সূর্যছক ( বাংলা উপন্যাস) , পর্ব তিন, চিরশ্রী দেবনাথ

৫:০১ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

তৃতীয় পর্ব


কালীশঙ্কর, পড়াশোনায় ভালোই ছিল। বাবা খুব মদ খেতো। তবুও মা বাবার প্রেম ছিল দেখার মতো। ছোট্ট ব্যবসা, বাবার নেশা আর নেশা ছুটে গেলে মায়ের অপূর্ব রান্না দিয়ে ভাত খাওয়া। টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি। কী যে মাধুর্য তার। 

 কীর্তন করতে ভালোবাসত বাবা। খোল করতাল ছিল বাড়িতে। তিন চারজনের একটি ছোট দলের নেতা ছিল তার বাবা। শ্রাদ্ধ বাড়িতে কীর্তন গাওয়ার ডাক পড়ত সেই দলের। ধনী বাড়ির কীর্তন নয়। গরিবের বাড়ির মৃত্যুশোক উদযাপন।

তার মার নাম ছিল মাধুকরী। তিনি একদিনের জ্বরে পট করে মরে গিয়ে তার নেশাড়ু , কীর্তন গাওয়া আধভোলা বাবাকে আর ক্লাস টুয়েলভের কালীশঙ্করকে মহা বিপদে ফেললেন। কে রেঁধে দেয়, কে সংসারের গাড়ি চালায়।

পুরুষ লোকের বউ জোটাতে মেয়েলোকের অভাব হয় না। এই গরিবের সংসার সামলানোর জন্যও এক ডুবন্ত রমণী এলো। তিনিও স্বামীহারা। সংসার আবার খটখটিয়ে চলতে লাগল। মহিলার নাম শ্যামা। কালীশঙ্করকে অযত্ন করেনি। বরং বেশিই যত্ন করত। তারও যে কোন আশ্রয় ছিল না। তবে বাবা নেশা করা ছেড়ে দিলেন। কীর্তনও। তিনি ব্যবসায় মন দিলেন। কালীশঙ্কর বুঝল এই মহিলা অর্থকরী ফসল। সংসার আগের চাইতে স্বচ্ছল হলো। পাকা ঘর উঠল। কালীশঙ্করকে তার বাবা একটি আলাদা ঘরও দিলেন। সেখানে কালীশঙ্কর তার মা বাবার ছবিও টাঙিয়েছিল একখানা। সে গ্র্যাজুয়েট হলো । নতুন মা আর বাবার ইচ্ছে ছিল, এখন সে সরকারি চাকরির চেষ্টা করে। কালীশঙ্কর ভাব দেখাতো সে খুব চেষ্টা করছে। আসলে তা নয়। তার বাবার গাওয়া কীর্তন গুলো আসলে সেই বাড়িতে আশ্রয় না পেয়ে গুমড়ে মরছিল। 

একদিন রাতে কালীশঙ্কর এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো, গভীর রাতে তাদের বাড়ির উঠোন মায়াবী জ্যোৎস্নার ভেসে যাচ্ছে। সেখানে অজস্র পংক্তি ভাসছে নৌকার মতো। কীর্তনের পংক্তি। সম্মোহিতের মতো সে বাইরে বেরিয়ে এলো যেন। আর অমনি অজস্র কীর্তনের লাইন তাকে ঘিরে ধরল, তার সমগ্র শরীর যেন শুষে নিলো সব। তারপর থেকেই শুধু মনে হতে লাগল তাকে কিছুদিন বিবাগী হতে হবে। অনুভব করলো সে আসলে অনাশ্রিত কেউ। তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। কিছুদিন ঘুরতে হবে। হয়তো এটাই আত্মশুদ্ধি। 

পরদিন ছিল গুড ফ্রাইডে। ছোটবেলা থেকেই কালীশঙ্করের খুব ভালো লাগে যীশুকে। কী সুন্দর দেখতে। এরকম একটি চেহারা পেলে অনায়াসে জয় করা যায় পৃথিবী। চৈতন্যদেবকে দেখো?

টুক করে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো কালীশঙ্কর।

কেমন খেউরে মার্কা চেহারা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইভ টিজারদের মতো। চোখ দুটো ভয়ানক শুষ্ক , ঠোঁটগুলো মোটা মোটা, ফেটে আছে , দুর দুর। দাড়ি রাখলে মনে হয় খেউরে ভাব কিছুটা কম হবে। তার কাছে মোট কুড়ি হাজার টাকা আছে। সেই ছোটবেলা থেকে তিল তিল করে জমানো। মাঝখানে কয়েকদিন ছাত্রও পড়িয়েছিল, সেখান থেকেও জমেছে কিছু। একটি ব্যাগে কিছু জামাকাপড়, আর বইপত্র নিলো । কালীশঙ্কর বইবিমুখ ছিল না। নিম্ন মধ্যবিত্ত একটি ছেলের যেসমস্ত বই পড়া একদম অবিশ্বাস্য সেইসব বই সে পড়ত। পাড়ার লাইব্রেরিতে তার সাতশ টাকার একটি কার্ড আছে। আস্তে আস্তে বই এর দাম বেড়েছে, সেও কার্ডের টাকা বাড়িয়েছে। কিছু বই প্রায় ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল লাইব্রেরির, ইতিহাস, দর্শন, ইংরেজি উপন্যাস বহু পুরনো, উর্দু সাহিত্যের বই, সংস্কৃত কাব্য, লাইব্রেরিয়ান দাদাকে বলে কয়ে সেগুলো সে নিয়েছে, বাড়ি এসে ব্যান্ডেজের ওপর ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সব ঠিক করেছে। প্রাণে ধরে এগুলোকে সে ছাড়তে পারবে না।

নিরুদ্দেশ হবে না। প্রথমে যার কাছে যাবে সে হরি ঠাকুর। তার বাবারই বন্ধু। আগে ওনার বাড়িতে যেতে হবে, শিলচরে। তিনি দেশভ্রমণ করেন কম খরচে। ছোটবেলায় এই বাড়িতে বহু এসেছেন। মা খুব যত্ন করে রেঁধে বেড়ে খাওয়াতো। আর কালীশঙ্কর গা ঘেঁষে গল্প শুনত ঘুরে বেড়ানোর। ওনার বাড়িতে বেড়াতে যাবে প্রথমে, তারপর ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। 

বাবা অনেকবার বাধা দিলেন, নতুন মাও। আসলে সব মানুষেরই ভয় আছে। বাবার বয়স বেড়েছে। নতুন মা কালীশঙ্করকেই অবলম্বন ভাবছেন। দোকান টোকান দেখতে হবে। এই বয়সের যুবক ছেলে যখন বাইরে বেরিয়ে যায়, তখন তার গায়ে ছোঁয়াচ লাগে। সংসারহীনতার ছোঁয়াচ। পরবর্তীতে সংসারের মায়ায় তাকে হয়তো জড়ানো যায়, কিন্তু একটি মন হয় তার, যে মনের মধ্যে পৃথিবীর অশ্লীলতা নিষ্ঠুরভাবে বাসা বেঁধে থাকে। সে নারী চিনে যায়, যাত্রার দলের বিবেকের মতো জীবনভর সংসারকে বাইরে থেকে দেখে, ঝগড়া করে সংসারের ভেতর ঢুকতে জানে না।

কিন্তু কোন লাভ হলো না। কালীশঙ্কর বাড়ি ছাড়ল। হরি ঠাকুরের বাড়ি এলো। হরি ঠাকুর একটু দুর্বল হয়েছেন বয়সোচিত কারণে। তার পত্নী আরো অসুস্থ। একটি মেয়ে আছে, কুড়ি একুশ বয়স হবে মনে হলো। ফ্যাকাশে রঙ। একটু লালচেমতো চুল। স্বাস্থ্য ভালোই। সেজেগুজে থাকে খুব। হরি ঠাকুর অবস্থাপন্ন লোক বুঝল কালীশঙ্কর। পৈত্রিক সম্পত্তি ও ব্যবসা আছে। তাতে চলে যায় ভালোই। মিতব্যয়ী। এজন্য দেশভ্রমণও বুঝে শুনে করে।

যে উৎসাহ নিয়ে কালীশঙ্কর হরিকাকার কাছে এসেছিল, দুদিন থেকেই মিইয়ে গেলো। উল্টে মনে হলো হরিকাকার ইচ্ছে আছে নিজের মেয়ের সঙ্গে কালীশঙ্করকে বিয়ে দেবার। ওনার ছেলে নেই, কালীকে পেলে তার ভালো হয়।

ফ্যাকাশে রঙের স্বাস্থ্যবতী মেয়েটি খুব লিপস্টিক দেয় ঠোঁটে, কালীশঙ্কররের সঙ্গে গল্পও করতে চায় বেশ। 

মেয়েটির মধ্যে একটি সারল্য আছে, এছাড়া আর কিছু নেই। আর তাছাড়া কালীশঙ্কররের এখন বিয়ে করার কণা মাত্র  ইচ্ছেও নেই। 

শিলচর কালীশঙ্করের এর আগে দু তিনবার আসা হয়েছে। তবে বড় হয়ে একা একা এই প্রথম। বিকেলবেলা সে একদিন সদর ঘাট গেলো। বরাক নদীতে সূর্যাস্ত দেখবে বলে। অজস্র গাড়ী ব্রিজের ওপর। নিচে বর্ষাকালের খরস্রোতা টই টম্বুর বরাক। মাছ ধরার নৌকোও আছে। দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ছেলে স্নানও করছে। এই খরস্রোতা নদীর তীব্র জলস্রোতে যেকোন সময় তারা হারিয়ে যেতে পারে নদীগর্ভে, অথচ কোন আক্কেল নেই। ব্রিজ থেকে নেমে সে একটি চায়ের দোকানে বসল। চা আর সিঙ্গারা খেতে খেতে ভাবতে লাগল কাল বা পড়শু সে হরি কাকার বাড়ি থেকে চলে যাবে। ট্রেনে করে গৌহাটি যাবে। সেখান থেকে দেখা যাক। সদর ঘাট থেকে ফেরার সময় এলোমেলো হাঁটছিল কালীশঙ্কর । শিলচর শহর কত ঝলমলে। অজস্র দোকানপাট। তবে সে কিছুই কিনবে না। এই পৃথিবীতে তার কাউকে কিছু কিনে দেবারও নেই। তাছাড়া সে খুব বুঝে শুনে টাকা খরচ করবে। 

আজ হরি কাকার বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে। উপলক্ষ কালীশঙ্কর। মাংস কালীশঙ্কর খেতে পারে না। গা গুলোয়। দু এক টুকরো কোনমতে খেয়ে সকলকে নিরাশ করলো । খাওয়া শেষ হওয়ার পর, হরিকাকা বললেন চলো গল্প করি। তবে হরিকাকার মেয়ে বাঁচিয়ে দিলো। মুচকি হেসে বলল কালীদার গল্পে মন নেই। সে বিবাগী মানুষ, তুমি চিনছো না তারে। আমি প্রথম চোখেই চিনছি। কালী একটু অবাক হলো। ঘরে গিয়ে ঘুমোনোর তোড়জোর করছিল, জল রাখতে এলো মেয়েটা। হেসে বলল, আমার নাম তো জিজ্ঞেস করলেন না, নাম ধরে ডাকলেনও না, শুনেছেন তো অন্যরা ডাকছে, আমার  ভালো নাম স্বস্তি। ভয় নেই মনের মানুষ রেডি। হার্ড ওয়ারের বিজনেস, শিলচরেই। বাবার পছন্দ না। বড়লোক বেশি। তবে রাজী হবেন। 

আপনাকে দেখে এখন বাবা লোভে পড়েছে,  আহা এমন ঝুট ঝামেলাহীন ছেলেকে মেয়ের জামাই করতে পারলে বেশ হতো।

আমি ভালো করেই জানি আমাকে আপনার পছন্দই নয়,  বিয়ে তো বহু দূরের ব্যাপার । 

  আপনিও সংসার করবেন, তবে দেরীতে। আমাকে ভালো না লাগলেও একদিন আমাদের দেখা হবে। তখন কথা হবে হয়তো। কালীশঙ্করকে আর  কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফ্যাকাশে রঙের মেয়ে দরজা টেনে চলে গেলো। কালী বুঝল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকিট করতে হবে তাকে।  যাতে চলে যেতে পারে এখান থেকে। এইসব ব্যবসা গন্ধ তার একদম ভালো লাগছে না। 


 


0 মন্তব্য(গুলি):