সূর্যছক ( প্রথম পর্ব) ( ধারাবাহিক উপন্যাস) চিরশ্রী দেবনাথ
সূর্যছক ( উপন্যাস)
এক
খুব ভোর। অল্প অল্প আলো লাগতে শুরু করেছে গাছপালার মাথায় মাথায়। হনহনিয়ে হাঁটছেন সুপ্রকাশ নন্দী। মর্নিং ওয়াক। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে গেলে আর হাঁটতে ভালো লাগে না ওনার। এখানকার রামকৃষ্ণ মহাববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছেন তিনবছর হলো। কলেজের কাছেই মনু নদী। হাঁটতে হাঁটতে মনুনদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে তিনি সূর্য ওঠা দেখেন। এ অভ্যাস অবশ্য বেশিদিনের নয়। অনেকটা নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে এই আয়োজন। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে এলে আর চোখ জোড়া লাগে না। তখন কিছু পড়াশোনাও করতে ইচ্ছে করে না।
আজ সকালে দেখলেন ব্রিজের ঠিক মাঝখানটায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর দিকে চোখ। যেখানে সবে অল্প সূর্য কিরণ পড়তে শুরু করেছে। একটি জিন্স আর উপরে সাদা রঙের হাফহাতা কুর্তা টাইপের শার্ট। ঝকঝকে চশমা, চুল আঁচরানো নয়, তাতেই ছেলেটিকে আরো সুন্দর লাগছে। তিনি একটু অবাক হলেন। এই শহরের ছেলেদের তিনি মর্ণিং ওয়াকে কমই দেখেন। একটু দূরত্ব রেখে তিনিও দাঁড়ালেন ব্রিজের রেলিং ধরে। বর্ষা মরে এসেছে। নদীতে এখন স্বাভাবিক জলস্রোত।
জুন জুলাই মাসে এই মনুনদীই প্রতিবছর কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে দেখেছেন তিনি।
অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। ছেলেটির কোন হেলদোল নেই। পাশের মানুষটির দিকে লক্ষও করছে না একবারো। যেন ধ্যানস্থ। তবে আজকে সুপ্রকাশের দারুণ কৌতূহল। তিনি একটু কাশলেন। নাহ্ ছেলেটি নিশ্চুপ। এবার বলেই উঠলেন, এই যে শুনছেন, এ শহরে নতুন আপনি?
এবার ছেলেটি তাকালো। যেন অনেকদূর থেকে তাকে কেউ টেনে নিয়ে এসেছে। তারপর গম্ভীর সুরে ছেলেটি বলল আমি একজন সন্ন্যাসী।
সুপ্রকাশ চমকে উঠলেন। একটি বেমক্কা কিন্তু দৃঢ় উত্তর। তারপর ছেলেটি আবার নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল।
সুপ্রকাশও বুঝে গেলেন সে আর কিছু বলবে না। তিনি
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন সূর্য উঠছে, রক্তিম হয়ে যাচ্ছে নদী ও আকাশ। শ্রীরামপুরের দিক থেকে দুটো ছেলে স্পিডে সাইকেল চালিয়ে ব্রিজের ওপর উঠল। খিলখিল করে হাসছে। দুই সাঁওতালি কিশোর। মোদ্দা কথা চা বাগানের কুলির ছেলে। কুলি শব্দটি সুপ্রকাশের খুব বাজে লাগে, তাই তিনি সাঁওতালি বলেন। এই চা বাগাান এরিয়াটাও তার দারুণ লাগে। প্রায়ই যান ওদিকে। কখনো হেঁটে, কখনো বাইকে। একটি চায়ের দোকান আছে তার সেদিকে খুব প্রিয়। সেখানে বসে পর পর দুকাপ চা খান। দোকানি দৈনিক সংবাদ রাখে। সেই পত্রিকা তার পড়া হলেও সেখানে বসে আবার পড়েন। দোকানির ছেলের নাম বিবেকানন্দ। ক্লাস এইটে পড়ে। বাবাকে সাহায্য করে সকালবেলা। গুটিকয়েক লোক চা খেতে আসে,সঙ্গে স্থানীয় বেকারির বিস্কুট। সুপ্রকাশের পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়ি পুরুলিয়ায়। নেট ক্লিয়ার করে ফেলেছিল খুব তাড়াতাড়ি, ত্রিপুরা সরকারের এই বিজ্ঞাপন দেখে এপ্লাই করেছিল। ইন্টারভিউ দিয়ে পেয়েই গেলো। বাড়িতে আরো দুভাই আছে। মা বাবা। তিনি মেজো । সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় এসে অধ্যাপনা করতে তার দারুণ লাগছে।
কেমন হয় যদি এখানেই কেটে যায় সারা জীবন। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলেন সেই ছেলেটি নেই। সন্ন্যাসী!
খুব হাসি পেলো। সামনেই শ্মশান। একটি মৃতদেহ এসেছে। হয়তো রাতে মরেছে কেউ। প্রস্তুতি চলছে পোড়ানোর। তিনি হাঁটা দিলেন। খুব জোরে। আজ কোয়ার্টারে গিয়ে নিজেই বানিয়ে নেবেন জম্পেশ চা। টিভি চালিয়ে, হোয়াটস্ এপে নতুনকে ধরবেন। বেচারিকে ঘুম থেকে জাগাবেন। খুব মনে হয়। আর ভালো লাগছে না। ওর অভিমান ভরা মেসেজ গুলো সারাদিনের খোরাক। নতুন এই নতুন ...অস্ফুটে বললেন দুই তিনবার।
রান্না করার একজন লোক রয়েছে। আমিনা দিদি। আগে ঘর টর মুছে দিতো। এটা কিন্তু একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মুসলিম কাজের লোক। স্বপ্নেও তিনি কল্পনা করতে পারেননি। অথচ এখানে চল আছে। তবে রান্না কেউ করায় না। তিনিই ধরিয়েছেন জেদের বসে। বছর পঞ্চাশ বয়স। একদিন তিনি অসুস্থ থাকায় নিজে থেকে রেঁধে গিয়েছিল। নাহ্ কোনো মুসলমানি ভাব নেই রান্নায়। একদম বাঙালি হিন্দুর রান্না।
সেই থেকে চালু করেছেন। যে যা বলুক, ঘরের ভেতরে এতটুকু বিপ্লব তিনি করতেই পারেন লোকে তো রেস্টুরেন্টে মুসলমানদের রান্না করা মোগলাই আইটেম কতই খায়।
ঘরে ঢুকেই টিভি ওন করল সুপ্রকাশ। বেসিনের সামনে মুখ ধুতে এসে আয়নায় একবার দেখলেন নিজেকে, ছেলেটি বেশি হ্যান্ডসাম ছিল না তিনি? মুচকি হাসলেন, মনুনদীকে জিজ্ঞেস করবেন কাল। এই সন্ন্যাসীকে বাগে আনতে হবে। খুব ইন্টারেস্টিং। কৌতুহল হচ্ছে তার খুব বেশি, খুব বেশি।
হোয়াটস এপ খুলতেই নতুনের নরম মেসেজ, আই লাভ ইউ, গুড মর্ণিং। লাভ লাভ লাভ। তিন চারবার লিখে সুপ্রকাশ ভালোবাসার ওজন কয়েক কেজি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। আর চা করতে ইচ্ছে হলো না। আমিনা দিদি একটু পরেই আসবেন, তার হাতেই নাহয় চা খাবেন। টি ভি খুলতেই নরেন্দ্র মোদীর শ্রীমুখ ভেসে উঠল। উঃ এই লোকটা কি কখনো প্রেম করেনি। ধুস। অটলবিহারী তো দিব্যি ত্যাগী প্রেমিক ছিলেন। সাট্ আপ ইন্ডিয়ান ইকোনমি, শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায়। দুই তিনটা চ্যানেল ঘুরিয়ে সুপ্রকাশ ফেসবুকে এলো। খুলতেই চন্দ্রিকার নয়া প্রোফাইল পিকচার। ফুরফুরে শাড়ি, কোমল চোখ, সরু ঘড়ি। সুপ্রকাশের ক্লাসমেট। চন্দ্রগুপ্তের বাগদত্তা। চন্দ্রগুপ্ত সুপ্রকাশের সিনিয়র ছিল। বন্ধুর বাগদত্তাকে আর কমেন্ট বা লাইক করতে ইচ্ছে হলো না। নতুন খুব বেশি প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করে না। একবছর ধরে একটিই ছবি আছে, চোখে আবার প্রায় মুখ ঢেকে যাওয়া সানগ্লাস।
কলিংবেলের শব্দ। আমিনা দি। সুপ্রকাশ দরজা খুলেই বলল আগে চা আর টোস্ট দাও, কড়া লিকার। তারপর তোমার যা খুশি রেঁধে দাও। আর কিছু জিজ্ঞেস করো না।
সকালবেলা নিয়ম করে মা বাবাকে একবার ফোন করে সুপ্রকাশ। আজও তাই করলো। মা ফোন করেই বলল, হিম পড়তে শুরু করেছে, সাবধানে থাকিস। বাবা বলল ঠিক মতো খাস কিন্তু, রান্না হয়েছে? কাজের দিদি এসেছে। তোর মা চাইছিল তোর কাজের দিদির সঙ্গে কথা বলতে। সুপ্রকাশ সব ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে এই প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলো। তারপরই নতুন। খুব তাড়া নতুনের। বেরোবে স্কুলে। তবুও একটুখানি, ফোন তুলেই নতুন বলল রাগ করো না, এখন সময় নেই, রাতে কথা বলবো। যাহ্।
আমিনাদি রান্না বসিয়ে ঘর পরিষ্কার করছে। তোমার বাড়িতে কে কে আছে আমিনা দি?
আমার দুই মেয়ে কৃষ্ণা আর শায়রা। কৃষ্ণা? হ্যাঁ দাদাভাই। ওদের আব্বার এই নাম খুব পছন্দ। মেয়ে কিন্তু ফর্সা। আমিনা একটি হাসি দিলো। এই হাসির নাম সারল্য।
সুপ্রকাশের কালো ফর্সায় কিছুই আয় যায় না। সে ভাবতে লাগলো মুসলমানির নাম কৃষ্ণা। এই না হলে দেশের নাম ভারত!
আরে সেই সন্ন্যাসী ছেলেটিকে বের করতে হবে খুঁজে।
নীলাম্বর আনমনে হাঁটছে, একথা যে কেউ বলবে। আসলে সে আনমনা নয়। মনে মনে অনেক কথা ভাবছে। সকালবেলা তার ধ্যানের সময়। এই সময় এক লোক এসে তার ধ্যান ভাঙিয়ে গেলো। বাড়িতে গিয়ে তার অশান্তি হবে। সে গৃহী নয় । নিষ্ঠাবান সন্ন্যাসী। তার কাছে এই মফঃস্বল শহর অর্বাচীন। কোন কসমোপলিটন সিটিও তেমনি। কী উদ্দ্যেশ্যে সে এখানকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে এসেছে জানে না।
হয়তো গুহা কন্দরের গিয়ে বাস করার চাইতে লোকজনের মাঝখানে থেকে নিজেকে কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের চেষ্টা।
সবকটা মানুষকে তার অশরীরী মনে হয়। তার জীবনে কি নারী আছে? ভাবতেই সে চমকে উঠল। একজন নিরাসক্ত মানুষ আলাদা করে একটি বিশেষ লিঙ্গের কথা কেন ভাববে? তার শরীর কঠিন বেদে তৈরী। পিচ্ছিল। তবুও দূরাগত সেই হাসিটি এলো না নীলাম্বরের মনে।
নীলাম্বর কৈলাসহরের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকে। স্কুল থেকে কাছেই, শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাড়ি। বাড়িটির চারপাশে গাছপালা আছে। উপরের তলায় মালিক থাকেন। নিচে দুটো ফ্যামিলি থাকার মতো অ্যাকমোডেশন। সে একটিতে থাকে। সব এটাচড্। ছোট্ট শহরের তুলনায় ব্যবস্থা ভালোই। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করলো নীলাম্বর। সামনের ঘরটিতে বইপত্র আর চেয়ার টেবিল রেখেছে। তারপরের ঘরটি তার শোয়ার ঘর। জানলা। একটি বড় সাইজের ক্যানভাস। তাতে পর্দা টানা। সামনে নীলাম্বরের বিছানা। এখান থেকে সরাসরি সেই ক্যানভাসের দিকে তাকানো যায়। ছবি দেখতে খুব ভালোবাসে নীলাম্বর। তার কাছে বহু ছবি আছে বড় বড় বিভিন্ন খ্যাত, অখ্যাত আর্টিস্টের। সে বিশেষ কিছু ছবি কেনে। খুব জটিল ফর্মের হতে পারে আবার সরল ছবিও হতে পারে। এমনকি মাঝে মাঝে বাচ্চাদের আঁকা ছবিও দেখে। দু তিনদিন পর পর সে ক্যানভাস থেকে ছবি বদলায়। এখন তার সামনে যে ছবিটি আছে সেটি একটি নারী মূর্তির। জানলার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। মোমের আলোর মতো শরীর। যেন চারপাশ থেকে গলতে শুরু করেছে এই মাত্র। এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিজের পরীক্ষা নেয় নীলাম্বর। বহুভাবে। মনের আঁতিপাতি খুঁজতে থাকে। এই নগ্নতা তাকে কোন দিক দিয়ে আকৃষ্ট করছে? নাহ্ আজ তিনদিন তাকিয়েও তার কোনরকম চাঞ্চল্য হয়নি। আর্টিস্ট বাজে না সে আসলেই সন্ন্যাসী, নীলাম্বর ভাবছে । সকাল হতে থাকে। রোদ বাড়ছে কসমস ফুলের মতো ...
0 মন্তব্য(গুলি):