ত্রিপুরার অণুগল্প চর্চা, ( প্রকাশিত, "দৌড় সাহিত্য পত্রিকা ")

১০:৩৬ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ 


ত্রিপুরায় অণুগল্প চর্চা 


অণুগল্প আজকাল খুব চলছে, এ কথাটি বর্তমানে খুব শোনা যায়, আসলে অণুগল্প ব্যাপারটি বহুদিন ধরেই চলছে। বিদেশ এবং স্বদেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিকরা অণুগল্প লিখে গেছেন এবং লিখছেন। ছোটগল্পের চাইতে বেশ কিছু ছোট গল্পকেই অণুগল্প বলা হচ্ছে। দুইশ বা আড়াইশো শব্দের মধ্যে হতে হবে তাকে। আয়তন স্বল্প হওয়ার জন্য প্রত্যেকটি লাইন মেধাবী, সংবেদী এবং তীক্ষ্ণ হওয়া দরকার। অতি অল্পের মধ্যেই বিশাল একটি চিন্তার অবকাশ রেখে সে শেষ হয়ে যাবে। যাতে পড়ার পর প্রাণ  থেকে খুব সহজেই  বের হয়ে আসে “আহ্ “।

তবে অণুগল্প এবং মুক্তগদ্য এক নয়। মুক্তগদ্য কবিতা ভাবনার বা গদ্য ভাবনার একটি ভাবগম্ভীর স্বাধীন প্রকাশ, নিটোল একটি গল্প বা কবিতা পাঠককে উপহার দেওয়ার তাড়না এখানে লেখকের নেই। তিনি তার ইচ্ছানুসারে ভাবনাটি এখানে বিস্তৃত করতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুক্তগদ্য নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রীক হয় না, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যান লেখক। তাই মুক্তগদ্যকে কখনই অণুগল্প বলা যায় না। অথচ প্রায়শই আমরা দেখি আবছা একটি ধারণাকেই অনেকে অণুগল্প বলে প্রকাশ করছেন। অবশ্য সত্যিকার অর্থে অণুগল্প, গদ্যকবিতা এবং মুক্তগদ্য তিনটির মধ্যে কোন পার্থক্য করা যায় না, লেখকরাও বাধ্য নন তাদের চিন্তাকে এতটা সীমান্ত মেনে লিখতে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে আমরা প্রায় প্রতিদিনই অণুগল্প পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। আর এইসব অণুগল্পের মধ্যে কিছু কিছু গল্প একদম চমকে দেয়, হীরকখন্ডের মতো দ্যুতি ছড়ায় গল্পের মূল সুরটি। মানুষের হাতে সময় কম, ট্রেনে, বাসে যেতে যেতে, কাজ করতে করতে টুকটুক করে পড়ে ফেলা যায় এই গল্পগুলো, কোন কোনটার রেশ  থেকে যায় অনেকদিন, কয়েকটি পড়ার পরই মন থেকে মুছে যায়।

কাফকার মেটামরফোসিস বা রূপান্তর কে অনেকে অণুগল্পের প্রথম সূচনা মনে করেন, বাংলা সাহিত্যে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অণুগল্পের জনক বলা হলেও, তাঁদের লেখা গল্পকে তাঁরা অণুগল্প ইত্যাদিতে আখ্যায়িত করেননি। এই নাম পরবর্তীতে দেওয়া হয়, গল্পের আয়তনের ওপর নজর রেখে। যদিও এখনো অণুগল্প ঠিক কত বড়ো হবে, দুশো না আড়াইশ না পাঁচশ এই ধারণা একদমই স্পষ্ট নয়। আমার ব্যক্তিগত মত হলো অণুগল্প দুশো থেকে আড়াইশো শব্দের মধ্যে হবে। 

পদার্থবিজ্ঞানে অণু বলতে পদার্থের সেই কণার কথা বলা হয়েছে যেখানে পদার্থের সকল গুণ বর্তমান এবং তার নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব আছে।

সুতরাং অণুগল্পও সেইরকম। গল্পের সকল গুণ থাকবে, ছোট হলেও সে স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক চেতনা বিস্তারে সম্পূর্ণ সফল।

এবার আসি মূল বিষয়, ত্রিপুরার অণুগল্প চর্চা।

প্রত্যেক গল্পকার বা কবিই আজকাল জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অণুগল্প লিখছেন, সেই গল্পগুলো সফল না অসফল সেটা বলে দেওয়ার কোন পাঠক বা সম্পাদক নেই, সকলেই বিতর্ক এড়িয়ে চুপচাপ দেখতে ভালোবাসেন, নিতান্তই জলো অস্পষ্ট ভাবনাকে অণুগল্প বলে ছাপিয়ে দেন প্রায় সকল সম্পাদকই।

এখন পর্যন্ত ত্রিপুরার লেখকদের কোন অণুগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়নি আমার জানা মতে। মৌমিতা প্রকাশন দীর্ঘদিন আগে অণুগল্প চেয়েছিল, সংকলন প্রকাশের জন্য, তা প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানি না সঠিক, কোন কপি বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়ে নতুন কোন আপডেট দেখতে পাইনি। ত্রিপুরার স্রোত প্রকাশনা শুনেছি একটি অণুগল্প সংকলন প্রকাশ করবে, এ বিষয়ে সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজ করছেন গোবিন্দ ধর ও পদ্মশ্রী মজুমদার। 

স্রোত প্রকাশনা থেকে গল্পকার সঞ্জয় পুরকায়স্থ এর একক অণুগল্প সংকলন বেরিয়েছিল কয়েকবছর আগে।গল্পকার দীপঙ্কর গুপ্তেরও একটি একক অণুগল্প সংকলন রয়েছে। 

সম্প্রতি দিব্যেন্দু নাথ তার লিটিল ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি করছেন অণুগল্পের ওপর।

দৌড় এবং উত্তরপূর্বের লিটল ম্যাগাজিন  যাপনকথা বের করেছেন বিশেষ অণুগল্প সংখ্যা। সেখানে ত্রিপুরার বহু লেখকলেখিকা অণুগল্প লিখেছেন। “দৌড় “ এর এই সংখ্যাটিতে প্রত্যেক লেখক লেখিকার ছবি,  নাম, ঠিকানা ও পরিচয় সহ চারটি করে দুশো শব্দের মধ্যে অণুগল্প প্রকাশিত হয়েছে। যেখান থেকে ত্রিপুরার সাম্প্রতিক অণুগল্প সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া গেছে। এই সংখ্যাটিতে অণুগল্প লিখেছেন ত্রিপুরার পদ্মশ্রী মজুমদার, পৃথ্বীশ দত্ত, হারাধন বৈরাগী, দেবাশ্রিতা চৌধুরী, গোবিন্দ ধর, অভীক কুমার দে, অমলকান্তি চন্দ, তমা বর্মণ, দেবীস্মিতা দেব, চিরশ্রী দেবনাথ।

এছাড়াও  মধুমিতা নাথ, অভিজিৎ চক্রবর্তী, অর্পিতা আচার্য, বিল্লাল হোসেন, চিত্তরঞ্জন দেবনাথ, বর্ণালী দাস বন্দোপাধ্যায়, শান্তশ্রী মজুমদার, রাধা দত্ত, রীতা শিব, রিয়া দেবী, সুমন পাটারী, তমালশেখর দে, বিভাবসু দে, নবীন কিশোর রায়, সোনালী রায় বাগচী, সঞ্জীব দে, সম্রাট পাল তাদের লেখা অণুগল্প মাঝে মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং দৈনিক কাগজে পড়তে পাই। 

এইসব অণুগল্পগুলোতে সবাই স্বকীয়তা এবং মেধার ছাপ রাখতে চেয়েছেন, কতটুকু প্রতিভাত হয়েছে, তারা তাদের সৃজনশীলতার ব্যপ্তি কতখানি প্রসার করতে পেরেছেন বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা আশাবাদী, ততটা উজ্জ্বল দ্যুতি সবার ক্ষেত্রে না দেখা গেলেও বলা যায় তারা অণুগল্প চর্চা করছেন এবং করবেন। 

আর একটু পিছিয়ে গেলে সময়ের দিক থেকে, ত্রিপুরার কিশোর রঞ্জন দে, হরিভূষণ পাল,  অশোক দেব, সদানন্দ সিংহ, দীপঙ্কর গুপ্ত, সত্যজিৎ দত্ত, শ্যামল বৈদ্য, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, অশোক সিনহা, সন্তোষ রায়,  অশোকানন্দ রায়বর্ধন, সুনীতি দেবনাথ,  হৃষিকেশ নাথ, , নন্দিতা দত্ত, গৌরী বর্মণ,  পার্থ ঘোষ, সঞ্জয় পুরকায়স্থ,  সবাই বহু সার্থক অণুগল্প লিখেছেন।


ত্রিপুরার বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়

অণুগল্প পাঠানোর জন্য সংবাদ বিচিত্রা বিভাগে বলা হয়, এবং সেখানে প্রায়শই সুন্দর অণুগল্প, পাঠ করার সৌভাগ্য হয়, ত্রিপুরার নানান জায়গার নবীন ও অভিজ্ঞ উভয় লেখকদের কাছ থেকেই।

সাম্প্রতিককালে পঠিত কিছু প্রিয় অণুগল্প সম্বন্ধে সংক্ষেপে বলে শেষ করছি,

যাপনকথায় পেলাম পৃথ্বীশ দত্তের “জলপড়া “ গল্পটি। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েও অণুগল্পের সমস্ত দিক বজায় রেখে শেষ পর্যন্ত একটি নিটোল গল্প, উপদেশ নয়। এই সংখ্যাটিতেই আছে, “লোকটাকের কইমাছ “,কিশোর রঞ্জন দে “র লেখা। গল্প রচনায় তার মুন্সিয়ানা পাঠকের মনে অব্যর্থ লাথি চালায়।

আর সহজাত মেধাবী দক্ষতায় ত্রিপুরার অন্যতম গল্পকার সত্যজিৎ দত্তের লেখা, “ভোর “। সুনীতি দেবনাথের লেখা, “সোনা বউয়ের একদিন “

তরুণ কবি সুমন পাটারীর লেখা “বিকেলবেলা”, তমালশেখর দে এর, “হরিণী “ইত্যাদি।

আসি “দৌড় “এর বিশেষ অণুগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত ত্রিপুরার কয়েকজন গল্পকারের লেখা,

এখানে তমা বর্মণের, “ঈর্ষা “,পদ্মশ্রী মজুমদারের “শাড়ি “,অমলকান্তি চন্দের, “কাকচাংতি “, হারাধন বৈরাগীর “বাবা লংতরাই, শঙ্কতাড়িনী ও তাদের সন্তান “, দেবাশ্রিতা চৌধুরীর, “স্বাধীনতা কারে কয় “, অভীককুমার দে র, “অবসরপ্রাপ্ত মা “ ইত্যাদি অণুগল্প বিষয়ের বৈচিত্র্য ও বলার ভঙ্গিমায় গল্পপাঠের রেশ রেখে যায়  । 

ত্রিপুরার এক তরুণতম অণুগল্পকার সৌম্যদীপ দেব। তারলেখা বেশ কয়েকটি বুদ্ধিদীপ্ত অণুগল্প পেলাম কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। উত্তর পূর্বের উপন্যাস নিয়ে চর্চা করছে এই তরুণ গবেষক, পাশাপাশি অণুগল্প চর্চাও করছে। তার একটি অণুগল্প

"অন্ধ"

একটা স্বল্পায়তন গর্তে কয়েকটা খরগোশ বাস করতো। প্রবল খরায় গর্তের দেয়াল খসে পরতে লাগলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে সবাই মন মরা।বাইরে গেলে মানুষের আহার হবার ভয় তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু বনে না যেতে পারলে খাবারও নেই। ক্রমশ সকলেই দুর্বল হতে লাগল।তখন একটা খরগোশ স্থির করলো সে বেরোবেই। তখন সে কাউকে কিছু না বলে, গর্ত থেকে বেরোতে চেষ্টা করে   উপরের দিকে উঠতে লাগল।পেছন থেকে বাকি খরগোশ গুলো বলতে লাগল-'আরে বোকা নীচে আয়, নইলে মরবি। 'কোনো কথা না শুনে সে চলতে লাগল। জয়ী হতেই হবে।বাইরে তখন ঘন অন্ধকার। সে গাঁ ঘেঁষে চলতে লাগল।বাকিরা আবার বলছে-'দেখ দেখ কান্ড।'রাত গিয়ে ভোর হয় তখন সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো এবং কাছেই একটি বাগানে চলে গেলো। খরগোশটি এতো দূর এসে প্রাণ বাঁচাতে পারলো, কারণ একটাই সে 'কানে শুনতে পায়না'। যার জন্য বন্ধুদের ডাক তার কানে আসেইনি।পরদিন সেই গর্তের মুখটা ধস নেমে বন্ধ হয়ে গেলো - আর কখনো খুলবেনা হয়তো। "

ত্রিপুরার বেশীর ভাগ অণুগল্পই সুঠাম, সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত বলে আমার মনে হয়, এই রাজ্যের  অন্যতম কবি ও গদ্যকার অশোক দেবের লেখা, “পুরুষ “অণুগল্পটি যেটি আন্তর্জালে সার্চ করে পেলাম, বাংলা ট্রিবিউন শারদ সংখ্যা, ২০১৮, তে মুগ্ধ করেছে। 

এখন পর্যন্ত বিশেষ কোন অণুগল্প সংকলন প্রকাশিত না হলেও, ত্রিপুরায় প্রচুর অণুগল্প লেখা হচ্ছে এ রাজ্য এবং বহির্রাজ্য থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, আন্তর্জাল পত্রিকায় ত্রিপুরার লেখক লেখিকাদের  উজ্জ্বল উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে। আর বর্তমানে ফেসবুকেও প্রতিদিন পাচ্ছি নানান স্বাদের অণুগল্প। 

অণুগল্পের ধারণক্ষমতা ছোট বলে অল্পতেই বিষ, অল্পতেই অমৃত, প্রথমদিকে টানটান হলেও শেষদিকে যদি ঢলে পরে কবিতার ভাবালুতা নিয়ে তবেই গল্প মাটি, এ বিষয়টি ছাড়া ঘটনার বৈচিত্র্যে, পরিবেশনের সৌকুমার্যে ত্রিপুরার অণুগল্প বিশিষ্টতা এবং মেধাবী সৃজনশীলতার পরিচয় বহন করছে। 




ইমেইল : chirasree.debnath@ gmail.com



 

0 মন্তব্য(গুলি):