মামেকং শরণং ব্রজ
মামেকং শরণং ব্রজ
শ্রীকৃষ্ণের তখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে, যদুবংশ ধ্বংসের শেষ সীমায় আগত, হিংসা, হানাহানি, মেয়েদের ওপর অত্যাচার, লোভ সবমিলিয়ে পাপের ঘড়া পরিপূর্ণ এমনই এক ক্রান্তিকালে শ্রীকৃষ্ণকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন উদ্ধব। শ্রীকৃষ্ণ এবং উদ্ধবের মধ্যে এই যে কথোপকথন এটাই উদ্ধব গীতা। কে এই উদ্ধব? তিনি শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের ভাইয়ের ছেলে, সম্পর্কে কৃষ্ণের ভাই এবং তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভক্ত । জীবনের শেষ সময়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন আমার কাছে প্রত্যেক ভক্তই কিছু না কিছু চেয়েছে কিন্তু তুমি তো কখনো কিছু চাইলে না। তখন উদ্ধব বলেছিলেন আমি আপনার কাছে শুধু কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর চাই , আপনি দেবেন ?
শ্রীকৃষ্ণ যেন খুব কষ্টে তাঁর ভুবনমোহনকারী হাসিটি দিলেন, বললেন করো।
ভগবদ্গীতা যদি যুদ্ধক্ষেত্রের দর্শন হয় তবে উদ্ধব গীতা হলো জীবনের শেষপ্রান্তের আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ।
উদ্ধবের করা প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি বিখ্যাত প্রশ্ন হলো,
আপনি তো ভূত ভবিষ্যত সবই জানেন তাহলে সেদিন আপনি যুথিষ্ঠিরকে কেন পাশা খেলা থেকে বিরত করলেন না ?
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন ,
আমি পাণ্ডবদের আজীবনের উপকারী বন্ধু ছিলাম । তাঁরা আমাকে ভগবানের মতই বিশ্বাস করত। কিন্তু যুথিষ্ঠির যখন দুর্যোধনের আহ্বানে পাশা খেলায় সম্মতি দেয় তখন সে একবারের জন্যও আমার পরামর্শ চায়নি। এমনকি কৌরবদের সভায় সদলবলে উপস্থিত হয়েও সে আমাকে একবারও ডাকেনি ।দুর্যোধন পাশা খেলতে পারদর্শী নয় তাই সে তার বিবেক ও বিবেচনা মামা শকুনিকে দিয়ে দিয়েছিল, পাশাও সেই খেলেছিল দুর্যোধনের হয়ে, যুথিষ্ঠিরও একইভাবে আমাকে তাঁর জায়গায় পাশা খেলতে দিতে পারত তাহলে তো এই ভারতকথাই অন্যরকম হতো। কিন্তু সুতীব্র অহংবোধে তখন ধর্মরাজ যুথিষ্ঠির আক্রান্ত। পাঁচ ভাই এবং দ্রৌপদী কেউ তখন আমাকে মনে করেনি। দুঃশাসন চুল ধরে টেনে আনার সময়ও দ্রৌপদী আমাকে ডাকেনি ,
সব শেষে বস্ত্রহরণের সময় নিরুপায় হয়ে দ্রৌপদী আমাকে ডাকল
" হে হরি অভয়ম
হে কৃষ্ণ অভয়ম "
এবং আমি উপস্থিত হলাম।
অহং, ক্ষমতা ও লোভ মানুষকে উপকারী বন্ধুর কথা মনে করায় না, ভগবানের প্রতি বিশ্বাসকে টলিয়ে দেয় তখনই তার বিনাশ হয়। এটাই যুগান্তর। আমরা সবাই এই কালচক্রের দাস। এই যেমন আমি নিজের হাতে মদমত্ত যদুবংশ শেষ করে যাচ্ছি কারণ তারা এখন শুধু অন্যের ক্ষতির কারণ হবে।
মহাভারতের প্রত্যেকটি ঘটনা এখন যেন আবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে ।
মোমবাতি মিছিলে হারিয়ে যাওয়ার দেশ এই ভারত নয়। এখানে তো নারীর অপমানে লঙ্কাকাণ্ড বা কুরুক্ষেত্র হয়েছে। বদলে গেছে সময়।
শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেকটি সময়ের প্রতিভূ যিনি বলেন কর্ম করো কিন্তু আসলে তুমি কেউ নও। ভগবান তোমাকে প্রত্যক্ষ কোনো সাহায্য করবেন না শুধু
তোমার ভালো ও খারাপ প্রত্যেকটি কাজের ফল তোমার জ্ঞানে এবং অজ্ঞানে দিয়ে যাবেন। এখন তোমাকেই ভাবতে হবে তুমি পাপের সঙ্গে থাকবে না শুভবোধের সঙ্গে।
কুরুক্ষেত্রের যু্দ্ধে অভিমন্যুর নৃশংস হত্যার পর চরম বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে বোঝাবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে আত্মা লোকে নিয়ে যান।
সেখানে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে অর্জুন দেখলেন অভিমন্যু তাঁর ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করার সুফল নিয়ে প্রসন্নমনে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
অর্জুন তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন ।বলছেন আমি তোমার পিতা হে পুত্র।
অভিমন্যু অবাক হয়ে বলছেন কে কার পিতা ? আমাদের হাজার জন্ম হয়েছে হয়তো। কোনো জন্মে আমি তোমার পিতা কোনো জন্মে তুমি আমার।
আত্মা তো অবিনশ্বর।
এখন আমরা যদি পরজন্মে বিশ্বাস করি তবেই হয়তো মোক্ষযোগের দর্শন এবং লোভকামপাপপ্রেমহিংসা ত্যাগ করে অক্ষয় আলোর এই স্তরে পৌঁছুতে পারব।
#চিরশ্রীদেবনাথ
0 মন্তব্য(গুলি):