গল্প

২:৪২ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

জানলার পাশে হঠাৎ বৃষ্টি

কৈলাসহরে আমাদের বাড়ির ঘরগুলো ছিল খুব বড়ো বড়ো, সবাই মা বাবুকে বলতো এতো বড়ো ঘর কেন বানালেন? আসলে মা বাবুর বাড়িঘরের প্ল্যানিং সম্বন্ধে কোনো আইডিয়া ছিল না, যে জমি তারা কিনেছিলেন অতিকষ্টে, তা ছিল ধানখেত ,
সেই  ধানখেতে পুকুর কেটে জমি ভরানো হল, তাতে পুকুর হয়ে গেলো বিশাল এবং গভীর। অনভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি যেমন বললেন, তেমনি ঘর হলো, বড় ঘর, খোলা বারান্দা। 
 তবে মজবুত, আর বহু ভাগে ভাগে,যখনই একটু টাকা জমেছে তখনই কখনো বারান্দার রেলিং, কখনো ঘরের মেঝে পাকা করা, চালের  টিন বদলানো এইসব হয়েছে।  
 বলা যায় সারা জীবন ধরেই তারা একটু একটু করে বাড়ি বানিয়েছেন। প্রথমে ছিল ইটের দেয়াল, মাটির মেঝে, ভিটে ছিল খুব উঁচু। সেই ঘর গুলো মাটি আর গোবর দিয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে টান টান করে লেপা হতো, আমি, মা আর দিদি মধ্যের ঘরে ঘুমোতাম, পাশে বাবুর ঘর, আর এক পাশে দাদার ঘর, ঘরের মেঝে পাকা হয়েছে বহু বছর পর। 
 আমি খুবই ছোটবেলার কথা বলছি, আজ বর্ষার দিনে হঠাৎ যেন একটা গন্ধ নাকে এলো, সেটা হলো জনতা স্টোভ জ্বালানোর সময় যে কেরোসিনের গন্ধ বেরোয় সেটা। তখনো পাকা রান্নাঘর হয়নি, পাশে বেড়ার ঘরে রান্না হয় , লাকড়ির মাচা, ভেতরে দুভাগে চুলো, আমাদের আমিষ, ঠাকুমার নিরামিষ। আর চা টিফিনের আয়োজন ছিল মধ্যের ঘরে। সকালবেলা যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে, আমি শুয়ে শুয়ে সকালের ঘুমের আয়েশ নিচ্ছি, তখনই নাকে আসতো কেরোসিনের মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধ, মা ঘুম থেকে উঠে মধ্যের ঘরের এক কোণায় রাখা স্টোভ ধরাতেন, দুধ জ্বাল দিতেন, চা করতেন, জল গরম করতেন, সকলের টিফিনের আয়োজন। পাশে ছিল একটি কাঠের মিটসেফ, তাতে টিফিনের সব কিছু রাখা থাকতো, আর সেই মিটসেফের ওপরে, একটি বিশাল রেডিও, কাঠের শাটার দেওয়া, দুপাশে বড়ো বড়ো নব। আমি এখন যেই সময়টার কথা বলছি সেটা ধরুন ১৯৮৪ সাল হবে, ফুটন্ত জলে চা পাতা দিলে যে গন্ধটা বেরোয় সেটা ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে, সঙ্গে রেডিও তে সকালের রবীন্দ্র সঙ্গীত আর খবর পড়া। তখন আমাদের বাড়ির চারপাশে কচুরি পানা, খুব বেশি বাড়ি ঘর নেই, এই ঘরটাতেই  বিছানার পাশে  বড়ো জানালা, মজবুত কাঠের পাল্লা আর মোটা মোটা লোহার শিক, এখন কৈলাসহরে যেখানে মধ্যপাড়া তার পুরোটাই দেখা যেতো জানলাটি দিয়ে, সেখানে ছিল ডোবা আর বেগুনি রঙের হাজার হাজার কচুরি পানার ফুল।  বর্ষার ঘন কালচে মেঘ, দূরে দূরে মানুষের বাড়ির ফলন্ত নাড়কেল গাছ, খেজুর গাছের ঝরোঝরো বৃষ্টিতে স্নান করার স্বর্গীয় সব দৃশ্য দেখা যেতো জানলার পাশটিতে বসেই। তবে ভাববেন না বন্ধুরা আমি খুব নস্টালজিক হয়ে সেইসব দিন ফিরে পেতে চাইছি বা ঐ মা বাবাহীন বাড়িতে আর যেতেও চাইছি না, আমার মা বাবা সারাজীবন প্রচুর দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে মরে বেঁচেছেন, শান্তি পেয়েছেন, আমারো আর সেইসব ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, গেলেই আবার কত্ত কত্ত অংক পরীক্ষা আর ইংরেজি গ্রামার পরীক্ষা  দিতে হবে, দরকার নেই!!
তবে, 
 মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি,
"বলতো চিরশ্রী জীবনের কোন ফেলে আসা সময়টি তুমি ফিরে পেতে চাও? "
চিরশ্রী গম্ভীর হয়ে চিন্তা করে বলে, একটি সময়ও না,
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবছর টাইমমেশিনে করে নিছক ঘুরে আসতে এই মন একটু একটু চায়, কিন্তু  ইউনিট টেস্ট, সেমিস্টার পরীক্ষা, প্রজেক্ট জমা দেওয়া, সেমিনার টেমিনার এসব বাদ দিয়ে,কেবল আড্ডা দিতে  ...

0 মন্তব্য(গুলি):