অন্য পৃথিবীর কবিতা

১:৪৯ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

অন্য পৃথিবীর কবিতা





"মানুষ তাড়াবে তুমি? তাড়াও তাড়াও!/

সে তো চির ছিন্নমূল/

হৃদয়ের খোঁজে খোঁজে চিরদিন বেপথু বেভুল! "/

এই কবিতা পংক্তি ছিন্নমূল মানুষের কথা ভেবে লেখা হয়েছে, আর আমি ভাবছি ছিন্নমূল বিষয়টির শুরু থাকলেও শেষ নেই, কতভাবে যে একজন মানুষ আস্তে আস্তে ছিন্নমূল হয়ে যান তার নির্দিষ্ট কোনো মাধ্যম নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, সাহিত্যপ্রাণ মানুষেরাও ছিন্নমূল , তাদের অস্তিত্বের সংকট তাদেরকে চিরদিন ছিন্নমূল থাকতে বাধ্য করেছে। 

ল্যান্ডফোন থেকে মোবাইল, মোবাইলের খোলনলচে ও অন্তরাত্মা পুরোপুরি বদলে চলে এলো স্মার্ট ফোন। আমাদের জীবনে ঢুকে গেল সোশ্যাল মিডিয়া, যার ভেতর তৈরি হওয়া এক নীরব হট্টগোলের মধ্যে আমাদের সাহিত্যচর্চা প্রবেশ করেছে অদম্য জেদ এবং সাহস নিয়ে। বেশ তো চলছিল, খুবই দ্রুত ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নতুন যুগের সাহিত্য পরিভাষা, আমরা যারা ফেসবুকের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, আমাদের সামনে এখন ইন্টারনেটের আরো এক দুনিয়ার হাতছানি, যা হয়তো বদলে দিতে পারে জীবনকে যাপন করে চলার ভাষ্য, মাটির পৃথিবীর বাড়ি আর ভার্চুয়াল পৃথিবীর অদৃশ্য ঘর এই দুটোর মধ্যে সমঝোতা করে আমরা খুব দ্রুতই হয়তো পৌঁছে যাচ্ছি মেটাভার্সে, যেখানে আমার অগম্য সব জায়গা ভ্রমণ করে আসবে আমার ডামি, অসাধ্য কাজগুলো করে দেবে আমার ভার্চুয়াল শরীর, শুধু একটি চশমা আর দ্রুততর ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে তৈরি হবে এক অদৃশ্য ফাঁদ, আগামীদিনের এই ভূমিতে দাঁড়িয়ে একজন তরুণ কি কবিতা লিখে চমকে দিতে পারবে কাউকে? কবিতায় যে বিস্ময় খুঁজত একসময় মানুষ, সেই বিস্ময় কি পৃথিবীর নরম ঘাসের শিশিরের ডগায় বেঁচে থাকবে?  হৃদয়মথিত পংক্তিমালার কাছে পৌঁছুবার জন্য কি মেটাভার্সের আবহে বাঁচতে শেখা নতুন প্রজন্ম অপেক্ষা করে থাকবে? এই উত্তরহীন রাক্ষুসে প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে

আছে অজস্র ভাষায় লিখিত পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য সম্ভার। আত্মমগ্ন পাঠক যদি নাই থাকে, তবে গুচ্ছ গুচ্ছ বই লিখিত হয়ে কী হবে, কারা পড়বে? হতাশার কথা ভাবলে সামনে দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। এমনও তো হতে পারে মানুষ নিজেদের তৈরি নিঃসঙ্গতার কাছ থেকে একদিন ফিরে আসতে চাইবে। খুঁজে নিতে চাইবে একসঙ্গে বসে গল্প করার স্পেস, তখন সেখান থেকে উঠে আবার জন্মলাভ করবে নতুন সাহিত্য। একটি ভার ও    ভরশূন্য জায়গা থেকে  ফিরে এসে ঘাম ও রক্তের সাহিত্যপাঠ। মানুষ আবার কবিতার মতো সংবেদনশীল হয়ে উঠবে, তার শিরায় শিরায় বইবে    

অবহনযোগ্য কাতরতা, যা সে লিখতে বাধ্য।



"কন্ঠে তোমার পরস্বর,/

যে গান ভেসে আসে/

সে তোমার ক্ষতবেদনা।/

আজ যন্ত্রের মন্ত্রে বিবাহ/

তোমাকে পাই না আর! "/

...কবি নকুল রায়

কবিতা কোনোদিন একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ বা ধারা মেনে চলে না, যদি তা কোনো পূর্ববর্তী কবির অনুসারী হয়, তবে সেই লেখা না লেখলেও চলে, তাই সবসময়ই অজস্র বিস্মৃতপ্রায় কবির মধ্যে জেগে থাকেন গুটিকয় নক্ষত্র, নক্ষত্রের আলো থাকে, সেই আলো পরবর্তী কবি গিলে নিতে পারেন, কিন্তু আলোর ছায়ায় থাকতে পারেন না। দশক দিয়ে আর যাই হোক কবিত্বের বিচ্ছুরণকে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় শূন্য দশক এবং পরবর্তী সময়ে কি কি লেখা হচ্ছে বা তার অভিমুখ কি, বিষয়বস্তুই বা কতটা বিস্মিত করতে পেরেছে পাঠককে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই লেখা হবে একদিন, তবে আমি শুধু স্পষ্টভাবে একটি কথাই বলতে পারি এইসময়েও কবিতার কোনো নির্দিষ্ট  অভিমুখ তৈরি হয়নি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই, যা লেখা হয়েছে তা সময়ের ধারক অবশ্যই হবে। এখন নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই তরুণ কবির কাছে, তার জীবনই শুরু হয় অদ্ভুত এক অস্থিরতার মধ্যে। আমাদের যাদের জন্ম বিংশশতকে, দুই প্রজন্ম আগেও একটু শান্ত  মফস্বলীয় পরিবেশ পেয়েছি বড়ো হয়ে    

ওঠার। মোবাইলের নীল স্ক্রিন আমাদের কাছে ছিল না। মনের ভেতরের আকাশটা ছিল অন্যরকম। কিন্তু এই আমরাই কেমন যেন বদলে গেছি এই সময়ে, মোবাইল গ্রাস  করে ফেলেছে আমাদের। গ্লোবালাইজেশন, ভার্চুয়েল দুনিয়া, রাজনৈতিক আদর্শহীনতা, পেনডেমিক, পৃথিবীর কোথাও না    কোথাও ঘটতে থাকা যুদ্ধ ও উদ্বাস্তু সমস্যা, এগুলোই আমাদের লেখার উপজীব্য এখনও। তাহলে অন্য পৃথিবীর কবিতা কি করে লিখব? সেই অভিজ্ঞতা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাকে অনুমান  করছি শুধু। প্রেমের ভাষায় কি বদল আসবে? শ্রাবণের ঘনঘোরঘটা, শরতের নীল আকাশ, হেমন্তের দীর্ঘ ধুসর মাঠ তো একইভাবে আমার কাছে আসবে  কিংবা বসন্তের পলাশপ্রান্তর। মেটাভার্সের স্বাদ পাওয়া তরুণতরুণীর  আবেগ কী ভাবে উঠে আসবে কবিতার শরীরে, ধমনীতে টগবগ করবে নতুন ভোরের সুবাস। নাহ্ এখনও যেমন সবাই স্যোসাল মিডিয়ায় নেই, তেমনি মেটাভার্সেও থাকবে না  অনেকেই। পৃথিবীর বুকে নিশ্চয়ই ভেসে থাকবে কিছু আদিম সরল বিস্ময়।



"তবু ঘ্রাণে বাঁচে দেহ, নামে জলে/

তবু নামে সব শ্রম শুধু গলে/

জেনো একা মানুষের আছে এক দেশ/

জেনো সব একা ভেতরে, বাইরে নেই রেশ "/

---অভিজিৎ চক্রবর্তী 

মানুষের যদি কিছু অতিক্রম করার থাকে তবে তা হলো তার একাতিত্ব, অসহ্য নির্জনতা, হয়তো এইসব নির্জনতাকে ভেঙে দিতেই কবিতা নতুন করে জন্ম নিতে বাধ্য হবে, জারি থাকবে ধারাবাহিকতা। 



"তোমাকে নিয়েই যত দুর্গমতা, অসতর্ক অ্যামবুশ পয়েন্ট/

পাতার আড়ালে ঢেকে রাখা এক ফুঁয়ে নিভে যাওয়া গ্রাম/

তোমাকে নিয়েই আর পাখিদের ফাঁদ/

অনতিদূরেই অপহরণের ছল! "/

--কবি বিশ্বজিৎ দেব।

কোন কবিতাকে পাঠক কী করে ভাববেন, তা লেখক জানেন না , কবিতা পড়তে গিয়ে কবি বিশ্বজিৎ দেবের এই কবিতাটি সামনে এলো হঠাৎই, 'ফোটামাটি 'লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে, হয়তো তিনি ভালোবাসার মানুষের কথা বলেছেন, আমার মনে হলো তিনি কবিতার কথা বলেছেন, যার কাছে অপহৃত হতে  কোন্ কবির না সাধ জাগে। 

মনে হচ্ছে আমি ক্রমশই কূলহারা হয়ে পড়ছি, কবিতার নির্দিষ্ট কোনো কাল তো মানছিই না, বরং খুবলে খুবলে তুলে আনছি বহতা সময়ের রক্ত মাংস।

"যারা ক্রমাগত হেঁটে যায়/

তাদের চোখে পড়ে, সবুজ মুষ্টিবদ্ধ ধানচারা/

কাদার উপর শুয়ে আছে।/

ধানচারা অপেক্ষায় থাকে/

নরম হাতের তালুয় মাটি ভেদ করে/

শেকড়সুদ্ধ চলে যাবে জলের উৎসে। "/

-- খোকন সাহা

উৎস থেকে থেকে আবার উৎসে যেতে হয়। আসলে প্রত্যেকটি লেখাই একটি উৎস। আত্মার খোঁজ আমরা করি কি? করে কী লাভ, তাকে তো উপলদ্ধি করা ছাড়া আমাদের কাছে আর  অন্য কোনো বিনিময় তাস নেই, কবিতাও তেমনি, আত্মার খুব কাছে থাকে একটি বিমূর্ত প্রতিক্রিয়া, যা মূলত অশান্তিদায়িনীর ভূমিকায় সবসময় একজন প্রকৃত কবিকে তাতিয়ে রাখে। বিংশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে একবিংশ শতকের এইসময় পর্যন্ত ত্রিপুরার বাংলা কবিতা নিজের মতো গড়ে উঠেছে, অনুসারী হয়েছে, আবার  নিজেকে ভেঙেছে, তৈরি করেছে নিজস্ব পদছাপ, তাতে ত্রিপুরার রঙ ও আত্মা যেমন আছে তেমনি আছে বিশ্বকে ছুঁয়ে থাকা সার্বজনীন রূপ। 





"যে সন্তান কোনদিন তোমার ছিল না তবু শব্দহীন বাসা বেঁধেছিল, কোনদিন লাথিও ছোঁড়েনি, সেই রেখে গেছে/ শুষ্ক জলদাগ, আটসপ্তাহের স্মৃতি, অবিশ্বাস,/ ভয়, আনন্দের পূর্বাভাস। যার জন্মদিন কখনো/ আসেনি, তার আয়ুর হিসেব করো? যার আয়ু বাস্তবিক/ ল্যাবের পরীক্ষা থেকে, অপক্ক বাবার/ আনন্দে লাফানো, তোমাকে চুম্বন, আলিঙ্গন থেকে/ শুরু হয়ে গাইনোর মনিটরে শেষ হয়েছিল - তাকে কত/ আয়ু দেবে? ঘুমুতে যাবার আগে আর কতদিন/ কথা কবে শ্রুতিহীন তার সাথে? শোক, আর কত দীর্ঘ/ হবে, ভালোবাসা, কত নিদ্রাহীন? সে তো যাওয়ার/ আগে জেনে গিয়েছিল - কাকে বলে শোক, কাকে বলে ভালোবাসা। "/

---কবি অমিতাভ কর।

আমাদের প্রত্যেক মানুষের ভেতর এইসব অজাত লেখা আছে তার নগ্ন শরীর নিয়ে, জোর করে টেনে আনতে গেলে ছিঁড়ে যায় আবেগ, সেই সত্য তখন লিখে ফেলতে পারে মানুষ হয়তো সেটাই তার প্রকৃত কবিতা।

অবাক হবার জন্য অপেক্ষা করি কবিতার কাছে। সব বিস্ময়কে গিলে ফেলার পরও মানুষকে  বিস্মিত করে দিতে পারে নতুন কোনো চিত্রকর, কোনো সুর, কোনো    কবি, তাই হয়তো অন্য পৃথিবীর কবিতার জন্য আমরা শান্ত হয়ে বসে আছি ...

"ছলছল রাতটি/

কালোর ভেতরে খোঁজে আলো/

নদীটি অবাক,/

উদ্ধত স্তন/

নীরবে বেঁকেছে কুঁজের মতন ..."/

---আম্রপালী দে

দুর্দান্ত সব যান্ত্রিকতার সঙ্গে সহাবস্থান করেই  নতুন সময়ের কবি খুঁজে নেবেন চাঁদের কিরণধোয়া

বৈশাখের ক্লান্ত গ্রাম।  



ঠিকানা

চিরশ্রী দেবনাথ

প্রযত্নে : অরূপ দেবনাথ

'কাজরী ' নেতাজী রোড

জেলা :    উত্তরত্রিপুরা

পোস্ট অফিস : ধর্মনগর

পিন  :    799250

মুঠোফোন    : 9402143011

0 মন্তব্য(গুলি):