১০৩২৩

১০:২১ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

১০৩২৩
                  ( চিরশ্রী দেবনাথ )

একটি আলোছায়া রচিত সাধারণ রেস্টুরেন্টে বসে আছে দুইজন যুবক যুবতী। তাদের নাম বরুণ এবং কিরণ।  সামনে পুরি তরকারি। বরুন খাচ্ছে, মানে যাকে গেলা বলে। কিরণও। অন্ধকার তাদের মুখ। বরুণ বলল বিয়েটা পিছিয়ে দিচ্ছি। কিরণ চমকে বলল কেন? বাহ্, সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের পর, বিয়ে করা আর মানায় না। কিরণ বলল, আমিও তো ১০৩২৩, তোমার মতই, আমি তো তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা বন্ধ করে দেবার কথা ভাবছি না। তুমি বিয়ে করার পর আমার বাড়িতে আসবে। আমি তোমার বাড়িতে নয়। আমার বাড়িতে ঘর কম। ভাবছিলাম সুপ্রিমকোর্টের রায়টা ভালো হলে, আরেকটা ঘর তুলব। বিয়ে করার পর সেখানেই তোমাকে নিয়ে তুলব। কিন্তু এখন কোন টাকা পয়সা খরচ করবো না। বোনের বিয়েটা কোনমতে দিয়ে দিতে চাইছি। ভাইটা টি এস আরের চাকরির জন্য চেষ্টা করছে, যদি পায় তাহলে তো ওর হয়েই গেলো। এই বাজারে এখন টিউশনিও ভালো খুব একটা পাওয়া যায় না। মা বাবা আছেন। তোমার মা বাবার মতো পেনশন হোল্ডার নন। কাপড়ের ছোট্ট দোকানটা বন্ধের মুখে, ওটাতে কিছু মালপত্র যোগ করে, বিজনেস টা বাঁচাতে হবে। তাহলে না খেয়ে মরব না। কি সমস্যা বরুন তাহলে?  হয়েই গেলো সব, কিরণ বলল।
চাকরি একদম চলে গেলে আমিও কিছু না হয় করবো। 
ততটা অসচ্ছল নই আমরা। কিন্তু বরুণ এই মুহূর্তে খুব কঠোর। সে ভুলে গেছে পেছনে ফেলে আসা বহু বিকেল, সকাল দশটার একসঙ্গে যাওয়া, কথা রাখার পূর্ব শর্তসমূহ। জীবন থেকে নিশ্চিত ভাবটা হারিয়ে গেছে এক লহমায়। এই চুরান্ত অনিশ্চিতের মধ্যে সে আর কাউকে জড়াতে চাইছে না। আসলে কিরণকে সে পুরোপুরিই ফিরিয়ে দিচ্ছে। একসঙ্গে বলছে না, ধাক্কাটা জোরে লাগবে বলে। আস্তে আস্তে ও আরো রূঢ় হবে। একসময় কিরণ ওকে যা খুশি তা বলবে। গালাগাল দেবে, ফেসবুকে ব্লক করবে। হোয়াটসএপে ব্লক করবে। এসবই চলতে থাকবে সামনে। তারপর একদিন ওর মা বাবা ওকে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে দেবে। বরুণ সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পারছে। 
খাওয়া শেষ। কিরণ বরুণকে কিছু না বলে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে গেলো।
কিরণের বয়স সাঁয়ত্রিশ। অনেক সাধ্যসাধনা করে এই গ্র্যাজুয়েট টিচারের চাকরি জুটেছিল।
পড়াশোনায় একেবারেই মধ্যমমান। মা বাবার তৃতীয় কন্যা। অন্য দুজনের ভালোই বিয়ে হয়েছে। তারা সুন্দরী ছিল অল্পবয়সী থাকতেই একজনকে শিলচরের এক উঠতি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আর সেই সূত্র ধরেই দ্বিতীয়জনকে গৌহাটিতে বিয়ে দিয়েছে বাবা। প্রচুর টাকা পয়সা খরচ হয়েছে। এখন আর তেমন একটা জমানো টাকা কিরণের মা বাবার হাতে নেই। সামান্যকিছু অসুখবিসুখের জন্য রাখা। একতলা টিনের চাল দেয়া বাড়ি। কিরণ চাকরি পাওয়ায় তারা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিরণ সুন্দরী নয় মোটেই। আলগা চটকও নেই। সবচাইতে অসুবিধার ব্যাপার হচ্ছে ওর মা বাবা, কিরণের জন্য বিয়ের কোন চেষ্টা করেন না । চাকরি পাওয়ার পর কিরণ নিজের মতোই সাধারণ কাউকে খুঁজে নিয়েছিল। ভেবেছিল যাক্, দুজনে মিলে সুখে দুঃখে থাকবে। জীবন থেকে কিরণের চাওয়া খুবই অল্প। কিন্তু এই ফিরিয়ে দেয়া তাকে একদম শেষ করে দিল। খুব কান্না পাচ্ছে তার, খুব খুব। বাড়ি গিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদবে সে। চাকরি হারানোর দুঃখে, বিয়ে না হওয়ার দুঃখে অথবা প্রেম হারানোর দুঃখে। সত্যিই প্রচুর কাঁদলো সে। মা বাবাকে কিছু বললো না। ওনারা হয়তো ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন না। দুজনেই দুর্বল হয়ে গেছেন। কিরণ তাদের লাঠি। বরুন কি বিয়ে হলে ওদের বাসায় থাকতে পারে না! ঘরের প্রবলেম দেখাচ্ছিল। একথা মনে হতেই কিরণ ফোন করলো বরুণকে। কিন্তু অনেকবার রিং হবার পরও বরুন ফোন তুলল না। এড়ানো শুরু হয়ে গেছে।
পরদিন স্কুলে গেলো কিরণ। স্কুলে কোন কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না। সবার মুখে মুখে ১০৩২৩, ওরা পাঁচজন একই স্কুলে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যাদের চাকরি হারিয়েছে। কিরণের তেমন কিছু বোধ হচ্ছে না এখন। মনে মনে সে স্বনির্ভরশীল সবসময়ই। আগেও ছাত্র পড়িয়েছে। দরকার হলে আবার পড়াবে। তার শরীর সুস্থ। সে যেকোন কাজ করে খেতে পারবে। ছোট ব্যবসা ইত্যাদি। কিন্তু সবার হা হুতাশ দেখে কিরণের বড্ড বিরক্ত লাগছে। বরুণও খুব চিৎকার করছে। ওর দিকে একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না। আশ্চর্য একদিনে, একরাতে মানুষ বদলে যায় কেমন। 
কমনরুম থেকে হঠাৎ কিরণ কে বাইরে ডেকে আনল সুক্তি। সুক্তি ওদের সঙ্গেই জয়েন করেছিল। কিরণ জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। কোন রাখঢাক না করে সুক্তি বলল জানো কিরণদি, কাল আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। ছেলে ক্লার্ক। আজ সকালে না করে দিল ছেলের বাড়ি থেকে। ওরা আমাকে নয় আমার চাকরিকে বিয়ে করতে চাইছিল। তাই না? 
সুক্তির দিকে তাকালো কিরণ। মোমবাতির মতো এক মেয়ে, জ্বলছে। 
 সুক্তি সুন্দর। ফর্সা, স্লিম, ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। এই সুন্দর মেয়েটিকেও না করে দিল ছেলের বাড়ি। আশ্চর্য!  কিরণ এতোদিন কারো সঙ্গেই তেমন মেশেনি। স্কুলে আসা আর তারপর বরুণের সঙ্গে একসঙ্গে ফেরা এই তো তার এ কদিনের জীবন। আজ সুক্তির ওর কাছে এসে
 এভাবে ভেঙে পড়ায় সে খুব আশ্চর্য হলো। সত্যিই তো। মেয়েরাও তো মেয়েদের বন্ধু হয়। কষ্ট পেয়ে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের কাছে এসেছে, যে নিজেও মনে মনে ভাঙছে। পৃথিবীর বুকে এসমস্ত ঘটনা ঘটে বলেই তো বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকতে হয়। কিরণ আর সুক্তি একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরল। একইসঙ্গে পরবর্তী দিনের মিছিল, মিটিং, রাজধানীতে ধর্ণা দেওয়া। ১০৩২৩ যেন বাইরের একটি জনগোষ্ঠী। যারা হঠাৎ করে বিভিন্ন স্কুলে অবৈধ ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। কি হবে তাদের। কোথায় আইকার্ড, বেঁচে থাকার হাসিখুশি সিলমোহর।
সময় গড়াচ্ছে। শুনানির পর শুনানি চলছে। এতদিনে কিরণ আর সুক্তির জীবনও থেমে নেই। 
সুক্তিকে পেয়ে কিরণ খুব খুশি। তার একজন বন্ধু হয়েছে। বরুণ কিরণের সঙ্গে কথাটথা বলে না। আড়ালে শুনেছে বরুণ তার বিজনেসটাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছে। হার্ডওয়ারের বিজনেস করবে নাকি। খুব দৌড়ঝাঁপ করছে। ওদের সংগঠনের মিটিংগুলোতে থাকে না একদম।
আগে দু একবার বরুণ ওকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। ওর মা বাবার সঙ্গে গল্পটল্প করেছে। সেদিন কিরণের মনে হলো, যাই না একবার, কেমন আছেন দেখে আসি।
বরুণ বাড়ি ছিল না। কিরণ তো গিয়ে অবাক। সুন্দর ঘর করেছে বরুণ। বোনের নাকি বিয়েও হয়ে গেছে। কই স্কুলের কেউ জানলো নাতো।
বরুণের মা বলছে সামনের অক্ষয় তৃতীয়ায় বরুনের নিজের দোকানঘরের উদ্বোধন  হবে।
কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কিরণকে কিছু বললেন না ওর মা বাবা। ওরা তো জানতেন সব। সন্দেহগ্রস্থ ও বিষণ্ণমনে বাড়িতে ফিরে এলো কিরণ। সব কথা সুক্তিকে না জানালে মন ভরে না। তাই ফোন করল সুক্তিকে। সুক্তি সবই জানত বরুন এবং কিরণের সম্পর্ক, সম্পর্কের ভেঙে যাওয়া, কিরণের ছটফট সেইসব দিন, যার দুঃখ, নিন্দে, ঝগড়া সবটাই সুক্তিকে উজাড় করে দিয়েছিল কিরণ। যেমনটা দিয়েছিল সুক্তি। তারা কেউ অসাধারণ নয়। তাদের কাহিনিগুলোও সাধারণ। তবুও চর্চিত হয় কমনরুমে, পাড়ায়, পরিচিত মহলে। বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙানোয় এইসব স্ফুলিঙ্গ দারুণ কাজ দেয়। কিরণ যদিও মাথা ঘামায় না। সুক্তি ভয় পায়। সে আকুল হয়। সিঁটিয়ে থাকে।

কিন্তু সুক্তি আজ প্রাণখুলে কথা বলছে না কিরণের সঙ্গে। ফোনের এপাশ থেকে শব্দের ওঠানামার স্বর, শ্বাস ছাড়া আর না ছাড়ার মুহূর্তভাঙা সময়ে কিরণ যেন টের পাচ্ছে কোথাও আটকেছে ধুলোর কণা।

এর মধ্যে কিরণের মেজদি এলো শিলচর থেকে। ওর বরের এক আত্মীয় করিমগঞ্জেই বিজনেস করে, বিয়ে করবে। মেয়ে খুঁজছে। কিরণের দিদি যূথীর ইচ্ছে একটু আলাপ এগোক। মা বাবাকে বললে, বাবা বললেন, চাকরিটি যে অবস্থায় আছে, ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়, আবার করিমগঞ্জ আর ত্রিপুরা মিলিয়ে কি করে থাকবে? তবুও  যূথী জোর করে কিরণকে নিয়ে গেলো করিমগঞ্জ, এখানে যূথীর মামাশ্বশুরের বাড়ি।  দেখাদেখি হবে একটা রেস্টুরেন্টে। ভদ্রলোক এলেন। তার আগে কিরণকে পার্লারে নিয়ে গার্নিশিং করিয়েছে যূথী। চুলের লগস কাটিয়েছে, ফেসিয়েল, থ্রেডিং। আর বকেছে কত মিষ্টি লাগছে দেখ তোকে। কেন এরকম থাকিস বলতো? হালকা সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, ছিমছাম লাগছে। অবশেষে মুখোমুখি। কফি আর দোসার অর্ডার দিয়ে  বসা হলো। ভদ্রলোকই প্রথম শুরু করলেন। শুনেছি চাকরি করেন। ত্রিপুরার ১০৩২৩, তা আপনাদের চাকরিটি শেষপর্যন্ত থাকবে তো?  এখন বেতন কত দিচ্ছে?  বি এড আছে, নাহলে করে ফেলুন?  চাকরি ছাড়বেন না। খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে আধঘন্টা কথা হলো। কিরণ দেখল লোকটা রুচিহীন ভাবে খায় ও পান করে। খাওয়ার সময় শব্দ করে, কফি কাপে জোরসে চুমুক দেয়। দোসার টুকরো বিশ্রীভাবে ছেঁড়ে, সাদা চাটনি, সবুজ চাটনি আর সাম্বারের সঙ্গে মাখিয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে খায়। 
এই মুহূর্তে ঝট করে কিরণের মনে হলো বরুণও অনেকটা এভাবে খায়, কিন্তু কখনো তো ওর চোখে লাগেনি। এই অন্ধত্বের নামই কিছুদিন আগে কিরণের কাছে ভালোবাসা ছিল। অথচ এখানে কিরণ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে এই বিয়েই ও করবে না, লোকটাকে পছন্দও করবে না, তাই প্রথম থেকেই সবকিছু খারাপ লাগছে এর।
এতক্ষণের মধ্যে লোকটা তার চোখের দিকে একবারও তাকায়নি। মুগ্ধতা তো দূর, সামান্য ভালো লাগাও যেন নেই।
মনে হয়েছে তিনি ১০৩২৩ মামলার এক স্বনিয়োজিত বাড়তি উকিল। টাকাপয়সা এবং বেতন নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া কিরণ নামক মেয়েটির আর কোন বিষয়ে তার কোন উৎসাহ নেই। এমনকি বিয়ে যদি হয়ও, কিরণ ত্রিপুরা থেকে গেলেও তার আপত্তি নেই।
আরো কিছুক্ষণ হয়তো লোকটা চালিয়ে যেতো, তবে কিরণ আর সুযোগ দিল না। চট করে উঠে, কাউন্টারে বিল পেমেন্ট করলো ও। তারপর সেই লোকটিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে এলো। যূথীকে ফোন করতেই চলে এলো, কাছে একটা দোকানে বসেছিল। কি হলো? যূথীর কৌতূহল। 
ল"মাথা হলো ", কিরণের উত্তর। খামোকা পার্লারে টাকা খসালি। চল তো। হবে না। এতো বিজনেসম্যান লোক আমার চলবে নারে। তবুও যূথী কিরণকে বাড়ি যেতে দিলো না। নিয়ে এলো শিলচর। আরো নাকি ছেলে আছে ওর জানাশোনা। তিনি বিপত্নীক । ভয়ে ভয়ে বলল যূথী। একটি বাচ্চা মেয়ে আছে, আর কেউ নেই। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। ব্যবসাই করে। তবে কিরণের ভালো লাগবে মনে হয়। দিদি আর জামাইবাবুর এতো উৎসাহ দেখে, কিরণ বললো, দেখা যাক তবে। মনে মনে ভাবল, আর একটা সার্কাসও দেখে যাই জীবনের।

যূথী সেই ভদ্রলোককে আর ওনার মেয়েটিকে নেমন্তন্ন করে আনালো ওদের বাড়িতে। তবে মেয়েটি তত বাচ্চা নয়। টকাস টকাস কথা বলে। কিরণকে দেখেই বলল, আমার মার অনেক গয়নাগাঁটি আছে, সব লকারে, এগুলো বিয়ের সময় আমি পরবো, ওসব হাতানোর চেষ্টা করবে না। ভদ্রলোক হেসে ব্যাপারটাকে লঘু করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিরণের ভেতর থেকে সব গুলিয়ে উঠল। ছিঃ, কিসের বিয়ে আর সংসার। যূথী আর জামাইবাবুকে ইশারা করে সে ঘরে চলে এলো, পরের দিন ভোরের ট্রেনে বাড়ি।

ফোনাফুনিতে মা বাবারা সব জেনেই গেছেন। আলাদা করে কিরণের আর কথা বলতে হলো না তাদের সঙ্গে, অবশ্য ওনাদেরও তেমন উৎসাহ ছিল না।
আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কিরণ ভাবছে সৌন্দর্য থাকলে কি হতো, আর না থাকায় কি হয়েছে, চাকরিটা থাকলে কি হতো, ঝুলে থেকেই বা কি হচ্ছে, কতগুলো ডিজিট ঘুরছে মাথার ভেতর শুধু, ১, ০, ৩,২,৩ আবার ৩,২,৩,০,১, ভীষণ হতাশ ডিজিট, বাজে ডিজিট সব। 

আদালতের রায়ে ১০৩২৩ এর চাকরিসীমা আরোও দুবছর বাড়ল। কিরণ আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। বেতন কম এখন অনেকটাই, তবুও এই করে করে যদি আরো কিছুদিন টিকে থাকা যায়। একদিন বরুণের সঙ্গে একা কথা হওয়া দরকার খুব।
মেসেজ পাঠালো বরুণের ফোনে। বরুণ সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল, অন্য কাউকে বিয়ে করো কিরণ, প্লিজ।
কত সহজে বলতে পারছে। আয়নার দিকে একবার তাকালো কিরণ, হয়তো বিয়ে করবে অন্য কাউকে, যদি পাওয়া যায়। মানুষ কি মনের মিল বুঝে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে আর?  এতই সহজ!  না যার সঙ্গে থাকে অনিচ্ছায় কিংবা  ইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে, কেবল দিন কাটায়, সন্তান নেয়, ভাত রান্না করে, ঘরের জন্য নতুন বেডকভার কিনে আনে  ঋতুতে ঋতুতে, পর্দার ধারাপাত বদলে দেয় নববর্ষে। এভাবে থাকতে থাকতে একদিন তারা নিজস্ব হয়ে যায় অথবা হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই থাকে। 

শেষপর্যন্ত সুক্তিই বলল কিরণকে। কিরণদি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বরুণের সঙ্গে। সুক্তির বাবাই এই বিয়ের প্রধান হোতা। তিনি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। বরুন লোনের জন্য এপ্লাই করেছিল। অনেক টাকার লোন। সুক্তির বাবা বরুণকে বলেন যে তিনি এই লোন তাকে পাইয়ে দিতে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করবেন, যদি বরুণ সুক্তিকে বিয়ে করে। বরুণ রাজি হয়ে যায়। তারপর ঘটনা এগিয়েছে অনেকটাই। সুক্তি প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারপর যখন জানতে পারে সে আপত্তি করেছিল, কিন্তু তাকে হার মানতে হয়। স্তব্ধ হয়ে যায় কিরণ।
হিসহিস করতে থাকে, হিংস্র হয়ে যায় কিরণের মুখ। সে বেশ বুঝতে পারে সুক্তির শরীরে লেগে থাকা ঐ রূপের কণাই সব। নাহলে এইসব সম্পদ, টাকা সেও বরুণকে কমবেশী দিতে পারত। বরুণ তো তাকে সুযোগই দিল না। সুক্তিকে কিছু বলতে গিয়েও, পারে না। শুধু থমথমে মুখে বলে, চলে যাও সুক্তি আর আমার কাছে এসো না।

১০৩২৩, চুক্তিবদ্ধ একটি সংখ্যা। তারা তিনজনও এরকমই একটি সংখ্যা। সংখ্যাটির অভিঘাত বদলে দিয়েছে অনেককিছু। সামান্য কয়েকটি নাম্বারের অতলে কত স্রোত বয়ে গিয়েছে, এইসব খবর কি আদালতের মহাবিচারকরা কোনদিন রাখেন?
এগুলো চোরাগোপ্তা হিসেবনিকেশ, মানুষের অন্দরমহলের বিষছোবল।

ক্লান্ত!  কিরণ আজ ভয়ঙ্কর ক্লান্ত। সে যেন দ্বিতীয়বার ভালোবাসা হারাল। মরে গেলে কেমন হয়। কেউ কি কাঁদবে তার জন্য? মা! বাবা! বোনেরা! আর বরুণ? বরুণকে কি শাস্তি দেবে সে! অনুশোচনার শাস্তির মতো ভয়ঙ্কর শাস্তি তো আর কিছু হয় না। মানুষ মরমে মরতে থাকে। অন্যকে বলতে পারে না। সারা জীবন বয়ে বেড়াতে থাকে।
মরবে না। এই শাস্তিই দেবে বরুণকে। সুক্তিকে মাপ করে দিলো কিরণ। ওর মধ্যে দিয়েই এখন সে প্রতিদিন নিজের সংসার দেখবে। দেখতে দেখতে পুড়বে।

 ধুমধাম করে বিয়ে হলো বরুণ আর সুক্তির। কোন অনুষ্ঠানে কিরণ যায় নি। এতোটা সহ্য ক্ষমতা তার নেই।
বিয়ের পর প্রথম যেদিন সুক্তি স্কুলে এলো  কপালে অস্তরাগ নিয়ে, কিরণের মনে হলো এতো অস্ত্রাগার।

 তবুও একমুখ হাসি নিয়ে কিরণ  সুক্তিকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলো কমনরুমে। জমে গেলো গল্প ... সংখ্যাদের বদলে যাওয়ার গল্প।

@ চিরশ্রী দেবনাথ 

বি : দ্র: ( চরিত্র গুলো কাল্পনিক)

0 মন্তব্য(গুলি):