অসিধারব্রত যাত্রা, চিরশ্রী দেবনাথ

৫:২৩ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ


অসিধারব্রত যাত্রা


যে ভালোবাসায় ভালোবাসা রয়েছে দুজন মানব মানবীর মধ্যে কিন্তু কোনোদিন স্পর্শ করে আনন্দ পাবার লোভ নেই, আছে শরীরবিহীন গভীর অনুভূতির অপার্থিব মিলন, এক কঠোর অসিধারব্রত,  কেবলমাত্র মনের গভীর থেকে নিরন্তর নিঃসৃত, তাই প্লেটোনিক লাভ।

এটাই কি প্রেমিকযুগলের মধ্যে কাল্পনিক ঐশ্বরিক প্রেম? যেখানে প্রাণের মানুষের প্রতি এতোটাই শ্রদ্ধাবোধ মিশ্রিত ভালোবাসা থাকে , মনে হয়   ঈশ্বরকে পুজো করছি।  পার্থক্য শুধু  ঈশ্বরকে দেখা যায় না,  তাই ঈশ্বরের মধ্যে যে গুণগুলো থাকার কথা  কল্পনা করি সেগুলো একটি কল্পনাই মাত্র, যাচাই করে নেওয়ার উপায় নেই,  এধরনের আলোকময় গুণ বাস্তবের পৃথিবীতে কখনো পাওয়া যায় কি? ভালোবাসায় পড়া দুটো মানুষ খুব কাছাকাছি দীর্ঘদিন থাকলে, নিজেদের ত্রুটিগুলো প্রখর হয়ে ওঠে, মুগ্ধতা কমে যায়, অভ্যাসে পরিনত হয়, প্রেম অভ্যাসে পরিনত হওয়ার আগে পর্যন্ত মোহাবিষ্ট সময়টুকুই জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া, তারপর তার ছেদ দিতে হয়, নাহলে আনন্দটুকু নষ্ট হয়ে যায়। 


 আমরা, বিশেষ করে মেয়েরা প্রায়শই অলৌকিক প্রেমের একটি স্বর্গ রচনা করি, আর  যাকে নিয়ে স্বর্গ রচনা করি, মনে মনে ভাবি সেই আমার পৃথিবীর ঈশ্বর। হয়তো এই প্রেমই ঐশ্বরিক, প্রেম হয়ে যায় তখন নিত্য পুজোর মতো। কিন্তু অপরপ্রান্তের মানুষটি প্রেমকে হয়তো সেভাবে দেখেন না। তিনি  স্পর্শ চান, প্রেমিকাকে আপন বাহুবলয়ে নিয়ে জাগতিক তৃপ্তি পেতে চান  অথচ মেয়েটি চায় স্পর্শহীন প্রেম।  ব্যাপারটা একটু বেশিই সরলীকৃত হয়ে গেল, অনেকটা দিঘির  ওপর ঝুঁকে থাকা আকাশের মতন, ব্যাকুলতা আছে, আর এই ব্যাকুলতাই বেঁচে থাকার সম্বল, ঈশ্বরের কাছে তো আমরা সেইভাবেই যাই, আমাদের পাপী মন আগে থেকেই একশভাগ সুনিশ্চিত থাকে ঈশ্বরকে কখনো পাওয়া যাবে না। তবুও একমাত্র তাঁর কাছেই পূর্ণ নিবেদন করা যায় নিজেকে। স্নানের ঘরে নগ্ন শরীরে খোলা জলের ধারা যখন আমাদের ভিজিয়ে দেয়, তখন আমরা অনেকেই পরম করুণাময়কে হৃদয়ের সমস্ত অনুভব দিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করি, ধুয়ে দাও আমাকে, শুদ্ধ করো, গ্লানি দূর করো, একবারও মনে হয় না এই ঈশ্বর তো পুরুষও হতে পারেন, তিনি কি এই মুহূর্তে আমাকে দেখছেন? না মনে হয় না, লজ্জা হয় না, অত্যন্ত সূক্ষ্ম এই বিমূর্তচেতনাবোধ, আমি নিশ্চিত আসল প্রেমের জন্মমুহূর্ত এখানেই, যেখানে ঐশ্বরিক  প্রেম এবং মানবিক প্রেমের মধ্যে সীমারেখা তৈরি হয়, মানুষের প্রেমের প্রথমক্ষণ কামনাহীন, বিশেষ মানুষটির প্রতি ভালোলাগা থেকেই এর জন্ম, শুধুমাত্র এইসময়টিকে সম্বল করে ভালোবাসা টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য শতাংশ। 

 ঐশ্বরিক প্রেমে আমরা নির্দ্বিধায় কামনাকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারি, কিন্তু মানব মানবীর প্রেমে এই সূক্ষ্মতাবোধ পৌঁছুতে পারে না, যদি বা পৌঁছুতে যায়  যেকোন একটি পক্ষ চিরকালের জন্য চুপ হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে অপরজনের জীবন থেকে। ঐশ্বরিক প্রেমের উদাহরণ টানলে  বহু বিশ্বখ্যাত প্রেমের গল্পের কথা বলা যায়, কিন্তু উদাহরণ দিয়ে কী হবে,  প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয়ের আসল টানাপোড়নের কথা কোনো ইতিহাসবিদ, কোনো সাহিত্যিক জানেননি, যা বলা হয় সবই অনুমাননির্ভর, অনুমাননির্ভরতার ওপর ভিত্তি করেই সাহিত্যের গল্প নির্মান, ঐতিহাসিকদের তর্ক বিতর্ক। 

তাঁকে কখনো পাবোনা জেনেই ঐশ্বরিক প্রেমের স্বর্গ

রচিত হয় পারিজাতের সৌরভে, আর তাকে পাবো বলেই আমরা মানবিক প্রেমের মেহফিল রচনা করি

রজনীগন্ধা ও সানাইয়ের যুগল বন্ধনে।


কত যুগ আগে বড়ু চণ্ডীদাশ বলেছিলেন, 


"রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম

কাম-গন্ধ নাহি তায় ! "

নিকষিত হেমের সন্ধানেই সারাজীবনের এই বুভুক্ষু যাত্রা। 

প্রেমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে, প্রত্যেকেরটি আলাদা আলাদা হবে। আমার কাছে মনে হয়, কাম গন্ধ হীন প্রেমটাই আসল, এই প্রেমে সংসার নেই, সন্তান মানুষ করার মনোযোগ নেই, তাই পরস্পরের প্রতি কোনো অনুযোগও নেই। এই প্রেমে দুটো হৃদয় শুধু পরস্পরের প্রতি মুগ্ধতা, ভালোলাগা ভাগ করে নিতে চায়, অন্তহীন কথোপকথনে মগ্ন হয়ে বেঁচে থাকতে চায় হয়তো পৃথিবীর অন্য অন্য প্রান্তে,  দুরত্ব যদি প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে তবে অবশ্যই তা নিকষিত হেম।

প্লেটোনিক প্রেমে যারা বাস করবে তারা মুক্তমনের মানুষ, দৈননন্দিন জীবনের জটিলতায় যুক্ত হয়ে এই ভালোবাসায় বাস করা যায় না। তবে যে মুহূর্তে তারা বুঝবে  প্রেম মনের অধিক কিছু চাইছে, তবে সেখানেই এই প্লেটোনিক প্রেমের ইতি। 

বাংলা সাহিত্যে মানুষকে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সার্থকভাবে  তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায়। তাঁর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের নায়িকা কুসুম ও নায়ক শশী ডাক্তারের দুটি সংলাপ বাঙালির সাহিত্যযাপনে  সুপরিচিত, বহুল ব্যবহারে অতি বিখ্যাত । সংলাপ দুটি এ রকম :

 “কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল- ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন, ছোট বাবু’?”

জবাবে শশী ডাক্তার বলেন, “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”

ভালোবাসা মুখ্য হলে, শরীর গৌণ হয়। 

 প্রেমিকের সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার পর,  সৈয়দ শামসুল হকের ‘তুমি সেই তরবারি’ উপন্যাসের নায়িকা সাকিনার উপলব্ধি: “ভালবাসার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ভালবাসা এর ঊর্ধ্বেও নয়, নীচেও নয়। ভালবাসা এর বাইরে এবং বিযুক্ত।”

কিন্তু এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন মনের কোণায় উঁকি দেয়, প্রেম হবার মুহুর্তে কি তারা শর্ত রেখেছিল, একজন আর একজনকে স্পর্শ না করবে না, তাহলে তো বাঁধন তৈরি হলো প্রথমেই, প্রেম হয়ে গেলো কারাগারের মতো, আর যদি অনুচ্চারিত ভাবে এই শর্ত দুজন দুজনের মনে প্রোথিত করে নেয় যে কোনো দুর্বল মুহূর্তেও আমরা স্পর্শ করবো না, একে অপরকে, সেক্ষেত্রেও জোর করে আটকানো হলো।

তাহলে প্লেটোনিক প্রেমে দূরত্ব থাকতেই হবে। মনের মধ্যে উথ্থিত হয়ে মনেই গড়িয়ে যাবে, পবিত্র চন্দনপ্রপাত। 

‘লোভের অতীত যাহা। সুন্দর যা, অনির্বচনীয়,

                 যাহা প্রিয়,

        সেই বোধ সীমাহীন দূরে আছে

                 তার কাছে।

        আমি যেথা আছি

    মন যে আপন টানে তাহা হতে সত্য লয় বাছি।

                 যাহা নিতে নাহি পারে

     তাই শূন্যময় হয়ে নিত্য ব্যাপ্ত তার চারি ধারে। ...রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্লেটোনিক প্রেম বোধহয় এইভাবেই চারপাশে ছেয়ে থাকে, যার মধ্যে ডুবে থাকে মানুষ, আলোর মধ্যে যেমন ডুবে যায় রাত্রি। কিন্তু লোভ কথাটি রবিঠাকুর এখানে নিশ্চয়ই  কামনা

বোঝাতে ব্যবহার করেননি হয়তো হতে পারে যৌনচাহিদা বা যৌনচেতনা কিন্তু এটাও নিশ্চিত নয়, রবিঠাকুরের ভাবনাকে একদম স্পর্শ করার নাম হলো স্পর্দ্ধা।

প্লেটোনিক লাভ শব্দটির উৎপত্তি মূলত প্লেটোর "প্লেটোনিজম" মতবাদ থেকে যাতে বলা হয় এমন প্রকার ভালোবাসার কথা যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসার সর্ব্বোচ পর্যায়ে প্রবেশ করবে অথচ শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত। কিন্তু প্লেটোনিক প্রেমের ধারনাটি সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আসা একথা ভাবার মোটেই কোনো কারণ নেই, যা আমরা বড়ু চণ্ডীদাশের পংক্তির মাধ্যমেই বুঝতে পেরেছি।  যুগ যুগান্তর ধরে মানুষ এই প্রেমের কল্পনা করে গেছে, প্লেটোর অতীন্দ্রিয় প্রেমের  রূপমাধুরী আমাদের বৈষ্ণব পদাবলির বিরহী গীতিকবিতায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রুত, বৃন্দাবনের কিশোর, মথুরার রাজা শ্যামতনু শ্রীকৃষ্ণই আমাদের পথপ্রদর্শক বলা যায়। 

  উপরের বিশৃঙ্খল আলোচনা যা আমার হৃদয় সংম্পৃক্ত হয়ে এসেছে তা  থেকে কয়েকটি লাইন উঠে এলো শুধু, 

প্লেটোনিক প্রেম অলীক স্বপ্নকল্পনা মাত্র, 

প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আত্মনিবেদন করে গোপিনীরা যে প্রেমের সূচনা করেছিল, সেই বিরহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকেই নিস্কাম প্রেমের সূ্ত্র বলা যায়। 

কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে এরকম কোনো প্লেটোনিক প্রেমের অস্তিত্ব  কল্পনা করা যায় না।

 হয়তো একতরফা ভালোবাসাই প্রকৃত প্লেটোনিক প্রেম, কারণ বিপরীত লিঙ্গ যদি এবিষয়ে কিছু না জানে তাহলে স্পর্শের ব্যাপারটা আর থাকেনা।

আমরা কি নিজের হ়দয়কে প্লেটোনিক প্রেমের আধার ভাবতে পারি, সমগ্র সত্তা যেখানে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় না? প্রিয় মানুষের স্পর্শসুখ পাওয়ার কথা কি কল্পনা করলেও, প্লেটোনিক প্রেমের আপাত সরল কিন্তু বাস্তবে কঠিন এই ঘেরাটোপকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারা যায় ... জানিনা। 

মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল জায়গা। সেখানে কোনো এক কোণায় বহু সংবেদনশীল মানুষই একজন বিশেষ নারী বা পুরুষের জন্য আকন্ঠ ভালোবাসা রেখে দেন, সেই মানুষটির সঙ্গে সারাজীবন না দেখা হলেও তার কোনো অসুবিধে নেই, এ একেবারেই নিজস্ব বসন্তে চির মগ্ন থাকা তরুণ প্রেমিক বা প্রেমিকার একান্ত দোহার, আমি এভাবেই প্লেটোনিক প্রেমের ধারণাকে বিশ্বাস করি। 

0 মন্তব্য(গুলি):