বিশ্বাসের কাছে নতজানু বইটির আলোচনা, রঞ্জন রায়
ত্রিপুরার কবি --১
'' বিশ্বাসের কাছে নতজানু : যাপনকথার আলো-আঁধারি কোলাজ ''
কবি : চিরশ্রী দেবনাথ
প্রকাশক : সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
গুরুচণ্ডালী ট্রাস্ট ,কলকাতা ।
প্রকাশকাল : কলকাতা বইমেলা ,২০২০
প্রচ্ছদ শিল্পী : চিরঞ্জিৎ সামন্ত
প্রচ্ছদ সহায়তা : সায়ন কর ভৌমিক
বিনিময় : ২০ টাকা ।
............................................................................
জীবনের প্রতি ,মানুষের প্রতি প্রবল বিশ্বাস থেকেই একজন সত্ শিল্পী তাঁর অন্তরাত্মা দিয়ে জীবনের পড়ন্ত বেলায় অনুভব করেছেন 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ '।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত্তি থেকেই 'সাহিত্য' গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছিলেন ,
' ...বিশ্বাস কোনও রকম খন্ডতা সহ্য করতে পারে না ।সে আপনার সৃজনশক্তির দ্বারা সমস্ত বিচ্ছেদ বিরোধ পূর্ণ করে সমস্ত ছিদ্র আচ্ছাদন করে ঐক্য নির্মাণের জন্যে ব্যস্ত ।'
যে কোনো সংবেদনশীল কবিই জীবনের প্রতি তাঁর প্রবল আস্থা থেকে বারবার এই বিশ্বাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন ।সেই সমর্পণ থেকে উঠে আসে তাঁর যাবতীয় সৃষ্টিসমূহ ।দেশকাল কিম্বা ভাষার গণ্ডী ছাড়িয়ে কবি-শিল্পীদের মধ্যে এই বিশ্বাসের ভিত গড়ে উঠেছে কালে কালে ।ত্রিপুরার বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কবিদের মধ্যে চিরশ্রী দেবনাথ (১২ ফেব্রুয়ারি ,১৯৭৯ )এই বিশ্বাসের কাছেই নিজেকে অর্পণ করে লিখেছেন তাঁর সাম্প্রতিক কালের কাব্য ' বিশ্বাসের কাছে নতজানু '(২০২০)।
সাহিত্যে ক্ল্যাসিসিজম-রোমান্টিসিজম-রিয়ালিজ্ম ইত্যাদি বিভিন্ন 'ইজম'-এর কথা বলা হলেও ব্যক্তিমানুষের জীবন কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ইজমের ঝুলন্ত দড়ির ওপর দিয়ে বয়ে চলে না ।বরং সুবিস্তৃত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবন এগিয়ে চলে আপন খেয়ালে ।কবি সেই নিয়ত যাপনজাত অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে পরিস্ফুট করে তোলেন তাঁর শব্দের তুলিতে ।চিরশ্রীও সেভাবেই তাঁর খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতার কোলাজ হিসেবে কবিতা লেখেন ।এবিষয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমের একটি খণ্ড আলাপচারিতায় কবি তাঁর কবিতার উত্স সম্পর্কে স্পষ্টতই জানিয়েছেন ,
'...ব্যক্তিগত যাপন অভিজ্ঞতার কিছু নির্যাস তো থাকেই ,তবে কবির একটি নিজস্ব জগত থাকে ,এই জগতের আলো-আঁধারি অবচেতন মনের অস্থির পরিক্রমাই আমার সব কবিতার উত্স ।'
এই অনুভবেরই ফসল এই কাব্যের কবিতাগুলি ।
আজকের যন্ত্রণা জটিল সময়ে দাঁড়িয়ে ব্যক্তি মানুষ তার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ।ম্যাথু আর্নল্ড তাঁর 'Isolation ' কবিতায় যেমন বলেছিলেন ,প্রতিটি মানুষ একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এবং একের সঙ্গে অন্যের ব্যবধান লক্ষযোজন দূরের ।সেই একক ব্যক্তি মানুষ তার যন্ত্রনির্ভর জীবনে নিজের যাবতীয় তথ্যাদি 'পাসওয়ার্ড ' দিয়ে 'লক ' করে রাখেন ।এমনকী একান্ত আপনজনের সঙ্গেও বেশীরভাগ সময় এই 'গোপন পাসওয়ার্ড ' দূরত্বের দেওয়াল তৈরি করে রাখে ।তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পাখির গান ।এমন এক বিচ্ছিন্নবোধে পীড়িত মানুষ হয়েও চিরশ্রী সেই হারানো দিনগুলো খুঁজে পেতে চেয়েছেন কাব্যের প্রথম কবিতায় ,যেখানে তিনি বারবার সেই পাসওয়ার্ড ভুলে যাবার কথা অকপটে ব্যক্ত করেছেন ,
' বার বার পাসওয়ার্ড ভুলে যাই সবকিছুর
কত জায়গায় লিখে লিখে রাখি তাদের ,
তারপর লিখে রাখা জায়গাগুলোও হারিয়ে যায়
গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিজ্ঞেস করলে ,
দোয়েল পাখির নাম মনে করার চেষ্টা করি ।'
( প্রিয় দোয়েল পাখি )
পরক্ষণেই কবি দিনের শেষে কথা হওয়া পাখিটির 'বাসা নিলামে' উঠতে দেখেন ,যার পরিণতি ঘটেছে কবিতাটির শেষ পঙতিতে ,'কিচিরমিচির আর উড়ান নিয়ে চলে যেতে চাইছে আশ্বিনের গ্রহ '।
স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে কবি পৌঁছে যান সেই শৈশবের দিনগুলোতে ।'হলুদ রঙের ঝুমঝুমি ' কবিতায় নস্টালজিক কবি আজকের যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেন ,
'মনে হয় ,আমি সেই পৃথিবীতে শ্বাস নিচ্ছি ,যেখানে কোনদিন যুদ্ধ হয় নি
তারপর আমি আরো ছোট হবো ,আমার হাতে ঝুমঝুমি ধরিয়ে দেবে কেউ ,আমি রাজরাণীর গল্প শুনতে চাইবো
তখন সবাই বুঝে যাবে ,যাক্ একে নিয়ে আর ভয় নেই ।'অনেকদিন কিছু লিখতে না পেরে কবির 'মনে হয় হয়তো পাড়া থেকে হারিয়ে গেছে সমস্ত কিশোর' আর
তিনিও হারিয়ে ফেলেছেন 'রাধাভাব ' ।সেইসঙ্গে ভালোবাসার দিনে 'সীমান্ত থেকে শহীদ হওয়ার খবর আসে 'সেই অবসন্ন সময়ে কবির মনে হয়েছে ,
' বসন্তে জন্ম নেওয়া সেদিনের সমস্ত পাখির দল বোবা ও জন্মান্ধ
তাই খুব তাড়াতাড়ি গ্রীষ্মকালীন নিস্তব্ধতা সমাগত ,
এই পলাশ ,শিমুলের দিনে ,ক্ষীণ মাঘীপূর্ণিমায়
কয়েকটি বিষাদময় পর্বতশিখর ,বৃক্ষরাজি এখনও মাথা নত করে আছে '। তবে 'এতো মৃত্যু আর প্রতিবন্ধী সংবাদের পরও ' কবি অনায়াসেই জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ের মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন । প্রসঙ্গত তিনি বলেন ,
' আমি রাতের বেলা মাংস কষিয়েছিলাম
পেঁয়াজ ,কাঁচালঙ্কা ছেঁচা গন্ধ ,মাংসের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া সর্ষে তেলে গমগম করছিল ভেতর ।' বাইরের এই যুদ্ধের ভয়ংকরতা যে কবির অন্তরকে আকুল করে তোলে ,তখন তাঁর প্রয়াত মা বাবার কথা মনে পড়ে ,চোখের সামনে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তাঁর কিশোরীবেলা ।এবিষয়ে তিনি অকপটে লেখেন ,
'... হৃদয়েও জব্বর গোলাগুলি হয় ,আর ডি এক্স বিস্ফোরণ যখন তখন
এইসব শব্দ শুনতে পায় আমার প্রয়াত মা বাবা
মৃত্যুর পর তাঁরা নিষ্ঠুর হয়ে গেছে ,আদর করে না
অথচ আমি রোজদিন কিশোরী হয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে
মনে হয় ,আমার বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়াবে এখন নতুন কেউ
তার মুখে বিকেল ঘনিয়ে আসা জঙ্গলের নির্জন ছায়া ।'
এইভাবে কবি বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বর্তমানে ফিরে আসেন ।
রোমান্টিক কবিদের মানসসুন্দরী বা প্রেয়সীর সত্তা চিরকাল কেবলই রূপসী নারী ঘিরে ।বাংলা কবিতায় প্রথম সেই রূপসীসত্তা থেকে স'রে এসে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন ,' রূপসী বলে যায় না তারে ডাকা ,কুরূপা তবুও নয় সে জানি '।আর কুত্সিত আইবুড়ো মেয়েটির জীবনে প্রেমের নিঃশব্দ পদসঞ্চার শুনতে পেয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।তিনি লিখেছিলেন ,
' লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধ'রে
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল --
ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে পায়ে এসে উড়ে বসল
আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি !'
( ফুল ফুটুক না ফুটুক )
এই তথাকথিত 'কুত্সিত ' মেয়ের জীবনে প্রেমের বার্তা বয়ে এনেছেন কবি চিরশ্রী ।'কৃষিজমিন 'কবিতায় আমরা দেখি ,'যে তরুণীর গোড়ালি খুব লাল আর মসৃণ ,তার সঙ্গেই বিয়ে হবে রাজার '।এই সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল রাজপথে ও গ্রামে গ্রামে ।'পিতা নিজের রক্ত দিয়ে মুছে দিয়েছিলেন মেয়ের গোড়ালি '। রাজা এলে গোলাপী গোড়ালির মেয়েরা উঠে দাঁড়ালো ।কিন্তু রাজা ধুলোমাখা ঘাস লেগে থাকা এক কৃষক মেয়েকে ঘোড়ায় তুলে নিলেন ।রূপকথাধর্মী এই রূপক গল্পের শেষে কবি জানিয়ে দিলেন ,
'... আমাদের ছেলেরাও একদিন তুলে নিয়ে যাবে সব ফাটা গোড়ালি মেয়েদের ,
আচ্ছন্ন শীতে সেই মেয়েরা বিবাহ তুলে দেবে ছেলেদের হাতে ।'
কবির এই বিশ্বাসের সাথে সংবেদনশীল পাঠকের প্রত্যাশাও অনিবার্যভাবে একইবিন্দুতে মিলে যায় ।
চিরশ্রীর এই মহতী প্রেমচেতনার ভিন্নতর দিক ধরা পড়েছে 'যৌনতা নয় ' কবিতাতেও ।কবিতাটির শেষে কবি লেখেন ,
'...সব মিলিয়ে পৃথিবীতে এখন গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে
ছেলেরা বাড়ি ফিরতে ফিরতে কিশোরীদের ঢেকে দিচ্ছে উপচানো রোদে
এতো স্বাভাবিক সবকিছু ,যেন কোথাও কোন জন্ম নেই ,শুধু বেঁচে থাকছে পুরনো মানুষেরা ।'
কিম্বা 'বৈভব' কবিতায় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কবি বলেন ,
'...চুম্বন ?
ভালোবাসা ?
একসঙ্গে কিছুকাল কথা বিনিময় ?
আসলে কি সে সুখ ?
জানো না !
আমি জানতাম ।
আমি জানি মফস্বল শহরে কোথাও প্রবল স্নেহে শেষবিকেলে রান্না হয় ,
তখন একমুঠো সুখ রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাত্ সে বাড়িতে ঢুকে পড়ে ...।'
এইভাবে কবির বিশ্বাসে ভালোবাসার এক স্বতন্ত্র ক্ষেত্র রচিত হয়ে যায় ।
কৌতূহলী পাঠক চিরকাল কবির সৃষ্টির ভেতরে কবিকে খুঁজে ফেরে । কবিরা স্বীকার করুন আর না-ই করুন ,তাঁদের সৃষ্টির ভেতরে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কবি নিজেকেই কখনো প্রচ্ছন্ন বা প্রকটভাবে তুলে ধরেন ।চিরশ্রী তাঁর কবিতায় আপন কবিসত্তাকে এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন যা অনায়াসেই ব্যক্তিক থেকে নির্বিশেষ স্তরে উপনীত হয়েছে কাব্যের 'ব্ল্যাকবোর্ড ' , 'একান্তে ' , 'গজল ' , নীল স্পর্শক ' , তার কাছে যেতে চাই ' , ' বীতশোক ' বেহালা বাদক ' ইত্যাদি কবিতায় ।'ব্ল্যাকবোর্ড ' কবিতায় একজন শিক্ষক সত্তাকে পাঠক খুঁজে পায় যিনি ক্লাসে 'বিশ্বায়ন ' পড়াতে গিয়ে ছাত্রদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন ,
'জেনে কি লাভ অর্থনীতি ! আমরা তো ব্যবসা করবো ম্যাডাম ।
কিছু ট্যাক্স ফাঁকি ,কিছু জবানবন্দি মিথ্যা ,ওতে কিছু হয় না ।'
এমন সময়ই পাঠক কবিসত্তার পাশাপাশি একজন সমাজসচেতন মানুষকে আবিষ্কার করে ।
১. ' লেখা হচ্ছিল না ,তিনদিন ।
ভাবলাম তবে শেষ ,মনে হলো আমার পাশে ব্রহ্মপুত্র নদ ।সন্ন্যাসীর পোশাক ,নির্বিকার ।
দূর থেকে দেখেছিলাম নীলাচল ,ঠান্ডার ঝাপট ।'
২. ' আসলে কি আমি যেতে চাই ?
আমি কি কোন আড্ডার কথা তোমাকে ছাড়া ভাবতে পেরেছি ?
তুমি কি কখনো ছিলে আমার সেসব ব্যক্তিগত ,বোকা আড্ডায়
যেখানে মেধা পুড়ে নি ,ক্লাসিক্যালের সুর আসে নি ?'
৩. ' দৈনিক সংবাদ অযথা বকবক করে গেছে ,
রেগার টাকা ,শীতের কম্বল ,ধর্ষণ ,বি পি এল কার্ড ,পেঁয়াজের দাম ইত্যাদি ,ইত্যাদি ।
টিভিতে ধীরে ধীরে পনের হাজার কৃষকের মৃত্যু ,কী অসাধারণ বিশ্লেষণ ।'
এসবের পরেও 'সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে একা' হয়ে যাওয়া কবির মতো চিরশ্রী লেখেন ,
' আসলে কারো সঙ্গেই আমি কখনো ছিলাম না ।
একা একা অবাধ্য হয়ে চুপচাপ থাকি ,হিম জমা করাই আমার কাজ ,উষ্ণতার দিনগুলোতেও কখনো বা সবসময় ।'
'একান্তে ' কবিতায় ২০১৯ এর একজন কবির কথা বলেছেন ,যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই ,একাকী এক গাছের মতো 'হেমন্তের সমস্ত পাতা জড়ো করে রেখেছে বুকে ' ।সেই কবি সম্পর্কে চিরশ্রী বলেন ,
'..সে কিছু রাখে নি নিজের জন্য
বই ,মাইক ,মঞ্চ ,এমন কি হাহাকার
শুধু পাতা আকঁড়ে শীত সহ্য করে ,
নিঝুম রাতে জ্যোত্স্নার আরতি তাকে তান্ত্রিক করেছে ...।'
কবির এহেন ব্যক্তিসত্তার আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত এরকম :
১. 'কেউ অন্য কিছু লিখে দিতে বললে
আমি শুধু বলি ,প্লিজ কবিতা ছাড়া কিছু লিখছি না ..
ভালোবাসায় ছিলাম বলে কিছু লেখা হয় নি ,লেখা যায় নি
সময় লাগবে ,অনেক সময় ,এই বিজন স্রোত বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে একা ,কেন যে জানি না ....।'
( গজল )
২. ' আসলে শীতকাল আমার যাওয়া আসার ডাইরি
লিখতে লিখতে নিজে থেকেই মুছে যায় লাইনগুলো
যদি দেখে ফেলে জ্বলন্ত দেশ ,প্রতিবাদী জনতা ,
অথবা স্বার্থপর আমাকে ।'
( নীল স্পর্শক )
৩. 'ধুলো ঝাড়ার সময় কই ,ম্যাগাজিন থেকে পুরনো কবিদের কবিতা পড়ি
আশ্চর্য দেখি তারা চেনা যুবকের মতোই ,স্পর্ধা আছে ,কাম ,ক্রোধ সবই
গভীর হতাশার কথা রবিবার সকালে লিখতে লিখতে ,
তারাও লিখেছেন বীতশ্রদ্ধ পৃথিবীবাসের লঘু দুঃখ ,বিষাদ ইত্যাদি ইত্যাদি ।'
( বীতশোক )
এইসব আত্মকথন এক থেকে বহুতে ব্যাপ্ত হয়ে যায় ।আর এই ব্যাপ্তি দেশকালের গন্ডীও ছাড়িয়ে গেছে 'বেহালা বাদক ' কবিতার শেষে ,
' কবিতায় প্রতিবাদ হারিয়ে গেলে ,জেগে ওঠে শ্লোগান
শ্লোগান হারিয়ে গেলে ,আগুনের কাছে জখম নাও
তারপর বাকি থাকে চিত্কার ,রুচিহীন চিত্কার ...
তবে কি তাই হবে আগুনওয়ালা ,বাঁশিওয়ালা ?
.. ও বেহালাবাদক বলো না ?'
জন্মান্তরে বিশ্বাসী কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পরে আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের অখ্যাত নদী ধানসিড়িটির তীরে ।এই ধানসিড়ি নদীকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে কবি চিরশ্রী তুলে এনেছেন 'বড়দিন ' কবিতায় ।কবিতার সূচনাতেই কবি জানিয়ে দিয়েছেন ,এই ধানসিড়ি নদী জীবনানন্দের নয় ,এযেন এক 'নাগাকন্যা'।নাগাল্যান্ডের এই নদী পাহাড়ী বাঁক পেরিয়ে পেরিয়ে শেষে ব্রহ্মপুত্র নদীতে মিশেছে ।বড়দিনের উত্সবে নদীটিতে প্রাণসত্তা আরোপ করে কবি ধানসিড়িকে নতুনভাবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন পাঠকের সাথে ,
' পঁচিশে ডিসেম্বরের সপ্তাহে তিনটে স্টার সারারাত ধরে জ্বলতে থাকে
শুয়োরের মাংস ,কোয়াস সেদ্দ ,নাগা মরিচের ঝালে
বনের জিহ্বায় স্বাদ ফিরে আসুক ,বীজমন্ত ,উর্বরা বৃক্ষমেয়ে ...
প্রসব ক্ষমতা অনন্ত হোক তাদের ,
যীশুর কাছে বহতা নদীর আর কিছু চাওয়ার নেই ,শুধু এই ,এইমাত্র ...।'
চিরশ্রীর যাবতীয় ভাব-ভাবনা আর মনন এসে মিশেছে কাব্যের শীর্ষনাম কবিতায় ।বিশ্বাসের কাছে নতজানু কবি প্রত্যক্ষ করেন ,'এখন রাত নামে সাধারণ ভাবে ,যেমন করে 'ঈদের রাতে মুসলমানের বারান্দায় বেড়াতে আসে '।অর্থনীতি ,জাতীয় সংহতি ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ের আলোচনাতে কবি প্রায়ই চুপচাপ করজোড়ে বলতে থাকেন 'এসো এসো এসো '।সেইসঙ্গে যাবতীয় সংকটের মাঝে দাঁড়িয়েও মানুষের প্রতি প্রবল আস্থা থেকে তরুণ প্রজন্মের কবি চিরশ্রী বলেন ,
'...বিশ্বাস করি তখন কিছু আসে ,
সে হতে পারে মরুভূমি অরণ্য হয়ে যাওয়ার খবর অথবা
ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠা দুজন মানুষ ।'
এই আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যেই কবি চিরশ্রী নিজেকে বাংলা কবিতার এই সময়ের ধারার গড়পড়তা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন ।
কেবলমাত্র বিষয়গত অভিনবত্বের দিক থেকেই নয় ,চিরশ্রী তাঁর কবিতার শৈলী নির্মাণেও অনেকাংশে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করতে পেরেছেন ।তিনি মূলত গদ্যছন্দেই সাবলীল ।ভাবের সঙ্গে তাঁর কাব্যভাষা অত্যন্ত সাযুজ্যপূর্ণ ।মাটিঘেঁষা জীবন থেকে যেমন তিনি তাঁর ভাষা চয়ন করেছেন ।যেমন,প্রচলিত কথ্য শব্দ হিসেবে 'বোগাস' , 'জমিন ' , ' বোরিং ', 'ঝাপট' , ' চাঙ্গা ' , ' ডিপ্রেশন ' , ' জখম ' ইত্যাদি অনায়াসেই ব্যবহার করেছেন ।
কবিতায় অলংকার-চিত্রকল্প প্রয়োগেও তিনি তাঁর সাবলীলত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন ।দু'একটি প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় ,
১. 'শীতের রোদ সারসের মতো পা ফেলে ফেলে খুঁজে নিচ্ছে সন্ধিস্থল '-- উপমা ও সমাসোক্তি
২. 'বাইরে ছেয়ে আছে কাশ্মীরী শালের মতো ওম দেওয়া আড্ডা '-- উপমা ও সমাসোক্তি
৩.'উটের মতো বোরিং চাহনি ' -- উপমা
৪.'নিঝুম রাতে জ্যোত্স্নার আরতি তাকে তান্ত্রিক করেছে '-- সমাসোক্তি
৫.'চিলের মতো গর্বিত ডানা ' -- উপমা
৬.' ঈদের রাতে মুসলমানের বারান্দায় বেড়াতে আসে চাঁদ ' --সমাসোক্তি
৭.'মাথার চুলগুলো ধূপগাছের মতো জ্বলছে গ্রীষ্মের দুপুরে ' -- উপমা
৮.'ধানসিড়ি নদীটি ,সে জীবনানন্দের নয় ,নাগকন্যা '
-- অপহ্নুতি
৯. ' সম্মান কমে গেলে যেমন ডেকে ডেকে উত্তরীয় দেখাই ' -- বিরোধাভাস
১০.'বহতা নদী দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে বানানো গল্প '
-- সমাসোক্তি ইত্যাদি ।
চিরশ্রীর কবিতার বেশকিছু পঙতি প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছে ।যেমন কবি লিখেছেন ,
১.'ভালোবাসা সরে গেলে
মানুষ শিল্পী হতে পারে অনায়াসে ।'
২.'জেনে কি লাভ অর্থনীতি !আমরা তো ব্যবসা করবো '
৩. ' ভালোবাসায় ছিলাম বলে কিছু লেখা হয় নি ,লেখা যায় নি ' । ইত্যাদি ।
বইটির পরিচায়িকায় লেখা হয়েছে ,
'সময়টি মাংসকালের ।নির্মোহ মাংসাশী গ্রাম ও শহর ।অপরাহ্নের নিমন্ত্রণে ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে রাত ,দিন,ধর্ম ,ধ্বজা ,পতাকা ও যোনি ।অন্ধদের থালা বাটি গ্লাস ভরে উঠেছে নৈবেদ্যে ।যেদিন হেমন্তকাল প্রবাহিত হবে ,মাঠের পাশে বসে থাকব আমরা সার বেঁধে ....মাংসের কথা ,পেট ভরার কথা ,শরীর সুখের কথা বলতে এতো অক্ষর লাগাও কেনো হে ,কসাইয়ের কাছে রক্তজলের মতো ,কৃষকের কাছে কাদা তো মুঠ মুঠ পরমান্ন ,আমাদের এই বোকা এবং অশ্লীল চেয়ে থাকা পৃথিবীর আঁচে নিজস্ব দহন জ্বালাবার জন্য ....।'কাব্যের একেকটি কবিতা যেন এই ভাবনার খণ্ড খণ্ড প্রতিবিম্ব এবং সমগ্রটা মিলে চিরশ্রীর কবিতা তাঁর যাপন কথারই কোলাজ হয়ে উঠেছে ।
২৫/০৮ /2020
0 মন্তব্য(গুলি):