অন্দরমহল থেকে বারান্দায়

৭:২২ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা  জানিয়ে 

অন্দরমহল থেকে বারান্দায় 
                        @চিরশ্রী দেবনাথ 

১৮৬৭ সাল। 
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। কলকাতা শহর থেকে বহুদূরে গ্রামটি  । গ্রামের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটি নদী। এই গ্রামের আধার সে। তারই জলে গ্রামখানি সুজলা সুফলা। 
  গ্রামের জমিদার কৃষ্ণচরণ মুখার্জি। 
অত্যাচারী নন। প্রজাগণ সুখে শান্তিতে থাকে। দরকার মতো খাজনাও মকুব করেন। তেমন দৈন্য কোথাও চোখে পড়ে না। 
তিন পত্নী জমিদার মশাইের । ছয়জন সন্তানসন্ততি।  
 বলতে অপেক্ষা রাখে না গ্রামের মধ্যে এতো বড় বাড়ি আর কারো নেই। তবে বাড়ির তেমন কোন নান্দনিক ছিঁড়িছাঁদ নেই। প্রথম অংশে বারমহল। সেখানে কিছু কারুকার্য রয়েছে। মোটা মোটা থামের ওপর ঠাকুর দেবতার মূর্তি। একটি বড়ো ঘর। সেখানে  গদিওয়ালা তিন চারখানা তাকিয়া। দুটো আরাম কেদারা। 
দেওয়ালে মৃত জানোয়ারের মুখ, পূর্বপুরুষদের ওয়েল পেন্টিং।

বার মহল  পেরিয়ে, নাট মন্দির, ঠাকুর দালান। তারপর ঘুঁপচি গলির মতো গিয়েছে খানিকটা। সেটাই অন্দরমহল। অন্দরমহলের মাঝখানে উঠোন আছে। চারপাশে টানা বারান্দা আর সংলগ্ন ঘর। পেছনে গাছগাছালি। সারা দিনমান ছায়া ছায়া হয়ে থাকে প্রায়। দুপুরে আর শেষবিকেলে রোদের পরশ লাগে বারান্দায়, উঠোনে। এই অংশে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘর রয়েছে। সেটি হলো পাকঘর। আর খাবার জায়গা। পঁচিশ ছাব্বিশ পাত পড়ে দুপুরে বিকেলে দাওয়ায়। সকালে জলখাবার। 
সবার আবার অন্দরে এসে খাওয়ার নিয়ম নেই। অনেক  অতিথিই অন্দরে আসেন না। বার দালানে দুটো ঘর, স্নানের জায়গা রয়েছে। বামুন ঠাকুরের মাধ্যমে বাইরেই খাবার পাঠানো হয় তাদের জন্য। 
গ্রামের মধ্যে এখন কিছু পড়াশোনা জানা লোকজন হয়েছে। দুটি ছেলে  গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। কৃষ্ণচরণ মুখার্জীর পড়াশোনা আছে। সংস্কৃত জ্ঞান। ইংরেজিও শিখেছেন। ইংরেজি সাহিত্যও পড়েছেন কিছু। বড় ছেলে পড়াশোনা তেমন করেনি। জমিদারীর কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুজনকে কলকাতা পাঠিয়েছেন। উত্তম বিদ্যালাভের আশায়।  
সকাল বেলা। অগ্রহায়ণ মাস। শীতের আমেজ। জমিদারবাড়ির সামনেই ধানক্ষেত। পাকা ধানের গুচ্ছগুলো সূর্যের আলোকে দোলা খাচ্ছ আহ্লাদে সোহাগে।
কৃষ্ণচরণ বাবুর সামনে ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে ঈষদুষ্ণ ঘন গরম দুধ আর লুচি হালুয়ার থালা নিয়ে যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সে ভরা যুবতী। বছর একুশ হবে। এখন বারমহলে লোকজন নেই।
সেইজন্যই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যা তার বাবার কাছে এসেছে। এসবই কৃষ্ণচরণ বাবুর জানা। বাবার কাছে একান্ত কিছু আর্জি থাকলে, সকালের জলখাবার অন্যদিনের চাইতে তাড়াতাড়ি তৈরী করে, নিজেই নিয়ে আসে। কিন্তু ধোঁয়া ওঠা এই খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণচরণবাবুর চোখে জল এল।  সন্ধ্যা তার জ্যেষ্ঠা কন্যা। 
 নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে । ঘন কোঁকড়ানো চুল ছোট করে কাটা। স্নান শেষ কিছুক্ষণ আগেই। ধবধবে সাদা শাড়ি। কুড়ি পঁচিশ ভড়ি গয়না দিয়েছিলেন বিবাহে। কোন কিছুই পরা হলো না সন্ধ্যার। যখন বিয়ে হয়েছিল,  গয়নার ভারে নড়তেই পারতো না। ভগবান বেশিদিন এই কষ্ট তাকে দেননি। নয় বছরের মাথায় বিধবা হলো কৃষ্ণচরণবাবুর বড়ো মেয়ে। একমাসের মাথায় পিতৃগৃহে ফেরা। তিনিই নিয়ে এসেছিলেন। বিধবা দু বোন আগেই ছিল। যোগ হলো তার বড় মেয়ে। বিধবা মহলে ঢুকে পড়ল সন্ধ্যা। সকাল থেকে সেখানে আচার বিচার শুরু। পুজো আচ্চা, নিরামিষ অন্ন একবেলা, রাতে খই দুধ। রাতগুলো যেন শেষ হতে চায় না। কি গুমোট এই অন্ধকার। কাক ডাকা ভোরে উঠে যেত  তারা তিনজন। জমিদার বাড়ির দুটো পুকুর। বাইরে আর অন্দরমহলের শেষে। সেখানেই স্নান। তারপর দিনের কাজ শুরু। কাজ কি কম ! বিধবাদের কঠোর পরিশ্রমই নিয়ম। যাতে শরীর থেকে রূপের জৌলুস ঝরে যায়। বুড়ো হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু সন্ধ্যার ফল হচ্ছে উল্টো। পরিশ্রম তার শরীরকে দীপ্তিময় করেছে। দীর্ঘকায়া, তন্বী, শ্যামাঙ্গী এই যুবতীর টান টান ত্বকে অশ্ব ছোটাচ্ছে যৌবন।
আজ নির্জলা উপবাসের দিন। সন্ধ্যা কিছুই খাবে না সারাদিন। 
কৃষ্ণচরণ জিজ্ঞাসু মুখে সন্ধ্যার দিকে তাকালেন। সন্ধ্যা কোন ভূমিকা না করে নির্লিপ্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে বলল, বাবা আমি পড়াশোনা শিখব।  বালিকা বিদ্যালয়ে যাবো। 
কৃষ্ণচরণ চমকালেন না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। কলকাতা থেকে যদিও বেশ দূরে এই গ্রাম, তবুও দুটো গ্রাম  পেরিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দুবার এসে পরিদর্শন করে গেছেন। সরকারি আনুকূল্য আর তেমন নেই এখন। ব্রিটিশ সরকার ঈশ্বরচন্দ্রকে এইসব বিদ্যালয়ের জন্য ব্যয়িত অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু নিজেরাও আর এই খরচের ভার বহন করতে চাইছেন না। এখন বিদ্যাসাগরের নিজের খরচেই মূলত চলছে সব। কৃষ্ণচরণবাবু শুনেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের পাঁচশ টাকা মূল্যের দামি চাকরিটিও ছেড়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য  হওয়ায়। 
এমন মানুষের গল্প শুনতে শুনতে মাথা নুয়ে আসে কৃষ্ণচরণের। বিধবাবিবাহ দিচ্ছেন তিনি। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সমাজে প্রবর্তন করতে চাইছেন।
বহুবার তার মনে হয়েছে গিয়ে একবার দেখা করবেন। আবার মনে হয়েছে, কি লাভ ! তার ইচ্ছে ছিল  নিজের মেয়েটিকে আবার বিবাহ দেন । কিন্তু অন্য বিধবা ভগিনীদের কথা ভেবে এগোতে পারছিলেন না। 
কারণ অন্তঃপুরে বিদ্যাসাগরের পরিচয় পৌঁছেছে। আজকাল সবাই তার নাম জানে। 
তবে বড্ড কদর্য  রূপে তাকে বিচার করে নিজেদের মধ্যে । এই মানুষটির অতিকায়ত্ব গ্রহণ করার মতো মানসিকতা বঙ্গদেশের মানুষের মধ্যে আসতে এখনো বহু দেরী। 
স্বকর্ণে নিজের ভগিনী, স্ত্রীদের  মধ্যে বিধবা বিবাহ নিয়ে তীব্র নিন্দে শুনেছেন। তার পত্নীরা কিরকম অশ্লীল ভাষায় বিধবাবিবাহ নিয়ে কথা বলছিল। অথচ তিনি যদি আজ মারা যান তার গৃহে একসঙ্গে তিনজন স্ত্রীলোক বিধবা হবেন। বিদ্যাসাগর কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের প্রতিবাদ করছেন।  নিজের এই ভেবে লজ্জা হয়, তারও তো তিনটি বিবাহ, এতকাল ভাবেননি, আজকাল ভাবেন । যদি ঈশ্বরচন্দ্র তাকে জিজ্ঞেস করেন, কি বলবেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এখনও বহু অনুরোধ আসে তার কাছে চতুর্থ বিবাহের জন্য। এই অশিক্ষিত অবলা নারীকুল নিয়ে তাদের মাতাপিতাগণ কি অসহায়। আর তিনি! তিনিও কি কম অসহায়।
এখন এইমুহূর্তে অকস্মাৎ তার চোক্ষে যেন আলোর চ্ছটা লাগল। তাই তো এদিকটা তো তিনি ভেবে দেখেননি।
পড়াশোনা করলে সন্ধ্যা নিজের মতো বেঁচে উঠতে পারবে। তিনি জমিদার। ভবিষ্যতে সন্ধ্যার জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় তিনি গ্রামে স্থাপন করতে পারেন। তখন বিদ্যাসাগর আসবেন তার গ্রামে, তিনি আমন্ত্রণ জানাবেন। তার বাড়ির মেয়েরা, বউরা পড়বে। গ্রামের অন্য মেয়েরাও পড়াশোনা করতে এগিয়ে আসবে। 
এইসব সূদূর কল্পনা জমিদার কৃষ্ণচরণের হৃদয়ে বায়োস্কোপের মতো দ্রুত খেলে গেলো।
তিনি আবেগ রোধ করতে পারলেন না। ভাঙা গলায় বললেন, কাল সকালে পাল্কি প্রস্তুত থাকবে। আমি তোকে নিজে নিয়ে যাবো মা।
সন্ধ্যা কিন্তু ততটা উচ্ছ্বসিত হলো না। সে মেয়ে। অন্ধকার দিকটা তার চোখে সর্বাগ্রে আসে।
সে বলল কিন্তু পিসিমাগণ। তারা কি বলবেন?
কৃষ্ণচরণ ভয় পান তার ভগিনীদের। তাদের বয়স সন্ধ্যার চাইতে খুব বেশি নয়। এখনো পূর্ণযৌবনা। মুখরা। কুসংস্কারে পরিপূর্ণ।  পত্নীগণ তাদের মান্য করে চলেন। বিশাল সংসারের বহুদিক এরাই সামলান।
তিনি বললেন, আজ রাতে আমি আলোচনা করব। বস্তুত কৃষ্ণচরণবাবু ততক্ষণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে গেছেন সন্ধ্যার ব্যাপারে। তবুও একটু মোকাবিলা করতে তো হবেই। 

রাতের বেলা কৃষ্ণচরণ সবাইকে ডাকলেন। সবাই মানে, কৃষ্ণচরণের তিনপত্নী, দুই বিধবা বোন, তার অপর দুই কন্যা, যাদের বয়স যথাক্রমে বারো ও তেরো বৎসর। দুজনেরই বিবাহের কথাবার্তা চলছে। হয়তো আগামী বৈশাখে তিনি দুজনকেই একসঙ্গে পাত্রস্থ করবেন। এবার শুধু ধনী নয়, শিক্ষা ও রুচি আছে এমন পাত্রের সঙ্গে তিনি কন্যাদের বিবাহ দিতে চান। যদি এরজন্য তাকে একটু বংশকৌলিন্য হারাতে হয় তবেও আপত্তি নেই। সন্ধ্যা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটি মোটা সুতির চাদর গায়ে। দুটো নির্মল চোখ, দীপ্তিময়। 
 কি সুন্দর দেখতে তার বড় মেয়ে। রাজরাণীর মতো তার থাকার কথা, অথচ একি সন্ন্যাসী বেশ। 
কৃষ্ণচরণ গম্ভীরমুখে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকে পড়তে পাঠানোর পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলেন। সেইসঙ্গে এও বললেন যদি আর কেউ পড়তে চায়, তবে তার আপত্তি নেই। পড়াশোনা শিখলে ধর্মগ্রন্থগুলো এখন তারা নিজেরাই পড়তে পারবে। তিনি পাল্কি করে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেবেন। গ্রামের জমিদার যদি পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহী হোন তবে অন্যরাও আস্তে আস্তে বিদ্যার্জনের গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
কৃষ্ণচরণ  মনে অসীম কৌতূহল নিয়ে সকলের মুখপানে চেয়ে রইলেন। স্বাভাবিক ভাবেই ওনার ভগিনী বিধবা কৃষ্ণপ্রভা মুখ খুললেন। তিনি বললেন বাড়ির বড়মেয়ে এবং অন্যান্যরা যদি এইভাবে বাইরে বেরোতে শুরু করে তবে শীঘ্রই অনাচার ঘটার সম্ভাবনা আছে। কারণ অবিবাহিতা দুই কন্যাদের ভবিষ্যৎ শ্বশুরবাড়ি কিভাবে এটা মেনে নেবেন, তা কি ভালো না মন্দ হবে ইত্যাদি। কৃষ্ণচরণের ছোট ভগিনী কৃষ্ণসুন্দরী, মুখরা এবং কটূভাষিনী বলে যিনি সর্বজনবিদিত, তিনি একমনে সাদা চাদরের তলায় তুলসীর মালার থলে রেখে জপ করছিলেন, মুখ ঝামটা দিয়ে তীব্র স্বরে শুধু বললেন, "মরণ "। তুই মরবি দাদা।
কলঙ্ক রটবে। বাড়িতে পড়াশোনা শেখার ব্যবস্থা করলেই হয়। পাল্কি দিয়ে অন্যগ্রামে গিয়ে পড়াশোনা শেখার কি দরকার।
সন্ধ্যা জমিদারের বড় আদরের কন্যা। তায় অল্পবয়সে বিধবা। সন্ধ্যার একটা ধীরস্থির শান্ত ব্যক্তিত্ব আছে। বড় বড় গাছে ঘেরা দিঘির মতো। সহজে তার ভেতর প্রবেশ করা যায় না। কথা বলতে গেলে দুদন্ড অপেক্ষা করতে হয়। সবকিছুর জবাবও সন্ধ্যার কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
তাই অন্য দুই পত্নী এ ব্যাপারে কিছু বললেন না, তবে সন্ধ্যার মা বললেন তার খুবই ইচ্ছে মেয়ে লেখাপড়া শিখুক।  অন্য মেয়েরা নাহয় এখন সন্ধ্যার কাছ থেকেও কিছুটা শিখে নিতে পারবে।
কৃষ্ণচরণ আর কোন কথা বললেন না।
পরদিন প্রভাতে পাল্কি প্রস্তুত হয়েছে। কৃষ্ণচরণ বড় কন্যাকে নিয়ে যাত্রা করলেন।
পাঁচ ক্রোশ দূর হবে। ব্রিটিশদের নির্মিত একটি বাংলো বাড়ি। আপাতত সেটিই বর্তমান বিদ্যালয়। কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে পড়ে আসা দুজন দিদিমণি আছেন। কালো নরুন পাড় শাড়ি পরা। আরো চার পাঁচটি মেয়ে  আছে বিদ্যালয়ে। সন্ধ্যার নাম নথিভুক্ত হলো। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এবং দেবী সরস্বতীর ছবি রাখা। সন্ধ্যা ভক্তিভরে প্রণাম করলো।
মাস দুই অতিক্রান্ত হলো। প্রতিদিন যায় না সন্ধ্যা। তবুও সে অন্যান্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। খুব তাড়াতাড়ি  বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ আয়ত্ত করেছে। যুক্তাক্ষরে সমস্যা হলেও মোটামুটিভাবে পড়তে শিখে গেছে সে।  
সেখানে কলকাতা শহর থেকে বেশ কিছু পত্র পত্রিকা আসে। সন্ধ্যা সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। বোঝার চেষ্টা করে সময়টাকে।  
 কোন দেশে সে বাস করে, ব্রিটিশ শাসনই বা কি? বিধবাবিবাহ নিয়ে উন্মাদনা, বিরোধ, বিদ্যাসাগর এবং আরোও অন্যান্য কয়েকজন ব্যক্তিদের দ্বারা এটিকে সত্য ঘটনায় রূপান্তর করা। বহু বিবাহের বিরোধিতা, দেশীয় আচারের অন্ধকার দিকগুলো ক্রমাগত লোকের সামনে তুলে ধরা হতো সেইসব পত্রিকায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এইসব লেখায় কেউ কেউ মুগ্ধ, কেউ বা প্রতিবাদ করছেন। 
সন্ধ্যার একটি সমস্যা হলো।  বাইরে বেরুনোর পোশাক । বিদ্যালয়ের দিদিমণিরা তাকে এভাবে চাদর জড়াতে না করলেন। পোশাক প্রস্তুত হলো তার। মিলের শাড়ি, কালো নরুন পাড় আর ভেতরে লম্বা হাতা জামা। বইপত্রগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটা কাপড় দিয়ে সুন্দর করে ব্যাগ বানিয়ে নিলো সন্ধ্যা নিজেই। পায়ে জুতো পরতে হলো। চুল ছোট করে ছাটা বন্ধ হলো। কয়েকদিনের মধ্যেই পিঠের ওপর ঝুলতে শুরু করলো লীলায়িত বেণী। এখন তাকে দেখতে লাগে অবিবাহিতা মেয়েদের মতো। 
অনেক কথা শুনতে হলো আড়াল থেকে, সামনে থেকে। সে অবিচল রইল। কারণ তার পথটাই সঠিক। যারা নিন্দে করছে তারা এই এগিয়ে যাওয়াকে মানতে পারছে না। 
সে যখন পাল্কি থেকে নামে গ্রামের অনেক মেয়েই যেন এক ঝলক দেখার আশায় বসে থাকে। আরো দু তিনটি মেয়েও বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু যাতায়াত সমস্যা প্রচুর। সবাই তো আর জমিদার কন্যা নন। আর সবার বাবা কৃষ্ণচরণবাবু নন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় কিভাবে দিনরাত এক করে পুরো হিন্দুশাস্ত্র, পুঁথি গুলে খেয়ে প্রমাণ করেছেন বিধবা বিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত সেই গল্প সন্ধ্যা একদিন অন্দরমহলে করেছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন পরাশর সংহিতায় খুব স্পষ্টরূপে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বার বিবাহের নিদান দেওয়া আছে। মেয়েমহলে, সে পড়ে শুনিয়েছিল কলকাতা তোলপাড় করা বিধবাবিবাহের বর্ণনা।
শুনে অবশ্য দুই পিসীমা কানে হাত চাপা দিয়েছিল।
 কিন্তু তারা তো তবু বছর পাঁচ স্বামীগৃহে ছিলেন। আর সন্ধ্যা, সে তো বোঝার আগেই সব শেষ।
নিজের বিবাহের কথা ভাবা যে অন্যায় নয়, সেই বোধ এখন সন্ধ্যার আছে।
এই দীর্ঘজীবনে যদি মনের মতো কাউকে পাশে পায় তবে সন্ধ্যা অনেককিছু করতে পারবে মেয়েদের জন্য। কিন্তু কিভাবে? 
এতো অসম্ভব!  নিজেদের গ্রামে একটা স্কুল খুললে হয় না?
বালিকা বিদ্যালয়। বাবা রাজি হবেন, সে নিশ্চিত। তবুও একা মনে হয় বড়ো নিজেকে।
সন্ধ্যা পাশে বসা নারীমুখ গুলোর দিকে তাকায়। কি অসীম প্রাণ তাদের মধ্যে। অথচ কিছু করার নেই।  সুন্দর পৃথিবীর কোনকিছুই তারা দেখল না। পড়াশোনা আত্মতৃপ্তি এবং অতৃপ্তি দুইই দেয় সন্ধ্যা বুঝল। 

গভীর রাতে তিন বিধবা পাশাপাশি তিনটি পালঙ্কে ঘুমুচ্ছিল। ছোট পিসিমা অবশ্য বার কয়েক ওঠা বসা করেন রাত্তিরে। সারাক্ষণ তার হাতে কৃষ্ণনামের থলে। এই থলে নিয়েই তিনি ঝগড়া করেন। কতরকমের কূট কথা বলে যান, তখনও তুলসীর মালা আঙুলে লটকে থাকে। সন্ধ্যার  ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, সে দেখল ছোট পিসিমা তার বই পত্তর গুলো ঘাটছে।
কি দেখছ ছোট পিসিমা?  চমকে তাকালেন তিনি । বড় পিসিমাও ঘুম থেকে উঠে গেলেন। সন্ধ্যা তেলের বাতিটি উসকে দিলো।
ধরা পরে যাওয়ায় একটু সংকুচিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণসুন্দরী।
সন্ধ্যা তার সংকোচ দূর করার জন্য বলল,পড়তে চাও বুঝি? 
 চলো না পিসিমা, তোমরাও বিদ্যালয়ে চলো। পড়াশোনা শেখো। কত ভালো লাগবে দেখো। অনেক বই পড়তে পারবে। বড় পিসিমা কৃষ্ণপ্রভা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বস্তুত তিনি যে একটা জীবন কাটাচ্ছেন, ঠাকুরপুজো, ভাঁড়ার সামলানো কীর্তন, পাঠ, এসবের বাইরে কিছুই আর ভাবতে চান না। দাদার আশ্রয়ে নিরাপদে আছেন, বেশ আছেন, কি দরকার বাপু আর কালির অক্ষরগুলোর ওপর হামলে পড়ে। তার জন্য কোনোদিন কাশীবাসই মোক্ষ। বারানসীতে মরবেন। পুনর্জন্ম হবে না তার।
সন্ধ্যা কিন্তু বুঝেছিল ছোট পিসিমার অন্য উদ্দেশ্যে। তবে কি? নাহ্ সন্ধ্যা ভয় পায় না। এরা একটু এগোতে চায় না জীবনে, যে চায় তাকেও শুধু পেছনে টানে। 

গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। কৃষ্ণচরণবাবু জায়গা দিলেন। দুজন দিদিমণি এলেন কলকাতা থেকে। কৃষ্ণচরণবাবুর ইচ্ছে ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরমশাই যদি আসেন  উদ্বোধনে। তবে তিনি আসতে পারেননি। দুজনকে পাঠিয়েছেন। সঙ্গে বিদ্যাসাগরের লেখা একটি অভিনন্দন বার্তা। সন্ধ্যা এবং
কৃষ্ণচরণবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি পত্র। উদ্বোধনে গ্রামের প্রায় সকলেই এলেন। অভিনন্দন বার্তা ও পত্র দুটোই পঠিত হলো। দুজন দিদিমণির থাকার ব্যবস্থাও করে দিলেন জমিদার বাবু স্কুল সংলগ্ন ছোট্ট একটি বাড়িতে।

সেদিন রাতে তীব্র ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছিল। অজস্র  জোনাক জ্বলছে  চারপাশে। শীত গিয়েছে কবেই। এখন চৈত্রের শেষ । তবুও হিমের পরশ লাগে রাত্রি হলে।  
প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয়, সন্ধ্যা একখানি বই পড়ছিল। চুল বাঁধা হয়নি আজ। বিদ্যালয় থেকে এসে আর একবার স্নান করে সে। ভেজা চুল গামছায় পেঁচানো। সাধারণত মা বেঁধে দেন অথবা বড় পিসিমা। আজ এখনও কেউ আসছেন না। প্রদীপের আভা তার মুখে এসে পড়েছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল সন্ধ্যাকে। এটাই  ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে দেখছিল কৃষ্ণসুন্দরী। মন বলছিল এই কপোলে পুনরায় সিঁদুরের ছোঁয়া লাগবে। সে সন্ধ্যার চাইতে দুইবছরের বড়ো। আজকাল মন খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে যখন তখন। সন্ধ্যা তার মনকে অতৃপ্তিতে ভরিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যার খুব জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহের পর, বিধবা হয়ে আসায় তার নারীসুলভ মন একপ্রকার নিষ্ঠুর আনন্দ পেয়েছিল। আর একজন বাড়ল তাদের সঙ্গী। 
মনে করেছিলেন জীবনের সব শেষ। এখন শুধু বেঁচে থাকা। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। তাদের মতো কত বিধবাই তো এমনি কাটিয়ে দেয় সারা জীবন। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে গেলো। কোথাকার কোন্ বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ, মেয়েদের পড়াশোনা, স্কুল কি কি সব অসম্ভব জিনিস করে দেখাতে লাগলেন। 

আগের মতো নেই আর গ্রামের পরিবেশ। মেয়েদের মধ্যে একটি চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। পড়াশোনা শিখতে চাচ্ছে অনেকেই। বিধবা জমিদারকন্যা সন্ধ্যা, সন্ধ্যার সাজপোশাক তাদের ঈর্ষান্বিত করে, অনুপ্রেরণা দেয়।
 হঠাৎ কৃষ্ণসুন্দরীর বুকে আগুন জ্বলে উঠল। দ্রুত এসে ঠাস করে সন্ধ্যার গালে সে একটি থাপ্পর লাগালো।
ঘটনার আকস্মিকতায় সন্ধ্যা বিমূঢ় হলেও, বুদ্ধিমতী, ধীরস্থির সন্ধ্যা জানতো একদিন তাকে বিস্ফোরণের সম্মুখীন হতেই হবে।
কৃষ্ণসুন্দরীকে সন্ধ্যা জানে। তাই কোন প্রতিবাদ করল না। এইবার কৃষ্ণসুন্দরী মুখ খুললেন।  স্কুলে যাওয়া,  পড়া শেখা, এগুলো হলো ছুতো, তাই না রে। আসল তো বিবাহ। দাদা নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখতে চাইছিলেন। ভগিনী বলে আমাদের কোন কদর নেই।
ভুল বলছো ছোটপিসীমা, তোমাকেও স্কুলে যেতে বলেছিলাম।
এইসব ভণ্ডামি আমি করি না। তুইও বিয়ে করতে পারবি না বললাম। বিধবাদের আবার বিয়ে! এজন্যই বোধহয় বিদ্যাসাগরের এতো গল্প করা হচ্ছিল। পরাশর সংহিতা দেখে তিনি বিধান দিয়েছেন। তাবর তাবর শাস্ত্রজ্ঞকে হারিয়েছেন, কত্ত গল্প, সেদিনই বুঝেছি, পুরুষ জুটেছে।
এবার সন্ধ্যা হিসহিস করে উঠলো। হ্যাঁ  জুটেছে। কলকাতার ছেলে। বিদ্বান। বিধবা বিবাহ করতে চায়। আমাকে দেখেছে। 
বাবার কাছে পত্র লিখেছে, সে আমাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক।

কৃষ্ণসুন্দরী বললেন, সব জানি আমি। তাই তো দাদার মুখে হাসি ধরে না। নতুন গহনা গড়তে দিয়েছেন কাল। তা আমাদের কাছে গোপন করা কেন? শুনি?

পিসিমা তুমি বিবাহ করে নতুন  জীবন শুরু করতে চাও? সত্যি করে বলো, তাহলে আমি ব্যবস্থা করবো।
এইসব পাপকাজ তুই কর, লোভী স্ত্রীলোক কোথাকার।

আনন্দে বাঁচতে চাওয়া কি বিধবা মেয়েদের অপরাধ? আমি মনে করি না। আমার কপালে যা আছে হবে। পাপ হলে পাপ। পুন্য হলে পুন্য। সন্ধ্যা সেরকমই শান্ত গলায় বলল।
 
কৃষ্ণসুন্দরী কোন এক অজ্ঞাত কারণে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সবাইকে দোষ দিচ্ছেন। 
আচমকাই সন্ধ্যার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল। সে নিশ্চয়ই কিছু করবে কৃষ্ণসুন্দরীর জন্য। বেশি দেরী হবে না। 

অতএব জমিদারবাড়িতে সানাই বাজলো। তত ধুমধাম করতে রাজি ছিল না সন্ধ্যা। বাবা, মা ছাড়া সকলেই সংকিত, ভীত, পাছে সমাজ তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তবে নানা কথা উঠলেও, হয়তো জমিদার কন্যে বলেই সন্ধ্যা রক্ষা পেলো।
 কলকাতা হতে বর  আসলো । সঙ্গে জনাকয়েক বরযাত্রী। বরের পিতা, আরো কয়েকজন আত্মীয়স্বজন। সবমিলিয়ে ভালোভাবেই বিবাহ সম্পন্ন হলো।
বরের সঙ্গে কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে কিছুদিন থাকার পর সন্ধ্যা  বুঝতে পারল বিধবাকে পরিপূর্ণ রূপে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা কলকাতার শিক্ষিত মানুষেরও হয়নি। কিন্তু তাকে জিততে হবে এই দ্বিতীয় জীবনে যে করেই হোক না কেন। তাকে দেখেই তো অন্য মেয়েরা শিখবে। সফল হবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষটি, বঙ্গদেশের মেয়েদের জীবনকে পাল্টে দেওয়ার   যে  স্বপ্ন দেখছেন।  
অবশেষে  সন্ধ্যার ধৈর্য, পড়াশোনা এবং ব্যক্তিত্বই তাকে শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় সংসারে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করলো এবং স্বামীর অনুমতি নিয়ে, নিজের পাঁচবছরের কন্যাসন্তান সহ সন্ধ্যা নিজের গ্রামে এলো আবার। 
কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করে সে  আস্তে আস্তে বিদ্যালয়টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল।  এই কাজে তার নবজীবনের স্বামী ছিলেন প্রধান সাহায্যকারী।
বহুদিন আগের সেইসময়ে সন্ধ্যা নামের একটি তরুণী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগররের আলোক নির্দেশকে বুকে ধারণ করে একটি অসম্ভব জীবনপথে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল, সে ধর্মান্তরিত হয়নি, নিজের নতুন শ্বশুরবাড়ি 
ছাড়েনি , সমস্ত সমস্যাকে জয় করে, 
 নিজের ধর্মকে আগলে রেখে রাজহংসীর মতো পা ফেলেছিল ভারতবর্ষের কোন এক সূদূর গ্রামের মেঠোপথে, আরো অনেক মেয়েকে আলোকিত করবে বলে। 

( কল্পিত ঘটনা) 

 
@ চিরশ্রী  দেবনাথ

একটি সংকলনে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল, অতিমারীর কারণে হয়তো পিছিয়ে গেছে।

0 মন্তব্য(গুলি):