নববর্ষ, ১৪২৭
আমাদের জীবনে দেখা একটি উচ্ছ্বাসহীন ব্যথিত নববর্ষ। হালখাতার উৎসব এবার নিজেই মাথা নীচু করে বসে আছে।
আমরা এবার আলিঙ্গন বিহীন, শুভেচ্ছা বিনিময়কে ভার্চুয়াল করে নিরাপদ থাকতে চাইব। বলব না আমার গৃহে এসো।
সমস্ত আয়োজনকে সন্দেহের চোখে দেখব, এই দধি মিষ্টান্ন,
পুজো উপচার, কোথাও কি লেগে আছে প্রাণঘাতী একটি অস্তিত্বের পজিটিভ উপস্থিতি।
এই দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের সামান্য আনন্দও অনৈতিক মনে হচ্ছে।
যখন দেখি সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ কাজ হারাচ্ছে, খুব ভয় হয়। কোথায় যাবে এতো মানুষের কর্মহীনতা। পৃথিবীতে মৃত্যুর চেয়েও বিযাদের খবর হলো কাজ হারানোর নোটিশ । একটি পরিবারে যখন চাকরি যাওয়ার খবর আসে তখন সেই মুখগুলোর কথা মনে হলে আমি তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই । একটি বছর শেষ হয়ে আর একটি বছর আসছে। মাঝখানে স্তব্ধতার সেতু। সংক্রমণের অভিঘাত। স্বার্থপরতার নির্বাক পদচারণ। সব জায়গায় শুধু নেই, নেই। অথচ উর্বর কৃষিক্ষেত্র আছে, ফলে ফলে সমাদৃত বাগান আছে, এখনো আছে মিষ্টি জলের সম্ভার আর আছে বর্ডার লাইনে দাঁড়িয়ে সতর্কবার্তা, মানুষ যেন সবকিছু শুষে না নেয়, নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিয়ে বাকিটা রেখে দেয় পশু, পাখি, গাছপালার জন্য।
আমাদের লক ডাউন যখন বেড়ে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে হাহাকারের শব্দ শুনতে পাই। বন্ধ কলকারখানা থেকে, মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য জিনিসপত্রের দোকান থেকে সেই শব্দ গুমড়ে ওঠে। বেঁচে থাকার লড়াইটা ঠিক কতদূর নিয়ে যাবে মানুষকে।
পরিযায়ী পাখির মতো আজকাল খুব পরিযায়ী শ্রমিকের কথা শোনা যায়। আমাদের কত সাহস, পরিযায়ী শব্দটি অন্যের ঘাড়ে বেঁধে দিতে ভাবি না। অথচ আমরাও প্রত্যেকে পরিযায়ী । অন্ন বস্ত্র আর বাসস্থানের সামান্য নিশ্চয়তা তৈরি হলেই গায়ে এঁটে যায় স্থায়ী শব্দ। লক ডাউনে নিজের ঘরে বসে আছে সারা পৃথিবীর বুকে এরকম অসংখ্য মানুষ, আর পরিযায়ী মানুষরাও আছেন রোদক্লান্ত রাজপথে, তারা কোথায় কোয়ারেন্টিনে যাবেন, এই বিশাল রাষ্ট্র তার কোটি কোটি জনগনকে কি নিশ্চয়তা দেবে? সবকিছু ভাবতে ভাবতেেই শিউরে উঠছি, ভাবছি নিজের ভাঁড়ারে টান পড়বে না তো? সেখানে উৎসবের প্রতিধ্বনি মনখারাপের শব্দের মতন ছেয়ে আসে চারদিক থেকে।
হয়তো আমরা খরচ কমিয়ে ফেলব। সামান্য প্রয়োজনের মধ্যে আস্তে করে নিজেকে গুটিয়ে নেবো। এই নববর্ষকে বিবিধ খাদ্য সামগ্রীতে ব্যথিত করতে ইচ্ছে করছে না। খুব বাধ্য হয়ে গুটি গুটি পায়ে সে সমস্ত বৈভবকে আইসোলেশনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে ম্লান মুখে। আমরা তাকে ধূপের ধোঁয়ায় তুলে নেবো ঘরে। এসো হে নতুন বছর। অসুস্থতা দূর করো , সমৃদ্ধি এনো সন্তানদের ঘরে। এই গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা শুকিয়ে দিক মনের আলস্য। ঘাম পড়ুক সেখানে। পৃথিবীর বুকে কত অন্ধকার সময় আসে। সুনামী হয়, ভূমিকম্প হয়, যুদ্ধ হয়। তবুও মানুষ হারে না। স্থানে স্থানে গড়ে তোলে জলসত্র, রেশনের দোকানগুলো বাঁচিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় শর্তগুলো পালন করতে তৎপর হয়। চারপাশ থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো যুবকদলের দেখা পাওয়া যায়, যারা কোনকিছুকে ভয় পায় না, সাহায্যের জন্য বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, বৈশাখের হু হু গরম হাওয়ায় তারা সবুজ কেতনের মতো। এই নববর্ষে আমরা আমাদের দেশকে অনুভব করতে চাইছি। পরখ করে নিতে চাইছি আমরা কি সত্যই গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশের বাসিন্দা? যেই দেশের মানবিক মুখ তার কোটি কোটি দেশবাসীকে গর্বিত করবে, বেঁচে থাকা মানুষেরা বলবে আমরা এই দেশে বেঁচে থাকার মজবুত আস্থা নিয়ে থাকি।
তবে এই যে শত শত মানুষ বেরিয়ে পড়ছেন বাজারে, মাছ, মাংস, সব্জি, মিষ্টি কিনতে, অবশ্যই বর্ষবরণ। খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়, প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমিতে, কিন্তু চীন, ইতালী, স্পেন, আমেরিকার মৃত্যুমিছিল কি আমরা দেখছি না, বুঝছি না। শব চলে যাবে শবের মতো। তাঁর ফুল মালা ধূপকাঠি, মন্ত্রোচ্চারণ কিছুই লাগবে না, একটি রাষ্ট্র যখন তার দেশের আগামীতে মরে যাওয়া মানুষের জন্য এক লক্ষ মৃতদেহের প্যাকেটের অর্ডার দেয়, সেই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে অর্থহীন লাগছে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা, নান্দনিকতা, এমনকি সৃজনশীলতাও।
উল্টোদিক থেকে ভাবছি আমরা অরণ্য ধ্বংস করে ফেলি, বাঁধ দিয়ে নদীকে বেঁধে ফেলি এইসব নিষ্ঠুরতার সময় আমরা কি একবারও ভাবি পশু পাখি আদিবাসীদের রক্তক্ষরণ, অসহায় চোখের জল, হারিয়ে যাওয়ার ক্রমাগত অনালোকিত নিষ্ঠুর ইতিহাসের কথা। বার বার ভাবি, আমাদের বেঁচে থাকাটাও তো কারো কারো কাছে অন্যায়?
আর কিভাবে ১৪২৭ এর নববর্ষকে বরণ করবো জানি না, শুধু মনে হচ্ছে নির্জন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাজুক পশুর দল , বন্ধ দরজার ভেতরে আমরা স্থবির , আমাদের অশ্লীল হইচইকে বন্ধ করে দিয়েছে রহস্যময় এক ভাইরাস, কে পাঠালো তাকে? সেও কি কোনো পক্ষপাতহীন ঈশ্বরের দূত?
( আজকের স্যন্দন)
0 মন্তব্য(গুলি):