বিষহরি
বিষহরি
পদ্মপুরাণের মানুষগুলো হলো আমাদের বেসিক চরিত্র। লোভ, হিংসা, গালাগালি, পিটাপিটি, সাংসারিক চুলোচুলি, এই ভালো, এই খারাপ, কুটকাচালির প্রাণরসে পূর্ণ এবং জীর্ণ । দেবী চণ্ডী, পার্বতী, মনসা সবাই কলতলার ঝগড়ার মতো করে এখানে ঝগড়া করেন। একটি শব্দ বসাচ্ছি, নীচুতলার মানুষ, অনিচ্ছুক শব্দের ব্যবহার করলাম, কারণ আমরা প্রত্যেকেই ভেতরে খুব যত্নে একজন নীচুতলার মানুষকে লুকিয়ে রাখি। রুচিশীল বহির্জগতকে দেখলে বোঝা যায় না ঐ নীচুতলার মানুষটি ঠিক কতটা নীচুতে আছে। পদ্মপুরাণ আমাদের আক্ষরিক এবং সামাজিক মনোজগৎ। শ্রাবণের কাদামাটিজল এই বিষহরি।
এটাও সেই সাহিত্যই যেখানে মেয়েদের খুব শোষিত, নিপীড়িত, অসহায় করে দেখানো হয়েছে। সবসময়ই একইরকম আসলে আমাদের সমাজ। শোষিত, নিপীড়িতরাই একসময় ক্ষমতাকামী হয়ে ওঠেন, স্বাধীনতা প্রিয়।
মনসা অযোনিসম্ভুতা।
মঙ্গলকাব্য অনুসারে কাশ্যপ মুণির মন থেকে সৃষ্ট কন্যা।
তখন পৃথিবীতে সর্প দংশনে মানুষের মৃত্যুর বাড়াবাড়ি দেখে, ব্রহ্মা কাশ্যপ মুণিকে কোন প্রতিষেধক মন্ত্র ভাবার কথা বলেছিলেন, কাশ্যপ মন দিয়ে যখন মন্ত্রচিন্তা করছিলেন তখনই এই অপূর্ব রূপসী তেজস্বী কন্যাটির সৃষ্টি হয়।
তাই তিনি মনসা, বাসুকি তাঁকে ভগ্নীর স্বীকৃতি দেন, ব্রহ্মা তাঁকে
সাপদের দেবী করে দেন, আর মহারাজ পৃথু যখন গাভীরূপী পৃথিবীকে দোহন করছিলেন তখন যে বিষ উঠে এসেছিল, বাসুকী সেই বিষের কর্তৃত্ব দেন মনসা কে। দেবদেবীর বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা টমতা প্রথম থেকে মনসার ছিল না, শুধু এই বিষটুকু ছাড়া। শিবের পরামর্শে তাকে বিষ্ণুর ধ্যান করতে হয়, তখন কিছু দৈব ক্ষমতা তিনি পান।
মঙ্গলকাব্যে মনসা শিবের কন্যা। অবশ্যই সরাসরি নন। শিবের সাময়িক কামোত্তজনার ফসল তিনি, সে আবার মহা ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার।
শিব প্রথম নাকি জানতেনই না মনসা তার কন্যা, তিনি এই অপূর্ব সুন্দরী কন্যাকে দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন।
মনসা তখন অনেক কষ্টে তাঁকে বোঝান যে তিনি কন্যা, শিব পিতা। জন্ম মাত্রই মনসা শুধু সংগ্রাম করে গেছেন। স্নেহ আর মায়া মমতার জন্য খুব লোভী হয়ে উঠেছিলেন প্রথম প্রথম। শিবের বাড়ি যেতে চান, চণ্ডীর ভয়ে ভীত শিব, মনসার অনেক কাকুতি মিনতিতে গাঁইগুঁই করে অবশেষে তাঁকে বাড়ি নিলেন, তারপর যা শুরু হলো, চণ্ডী ধরে নিলেন এই অপূর্ব সুন্দরী কন্যাটি অবশ্যই তাঁর সতীন। অতএব,
তিনি উন্মত্তের মতো মনসাকে মারতে লাগলেন।
পূর্ববঙ্গের কবি জানকীনাথের বর্ণনায়,
"কুনুহাতে কিল মারে কুনু হাতে চড়ঃ
কুনু হাতে মটকি এ মারছে চাপড়,
কুনু হাতে টুকর মারএ ক্ষণে গালে :
কুনু হাতে ধরে চণ্ডী মনুসার চুলে
দক্ষিণের চক্ষু হস্তে বড় কুপ মনেঃ
অঙ্গুলির অগ্রে হানে পৌদ্দার নয়নে।
চণ্ডীর প্রহারে পৌদ্দা সহিতে না পারে :
অচেতন হৈয়া পৌদ্দা পড়ে ভূমিতলে। "
তারপর মনসারও রাগ উঠল, সে ও একসময় প্রতিশোধ নেয়, এমন বিষ ঢালে যে চণ্ডী কুপোকাত। সেসময় সব দেবতারা এবং শিব স্বয়ং তাড়াতাড়ি চণ্ডীকে বাঁচিয়ে দিতে মনসাকে অনুরোধ করেন, এতক্ষণ ধরে যে পদ্মা মার খাচ্ছিল তখন কেউ আসেনি কিন্তু, কি নিদারুণ পক্ষপাতিত্ব।
মনসা আবার সবসময় দারুণ পিতৃভক্ত, পিতার কথা রেখে তিনি চণ্ডীকে বিষমুক্ত করলেন। বাসুকী বুঝেছিলেন ঠিকই, মনসাকে খুব লড়াই করতে হবে, তাই জন্ম থেকেই তাঁর চোখে ঢেলেছিলেন বিষ।
এই সময়টা ছিল মনসার মার খাওয়ার আর শোষিত হবার সময়, সবরকম ঘৃণা তাঁর মনে পুঞ্জীভূত হয়ে তাঁকে এক নিষ্ঠুর, হিংস্র, প্রতিশোধ পরায়ণ দেবীতে পরিণত করেছে, অথচ ভেতরে কত পিপাসা তাঁর।
বৃদ্ধ মুণি জরৎকারু বিয়ে করবেন না, শেষপর্যন্ত পিতৃপুরুষদের মুক্তির জন্য পুত্রার্থে বিয়ে করবেন বলে ডিসিশন নিলেন , পাত্রী সেই মনসা বা পদ্মাবতী।
জরৎকারু আবার চরম অপমান করে শিব কন্যা মনসাকে বলেছিলেন ভাঙ্গরার বেটি। মনসা পিতৃনিন্দা সহ্য করতে পারতেন না, বহু কষ্ট করে তিনি এই বহুমূল্য পিতৃপরিচয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, তাই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে তিনি জরৎকারুকেও রেহাই দেন না বিষদৃষ্টি থেকে,
" ভাবিতে চিন্তিতে পদ্মা স্থির করে মন
কোপে বিষ পূর্ণিত হইল দু নয়ন
বিষ নয়নে পদ্মা মুণি রে নেহালে
পদ্মার কোপে পোড়ে মুণি কালবিষের ঝালে "
এটাই মনসার চরিত্রের উগ্র সারল্য।
অন্যায় সহ্য করতে পারেন না, অথচ নিজেও তাঁর পুজো করতে না চাইলে কেউ, ধনে ও স্বজনে হত্যা করতেন তার পরিবারকে।
অতুলনীয় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন দেবী মনসা, বিশেষ করে যেন তেন প্রকারেণ চাঁদ সরকারের পুজো পাওয়ার পর থেকে। একজন দেবী আত্ম প্রতিষ্ঠার জন্য একাই লড়েছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন, এক্ষেত্রে ভয় প্রদর্শন হলো তার অন্যতম অস্ত্র। খুুুব মিল এখনের কোন কোন নেত্রীর সঙ্গে।
ভারত হলো সর্প প্রভাব যুক্ত দেশ, আমাদের নাগপুর, নাগপত্তন, অনন্তপুর, তক্ষশীলা, এসব নামই বলে দেয় সাপ কি ভীষণ গুরুত্ব নিয়ে আছে, সেই সঙ্গে প্রিয় বিষহরা।
জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিয়ে হবার পর, কিন্তু চণ্ডী আবার নানান ফাঁদ পেতেছিলেন, একদম টিপিক্যাল সৎ মা দের মতো। তিনি বলেন মনসা যাতে জ্যান্ত সাপ মালার মতো গলায় জড়ান। আর তিনি ঘরে ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ব্যস্ বাসররাতে সব সাপ ব্যাঙের পেছনে ছুটতে লাগলো, ঋষি জরৎকারু ভয়ে পালালেন।
চণ্ডী মনসার বাসরকে এভাবে ভণ্ডুল করেছিলেন বলেই বোধহয় মনসাও পরবর্তীতে বেহুলার বাসরকে ভণ্ডুল করেন, তাঁর দুঃখ, অতৃপ্তি কিছুটা হলেও বেহুলার মাধ্যমে মিটল।
এভাবে এক নারী থেকে অন্য নারীতে সংক্রামিত এই হিংসা সর্পবিষের চাইতে কম মারাত্মক নয়, এই আদিমতা মেয়েরা দারুণ রকমভাবে রক্তে লালন করেন এবং পূর্ববর্তী প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তা দিয়ে শোধ নেন আজও, বাইরে যতই শিক্ষার প্রলেপ পড়ুক না কেন।
বৃদ্ধ জরৎকারুর আবার শর্ত ছিল, জরৎকারুর কথা না শুনলেই তিনি মনসাকে ছেড়ে দেবেন। আশ্চর্য, এতসব অপমান মিশিয়ে মনসা নামক পৌরাণিক চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছেন, সেকালের কবিরা। তাঁরা জোট বেঁধে মনসার মধ্য দিয়ে মেয়েদের সামাজিক অবস্থানকেই দেখাতে চেয়েছিলেন।
খুব একটা উনিশ বিশ হয়েছে কি এই অবস্থানের !
পদ্মাবতী বেশ কয়েকবার ধর্ষণেচ্ছু মানুষের সম্মুখীন হয়েছিলেন, যার মধ্যে সূর্য নামে এক মুণিও ছিলেন, মনসা তখন বিবাহিতা, মনসার সঙ্গীনী নেতা নিজেকে বলি দিয়ে মনসার সতীত্ব রক্ষা করেন, এজন্য মনসা আবার সেই মুণির দ্বারা অভিশাপ গ্রস্ত হন, যে তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে যাবে, কি লোভ ! কি লোভ, ভাগ্যিস এখনের দিনে আর অভিশাপ কার্যকরী নয়, তাহলে যে আরো কি দুরবস্থা হতো। আবার এক হালুই ব্রাহ্মণ, বচাই বা বছাই তার নাম সেও মনসাকে ভোগ করতে চান, তাকে অবশ্য মনসা বিষ দিয়ে পর্যুদস্ত করেন।
দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য "নামক গ্রন্থটিতে মোট বাষট্টি জন মনসামঙ্গল রচয়িতার কথা বলেছেন,
এছাড়াও আরো বহু মনসামঙ্গল কবিদের কথা জানা যায় পূর্ববঙ্গের আনাচে কানাচে, হয়তো তারা অনুল্লিখিতই রয়ে গেছেন।
মানুষের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই বিষরস এতটাই জনপ্রিয়, এতটাই গীতমুখরতা তার পৃথিবীর শ্রাবণধোয়া জলে আজও।
শেষে রচিলাম দু চারি খানা পংক্তি, কানাহরি দত্ত দিলা অনুমতি।
মনসা
পাঁচশ টাকা দিয়ে মনসা মূর্তি কিনে এনেছে যূথিকাবালা
তার পনের বছরের মেয়ে বলে, মা, মূর্তির দেখি দুই চোখ ভালা?
অথচ পদ্মপুরাণে কয় মনসা বলে কানা ...
মা কয়, চুপ চুপ, দেবতা ! দেবতা !
রাতের বেলা মাইয়াটা কালি দিয়া করল এক চোখ কানা,
মনসা হাসে, ঘুমায়
কত আন্দোলন করছে, এখন তাঁর শরীরভরা ক্লান্তি
আসলে তো ছোবলেরও শক্তি নেই, চক্ষুতে নাই বিষ
শ্রাবণের ভরা নদীর মতো খোলা মন আজকাল
কি যেন নাম তাঁর... অনার্য দেবী... চ্যাং মুড়ি কানি।
© চিরশ্রী দেবনাথ
0 মন্তব্য(গুলি):