেরিয়ে আসা যায় না !
নিঃসঙ্গ প্রপাতের মতো তাদেরও থাকে ব্যক্তিগত মানচিত্র,
এসবের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে থাকি, কেউ উজ্জ্বল , কেউ গোধূলি , মাতৃস্নেহ যেন ...
৮
কেমন করে যেন আমার সমস্ত ভাবনা তোমার কাছে চলে যায়
অথচ আমার সব মনখারাপের মেঘ ধার চেয়েছিল অন্য কেউ
৯
আরো আস্তে বলো, অনেকটা ঠিক নিস্তব্ধতার মতো
১০
হৃদয়ের কাছে এলে আর চিৎকার করো না ...দূরে গেলেও
১১
যেদিন কবিতা লিখতে পারি, ভালোবাসার কথা একবারও মনে পড়ে না
১২
অক্ষরের কাছে এল সমস্ত ব্যর্থতা ভুলে যাই
এমনকি মা বাবার মৃত্যুতারিখও
কিন্তু কবিতা আমাকে স্বার্থহীন এবং একা থাকার প্রবণতা দিয়েছে
১৩
তোমার দৃঢ় হাত কাঁধে আছে বলে লিখতে পারি
অবচেতনে এসব কথা শুধুই আমাদের
যা দাম্পত্য বলে না কখনো কাজের কথার মাঝে
একটু নক্ষত্র ভেঙে পড়ে কখনো কখনো
তখন সেইভাবে কি বাজে তোমার... ঠিক যেন প্রেমের মতো
১৪
সবকিছু অপবিত্র হয়নি
তাই ভালোবাসা মাঝে মাঝে শৃঙ্গারের মতো জেগে ওঠে
১৫
বিষণ্ণতা কি কেবল বন্দী করে নিজের মধ্যে
কাছে আসা সেই বিষাদের কাছে আমি প্রখর তেজ চাই
১৬
তেমন করে কেন ভালোবাসতে পারি না
যেমন করে গভীর কষ্ট আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
১৭
কোন কোন চাওয়ার সামনে মরে যেতে ইচ্ছে করে, একেই বোধহয় সুন্দর বলে
১৮
তখনো তো বৃষ্টি এসেছিল খুব
দুপাশই ভিজেছিল... ভাবতে ভালো লাগে
১৯
উৎসর্গ জিনিসটি কেমন হয়
কোন আলাদা রূপ, ভাস্কর্য, যন্ত্রণা অথবা শুধুই নীরবতা
২০
যা বলেছো কিছুই শুনিনি
অনুবাদ করে গেছি মুছে যাওয়া অক্ষরে
২১
সম্পর্ক ভাঙা গড়ার শব্দে উত্তর গোলার্ধে ঋতুকাল বদলে যায়
২২
মনকেমনের ভুবন ভাগ করে নিয়ে দুজনেই ঝলক দিচ্ছি খুব,
চকমকি পাথর জমাচ্ছি ছেঁড়া পকেটে
২৩
জীবন আমাকে আর কোন সুযোগ দিও না
সব সুযোগ থেকে দূরে চলে যেতে চাই
জীর্ণ মেধার চাষে অসফল কৃষকের মতো ঋতুধারা পান করি
পেপার ওয়ান, পেপার টু এবং বাদবাকি সেমিস্টার
ট্রপোলজির সূত্রের কাছে ফিরিয়ে দিই
এসমস্ত দীর্ঘ দীর্ঘ থিয়োরি নিয়ে তারা কেন এসেছিল আমার কাছে, জানি না
আকাশ ভাসিয়ে আসা বহু বর্ষা দুহাতে ফিরিয়েছি তখন
বিদ্যুতের রঙ ছিল নীল, গিলে নিয়েছি।
পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছি শুদ্ধ সমাপতন।
ভরা কার্তিকের শেষ দুদিন পৃথিবী ডুবে গিয়েছিল যে কীর্তনে,
বিনা প্রসাধনে তাকে যদি একবার ডেকে নিই
ভোগের থালায় নিরাবরণ শাক, কুমড়োফুলের বড়ায় কামড় দিয়ে বলবো, আমি খুব সহ্য করতে পারি...আগেও এবং এখনও।
২৪
তোমার পিঠে হেলান দিয়ে আমি বিরহের কবিতা লিখি…
২৫
আকাশও বলছিল 'সন্ধ্যা' চলে এসো, 'রাত্রি' এসেছে
জাতীয় সরকের চায়ের দোকানগুলোতে পকোড়া আর নেশার শুরুয়াৎ
এসব তাকিয়ে দেখতে দেখতে যেতে যেতে তুমিও কি ভাবো অন্যকিছু
নতুন কোন বন্ধুত্ব বা চিনে নেবার সেরকম কথোপকথন
একটি অভিমান ঘরফেরত পাখির পালকে, সে কি কম
২৬
মনে হয় রোজ তোমাকে লিখি
জড়ায়ে জড়ায়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে আমার রবিবার, সোমবারের করতল, সুরভিত খাদ
প্রতিদিন গাছ যেন পুরুষ অনিন্দ্য, রূপময়,
বিরহিত ঝরা ফুলকুঁড়ি শিকড় স্নাত, নতুন হয়ে ফুটে থাকি প্রশাখাময়
নখ, দাঁত, হাড়... গলে যায় শক্ত কাঠামো
গাছের সঙ্গে না মিশে গেলে,
কেমন করে উত্তর গোলার্ধে বসন্ত আসবে বলো !!
২৭
বার বার ভালোবাসার কবিতা লিখতে ভালো লাগে
কারণ তারপর আমি মরে যাই, ব্যাকুল অহংকারী মৃত্যু
ভালোবাসা, তোমাকে অহংকার ছাড়া মানায় না
পরী হুঁ ম্যায়... পরী হুঁ ম্যায়... সব মুহূর্ত বেসামাল
অনন্ত মরণ শুধুই কেনো দরজা খোল
২৮
তুমিই কি সেই গন্ধবণিক
যার অরণ্যে আমার অন্য বসন্ত
২৯
বসন্তের এই গৃহমুখীতা থেকে আমি ফিরে যাই
যেখান থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিলো
ভেতরে ভেতরে নিসর্গ বয়, প্রপাত থেমে থাকে
অনিমেষ যাদুরাশির খুবসুরত বন্ধ্ নিগাহে ...যেসে ফরমায়ে মাগরিবকা আজান
তুমহারা তাবির কো লিহাজ হে মেরা
এক সুফি কা দর্দ, এক বাউলের গীত মিশে গেছে বালি আর পলিতে
সিদ্দত কই নজাকত নেহি, জিন্দেগী সে দূর রহো !
সমুদ্দর সে যেসে বালিয়ারী, ঝিনুকের ঘরবাড়ি
ঈশ্বরের আঁখিতে জল দেখবো, বংশীবালকের রুহানিয়ৎ
হে আল্লা ইয়ে কেসা ইনায়ৎ
সুকুন সে ভাগতি হু, ব্যথার স্পর্শে রাখি না বরফ
ফিরভি এক আফতাব, থোরি সি মিঠা রোদ ওউর বারিষোকা ধুন...
৩০
তবে একটি মুহূর্তের জন্ম হোক
আত্মহনন নয় শুধু হননসময়
... সবকথা লিখে ফেলার পর দীর্ঘ নিঃসঙ্গতা, অনিয়মকাল, ডিপ্রেশনের অন্ধকার।
ট্রেন থেকে দেখা দূর জনপদের সন্ধ্যার হাট,
মৌচাকের জীবন লাগা বিন্দু বিন্দু আলো,
পঞ্চায়েত রাজনীতির হুল লাগানো প্রবল বেঁঁচে থাকা,
এখান থেকে মধু আসে, মোটরবাইকের হর্ণ, উদ্ধত চোয়াল আর যাযাবর হৃদয়ের তাবৎ উশৃঙ্খলতা
রাত্রিলাগা তরমুজের ক্ষেতে জেগে ওঠে একটি আলো ঘর ,
চিনেবাদামের খোলসটির দিকে চোখ পড়ে
দুটো বাদামচিহ্ন ... সুনিশ্চিত প্রত্যাবর্তন, একটুও অসুখ হয়নি তাদের কোথাও,
যেন বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছে জোনাকির দল, শিশুরা মাঝখানে
৩১
প্রেমের কবিতা শুধু লিখতে জানি
কাচ কি এক গ্লাস হো, হর এক মৌসম্ উস্ মে টুট যায়ে
৩২
সব মুহূর্তে কেন আশা করি তুমি আমাকে বুুুুঝে গেছো
কাল সকালে আর কিছু মনে থাকবে না তোমার
পাখির পালক তুলে এনে বলবে, রেখে দিও
যদি সে ফেরত নিতে আসে আগামী শীতে
৩৩
আমার কাছে পড়ে থাকা অগুনতি লাইন...সঠিক ঠিকানাবিহীন
মায়াবী সময়কে টুকরো করে তাদের পায়ে পরাই
বহুগামী সুর নয়
একটিই সুর কেবল একটিই সুর
প্রাণপণে বেজে উঠুক ধুলোতে আর সবখানে
৩৪
হে অনিন্দতম
রামধনু দেখতে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা হবে কোনদিন এই পৃথিবী ততদিনে শান্ত হোক
৩৫
প্রাচীন সেই মেয়েকে চিনে রাখছি
আগামী দিনকালে তাকে জিজ্ঞেস করবো
কেমন কেটেছিল গহন কাল গ্রহণে গ্রহণে, সোনালী কামড়ে
৩৬
সব কিছুর আলাদা আলাদা ভাষ্য আছে
আসার, চলে যাওয়ার, থাকার, না থাকার
এ সবকিছু কুড়িয়ে নিতে নিতে সম্পর্ক ঝাপসা হয়ে যায়
অনেক দূর থেকে খরখরে দুপুর কাদা মেখে নরম হয়
সত্তার নিবিড় সংঘাতে, অজুহাত চুপ করে থাকে
কেউ কারো কিছু নয়, তবুও পারফিউম বদলে যায়
একটি অলিখিত বইএর লাইনগুলো কারো ব্যক্তিগত নয়, একথা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়।
৩৭
দীর্ঘ কবিতার একশতম লাইন লিখে
কবি কেটে দিলেন সব, তীব্র তীব্র কাটা
সেইসব শব্দ, একটি একটি অক্ষরের কাছে আজীবন ঋণী থেকে গেলো আত্মার অংশ
কবিতায় যাপন করা হয়ে গেলো
বিনম্র বিষাদ, রূপময় নিঠুর আস্বাদ
৩৮
উচ্চতা দীর্ঘ হলে ফিরে যাওয়া দেখতে ভালো লাগে
মনে হয় আমার পৃথিবী যেন ঢেকে থাকে তার ছায়ার বনাঞ্চলে
৩৯
চিনে নেওয়ার পর অপরিচিত হতে বেশ লাগে
কিছু জানা নেই আমার
পছন্দের রঙ্
খাবার
পাহাড় না সমুদ্র
বন না মরুভূমি
হস্তী অথবা অশ্ব
দুর্বার স্বাধীনতায় আমি তখন যুদ্ধ করি... ধুলো উড়িয়ে
৪০
ভালোবাসাকে, শ্রদ্ধাকে ছোট হতে দেখলে
চোখ বন্ধ করে ফেলি
আমি, আমিও তো করি এসব চু কিৎ কিৎ
দুহাতের আঙুল দিয়ে সঞ্চিত শ্রদ্ধারা ঝরে যাচ্ছে দেখতে দেখতেই তো মরব
ইমেল, পাসওয়ার্ড সব জানা থাক কারো কারো
আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে সেখানে, অবিন্যস্ত সজ্জায়
৪১
পাহাড় থেকে রোজ আত্মহত্যা করে ঝর্ণা
কত আনন্দের কান্না তার
নীচে দাঁড়িয়ে কেউ যখন স্নান করে তাকে ছুঁয়েই যেন তার মানুষ হওয়া, মৃত্তিকার গন্ধে পাগল পাগল ভাব
৪২
আমার চাওয়ার মতো যদি আসতে,
বেসুমার স্নেহে, গভীর বাৎসল্যে যেন পাহাড়ের গ্রীবা জড়িয়ে ধরেছি
৪৩
মা কেমন আছো?
আমি ভালো।
যার কাছে রেখে গেছো,
তার কাছে আছি, দিনরাত কবিতা লিখি, যা খুশি
এর চাইতে বেশী ভালো থাকা কাকে বলে জানি না
৪৪
এসব নোনাধরা কাজের মধ্যে আমরা দন্ডকারণ্য দেখতে গিয়েছিলাম
ঠিক কি ধরনের সংসার থাকে বনের আদরে ও অন্ধকারের নিবিড়ে
চোরাশিকারীর দলের কাছে বুক পেতে দেওয়া সেই চন্দনবৃক্ষের মেয়ে
গাছ নত হওয়া শিখেনি, শেষ হতে হতে মরুভুমি করে যায়...দেখে এলাম এসবই,
সুবাসিত বসন্তের দিন সমাগত, জঙ্গলের স্মৃতি লিখছি
নিহত পশুর দাঁত, চামড়া, রক্ত আমার পংক্তি জুড়ে,
বনজ ফুলে লেখা এপিটাফে মৌমাছির গান।
কাছাকাছি কোন অরণ্যে আবার যাবো আসন্ন বুদ্ধপূর্ণিমায়,
সেখানে বৈরাগ্য চাই না, স্তোত্ররা যেন হয় বিবাহমন্ত্রের মতো।
৪৫
বৃষ্টির একটি আলাদা গন্ধ আছে, "পেট্রিকোর "
এ গন্ধটি এখনো তৈরী করতে পারেনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুগন্ধি কারখানা
মনে হয় গন্ধটি পৃথিবীর নরনারীর নিরুচ্চারিত ভীতু ভালোবাসা
তার রঙ্ ও গন্ধ দুটোই চেনা গেলো না...
৪৬
একটি নিবিড় উচ্চারণ করতে কেন ভয় হয়
যেন বাজপাখি উড়বে, ভয়ানক চোখ মেলে আছে,
আকাশেও খেলছে বিদ্যুৎ প্রবাহ
ধ্বংসের কথা শুনতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে দোয়েল পাখি
৪৭
যেদিন অর্ধশত হলো, সেদিন বুঝতে পারলাম
এই ধুলো ঝড় উপহার দিতে হবে আমাকেই, অন্যকাউকে নয়
৪৮
এজন্যই বোধহয় কেউ কাউকে বুঝতে চায় না
তারপরই যে সরে সরে যায় হৃদয়ের স্তুপগুলো
খাদ হয়, নীচে অন্ধকার জমে, জমতেই থাকে
৪৯
কেমন করে যেন হয়ে যাচ্ছে এই সিরিজ অথবা
ব্যর্থনামা
কত হরিণ চুপ করে দাঁড়িয়ে, আমলকীর বনে কখন আসবে আবার ফল ঝরার সময়
হঠাৎ যেন কেউ এসে চলে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে অরণ্যের শব্দ
৫০
কবিতার মৃত্যু হলে মরে যাবো, সীমাহীন স্বেচ্ছামৃত্যু
৫১
স্বগতোক্তি মিলে গেলে, ক্ষমা করো পাঠক
পড়েছিলে, ভালোবাসা জেনো
৫২
কেন মনে হয় অপমান ! মুঠোতে শুধু ধুলোই জমেছে
দোলের রঙ, উড়েছে, ঝরেছে, পথ রচিত হয়েছে ঘরে ফেরার
আনমনে শুধু হেঁটে যাচ্ছি, পলাশ তুলেছি পুনর্বার
৫৩
অবজ্ঞা আমারো আছে
তুমুল হয়ে কেউ আবার ফেরত দেবে আমাকে ...জানি
এ কোন অভিসার নয়, ছোট্ট খাপখোলা বিস্তার
৫৪
আঘাতেই ভালো থাকি, তবু রাখো আদরে
৫৫
শূন্যতর হতে ভয় লাগে, একটি অসম বিন্দু হাতে নিয়ে বসে থাকি
এপর্যন্তই আমার উজাড়, আমার উজান, আমার কাছে আসা
৫৬
কিছু বোঝাতে চাই না, শুধু চাই আমাকে পড়ে নিও
জেদ, রাগ, যাবতীয় দিয়ে দিলে, নিজের কাছে আর কিছু থাকে না
৫৭
সকাল বেলা খুব লিখতে ইচ্ছে হয় এই বিহঙ্গবাড়িতে
তখন আমার দিকে পৃথিবী ছুটে আসে ধূসর চিতার মতো,
খলবল করতে থাকে রোদ
গাছেরা ছুটে বেড়াচ্ছে এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে
তুমিও এইসময় আয়নায় দাঁড়াও
পেছনে আমাদের সময়,
আমি এক চামচ স্বপ্ন তুলে দিতে চেষ্টা করি
হয়তো গলার স্বর রূঢ়, চোখও তেমনি সতেজ নয় আর,
অথচ দেখো !
এমন ভাব হয় আকাশে বাতাসে আর খোলা দরজায় ...
মনে হয়, সব পংক্তি উড়িয়ে দিই, ঘুরে ঘুরে আসুক আরোও ধারালো হয়ে
...যেন চিতা ফিরে গেছে নরম শিকার ফেলে,
আপাতত, এখন!
৫৮
স্পন্দনের বিভাজনে পরাজিত হই, ব্যক্তিগত বিশুদ্ধ পরাজয়
৫৯
কলেজ থেকে যে মেয়ে ফেরে, তার সঙ্গে সঙ্গে আসি
সে জানে না, আমি তার ছুঁয়ে যাওয়া রোদ ভাগ করে নিচ্ছি
সে জানে না, আমি তার একটুখানি "তাড়াহুড়ো ",
আর এক পালক ' ক্লান্তি ' ভাগ করে নিচ্ছি
তুমি জানো না, মেয়ে
তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমি হারানো পৃথিবীর মাঠ ভাগ করে নিচ্ছি
বাড়ি ফিরে তুমি মুখ ধোবে, আমিও ধুয়ে যাবো,
যেন এক ধুলোর জাদুকরী বদ মতলবে ঘুরছিল...
৬০
খুব কাছে, কি খুব দূরে, পাহাড় কোন মায়াবী হ্রদ কিংবা ঝর্ণা ...
যাওয়া হয়নি সময়ে,
আজ দেখি ঘর ভর্তি জলাশয়, পাহাড়ি সূর্যাস্ত
এখানেই বানিয়ে দিচ্ছে আপামর নিভৃৃত অরণ্য
হয়তো খুব একটা কঠিন নয় এই অরণ্য উৎপাদন
যেমন করে গুহাতেই গড়ে ওঠে ক্ষীণ পৃথিবী, সেখানেই মরে যায়
৬১
আজকাল আমরা নিঃশব্দে কথা বলি
৬২
দাম্পত্যের কোন শুশ্রূষার দরকার নেই
সে একটি দেয়াল, পাশ ফিরে দাঁড়ানো
দুহাতে শ্যাওলা জমাচ্ছে, কালো কালো
কেউ বোঝে না তাকে একটু মুছতে হবে, রঙ করতে হবে
সবকিছু মেরামত হয়, পালিশ হয়, এমনকি সেই পুরনো কিছু জিনিসও
শুধু দাম্পত্য দাঁড়িয়ে থাকে, দেখতে থাকে
সামনে এক নির্জন উঁচু বাঁধ,
জোড়া জোড়া পানকৌড়ি রোজ আসে সেখানে,
তারা শুশ্রূষা জানে, জানে কিছু অপরাহ্ন শুধু জলের কাছে বসার , শুধু নিজেদের কাছে...
৬৩
এতো কোলাহল শরীর জুড়ে, ক্লান্তি ভরা জরায়ু
আঙুলেই অকালবর্ষন হোক, পাপহীন থাকি তবু
কোনদিন বন্যামুখর পাহাড়ি নদীর তীরে মৌণ থাকবো
এরকমই আপ্রাণ আমার সম্মতি ও সন্তরণ।
৬৪
মাতাল হও যদি ভালোবাসো
ঠিক ততটাই যখন আমার কালো উচ্ছন্নে যাওয়া ত্বক
তোমার কাছে রাঙা মাটি, বুনো গন্ধ
শীর্ণ হরিণী ক্লান্ত শরীরে চোখ রেখেছি দিগন্তে
বাজের মতো ডানা ঝাপটাও
নেমে আসতে আসতে তুমি সন্ধ্যার মতো ঝরে পড়ো
৬৫
বিকেলের দরগায় একটি সাইকেল থেমেছে
একশিশি আতর রেখে গেলো হাসান মিঞা
ঘরে শেষ শয্যায় বিবিজান, এ আতর বড়ো প্রিয় তার
হে খোদা, তোমার বাগানে একখানি ঘর দিও তারে,
বেহেস্তের অর্ধ চাঁদে জানলায় রেখো এই আতরদান কাল সন্ধ্যায়
৬৬
হোটেলের আয়নায় কত টিপ
সব টিপের পেছনে উন্মনা আমি
এই অনু ঠিকানাগুলো দংশিত সময় কারো
হৃদয়ে বাতিল সন্ধ্যা রেখে তারা বাড়ি ফিরে গেছে
৬৭
তোমার কষ্ট পাওয়া মুখ থেকে বর্ষা ঋতু নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি শুধু
৬৮
কি উপহার দিতে চাও?
পেতে ইচ্ছে করে, দুহাতে, এক শরীরে, দৃপ্ত নয়নে।
বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড় ও চুম্বন পুরনো হয়ে গেছে।
যদি বলো এনেছো কিছু, চাও দিতে, তার আগে...!
তবে বলি ওষ্ঠ জুড়ে মগ্নতা চাই, ক্লান্তির নিভে যাওয়া দেখতে চাই।
৬৯
আমাদের হাত কেউ কাউকে ছোঁয় না
একটি স্বর্গ মাঝখানে
ফুটছে দেদার অপরাজিতা
আমরা আলো জ্বালি
হাতগুলোতে স্পর্শের আকুতি নেই
এসব প্রাপ্তি অপার্থিব
জরাহীন সমূহ মুহূর্ত
নির্বাক ঔষধ গিলে যাওয়া সন্ধ্যাসময়ে
দেহ ছড়িয়ে দেবে জমিয়ে রাখা এই অলোকানন্দা নিঃশ্বাস
বালকবালিকার কোলাহলের মতো পৃথিবীর কোন কোণায়
একটি অচেনা তারা জ্বলে ওঠে নিভে যাবে
শুধু একবার...একবারই ...
৭০
এই তো আমি খুলে দিলাম সন্ধ্যা
নক্ষত্ররা এসো, এখানেই হোক তবে আড্ডা
প্লেটের ঢালে ক্লান্ত পাপড়, একটুখানি ঠান্ডা চা
তোমার মতোই কিনেছে সে একমুঠো বিষণ্ণতা
এমন করে তাকাও যেন আটলান্টিকে ডুবছে জাহাজ
রাস্তা হারানো সাইকেল এক, দেয়াল জোড়া তুচ্ছতা
তোমার ছায়ায় লেপ্টে আছে ক্লাসফাঁকি অন্যমনস্কতা
আমিও যেন তরুণ এক, পকেট ভর্তি হতাশ জিজ্ঞাসা
তবু জানি ভাঙা মাস্তুলেই থাকে চোরাবালি, ফিরে আসার ঠিকানা।
৭১
আসমানী রঙ সারাদিন মিশেছে লালে... কাল ছিল ঈদ,
কুরবানীর সিদ্দৎ আজ ঝুলনের সায়াহ্নে
পশুর রক্ত মানুষের রক্তে কি রাখে বাঁশরীর সুর!
আর মেঘও উঠেছে বহুত খুব, ইস্ ঝুলনকা নজাকত তো দেখো
শেরওয়ানী ও চুনরী দুটোই হারিয়েছি আমরা এই চন্দ্রশহরে...
৭২
কিছু রইলো না বললে ফাঁকা লাগে আভূূূূমি দিকচক্রবাল,
সব আছে,
যেন একটি ছায়াছন্ন রাস্তার পাশে কাঠ চেরাইয়ের কারখানা
খুব সকালে গাছেদের গায়ে মৃত্যুচিহ্ন এঁঁকে কাজে মন দেয়
এমনি করে সকাল হোক আমার,
খুব নীচু স্বরে বলি নিজেকে মন্ত্রের মতো, 'ভালো থাকো '
কোনদিন জোনাকি শুনে ফেলে, কোনদিন মৌমাছি
এত দূর উড়ে যেতে পারে না বলে, তারা এ শহরেই আলো জ্বেলে যায়
৭৩
আমার গণিত ভুল সূত্রে ভরা, হাতে শুধু রুক্ষ পদাবলী
সুর নিজের কাছে রেখে, ঈশ্বর দিয়েছে আমাকে গান শোনার পাখিরালয়
ওখানেই প্রিয় পাখির দল অচেনা রঙের পালকে বার বার স্পর্শ দিয়ে যায়
এতবার জন্ম নিই, সুবাসিত মৃত্যু,
কিছু শব্দের জন্ম দেওয়া বাকি ছিল বলে
ফিরে ফিরে আসি তার কাছে, তোমার কাছে
৭৪
সেই শূন্যতাই, অবশেষে ঋতুচিহ্নের মতো শরীরে ও যাপনে
বসন্তের সমাগমে অর্থহীন পংক্তিমালা, তোমাদের শুদ্ধ ঠিকানা খুঁজে নিও
৭৫
দিন দিন রাক্ষসীর মতো হয়ে যাচ্ছে অভিমানের মুখ,
সমস্ত আগুন নিয়ে যে বক্ষজোড়া গড়ে ওঠে তাতে ভরা বাদল শুধু, মা ভাব।
কি চেয়েছিলে? কি চেয়েছিলে? কি চেয়েছিলে?
চিৎকার করেছি, এতো জোরে ... এত নীরবে
পৃথিবীর সব মেয়েদের অভিমান হয়ে মরে গেলো সে আমার ভেতর ...
৭৬
তারপর আর একদিনও এলো না এমন ঘোর
যার পায়ে হাত রেখে লিখে দিতে পারি নিহত সময়গুচ্ছ
কি আশ্চর্য ! হঠাৎ একটি আস্ত নিরাভরণ আমাকে দিয়েছিল সে
দূরে দূরে ঘুমিয়ে থাকা শালবনের মতো
মনে হয় সেই ক্ষণমুহূর্তটি অর্ধেক করে নিয়ে গেছে সেইসব কিশোরীরা
যারা সবুজ জলপাই এ কামড় দিয়ে ঝুটমুট ঈর্ষার জানান দিতো
৭৭
ঘুরে এলে পাহাড়শ্রেণী, নেশাগ্রস্ত পাকদন্ডি, গাছের চাঁদোয়া,
সে সবই আমি জেনেছি, অন্ধলোক যেমন করে পড়ে নেয় স্ত্রীলোকের ভাষা
হয়তো তোমার ছিল সমূহ স্বগতোক্তি বাতাসের কাছে
নিম্নচাপে ভেসে আসা সেইসব শিলাবৃষ্টির কুচি আমাকেও ছুৃঁয়ে গেছে
দানা দানা লাল রঙ দূরত্ব মেপেছে, অথচ কাছে নেই কোন আগুনের স্টেশন
আকাশবাতি পাঠালে কেমন হয়
সেইসব বনজ পদচিহ্ন খুঁজে আসবে, শিশিরের ওপর ঝুঁকে থাকা হৃদয়
জানতে ইচ্ছে করে খুব, তুমিও কি পড়ো আমাকে একইভাবে?
দূরত্বের বেলাভূমি দীর্ঘায়িত হতেই থাকে
যেন কোন এক নুলিয়ার অপেক্ষায় আছি আমরা, যে আমাদের গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাবে !
৭৮
পশুমেলায় পুরুষ অশ্বটি লাখে বিক্রি হলো
একইসঙ্গে অশ্বিনীও
দুদিক থেকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদের দুই অশ্বারোহী
খুড়ের অসহায়তা জানে এই শেষ, জানে কান্না শুষে নেবে মাটি
যদি না মেরে ফেলা হয় তাদের
তবে রাত্রিশেষে একটি গৃহ থেকে অনেক দূর অব্দি যাবে দীর্ঘশ্বাস
আমি তাকে যাদুত্বরণ দেবো,
নক্ষত্রখচিত ভোরের আকাশ তোমারও খুব প্রিয়, কোন একদিন বলেছিলে
কি করে জানি মনে থেকে যায় আমার সব !
৭৯
বালিকা ওঠ !
বালিকা উঠিবে না, তাহার বিরহদোষ লাগিয়াছে
সে সকল ক্রন্দন আমার হস্তে তুলিয়া দিয়াছে
আমি বড়ো হইয়া গিয়াছি, অথচ সে ইহা বুঝিতেছে না
সবুজ ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে এখন আমার খড় চোখ।
বিরহ কাকে বলে জানি না,
জানি পথ হেঁটে যেতে হয়, বিরহ খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনতে হয় লেখা,
বালিকা বুঝিতে শিখিয়াছে সকলি বাণিজ্য ...বাণিজ্যে বসতি সরস্বতী
৮০
মৃত্যু আসার আগে
বলব আসতে, বলব দেখে যেতে হবে
ততদিনে হেরে গেছে যশইচ্ছা, কুটোকাটা মনখারাপ
নিঃশর্ত হয়েছি সব শর্তে
বৃষ্টির মতো নেমে আসা সেইসব লাইন
পুনর্লিখিত হোক, চুরি হোক খুব
গ্রীবার কাছ থেকে চুল সরিয়ে
লিখে ফেলুক অন্য কেউ
আত্মার আচ্ছন্নকাল দিয়ে দিতে চাই তাকে নির্জনে,
তেমন প্রসারিত হাতই খুঁজেছি জাঁহাপনা
আজানের সময় শুকতারাকে বিদেয় দিয়ে
ভোরের রঙে লোভ করেছি
আড়ম্বর দেখে সরেছে কলম,
নিষাদের মতো নিষ্ঠুর হয়েছে সে, ক্ষতের কাছে ফেলে গেছে তির ধনুক ...
৮১
আমরা আর ততটা সামাজিক নই
মানে আমি, তুমি, বেড়াতে আসা বেড়ালটা, নৌকার মতো দেখতে যে ঝোপটা তৈরী হয়েছে সেটা
মহাজাগতিক একটি স্টেশনে যাবার অপেক্ষায় আছি
যেখানে রয়েছে পাশাপাশি কয়েকটি সদ্যজাত পৃথিবী
আগের পৃথিবীতে আমার শূন্যতা এবং অভিমানগুলো আছে
এখানে আসার সময় ইচ্ছে করেই এগুলো আনিনি,
বার বার কুড়িয়ে নিয়ে গোছাতে গোছাতে আমি গ্রহান্তরে যাবো
৮২
ভালোবাসার কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে এলে তাকে চেনা যায়।
আসলে সে খুব একা
কোনদিন পাশে সঙ্গী রাখতে পারেনি
বোঝাতে গিয়ে এই শব্দটির আরেকবার প্রয়োগ করতে হল আমাকে,
বলতে হল, 'ভালোবাসা ' একাই বাস করে , স্বনির্ভর , নিবিড় এবং অসুখ করে না তার …
৮৩
আজ সকাল দশটা বেজে যাচ্ছে, কাল রাতেও কিছু লেখা হলো না, আজকেও না
অথচ বাজার করে আনলে তুমি, রান্নাও হলো, কিন্তু লেখা হলো না
কালকে যখন দশটা বাজবে, তুমি বরং মেঘেদের চলে যেতে বলো
ভিজে ভিজে লিখতে হয়, এসব কথা পুরনো হয়েছে
বরং ব্যস্ত ব্যস্ত একটা দিন হোক, সূর্য বেশ খানিক ভাজা ভাজা
উল্টোপাল্টা আইন, বন্ধ কারখানার শ্রমিকের আত্মহত্যা, অভাব, খুন, ধর্ষণ, বেকারসমস্যা, অনশন আর অনশন,
ইত্যাদি বলে দিক এসব লিখে কোন লাভ নেই।
জনসংখ্যাবৃদ্ধি কিংবা নদীবাঁধজনিত সমস্যাও তো কবিতার প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে...
তারপর আবার কিছুক্ষণ পর যখন দেখি তোমার মুখে দিব্যি মিশে আছে আলো হাওয়া,
তখন মনে হয় একটা কবিতা লেখা এখনও ঠিক অপরাধ না।
৮৪
আজকাল আঘাত নেই বলে চুপ করে আছি
আদর করছো বলে দিনান্তের অক্ষরগ্রাস নেই
বিষাদ নিয়ে তাকিও না, আত্মঘাতি সিঁড়ি যেন
এসো আমরা উত্তর মহাসাগরের গল্প করি
৮৫
শহরের বুকের ওপর আস্তে আস্তে নামছে কুয়াশাযূথ ...
হেমন্তের বিষাদময়ী নারী সব
তাই দেখে রাস্তা ফাঁকা করে দিচ্ছে মানুষ,
তাদেরকে ভয় পায় ফ্ল্যাটবাড়ীর ডাইনিং রুম, ব্যালকনির দোলনা
তারা যদি একবার তাকায় দোলনা থেমে যাবে,
খাবার টেবিল থেকে গন্ধ ফিকে হতে হতে নীরবতা চুর চুর
এই যে সার বেঁধে হৈমন্তিকার দল অঞ্জলি খুলে ছড়িয়ে দিচ্ছে খইের দানার মতো শীত
ইটকাঠ পাথরের মধ্যবিত্ত শহর মনে করছে কেকের দোকানে ভিড় হোক,
অথচ লুটিয়ে থাকা খই এর শরীর জন্মমৃত্যু ঘোষণা করে যাচ্ছে একসঙ্গে।
৮৬
যেসব লোকেরা বিয়েবাড়ির প্যান্ডেল বানায়
সবশেষে সানাই বেজে উঠলেই ধূমপানে মন দেয়, গ্লাসভর্তি করে খায় জিন্দেগী কা ঝুট্,
তাদের সামনে রজনীগন্ধার সুলভ দৃশ্যময়তা, একচিলতে কনের মুখে অনাগতজুঁইশোভা,
শহরের মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য গাছের বৈভব,
এই চন্দনের বাগানে তাকে নিয়ে যেতে পারলে, গাছের ছাল ছাড়ানো দেখতে পারতো সে,
পাথরের গায়ে ঘষে ঘষে কত ব্যথা হয়, সাদা রক্ত ঝরে
৮৭
শঙ্খের মতো এক শহরে বস্তি নেই, ক্ষিদে পাওয়া ক্ষিপ্র মানুষের দল নেই,
সেখানেও সার সার দুঃখের ঝাউ বসতির মৃদু নিনাদ
একজন মানুষী আরেকজন মানবের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে মসৃণ হেসে
পোর্সেলিনের কাপ ছাড়িয়ে অভিজাত ধোঁয়ায় রিং খুঁজতে বেরিয়েছে টানা বারান্দার বাড়ি, রঙওঠা নেমপ্লেট
ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লোকটি হ্যাঁ করে গিলে নিচ্ছে এসমস্ত আবছা দূষণ
আর ঝকঝকে গ্রীণ সিগন্যাল পথ দেখিয়ে দিচ্ছে ...ঐ তো দূরে কাচের ঘর, পারিজাতফুলের বাড়ি
৮৮
মল্লিকা বনে যুদ্ধ লেগেছে, দামামা শুনে গতি কমিয়ে দিয়েছে ছুটে আসা দূরের ট্রেন
কামরা ভর্তি করে এনেছিল তারা পর্যটনপ্রিয় মানুষ
কিন্তু শহরে আলো নেই,
ভ্রমরের দল মরে পড়ে আছে এমনি সংবাদ ছড়িয়েছে সবখানে
শহরের সব মল্লিকালতা ছিঁড়ে গেছে... ভ্রমরের শব,
সেখানে মুখ নীচু করে নেমে আসছে আকাশ,
মেঘ দিয়ে দিয়ে মৃত্যু ঢেকে দিচ্ছে, ঢেকে দিচ্ছে ফুলের প্রলাপ
পরবর্তী আলো জ্বালাতে একটি মাত্র ঋতুকাল সময় দিও ...
৮৯
তুমি আজকাল খুব পার্কে যাও, কি দেখো জানি !
পার্কের পাশেই স্নেহলতা কুঞ্জ, বিক্রি হবে ...
গেটের পাশে ক্রীশমাস ট্রি কে খুব উজ্জ্বল লাগছে তবুও।
কেউ নেই বাড়িটির বুকে ,
বসে বসে শুনতে থাকো অনেকদিন আগের জলভাঙা ঢেউ, ফুটবল ম্যাচের গোওওওল
এখন বাড়িগুলো লোডশেডিং জানে না, পাড়াশুদ্ধ অন্ধকারে জ্যোস্নায় হাঁটা ভুলে গেছে কতকাল ...
৯০
...
চিনি খাওয়া কমিয়ে দাও, পারলে খেও না
এসবই সাধারণ কথাবার্তা শীতের সকালে, নাগরিক টেবিলে।
তেরছা করে আসা রোদে ক্যুরিয়ারের খাম, আগে থেকে জানা বিষয়বস্তু
তখন মনে হয় খুব কাছাকাছি যদি থাকত একটি সহজ নদী,
আর তার নাম হতো রিন্টি মিন্টি ঝিঙ্কি কিংবা মধুবালিকা ।
বলতাম "মধুবালিকা "থেকে গা ধুয়ে আসি, কি পরিস্কার জল !
আসার সময় দুহাত ভরে থাকত উৎস থেকে ভেসে আসা রোগ নিরাময়ের ওষুধ, পথ্যের সতেজ বেগমবাহার।
৯১
বন্ধু শব্দ টি নিয়ে ভাবলেই
দূরে জেগে উঠছে একটি ধূসর তাঁবু
শুধু দুজন মানুষ অনেকদিন পরে সেখানে
তারা গল্প না করেও, জেনে যাচ্ছে
তাদের ভেতরের সব পাতা ঝরার সোজাসাপটা বিবৃতি
৯২
আমার মধ্যে একটি, “পালানো “আছে
চোখ থেকে, চিবুক থেকে, ঘামকপাল থেকে
একেই আমি, “ভালোবাসা “ বলি …
৯৩
কোন বৃহৎ কথা মনে আসে না
এই টুকিটাকি, শিশিরের পতন, এক কণা আগাছা
দু হাতে ধরে বসে আছি ছোট পাহাড়, রেলপথ
একটি ছোট স্টেশন আমাকে ঘিরে
দুজনে বসে আছি, পানপাত্রে সর্ব রোগহরা ঔষধি
গা থেকে ঝরে যাচ্ছে নদী, মাঝি আর নৌকো
এই যে বলে যাচ্ছি সংলাপ
দ্বিতীয় জন, তৃতীয় কোন অভিসন্ধি, গলি বা রাস্তা নির্বাক
এখানে কি ইতিহাস লেখা হতে নেই, শীতঋতুর যাত্রাপালা
মুখ থেকে রঙ ধুতে ধুতে
দেখেছিলাম এক নারী কেমন করে হয়ে যায় পুরুষ
একটি অশ্ব যেন গোয়ালে বাঁধা
কেশরের কাছে বাজি রেখেছে স্বচ্ছতোয়া চোখ
৯৪
লিখতে পারছি না, অক্ষর ছিঁড়ে যাচ্ছে, বিন্দু বিন্দু হেমন্ত জল
উনুনে আগুন জ্বেলে যেন চলে গেছে কেউ
বাজার করতে ইচ্ছে করে ভুলেছে সে, আনেনি হলুদ গুঁড়ো
আসলে সে আর ফিরেই আসেনি, ডাকতেও পারি না আমি তেমন করে,
বাকি যা কিছু দুর্বল অজুহাত, "আশ্রয় "সে কি এতোই সহজ!
৯৫
আমার মধ্যে যজ্ঞ শুরু হয়েছিল
হঠাৎ চারপাশের বন থেকে কুড়িয়ে আনতে লাগলাম সুগন্ধি সমিধ
আত্মমাংসে কি প্রচন্ড দহনপ্রবণতা
তিরতির করে দুগ্ধ, ঘি, মধু ঢালছি
শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি , রম্য আহুতি হোক হৃদয়ের
কয়েকদিন মাত্র ! জানলাম, এই দহনকালের লিপিভাষ্য,
নতুনত্ব নেই, দেবতাদের ভাষাই , মুণিদের অক্ষরে লেখা।
এখন যজ্ঞ থেকে উঠে যাচ্ছি ... হোমাগ্নিই চেয়েছিলাম, পেলাম কিছু সাধারণ আগুন,
যা গৃহসমূহে রাতে জ্বলে, পূর্ণতা অপূর্ণতায় তার কিছু এসে যায় না।
৯৬
দেবারতি মিত্র আমার খুব প্রিয় কবি
ওনাকে পড়ার পর, আমাকে পড়ি
শব্দসম্ভার শুধু ...শুধুই,
আঁচ নেই ! ধোঁয়া নেই ! গলা জ্বালা করা নেই !
শুয়ে আছে নিথর,
যেন সব সৌন্দর্য তারা পান করেছে
গত জন্মের অমাবস্যায় সমবেত মিলনে
এখন শুধু ফ্যাকাশে রক্তাল্পতা
চেরী ব্লসম শেষে ভেতরে ক্ষয়, ত্বকে বেড়ে চলা শুষ্কতা।
৯৭
অনেক অনেকদিন পর হয়তো তুমি একদিন জাগলে ঘুম থেকে
জিজ্ঞেস করলে আজ কেমন আছো
আমিও যেন, কালই বলেছিলাম অনেক কথা সেরকম ভাবেই বললাম
জ্বর গেছে পালিয়ে, দেশেও শান্তি ফিরেছে
চল বেরিয়ে পরি কোথাও নির্বিবাদে,
তারপর আর নেই, বহুদিন কিছু নেই, চিরাচরিত খরা
যেন কোন কথা হয়নি কোনদিনও আমাদের
তুমি বলেছো আমি দুঃখ দিই শুধু
আমি বলেছি তুমি দুঃখ দাও শুধু
সেইসব নিরীহ বোকা বোকা দুঃখরা সোচ্চারে ফুটেছে আজ বাগান আলো করে।
৯৮
ঠিকই আলো জ্বলেছে কবিতার ঘরবাড়িতে
বকেয়া টাকাপয়সা পেয়ে মালিক, আত্মা খুলে রেখেছে দরজায়
জুতো খুলে ঢুকতে হয়
পশমের জুতোজোড়া পরে ঘুরেছি শীতের কালে
মাটির মেঝে গরম হয়ে আছে, পশুর পায়ে চলেছি হেঁটে
কোথায় খাবার আছে, পিপাসা খুব
আর দেরী নয়, আমি দরজা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি
আসলে তো ঘর নয়, জলাশয়ের রাস্তা, নীল ছায়া তুলে নিয়ে পথঘাট সাজাচ্ছে কয়েকজন কলেজের ছেলেমেয় ।
৯৯
তুমি খেতে, পরতে দাও বলে লিখতে পারি
ধুলো ঝারতে ঝারতে কোনদিন সামান্য বাদলা
আমি মনে মনে ভাবি জীবন আর কদিনই বা
দীর্ঘ হতে দেবো না তাকে কোনমতে
একটুখানি লিখেটিকে, ছোটখাটো নামযশ, উত্তরীয়...
শান্ত হয়ে বলব, মরণ এসো, অনেক হয়েছে,
পাল তোলো সাদা ধবধবে,
কালো মাঝি, সিডার কাঠের নৌকো
পূর্ণ চাঁদ, গভীর বিস্তারে ছড়িয়ে পড়া কোন এক মোহনা,
খুব রাজকীয় ভাবে আমি যাবো, বললাম কিন্তু দেখো !!
লেখক পরিচিতি
চিরশ্রী দেবনাথের জন্ম ত্রিপুরার কৈলাসহরে , ১৯৭৯ এর ১২ ফেব্রুয়ারী। বাবা রাধাগোবিন্দ মজুমদার, মা মায়ারাণী মজুমদার। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হন। তার লেখা ত্রিপুরা ছাড়াও আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত লিখেন। এই বইটি সহ তার কাব্যগ্রন্থ হবে পাঁচ। কবিতা আত্মার সঙ্গে মিশে গেলে আর ফেরা যায় না, এটাই বিশ্বাস করেন।
যোগাযোগ করতে হলে,
chirasree.debnath@gmail.com
0 মন্তব্য(গুলি):