আমার বড়ো হওয়া
আমার বড়ো হওয়া
....চিরশ্রী দেবনাথ
আমার বড়ো হওয়ায় যা যা ছিলো, কিছুই যদি না লিখি। যদি না লিখি মায়ের কথা, বাবার কথা, ভাইবোনের কথা, সংসারের রঙমশলা, ধুলো আর দখিনা বাতাসের কথা, স্কুলের কথা, স্যারের বাড়ি, সরস্বতী পুজো, মহালয়ার সকাল এবং বড়ো হওয়ার কিছু মোস্ট কমন ফিলিংসের কথা, তাহলে কি আমার বড়ো হওয়া লেখা যাবে?
আমি এই সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে আমার বড়ো হওয়া কন্টিনিউ করতে চাই।
এই তো বড়ো হয়েছি, একটা বিশাল বড়ো পাথর গড়াচ্ছে চাকার মতো, নীচে স্বাদ স্বাদ, মাখা মাখা ঝোল পরছে টেনে নিচ্ছি, উপরে জ্যোৎস্নার পায়েস, চেটে নিচ্ছি।
আমি আপাদমস্তক সাবধানতায় বড়ো হয়েছি।
অনেক আগেই বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম রামের কথা, দ্রৌপদীর কথা, চরিত্রহীনের সাবিত্রীর কথা পড়ে পড়ে।
সব কিছু আগেই বুঝতে পারি এই অনুভব নিয়ে বড়ো হয়েছি। রামধনু কেটে একটুকরো হাসি রাখতাম মেঘলা জামায়, সুযোগ বুঝে ছড়িয়ে দিতাম সন্ধিক্ষণে।
একটু খুশি টগবগ।
এর চাইতে বেশী বড়ো হতে বলো আমাকে ঐ বয়সে !!
এক ট্রাঙ্ক ভর্তি আনন্দমেলা পেয়েছিলাম উত্তরাধিকার সূত্রে, দাদা দিদির। তারা আমার থেকে পুরো একযুগ বড়ো।
সেগুলো ছিল ছোট সাইজের আনন্দমেলা। তাতে ধারাবাহিক দ প্রকাশিত হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রুকু সুকু।
রূপকথার মতো পাহাড়ি শহর, কি যেন নাম ছিল ঐ বাচ্চা মেয়েটির, রুকু সুকু দুই ভাই, ফাদার, চার্চ, মিষ্টি মিষ্টি হালকা হলকা কৈশোরের আগমন বার্তা।
একই সঙ্গে ঐ আনন্দমেলা গুলোতে ধারাবাহিকভাবে লেখা বসুবাড়ি। খোপ খোপ, সাদা কালো বারান্দায়, একটি ইজি চেয়ার, নেতাজী কি তাতে বসা ছিলেন না শুধু ইজিচেয়ারের ছবি ছিল, ভুলে গেছি।
আমি অনেকক্ষণ ধরে অভিজাত বসুবাড়ির বারান্দার ছবি দেখতাম, নিঃসঙ্গ, একাকী ছবি একটি।
বড়ো হওয়া মানে যেন হঠাৎ করে একলা সম্পূর্ণ আলাদা মন গড়ে ওঠার রাজকন্যে দুপুর।
আমি তখন রুকু সুকুর সঙ্গে বড়ো হচ্ছিলাম। সেরম একটি শহর আর বন্ধুর শখ হতো খুব।
দেবদূতের মতো সব ভালো ভালো মানুষ ছড়ানো ছিল পুরো উপন্যাসটিতে। সুন্দর তাদের ব্যবহার।
কৈশোরের কোমল অনুভূতির কি সার্থক চাষাবাদ।
আমার বড়ো হওয়ায় তাই মিশে গেলো এক খাম ভর্তি পৃথিবীর ভালো মানুষের গল্প।
সেই থেকে আমি জানি মানুষ ভালো, খুব ভালো।
একটি রুশ বড়ো গল্প। কিশোর সাহিত্য। অনুবাদ করা। কমলা রঙের মলাট, রাইটারের নাম মনে নেই, বইটির নাম ছিল, "নীল পেয়ালা "।
ভুট্টা ক্ষেত, গাজর ক্ষেত, রোদ ঝলমলে ঝকঝকে বরফাচ্ছন্ন রাশিয়া, আপেল গাছ, কাঠের বাড়ি।
কয়েকটি টগবগে রুশ ছেলেমেয়ের সঙ্গে বড়ো হলাম কিছুদিন।
কথায় কথায় রেড স্যালুট, শ্লোগান ।
মনেপ্রাণে প্রেমিক হলাম। কমরেড হলাম। কমরেড মানেই প্রেমিক, হৃদয়ভর্তি সাম্যবাদের চাষ।
কি ভালো, কি ভালো এই বিপ্লব, শ্লোগান, মনপ্রাণ ভরে শুধু মধুময় ভালো লাগা মিশে যেতে লাগলো।
গল্পটির ছেলে মেয়ে গুলো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বোধহয় , ঝোলায় পাউরুটি, মাখনের কৌটো, ঝাঁঝালো কফি!
কি এক ঘোর লাগিয়ে আমাকে আক্রান্ত করে দিয়েছিল সেই কিশোর গল্প।
বাবু একদিন কলেজের লাইব্রেরী থেকে এনে দিলেন, টলস্টয়ের ছোট গল্প ( বাংলা অনুবাদ )।
আঠারশো শতাব্দীর ধূসর পথ, শীতার্ত জীবনে বড়ো হতে লাগলাম।
ট্যু পিলগ্রিমস্, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলাম।
ভালো লাগতো রাশিয়ার সেই গ্রামটির কথা পড়ে।
মূলগল্প থেকে গল্পের পারিপার্শ্বিকই আমাকে টানতো বেশী।
আমার ছোট্ট পৃথিবী তখন অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে।
লিও টলস্টয়, আবার আচ্ছন্ন হলাম।
ওয়ার এন্ড পিস।
উপন্যাসটির দুটো খন্ড, কি যে বোরিং লাগছিল উপন্যাসের শুরুটি।
টলস্টয় ছয় বছর ধরে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন ।
তিনি জন্মেছিলেন সেই সময়টির পনের বছর পর, কিন্তু কি অপরিসীম খুঁটিনাটি।
আমি নেপোলিয়ানের যুদ্ধ, সৈন্যদল, অজস্র ষড়যন্ত্র,বহু চরিত্র, বহু প্লট এসবের বাইরে গিয়ে শুধু রাশিয়ার প্রাকৃতিক আবহাওয়ার বিবরণ খুঁজতাম।
না শেষ করে পারিনি, পড়েছিলাম, বেশ কয়েকদিন লেগেছিল, মাঝে মাঝে পাতা স্কিপ করতাম।
দুটি খন্ড, অবশেষে পরীক্ষা শেষ হওয়া এক বিকেলে শেষ হলো।
বড়ো হয়েছিলাম কিন্তু এই উপন্যাসটি পড়ে।
বুঝলাম সব যুদ্ধই একটি পটভূমিকা ।
পরিবর্তনের তাগিদ নিয়ে আসে।
তাই যুগে যুগে যুদ্ধ অনির্বায।
নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি পৃথিবীর ইতিহাস নয়।
এরমধ্যে আস্তে আস্তে নানা কিছুই পড়ার বইয়ের তলা দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করছে, ডালপালা শিকড় সহ এমন খুঁটি দিয়েছে যে, গলগল করে অন্তরাত্মার পজিটিভ এবং নেগেটিভ উভয় ধরনের বড়ো হওয়া চললো সমানভাবে।
বন্ধু নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত, বলে দিয়েছেন "আমার বড়ো হওয়া নিয়ে "লিখতে হবে।
এক্ষেত্রে আমার বড়ো হওয়া হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপর আরেক হ য ব র ল, তাই অষ্টম শ্রেণীর পরবর্তী পর্যায় বাদ থাকলো ।
এই সময়ে আমার পড়া সবচেয়ে প্রিয় কিশোর উপন্যাস, "হাসি কান্না চুনী পান্না ",
( সত্যজিৎ সমগ্রকে আলাদা ভাবে রাখতে হবে, কারণ, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু তারা অন্যগোত্রের , ষষ্ঠীপদর পান্ডবগোয়েন্দা, সুনীলের কাকাবাবু সন্তু, জিম করবেটের শিকার কাহিনী ইত্যাদি ইত্যাদি বড়ো হওয়ার বাইরে, নির্মল আনন্দ দিয়েছে , বড়ো হওয়ার তির ছোঁড়েনি।
আর বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় কম্পিটিশনের বাইরে রেখেছি, প্রতিদন্দ্বী নেই বলে ),
সঞ্জীব চট্টপাধ্যায়ের "হাসি কান্না চুণী পান্না ",এতো রোমান্টিক কিশোর উপন্যাস, আমাকে ঝালাপালা, আর ডুবন্ত করে দিয়েছিল।
এই বইটিতে দুটো উপন্যাস বা বোধহয় বড়ো গল্প বলাই যথাথথ হবে, ছিল সম্ভবত।
দ্বিতীয়টিতে একটি মেয়ে, দুটো ছেলের গল্প।
বড়ো হতে হতে জানছি, বড়ো হওয়া মানেই ত্রিকোণমিতি ।
প্যান্টাগন, হ্যাক্সাগন, অক্টাগন ইত্যাদির অপরিমিত খেল্।
শুধু ইউক্লিডীয় সারল্যের প্রমাণিত উপপাদ্য হিসেবে জীবনকে প্রমাণিত করা যায় না
এই উপন্যাসটিতেও একটি মফস্বল শহর, মাস্টারমশাই, মিছরির মতো কুয়াশা, কাচের মতো নদী, ছবির মতো বাংলো বাড়ি, সবকিছু স্বপ্নসম্ভবা।
আমি এই বইটির বাসিন্দা হয়ে রইলাম বহুদিন।
জানলাম কেউ কেউ জীবনের কথক হোন।
পাশ দিয়ে চলেন। তার ভালোবাসতে নেই, আত্মবিমুখ হতে হবে, সব বুঝবেন কিন্ত ভাঙ্গবেন না।
তার একটি প্রেমিকা থাকে, তিনি আসলে ঈশ্বরী, তাকে ছুঁতে নেই, নদীকে দেখার মতো তার তীরে বসে তাকে দেখতে হয় আর সূর্যাস্তের ঠিক আগে মানে ডুবে যাওয়ার ঠিক আগে ফিরে আসতে হয় বাড়ির পথে, বাড়িটি তখন প্রত্নতাত্ত্বিক, বটগাছের অলস ঝাপসা অন্ধকার।
বইটির সঙ্গে সঙ্গে আমার অনুভব প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি বিকেল, গোধূলি, সন্ধ্যা, রাত আর সকাল হয়ে বাড়তে লাগলো।
গল্পের মেয়েটি গোলাপী ফ্রকে ঘুরে বেড়ায় ,তাই আজ অব্দি আমার কাছে আধফোঁটা সব কিশোরীর জামার একটিই ডিজাইন গোলাপী রঙের সাদা লেস লাগানো
বলপ্রিন্টের ফ্রক।
আমারো তখন ক্লাস এইট।
একটি সুন্দর গোলাপী ফ্রক আমিও পরতাম।
এতোটুকু বড়ো হওয়াই না হয় আপাতত থাক।
পুনশ্চ এক ...কৃত্তিবাসী রামায়ন, কাশীদাসের
মহাভারত, কথামালা, পুরানের গল্প, হিতোপদেশ, মেয়েদের ব্রতকথা, গল্পে উপনিষদ, ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্টের বঙ্গানুবাদ, জাতকের গল্প, ফাইভ টাইভ অব্দিতেই পড়া হয়েছিল, কারণ বাড়িতেই এনারা মজুত ছিলেন আরো অনেক বাড়ির মতোই।
নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যৎ বাণী, ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, কি করে যেন এক কপি আমাদের বাড়ি এসেছিল, পৃথিবীর ধর্ম টর্ম সম্পর্কে একটি ধারণা ঢুকিয়েছিল মনে, ভালো ও খারাপ মিশিয়ে বড়ো হয়েছিলাম নিজের মতো।
গল্পের বইয়ের নিতান্তই অভাব দেখা দিলে, বাবুর আলমারী থেকে মহাপুরুষের জীবনী, ভারতের সাধক ইত্যাদিতে হাত লাগাতাম, সবকিছু মাঝে মাঝেই ভীষণ অলৌকিক মনে হওয়ায়, বয়ঃসন্ধির অবাধ্য মন লৌকিকতার দিকে আকৃষ্ট হতো খুব।
একদম অনুসারী কিছুতেই হতে পারতাম না। একটি তর্ক, দ্রোহ বাসা বাঁধলো ক্লাস এইটের আমার চারপাশে।
পুনশ্চ দুই ...তথ্যগত ভুল থাকতে পারে, পুরোটাই স্মৃতি থেকে লিখিত, যারা পড়বেন, শুধরে দেবেন।
পুনশ্চ তিন...রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প, স্মৃতিকথা, উপন্যাস কিছুই উল্লেখ করলাম না। কারণ তাঁর হাত ধরে আমি মৃত্যু পর্যন্ত বড়ো হবো, তিনি সব মুহূর্তেই আমাকে বড়ো করছেন।
কেবলি জল পড়ছে, পাতা নড়ছে।

0 মন্তব্য(গুলি):