ঝাউবন ও জ্যামিতি বাক্স, চিরশ্রী দেবনাথ
বইয়ের নাম
ঝাউবন এবং জ্যামিতি বাক্স
চিরশ্রী দেবনাথ
জ্যামিতি বাক্স
কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না বলে
কেমন সস্তা হয়ে যাচ্ছে বিকেলগুলো
যেন ধুলো ঢেকে দিয়েছে বিকেলের গাল
একটি রাস্তা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে দুপুরে
আজ, কাল বা পড়শু বা আরো অনেকদিন
এ পথে যাবে না কেউ, তাই বুকজোড়া ঝোপ তার
কুবো পাখি দেখে এসেছে বারান্দায় কুয়াশার জুতো
যে দম্পতি হারিয়ে ফেলেছে পৌষের সকাল
তাদের মানিব্যাগে টুক করে ঢুকে যাবে বলে
ঘন আষাঢ়ের রামধনু স্নান সেরে বসে আছে
ছালমোচন
দুঃসহ সময়ে কবিতা থেকে উঠিয়ে নিলাম প্রতিবাদ,
আগুন থেকে যেমন সরে যাচ্ছে ক্রমাগত দহনের দাগ
প্রতিবাদ, দহন ছাড়া শুধু লেখা হোক প্রেমের কবিতা,
প্রেম কোন প্রতিবাদ নয়, রাজনৈতিক খুন কিংবা বক্তৃতা নয়
নিরবিচ্ছিন্ন রুগ্ন বসন্ত ছড়িয়ে...কবিতা লেখে প্রেমিকের হাত।
প্রেমের কবিতা খুব নিরাপদ,
অন্তরে ঘটতে দেওয়া অপরাধের মতো
তাই হোক, কেমন শব হয়ে গেছি সব
স্বেচ্ছাচারী কবি একটি বাকলহীন প্রেম লিখো,
সতৃষিত ধর্ষণের পংক্তি,
এ সবকিছুই খুব নিবিড়, নিরাপদ, গোপন, প্রতিবাদ।
অন্নদাতা
অনশন চলছে, কৃষকদের,
আদিগন্ত মাঠ পেতে তারা বসেছে
জল খাচ্ছে না, শস্যদানা খাচ্ছে না
যেন পৃথিবীর পাখি তারা, সন্ধ্যার আগে নীর ছোঁ মেরে নিয়েছে কেউ
তাদের এখন ধর্মঘট, বীজ বুনবে না, ট্রাক্টর চালাবে না, ভোরের কুয়াশা মেখে মাঠে আসবে না
হে শক্তিমান, তুমি কি হেনেছো সেই কুঠার
করো না এমন, করো না এমন
দেখো কেমন মায়া ভরে
পৃথিবী তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে সূর্যাস্তের মদিরা, সভ্যতার অনীহা ...
গোলাপী মুক্তো
আমার সবকিছু ব্যক্তিগত
যেমন একটি গ্রাম, শহর ও মহানগরী একান্ত
গ্রামের দেহাতী, রূঢ় যুবকটি আমার ভেতর
সে শহর দেখতে চায় না, কথা বলে না, জেদের পাহাড় তার ভেতরে
শহুরে যুবকটিও আমার, শুধু নির্জনে দরজা বন্ধ করতে জানে
মহানগরীতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেহাতী যুবক বদলে গেছে
কাঠের বাক্সে তার কাছে এখন গোলাপী মুক্তো,
যত্ন করে পাঠিয়েছে আমাকে
মিথ্যে শেখার পর থেকে সে একদম নির্ভুল
ধানক্ষেতে ছড়িয়ে দিয়েছি মধ্য জোয়ারে আহৃত সেই গোলাপী সমুদ্রবীর্য
আমার কাছ থেকে সমুদ্র অনেক দূরে
তাই আগে মুক্তো চাষ করি, তারপর জল, তারপর ঢেউ, তারপর গর্জন, আস্তে আস্তে গোটা সমুদ্র
ঝাড়লন্ঠনের ছায়া
আজকে বোধহয় আর লেখা হবে না
বড়ো মগ্নতা এসে গেলো, মনে হলো ভাবি একটু
এই ভাবনাগুলোকে রাজপ্রাসাদে রাখি তো !
সেখানে শুধু ঝাড়লন্ঠন আর টানা পাখা...
পাখা আলো সরিয়ে দেয়, আলো বাতাসকে, কেমন বৈরীভাব দুজনে
আর তখন সব শোনা যায়
শিশিরপতনের শব্দ , কচুপাতায় নক্ষত্রের রঙ জমা হওয়ার শব্দ
আশ্চর্য গাছেরাও এতো জোরে কথা বলে জানতাম না
রাতের বেলা আকাশ যে আস্তে আস্তে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে, অন্ধ না হলে দেখা যায় না
সব সুর, সব কবিতার জন্য অন্ধ হয়ে যেতে হয়,
বাউলের একতারার কাছে হিংসে রেখে আসতে হয় ...
উদাসীন মাল্যগ্রন্থি
আজ এসেছি মুগ্ধ হতে, রঙ চটে নির্জন হয়েছে কিছু,
বাকি সব উদ্ভাস
কোথাও জমেছে পাথর আদর জমে জমে, শ্যাওলার মখমল
রাস্তা শেষে আঘাতেরা মেলেছে ডানা
সিন্দবাদের সমুদ্রদ্বীপে তারাই রূপপাখি
এখন গুটানো হাত, নিমগ্ন পা ঈশ্বরের কাছে
তবুও পেতেছি হাত, যা কিছু দিলাম অবিশ্বাস, অবিরত সংঘাত
কোনটাই স্বাধীনতাকামী যুদ্ধ ছিল না
ভেবে গেছো অপ্রেম, নির্বোধ এ জমি
জেনেছ হয়তো বুদ্ধের মতো নির্বান অস্তরাগ, ক্ষীণ পাকদন্ডী, দেয়ালে তারিখমালা, অশুদ্ধ তিথি
যদি এখন ফেরত দিতে বলি সমস্ত অগম্য গ্রহণ, খোলা জানলা, কিছু ব্যক্তিগত মাল্যগ্রন্থি
কি অসম্ভব দুর্বার হবে সেইসব রঙীন ফেলে আসা গেঁজে যাওয়া ফেনা !
সোনার চুড়ি
ভালো হবো, ভালো হবো খুব!
এই খুলে ফেললাম দুর্বিনীত জিহ্বা, শ্লেষ শব্দ অস্ফুট
খরা তো ছিলো না কখনো, কি সে মরল কে জানে
এই কি সেই মসৃণ সেগুন, শিকড় ছড়াতে জানে না ভালো করে
এমনি সহজ, ভয়াবহ সরল
হঠাৎ বিদ্যুতচমকে খুঁজেছে মেঘের উৎস, হেমন্তে ও বাকি ঋতুতে
অবিরাম বক্ষ পেয়েছে সে, ঝরেছে প্রথমের মতো
সূচকাঙ্ক
আজই তাদের দেখাদেখির শেষদিন,
তারপর মেয়েটি বিদেশ যাবে বরের সঙ্গে।
ঐ যেখানে মিসিসিপি বয়ে চলে, এলোমেলো উদ্বাস্তু ছাতা।
তাই সে ফিরিয়ে দিতে এসেছে সমস্ত মেসেজ, প্রাণপণে ডিলিট করছে ভাগ করা কথোপকথন ।
এক জোড়া চোখ সামনে। নির্বাক।
দীর্ঘ শুভেচ্ছাবার্তার লাল হলুদ রঙগুলো দ্রুত মরে যাচ্ছে।
উড়িয়ে দাও সব, এসমস্ত দিনরাত, বিহঙ্গের ছটফটানি।
এখন দ্বীপান্তর হবে। সঘন নির্বাসন। স্ব ইচ্ছায়। যুদ্ধে মন নেই।
ছেলেটির কিন্তু খুব যুদ্ধ করতে ইচ্ছে করছে।
যেন সে অর্জুন। গান্ডীবে এখনি দেবে টান।
আসলে এসব কিছুই হচ্ছে না, শুধু মেয়েটি চলে যাচ্ছে।
আর দিকচক্রবাল জুড়ে হেরে যাচ্ছে তৃৃতীয় বিশ্ব ...
ডাকটিকিটের মেয়ে
এখন কিছু কাগজ আসে নিজের নামে
একটি ঠিকানা রয়েছে যেন কোথাও আম্রপল্লবের স্বস্তিকাচিহ্নরচিত
আমার মার একটি বাড়ি ছিল, নিজেদের ঘাম রক্তে ঘেরা।
সেখানে বাবার নামে অজস্র চিঠি আসতো, বই পত্র ইত্যাদি।
মার নামে তেমন কিছু চিঠি আসেনি কোনদিন, কিন্তু বাড়িটি প্রবলভাবে মাকে ঘিরেই হয়ে উঠেছিল।
এই যে, আজকাল কিছু পত্রিকা, বই ডাকযোগাযোগ !
এটাই বোধহয় সামান্য অতিক্রম করা মাকে,
বাড়ি, অস্তিত্ব কিছুই হয়তো ঠিকঠাক নেই, তবুও, খামের ওপর এইসব অদেখা জায়গাগুলোর নাম পড়ে পড়ে শুধু মনে হয়
অক্ষরগুলো নৌকার মত, মৃদুমন্দ বাতাসে তাদের বিবাহ দিয়েছি দূরদেশে
পরিচয় আর ঠিকানা নিয়ে মায়ের হৃদয়ে ফিরে এসেছে সুখী মুখ দেখাতে।
বলপ্রিন্টের ঘর
তাদের বাজারে চড়া ঋণ
বাকি পড়ে আছে স্কুল ফি, দোকানের খরচ,
জমে আছে বেঁচে থাকার জন্য না কেনা ঔষধের প্রেসক্রিপশন ।
সবাই আজ বিকেলে মরে যাবে ঠিক করেছে
কেউ তাই ছাদ থেকে কাপড় আনছে না, বিকেলের ট্রেনের হুইশেল শুনছে না,
কাঁদছে, নিস্তব্ধ হয়ে কাঁদছে।
ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ দরজা খুলে দিলো
ওমনি ঝাঁক বেঁধে ঘরে ঢুকে গেলো একদল গৃহগামী পাখি
আজ রাতে তারা এখানেই থাকবে
সুতরাং রাঁধতে হলো, খেতে হলো, রাতের বাহুতে দীর্ঘায়ত হচ্ছে প্রহরকাল,
এই নিবিড় রসিকতা চলতে থাকুক।
সমুদ্র গৃহ
একজন বড়লোকের মেয়ে একজন গরীবের ছেলেকে ভালোবাসলো
তারপর গাছে গাছে ফুল ও ফল
একটি নিবিষ্ট বৈশাখে রেজিষ্ট্রিও সমাপ্ত
আকাশ থেকে আসন্ন বর্ষার আরক্ত জলধারা তাদের ভিজিয়ে দিলো খোলা রাস্তায়
মেয়েটি ছেলেটির বাড়ি এলো
তিনখানা ঘর, খোলা বারান্দা,
একটি লেবু গাছ ও পাশের বাড়ির কাঠগোলাপ গাছের ফুলে ছাওয়া অবাধ্য ডাল
সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটি অপেক্ষা করতে লাগলো নির্জনতার
অবশেষে রাত , মাঝখানের ঘর, তিনখানা দরজা , সারা রাত অন্যদের আসা যাওয়া।
রাগ, চলতে থাকা অভিমান !
গরীব ছেলেটি হয়তো এই দুরন্ত সমস্যাটির আশু সমাধান নিশ্চয়ই করবে
কিন্তু খুব দেরী হওয়ার আগে
এইসব ভালোবাসা প্রবণ দম্পতিরা
পৃথিবীর কাছ থেকে কি একটি নির্জন সমুদ্রগৃহ উপহার পেতে পারে না !!
সংলাপ ...ঝাউবন ও ধুনকর
তোমার বুঝি চার পাহাড় অভিমান হয়েছে !
আমি খবর দিয়েছি ধুনকরকে, খবর দিয়েছি তাঁতীকে
খবর পাঠালাম রঙীন ধুলোর কারিগরকে ...
কি হবে তাতে?
নিদাগ হবে, ধূসরিত হবে, তুলোর ফেঁসো জড়াবে নাকে মুখে,
মোটা কাপড় পরে কুড়িয়ে আনবে লম্বা মিছিল
তাতে কি অভিমান কমবে?
তাতে অভিমান লজ্জা পাবে, ডোরাকাটা দাগ, গর্জন শুনে মনে হবে সুখী মাওবাদী।
আমি তখন গুহা কিনতে বেরোব। তোমার হাতে গর্জন গাছের ডাল, মেঘ আটকে রেখেছো। দাঁড়িয়ে আছো পেছন ফিরে।
গুমগুম পাহাড় ভাঙছে, দিনদুপুরে... শুনতে পাচ্ছো? পাচ্ছো কি?
এসেছো তাহলে !
তবে শোনো ..., কিছু ঝাউগাছ আর দু তিন টুকরো বেলাভূমিও এনো সঙ্গে , বারান্দা সাজাবো আমি
দস্যুরোগ
যে পথে চলে গিয়েছ সে পথে এখন নদী, দিক বদলে এসেছে
জটায়ূর আহত পাখা থেকে কুড়িয়ে এনেছি যুগ্ম আভরণ,
অভিমান আর অভিমানে লেখা
চা গ্রাম গুলোর ভোর জুড়ে আজও, এই ভরা অন্নকুট উৎসবে, ক্ষুধা নামে
পচা ভাতের সোমরস গিলে গিলে বনমালীর দল সমূহ কুটিরে ঢেলে দেয় রাতজাগা নক্সা ,
তাদের কাছেই দিতে হলো ধান্যপল্লবে লেখা একটি মাত্র পংক্তি, " আমি যে নত হয়েছিলাম ",
সে থেকে ডানা ভিজে ভিজে ওঠে , গায়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরকুনো শ্যাওলা, কচি বেড়ালশিশুর ভয়লাগা স্বর
লিখে রাখি সব ... বিকেল করে আসা গৃহরোদে
একা একা পড়ি, বৈশাখমাস জাগে নিভৃত প্রদেশে
ঘেমে ঘেমে রক্তচন্দনের দস্যুরোগ বাঁধাই,
এ সুখদান, এ দুঃখদান, এ ভরা কলস দিয়েছো বলে আমি পথচারিণী …
উন্মোচন
পাগল দম্পতি দেখেছি, যুগ্ম নক্ষত্র , সহাস্য পঞ্চাশ
একটি ছেলেও আছে, সুস্থ, সুন্দর শালতরু
কি বিশুদ্ধ মিলনে জন্ম হয়েছিল তার, কত প্রবল ভালোবাসাবাসিতে
আগুনের ঘরবাড়ি, ভেতরে গুহা, নদী, অন্ধকার,
ধরেছে হাত, জ্বলেছে মনের গহন
অথচ মস্তিস্কে জট, খাদের গভীর, নেমেছে কুয়াশা, সূর্যের আলো দিকচিহ্ন হীন
এই সময়ে রোপিত বীজ, পত্রপুষ্প দিয়েছে ঢেলে কোন্ শ্বেতপ্রপাত ?
লেখক পরিচিতি
চিরশ্রী দেবনাথের জন্ম ত্রিপুরার কৈলাসহরে , ১৯৭৯ এর ১২ ফেব্রুয়ারী। বাবা রাধাগোবিন্দ মজুমদার, মা মায়ারাণী মজুমদার। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শুরু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হন। তার লেখা ত্রিপুরা ছাড়াও আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত লিখেন। কবিতা আত্মার সঙ্গে মিশে গেলে আর ফেরা যায় না, এটাই বিশ্বাস করেন।
প্রকাশিত অন্যান্য কাব্য গ্রন্থ: জলবিকেলে মেঘের ছায়া, ঋতুক্ষরণের রোদ চশমায়, প্রেমেসন্ত্রাসে, শুভ দ্বিপ্রহর।
যোগাযোগ: chirasree.debnath@gmail.com
0 মন্তব্য(গুলি):