বাংলা উপন্যাস, সূর্যছক, পর্ব দুই, লেখিকা চিরশ্রী দেবনাথ
সূর্যছক, পর্ব দুই
.....................
দরজায় নক। দূর কে এই অসময়ে? খুব বিরক্ত হলো নীলাম্বর। তার এখন রান্না, খাওয়ার সময়। খুব সামান্যই রান্না । সেটাই তিনবেলা খায়। অনেক সময় রাতে উপোস দেয়। আবার কোনোদিন বেশ গুছিয়ে রান্না করে। বিবেকানন্দও সন্ন্যাসী ছিলেন। তবে খাদ্য রসিকও ছিলেন। সব ইচ্ছেকে মারতে নেই। ইচ্ছে হলে কী তা পূরন করে নেওয়া ভালো? নিজেকে জিজ্ঞেস করল নীলাম্বর।
এদিকে দরজায় বাড়িওলা। খেজুরে আলাপ করতে এসেছেন। রিটায়ার করবেন খুব সম্ভবত দু তিন বছর পর। অফিসের কাজ নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই।
সময় কাটানো নিয়ে খুব মুশকিলে আছেন। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বসলেন। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন। ব্যাচেলর চাকুরিরত পুরুষদের প্রতি বাড়িওয়ালাদের খুব প্রশ্রয় থাকে, বিশেষ করে যদি বাড়িওয়ালার মেয়ে, শালীর মেয়ে, ভাই এর মেয়ে, আত্মীয় স্বজনের মেয়েদের মধ্যে বিবাহযোগ্যা কেউ থাকে।
এই বিষয়ে নীলাম্বর পাথরের মতো অচল অনড়। কারণ তার বাড়িওয়ালার দুটো মেয়ে আছে। ছোটটি স্কুলে তারই ছাত্রী। নবাঙ্কুরা তার নাম। আর বড় মেয়েটি শুনেছে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে।
ছুটিতে এসেছিল বাড়িতে, তখন নীলাম্বরও ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল, তাই দেখা হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে সে বিবাহযোগ্যা।
তবে তার বাড়িওয়ালা নির্মলবাবু এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাননি এখন পর্যন্ত। নীলাম্বরের অতিরিক্ত নিরুৎসাহিতায় বাধ্য হয়ে বিদায় নিলেন।
আজ স্কুল থেকে ফিরে নীলাম্বরের একটি প্ল্যান আছে। মনুনদীর তীরে নাকি একজন সাধু এসে ডেরা বেঁধেছে । তাকে একটু অবজার্ভ করতে হবে। সে একশভাগ নিশ্চিত লোকটি একটি ভণ্ড। নীলাম্বরের ভণ্ড লোকদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ।
ভণ্ড লোকরা হলো পৃথিবীর কঙ্কাল। সন্ন্যাসীরা কঙ্কালকে দেখবেন। ওপরের মাংস, চামড়া, পশমে তো ম ম করছে গার্হস্থ্য।
পাঁচটা বাজে। এখনও বেশ রোদ নদীতীরে। মাটির বাঁধ দিয়ে সে হাঁটছে। এখানে নদী তেমন সুন্দরী নয়। অবসাদ লেগে গেছে নদীর শরীরে, ভাঙাচোড়া নারীর মতো । একটি সাইনবোর্ড।
"কালীশঙ্কর বাবার ডেরা "স্পষ্ট লেখা।
নীলাম্বর ঢুকতে গিয়ে দেখল লেখা আছে, খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে। বাঁশের ঘর। সামনে মাচা বাঁধা। সন্ন্যাসীবাবার সঙ্গে দেখা হলো। কোন উৎসাহ দেখালেন না। রোগামতো একজন লোক কপালে সিঁদুর দেওয়া। একটি বটগাছ আছে এখানে, নিচে শিবলিঙ্গ আর পুজো চিহ্ন।
নীলাম্বরই শুরু করল, কালীশঙ্কর বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
লোকটি তাকাল। বলল আমার ঘরের পেছনে একটি পাথর আছে। ওখানে বসে সূর্যাস্ত দেখে এসো। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। আজ সূর্যাস্ত দেখতে দেওয়াটা তোমার উপহার। তারপর কথা বলব।
নীলাম্বর পেছনে গেল। সত্যিই একটি শক্তসমর্থ প্রাচীন পাথর। স্রোতের টানে ভেসে আসা নয়। শিকড় আছে যেন পাথরটির।
নীলাম্বর বসল। দেখল কয়েকটি জেলে মাছ ধরছে, নদীর জলে ভেসে আসা বাঁশ সংগ্রহ করছে দুটো যুবক।
সূর্য ডুবে গেল। প্রচণ্ড মশা। বিন বিন করছে। ফিরে এলো।
কালীশঙ্কর নিজেই বলল, আমি গ্র্যাজুয়েট । কিছু পাচ্ছিলাম না। তাই ভেক ধরেছি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। গোপনে ব্যবসার সন্ধান করছি। টাকা রোজগার করতে পারলে অন্যরূপ নেবো। তোমার ইচ্ছে হলে আসতে পারো মাঝে মাঝে। একটি বিদ্যা আছে বটে। জ্যোতিষ। মাঝে মাঝে লেগে যায়। এই যেমন তোমার কপালে তীব্র বিবাহযোগ আছে।
এবার নীলাম্বর প্রাণপনে একটি গালি দিল
"শালা "।
কালীশঙ্কর হাসল। চা খাও। ফার্স্ট ক্লাস চা আছে। ভাত না খেলেও বাজে চা এর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করি না। খাবে?
নীলাম্বর কিছুই বলল না। আশাতীতভাবে
ধবধবে সাদা দুটো চিনা মাটির কাপ প্লেটে চা এলো।
চা য়ে চুমুক দিল নীলাম্বর। যেহেতু আনন্দ প্রকাশ করা তার ধর্ম নয়। তাই বহুদিন পর একটি দুর্দান্ত চা খাওয়ার পরেও সে চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর মুখে কালীশঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি একজন সন্ন্যাসী "।
কালীশঙ্কর হাসতেই লাগল, হাসতেই লাগল। গুনগুনিয়ে না ভনভনিয়ে বোঝা যাচ্ছিল না। সেই হাসির দমকে দমকে বেরিয়ে আসছিল পরিহাস শুধু পরিহাস।
বলি ওইটি হয়েছে?
কোনটি? নীলাম্বর জিজ্ঞাসা করল।
আরে সেক্স, সেক্স!
ছিঃ ছিঃ। সটান উঠল সে। এসব কি কথা?
কালীশঙ্কর নিরুত্তাপ চোখে তাকিয়ে বলল, তবে আর কি? তুমি কী তাই জানতে পারলে না।
নীলাম্বর হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল। কালীশঙ্কর সেই একই সুরে বলল আবার এসো হে।
সুপ্রকাশ আজ ভারী ক্লান্ত। তিনটে ক্লাস, ট্রাইবেল ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্প্যাশাল কোচিং এবং একটি অন্তঃসার শূন্য কচকচিতে ভরা মিটিং করতে হয়েছে। মিটিং এর প্রাপ্তি একটাই ছিল। সদ্য জয়েন করা সুন্দর দেখতে দুজন অধ্যাপিকার সঙ্গে আজই ভালো করে পরিচয় হলো। একটু উন্নাসিক টাইপের মনে হলো।
উন্নাসিকতা খারাপ নয়। তবে একজন মনে হলো কিছুতেই নেই। ভারী চশমা। খুব ফর্সা, তিনি ফিজিক্সের। কথা বললে বোধ হয় ওনার তেজস্ক্রিয়তা ফালতু খরচ হবে। নাকের পাটা লাল হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়জন ইতিহাসের। ইনি স্বাভাবিক, সচ্ছন্দ। সুন্দর কথা বললেন। সেন্স অব হিউমার আছে। বোরিং টাইপের মেয়েদের একদম পছন্দ নয় সুপ্রকাশের। নতুন তার প্রেমিকা।
নতুনকে বাঁশ দিলে, সে বাঁশরী করে ছাড়বে। এখানেই নতুন তার নির্বাচন। একটি স্থূল, অনুভূতিহীন, ক্যাবলা টাইপের গৃহী মেয়ের সঙ্গে সে সংসার করতে চায় না। কি রকম হবে তখন সেই ঘর, অনেকটা ব্যাঙ্কের মতো। টাকা আসছে যাচ্ছে, সংসার চলছে।
তার ঘর হবে ট্রেনের মতো। সেখানে দৃশ্যান্তরে চরিত্ররা নিজেদের সামান্য বদলাবে, চেটে নেবে চলমান জীবনের ঝালমুড়ি, আচার। ফুঃ দিয়ে বাঙ্ক অদল বদল হবে। প্রতিটি স্টেশনে নিজেদের আবিষ্কার করতে হবে।
মনু নদীর ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেই সন্ন্যাসী ছেলেটির খোঁজ করতে হবে, ইন্টারেস্টিং। বাজিয়ে দেখতে হবে তাকে।
কোয়ার্টারের জানলা খুলে দিল বর্ষা। একটু সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা? একটু হাসি পেল তার। বর্ষাই তো বৃষ্টি।অথচ ভারী কাচে আটকে গেছে তার তাবৎ কোয়ান্টাম ফিজিক্স। ভারী কাচটির নীচে গান আছে। গাইবে না কী সে! না, জানালায় নয়। ঘরে ঢুকে গুনগুনিয়ে। ভাত বসিয়েছে। একা একা ভাত খেতে ভালো লাগে না। কতদিন ধরে বর্ষা একা একা ভাত খাচ্ছে। ডাল ভাত, আলুভাজা, মাছের ঝোল, একটু টমেটোর চাটনি। খুব ইচ্ছে করে ভাত খাওয়ার সময় দুজন বসে। ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ এবং তারপর হোস্টেল জীবন। মা বাবা ছোটবেলায় মরে যাওয়ায় তাকে অনেকেই বলত অপয়া। তাই আরো মুখ লুকিয়ে থাকতে সে ভালবাসতো। কথা বলতেই তার ভালো লাগে না।
কিন্তু মামার বাড়িতে কী সেসব চলে। তাকে কোন কাজ করতে হতো না, আদরেই ছিল সে, দাদু দিদা ধনী লোক ছিলেন, , বর্ষার বাবা ছিলেন নিতান্তই মধ্যবিত্ত লোক । মা নাকি নিজে পছন্দ করে বাবাকে বিয়ে করেছিলেন, দাদুর বাড়ির সমকক্ষ নন তারা। তবে বাবা খুব মেধাবী ছিলেন। বর্ষাও দারুণ মেধাবী ছোটবেলা থেকেই। খুব সিরিয়াস সেইসঙ্গে।
তাই রাগী, অহংকারী, দেমাকি ইত্যাদি অভিযোগ কিশোরীবেলা থেকেই জুটেছে।
আর আছে অপূর্ব গানের গলা। কিছুদিন সঙ্গীতশিক্ষাও হয়েছে। দাদু খামতি রাখেননি। পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় সে নিজেই ছেড়ে দেয়। আপনমনেই গাইত।
দাদুর ঘরের সঙ্গে সে একটি ঘর পেয়ে গিয়েছিল। এটাই তার গুহা। সকল মুখ গুমরে কান্না, মনখারাপ সেই ঘরেই বন্দী থাকত একান্তে। তার অতিরিক্ত ফর্সা রঙ আর ভারী চশমা একটি সম্ভ্রম তৈরি করে দেয়, বা একটি খোলস, সেই খোলসটি বর্ষার জাদু বর্ম, এ থেকে না বেরিয়ে যদি এই জীবন কেটে যায়। না মধ্যবর্তী জায়গায় তাকে কারো কাছে যেতে হবে। কোনও অভিসার, বা সমঝোতা বা একাত্ম হওয়া সেটা কী সম্ভব তার পক্ষে কোনোদিন?
সদ্য চাকরি পেয়েছে। এখন পুরো দস্তুর একার সংসার তার। কাল খুব সকালে উঠবে সে। একটু মর্নিং ওয়াক করে এই শহরটাকে ঘুরে দেখবে।
সামনের কোয়ার্টারে খুব জোরে নিউজ শোনা হচ্ছে।
নিউজ হলো পৃথিবীর অসুখ। বর্ষা শোনে না। ভালো লাগে না। তার চাই নিরাময়। সে শুধু গান শোনে, গানের মধ্যে তার অসুখ হয়, ঘাম হয়, সেরে যায়।
0 মন্তব্য(গুলি):