সূর্যছক ( বাংলা উপন্যাস, চতুর্থ পর্ব ) চিরশ্রী দেবনাথ
৪
নীলাম্বরের ধারণা সম্পুর্ন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কৈলাসহর শহরটি সুন্দর। এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে মনোরম বাগানওয়ালা একটি বাড়িতে সে থাকে। সেই বাড়িওয়ালার দুই মেয়ে। ছোটটি তার ছাত্রী। বড়টিকে নিয়ে নীলম্বরের সন্দেহ ঘন। সে আগে থেকেই নিজেকে তার সম্ভাব্য পাত্র বলে ভেবে রেখেছে। বাড়িওয়ালাকে ভাবছে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। মেয়েটিকে সে নিজের প্রতি গদগদ ভাবে দেখতে চাইছে। অথচ নিজেকে ভাবে সন্ন্যাসী।
বাড়িওয়ালার মেয়ে এসেছে কালই। আজ পর্যন্ত তার মুখটি পর্যন্ত দেখতে পায়নি নীলাম্বর। মনের মধ্যে মাত্রাতিরক্ত অস্থিরতা। রাত সাড়ে আটটায় দরজায় টোকা পড়ল। নীলাম্বর একটু আশংকিত হয়ে দরজা খুলল। মোটামুটি ফর্সা, লম্বা একটি মেয়ে, প্লাজো আর গেঞ্জি পরা। বলল, আলাপ করতে এলাম। আমাদের বাড়ির নতুন অতিথি আপনি।
নীলাম্বর হতচকিত হয়ে গেল, তার সামনে একটিই প্লাস্টিকের চেয়ার। বসতে বলল মেয়েটিকে। আমার নাম মেঘ, মানে বাড়িতে, আর অফিসিয়ালি তনুশ্রী। মাস্টার্স করছি ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষা সামনে, তাই পড়ার জন্য বাড়িতে এলাম। পাশাপাশি এখানে একটি এন জিও র যুক্ত আছি। গান, পথনাটক করি। একটু হাতখরচও হয়। মাঝে মাঝে আপনাকেও চাঁদা দিতে হবে কিন্তু। মেয়েটি দেখতে অতি সাধারণ। সাধারণ চাকচিক্য হীন লম্বা চুল। চোখ দুটো খুব সন্ধানী। প্রখর। কথাবার্তার ধরন খুবই কেজো। যেন উদ্দেশ্য ছাড়া তার কথা বলা উচিত না। নীলাম্বরের সঙ্গেও উদ্দেশ্য নিয়েই কথা বলতে এসেছে। যেমন চাঁদার কথা প্রথমেই বলে দিল।
যে কারণে এসেছিলাম, বলে ফেলি। আমাদের একটা আশ্রম হচ্ছে, দুঃস্থ মেয়েদের জন্য । কিছু সরকারি চাকরিওয়ালা মানুষ, ধনী ব্যবসায়ী, ঠিকেদার আমার লাগবে সাহায্যের জন্য । প্রচুর টাকা দরকার।
নীলাম্বর একটু টাল খেলো। এই বয়সের মেয়েরা তো প্রেম ট্রেম করে। সংসার করার স্বপ্ন দেখে। এ কীরকম মেয়ে, "মেঘ "। মেঘের মতো। নিজেকে একটু ছোট ছোট লাগল নীলাম্বরের।
কী যাবেন তো? নীলাম্বর যন্ত্রচালিতের মতো বলল হ্যাঁ যাবো স্কুল থেকে ফিরে। কিন্তু আপনার তো এখন পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়ার কথা, আপনি এসবে সময় নষ্ট করবেন? মেঘ বলল, আরে পড়ব তো রাতে। পড়া নিয়ে এতো ভেবে কী হবে? তাছাড়া কাল আপনার স্কুল নেই। রবিবার। আমরা বিকেল চারটায় বেরোব।
এইভাবে মেঘ ও নীলাম্বরের একটি অভিব্যক্তি হীন সাধারণ বার্তালাপ সমাপ্ত হলো। বছরের এই সময়টাও খুব বদমেজাজী । অর্থাৎ বৈশাখ মাস। যখন তখন কালবৈশাখী। ঝড়ো হাওয়া। মুহূর্তেই তছনছ গাছেদের বাড়িঘর। মেঘ চলে যাবার পরপরই আকাশে কড়কড় করে বাজ পড়ল। বিদ্যুৎ চমকালো। প্রচণ্ড গরম যাচ্ছিল সারাদিন। বাতাস বইতে শুরু হলো, রাস্তায় ধুলো উড়তে লাগলো। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীলাম্বর দেখছিল। ঘরে দুটো জানলা। বন্ধ করতে হবে। না হলে ঘরে ধুলো ঢুকবে। শুরু হলো বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি।
ঘরে এসে দুটো জানালা বন্ধ করে, বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে কালবৈশাখী উপভোগ করতে লাগল নীলাম্বর। ধুম ধারাক্কা মেঘের ডাক, ঘরের দেয়ালে তার লাগানো ছবিটা কাঁপছে। লোড শেডিং হলো। আলো জ্বালাবার প্রশ্নই নেই।
খুব ভোরবেলা উঠেছে বর্ষা। একটি সালোয়ার কামিজ পরে, চুলগুলো হাত খোঁপা বেঁধে, মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা লক করে বর্ষা বেরোল মর্ণিংওয়াকে।
কাল সন্ধ্যারাতে কালবৈশাখী হয়েছে। পিচের রাস্তায়
গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে আছে। বৃষ্টির জলে স্নান করে ফেলেছে আশেপাশের ছোট ছোট পাকা বাড়ি গুলো। এখনো সকালের তেমন কড়া রোদ ওঠেনি। কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে শহরের মাঝখানে পৌঁছালো বর্ষা। বাজার দোকান পাট। এখনো খুলেনি সবকিছু। একটি মিষ্টির দোকান, পুরি তরকারি বানানোর প্রিপারেশন চলছে মনে হলো। একটি বড় কেটলী বসেছে চায়ের। বর্ষার ইচ্ছে হলো এক কাপ চা খেতে। দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলো সে।
ভেতর থেকে হাঁক এলো এই যে ম্যাডাম আসুন এদিকে। বর্ষা তাকিয়ে দেখলো তার কলিগ, মনে হয় ওনার নাম সুপ্রকাশ, আলাপ হয়েছে শুধু। বেশ হাসিখুশি ভদ্রলোক। বর্ষার ভালোই লেগেছে। তবে সে তার স্বভাবের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই গম্ভীর ছিল। কেনো যেন কোন এক্সপ্রেশন আসে না তার। পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীর থেকে দূরে তার বাস।
বর্ষা মৃদু হাসল। সুপ্রকাশের সামনে গিয়ে বসল। লাল গোল প্লাস্টিকের টেবিল। বর্ষা বসতেই, সামনে চা এলো, দু প্লেট পুরি তরকারি।
সুপ্রকাশ বলল, তা কাল রাতে ঝড় বৃষ্টিতে ভয় পান নি তো একা একা?
বর্ষা বলল না তো।
সুপ্রকাশ বলল, কেনো, অবলা সুন্দরী মহিলাদের ভয় বেশি থাকে। আমি তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম কেউ যদি ভয় পেয়ে ডাকে আমাকে।
কৌতুক খেলে গেল সুপ্রকাশের চোখে। বর্ষাও হাসল।
ম্যাডাম কী খুব কম কথা বলেন।
বর্ষা এবার বলল হ্যাঁ।
আমি কিন্তু খুব কথা বলি। হাঁটা শেষ? না আর একটু হাঁটবেন। চলুন নদী দেখে আসবেন।
নদী?
আরে 'মনু নদী' কাছেই তো। কাল রাতের বৃষ্টিতে কী অবস্থা হলো পাহাড়ী রমণীটির দেখে আসি।
একটি টুকটুক রিক্সা নেবো। বর্ষা একটু থমকালো। সুপ্রকাশ সটান তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে।
একটু ভেবে বর্ষা বলল, না আজ থাক।
সুপ্রকাশ আবার হাসলো। জানতাম আপনি না করবেন।
তবে জেনে রাখুন, আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন বৈশাখের এক বৃষ্টি সিক্ত সকালে একজন পুরুষ আপনাকে একটি পাহাড়ী নদী দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল।
দামটা কিন্তু আমি দিলাম। আর একদিন আপনি খাওয়াবেন।
বলে সুপ্রকাশ হঠাৎই বেরিয়ে গেলো।
কলেজে ক্লাস চলছে। কমন রুমে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল বর্ষা। জোর ক্লাস নিয়েছে। ঝারা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। চশমার কাচ ভর্তি হয়ে গেছে চকের গুঁড়োতে।
সুদর্শনা রায় এলেন। বর্ষার সঙ্গেই জয়েন করেছেন। এটা তার দ্বিতীয় চাকরি। আগে ঝাড়খন্ডের একটি কলেজে ছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে আবার এখানে এপ্লাই করে পেয়েছেন। খুব কথা বলেন। বর্ষাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন। কী হে সুন্দরী বালিকা, এতো চুপচাপ কেন?
আজ ক্লাশ শেষ করে আমার কোয়ার্টারে চল। ইলিশ রেঁধেছি। খাওয়াবো তোমাকে। সকালে বাজারে গিয়ে কিনে আনলাম। বারশো টাকা কেজি বুঝলে। কতদিন হলো খাওয়া হয় না।
বর্ষা ভাবল যাওয়াই যাক। কী আর হবে কোয়ার্টারে গিয়ে এখন।
সুদর্শনা ডাইনিং টেবিলে দুজনের ভাত বাড়ল। ইলিশ মাছের ঝোল আলু বেগুন দিয়ে। ইলিশ মাছ ভাজা আবার গরম করলেন। কাঁচা লঙ্কা। আর ফ্রিজ থেকে দই।
খেতে খেতে সুদর্শনা বলল, ঝাড়খন্ডে থাকতে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম। মানে স্বনির্বাচিত পাত্র। তা ভদ্রলোকটিও আমাকে ভালো বাসতেন বলেই মনে হতো। একই কলেজে দুজন পড়াতাম। তিনিও বাঙালি।
বিয়ের এক সপ্তাহ আগে জানালেন তিনি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে পারছেন না, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া যাবেন। আমি বললাম বিয়ে করে যাও। যেতেই পারো। কিন্তু তিনি চাইলেন না। যাহোক গেলেন। তারপর দু তিনমাস পর জানালেন, তিনি আর সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নন। ব্যস্। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। আমিও সেই কলেজই ছেড়ে দিলাম।
খাওয়া শেষ। হাতমুখ ধুয়ে সোফায় বসতে বসতে সুদর্শনা বলেই চলেছেন, আমরা তো শারীরিক ভাবেও কিছুটা সংস্পর্শে এসেছিলাম। বেড়াতেও গেছি এদিক ওদিক। ঝর্ণার পাশে বসেছি ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। নদীর শব্দ কত শুনলাম। তিন চারটি স্বপ্নতেও একসঙ্গে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছিলাম।
বুঝেছি, আমার মধ্যে আটকে রাখার ক্ষমতা নেই। বর্ষা খুব অবাক হয়ে শুনছিল, আসলে সে ইন্ট্রোভার্ট। এরকম খোলামনে কথা বলাটাকেই সে অবিশ্বাস করে। অথচ সুদর্শনা এমনভাবে বলে যাচ্ছেন যেন জীবন জলের মতো প্রবাহিত। স্পর্শ আসে স্পর্শ যায়, দাগ থেকে যায় বহু গভীরে।
0 মন্তব্য(গুলি):