সৃজনের মাধ্যমে আলোকিত হোক বিষাদ

১:০৬ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

( প্রকাশিত ...জঠর)

"সৃজনের মাধ্যমে আলোকিত হোক বিষাদ "
……………
চিরশ্রী দেবনাথ

জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দিত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যুর আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?

“কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম অসল্ মে দনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”

কথাটি বলেছিলেন, পৃথিবীর একজন আধুনিকতম  মানুষ, তাঁর নাম মির্জা গালিব। একজন কাব্য আলোচকের মতে ভারতবর্ষে নাকি দুটোমাত্র প্রেরিত বই রয়েছে,একটি হলো    বেদ এবং অপরটি হলো মির্জা গালিবের কাব্য সংকলন। মোগল সাম্রাজ্য অস্ত যাচ্ছে, ম্যালেরিয়া মহামারী আক্রান্ত দিল্লী, ব্রিটিশদের কঠিন হাতে সিপাহী বিদ্রোহ দমিত হচ্ছে, চারদিকে রক্ত, খুন, হাহাকার, মৃত্যু, সাহিত্য সংস্কৃতির এমন অন্ধকার সময় যেন আর কখনো আসেনি,  রঙিন গুলদস্তার মতো ঐতিহাসিক দিল্লি নগরী শ্মশানে পরিনত হচ্ছে, আর দারিদ্র ও ক্ষুধার মাঝে বসে মির্জাগালিব লিখছেন, আত্মজীবনী, আমরা জানতে পারছি আজ ইতিহাসের সেই ব্যথাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা আশংকা করছিলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের, কোন্ কোন্ দেশের মধ্যে লাগতে পারে, ইত্যাদি। 
সেই বিশ্বযুদ্ধ কিন্তু প্রায় শুরু হয়ে গেছে, চলছে,
একটি দেশ আর একটি দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কোথাও সমুদ্রের বেলাভূমিতে পরে থাকছে বস্তাবন্দী শিশুদের মৃতদেহ । 
 পৃথিবীর সমস্ত দেশ এক দিকে, অন্যদিকে ছোট্ট একটি ভাইরাস। তার বিরুদ্ধেও লড়াই চলছে এখনও, শারীরিক ক্ষতি ও মানসিক ট্রমা কোনটাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্মহীনতার হতাশ প্রান্তর। 
তাই বলে কী সৃজন থেমে থেকেছে?
যত বেশি বেশি অন্ধকারের মধ্যে আমরা ঢুকেছি, তত  অবাধ্য হয়ে কলম ধরেছি। 
যদিও, ' Hunger have no choice ' তবুও ইতিহাস কিন্তু আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়। 
আর যেহেতু আমি কবিতা  লিখি তাই কবিদের ওপর বর্ষিত যাবতীয় অভিশাপও কিন্তু আমার বেশ গায়ে লাগে, বিশ্ববিখ্যাত Poetry পত্রিকার প্রতিষ্ঠাত্রী-সম্পাদিকা হ্যারিয়েট মনরো, যিনি নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত কবি, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা একটি সম্পাদকীয়তে যুদ্ধকে romanticize করবার জন্য কবিদের দায়ী করেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। এই ভ্রম সংশোধন করার দায়িত্ব তিনি ন্যস্ত করেছেন কবিদের কাঁধেই:
তেমনি সদ্য বিগত মহামারীও কিন্তু কবিদের  নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছে, আসলে সবাই বাঁচতে চেয়েছে। তাই এতো এতো গল্প, কবিতা রচিত হয়ে গেলো।
আমাদের আরো একটি দীর্ঘ যুদ্ধ করতে হচ্ছে, যারা লিখছি তাদের জন্য, সেই যুদ্ধটা হলো ডিপ্রেশনের বিরুদ্ধে। সৃজনশীল মানুষদের কাছে    এই অন্ধকার থেকে কখনো আলো আসে, কখনো তা পাথরের মতো নিরেট। আমরা এই রাজ্যে যারা  লেখালেখি করছি, তারা আসলে 
কেনো লিখছি। বিশেষত বৃহত্তর বাঙালি পাঠক সমাজ আমাদের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত নয়। আমাদের কারোরই এখন পর্যন্ত নোবেল প্রাইজ ইত্যাদি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। কেউ কেউ বলবেন উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমরা লিখছি, কেউ বলবেন নিজেদের আনন্দ দেওয়ার জন্য, মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য লিখছি, কিন্তু এই তাগিদটুকু কতোদিন থাকবে, একসময় সামনে শুকনো খাদ ছাড়া তো আর কিছুই থাকবে না, তবুও যেহেতু লিখতে শুরু করেছি, তাই থামতে পারছি না  এবং যে জিনিসটা ভীষণভাবে অনুভব করছি তা হলো সমালোচকদের অভাব। খারাপ লেখার থেকে ভালো লেখাকে তুলে আনতে এবং একটি অকাব্যিক শব্দ ব্যবহার করছি  ' বাজার ' সেই বাজার তৈরি করতে হলে, লেখক মাত্রই দ্বারস্থ হতে হবে নিরপেক্ষ সমালোচকের। আজ  ত্রিপুরার সাহিত্যিকরা যা কিছু লিখছেন, তার বেশিরভাগই আড়ালে রয়ে গেছে, আলোচনা করার মতো রসদ আছে, এমন কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস বাছাই করে সেগুলোর ধারাবাহিক পদ্ধতিতে আলোচনা  হওয়াটা খুব  দরকার। 
পাঠকের মনন এবং বোধের জমি তৈরি করেন সমালোচক। পাঠকের মেধাকে শান দেওয়ার দায়িত্ব সমালোচকের। আর একবার যদি বোদ্ধা, মননশীল পাঠক তৈরি হয়, তবে তা নিশ্চিত ভাবে কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অউপন্যাস, অকবিতা, দুর্বল গল্প প্রকাশিত হয়ে 
সাহিত্যের অবনমন ঘটানোর থেকে রাজ্যের মৌলিক সাহিত্যের সমৃদ্ধির  জন্য আলোচনা হোক। 
তাহলেই শুধু বইের সংখ্যা এবং গুণগতমানের মাঝখানে যে একটি গভীর কুয়ো রয়েছে সেটা খুঁজে পাওয়া যাবে, আর আমার মতো কুয়োর ব্যাঙ কতটুকু সাগরের ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পেয়েছি তা বোঝা যাবে। 
বর্তমান সময়ে সৃজনের সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ,
জাপানের মর্যাদাপূর্ণ একটি সাহিত্য পুরস্কার হলো আকুতাগাওয়া সাহিত্য পুরস্কার। জাপানি ঔপন্যাসিক রিয়ুনোসুকে আকুতাগাওয়ার স্মরণে ১৯৩৫ সাল থেকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়ে আসছে।
এ বছর জাপানি সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার আকুতাগাওয়া পুরস্কার জেতা জাপানি লেখক রি কুদান, লেখকদের তাদের লেখায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছেন।
'দ্য টোকিও টাওয়ার অফ সিম্পেথি' (জাপানি ভাষায় 'টোকিও টু দোজো তো') উপন্যাসের জন্য পুরস্কার জেতার পর লেখক একটি প্রেস কনফারেন্সে  নিশ্চিত করেছিলেন যে, তার এই বইটির প্রায় ৫ ভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় লেখা হয়েছে।
 'দ্য টোকিও টাওয়ার অফ সিম্পেথি' উপন্যাসটির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন বিচারকরা। বিচারক কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, এই বইতে কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। 
লেখক কুদান ব্যাখ্যা করেছেন যে তিনি AI
 ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষার সারমর্ম বা প্রকৃতি অন্বেষণ করতে চেয়েছিলেন।
পাঠকদেরর মনে হয়েছে, বইয়ের প্রকৃত গল্পের চেয়ে লেখার ধরন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের মতে বইটি জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য অধ্যয়নের জন্য উপযুক্ত, যেখানে ভাষাগত দক্ষতার ওপর প্রায়শই জোর দেওয়া হয় ।
লেখাকে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর করতে লেখক সাহায্য নিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার । নিজস্বতাকে ছাপিয়ে এখানে যে সূক্ষ্মতার প্রকাশ দেখানো হয়েছে তা লেখকের নিজস্ব আভিজাত্যকে ক্ষুন্ন করে বৈকি । 
এটা অনেকটা কনটেন্ট রাইটিংএর মতো হয়ে যাচ্ছে বা অফিসিয়েল চিঠি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগেও তো আমরা লেখালেখিতে রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতাম। ভালো লিখতে হলে ভালো পড়ুয়া হওয়া চাই। ফারাকটা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখানে টিচারের কাজ করছে, কারেকশন করছে, কোথাও লেখাটা আর নিজের থাকছে না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে লেখালেখির ভাষ্য এভাবেই বদলে যাবে অতি দ্রুত হয়তো কোথাও মূল্যহীন । এখানে শূন্যতা ও বিষাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এইসময়ের লেখক ও পাঠক সমাজ। 
একজন কবিকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, কবিতার কাছেই আবার আসবো। কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করছি কবিতার আশ্চর্য শক্তি। গল্প বা উপন্যাসের পাঠক হয়তো বেশি, কিন্তু সবচেয়ে দ্রুত যা বিকীর্ণ হয় এবং সারা বিশ্বে যার বিকেন্দ্রীকরণ হয় সবচেয়ে বেশি, তা একমাত্র কবিতাই। কেন জানি মনে হয় সাহিত্যের
বিশুদ্ধতম মৌলিক রূপ হলো কবিতা। 
 পোয়েট্রি’-তে শেলি বলেছিলেন: “poets are the unacknowledged legislators of the world .
ইংরেজি কবিতার অন্যতম স্তম্ভ এলিয়ট ১৯৪৩ সালে একটি বক্তৃতায় বলছেন: “একজন কবির দায়িত্ব আগে ভাষার প্রতি, তারপর মানুষের প্রতি। ভাষার সংরক্ষণ, পরিবর্ধন ও সর্বোপরি ভাষার উন্নতিসাধনই তার প্রাথমিক কর্তব্য।” আর সমালোচকের মতে কবি হিসাবে ইলিয়ট সর্বদাই “relatively indifferent, or uninterested, observer of the phenomenal world”
কবিদের চিন্তা ভাবনায় একটি লিমিটেশন আছে, ভাবজগতের বাইরে, তিনি বাকি যা কিছু বলবেন সব নাকি মূল্যহীন, কবিতাটিই তার ভাষ্য। কবিতাটি শক্তিশালী না হলে কবি হারিয়ে গেলেন। কিন্তু কবিকে তাহলে  কেন  ভয় পায় মানুষ? কেন জেল বন্দি করে রাখে? কেন কবিকে হত্যা করে তার মৃতদেহ গুম করে দেয় শাসক? অথচ কবিতা কোনো কাজের নয়, অন্নের সংস্থান কোনোদিনই কবিতা দেয় না? তবুও  পেনডেমিক,  রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিপন্নতার সময়ও প্রচুর কবিতা লেখা হলো, বেরুলো অনেক কবিতার  বই। 
কবিতা আসলে যেকোন জায়গা থেকে শুরু হতে পারে, যে কোন জায়গায় শেষ হয়ে যেতে পারে, ছোট্ট একটি দৃশ্যকল্পের এরকম অসীম ভাব বিস্তারের ক্ষমতা আর কোথাও নেই কবিতা ছাড়া । 
রবীন্দ্রনাথ নিজেও একসময় জানিয়েছিলেন তাঁর বলিষ্ঠতা এবং দুর্বলতার জায়গা একটাই; inconsistancy।’ একটি ভঙ্গুর সত্তা আমাদের গ্রাস করতে করতে লিখিয়ে নেয়। 
একটাই দ্বন্দ্ব চিরকালীন, টু বি ওর নট টু বি। রাজনীতিক এবং কবি, দুজনেরই মানুষের সঙ্গে দ্রুত কানেক্ট হবার ক্ষমতা প্রচুর, কবি যদি নির্জনতার পূজারীও হোন, তার কবিতা কিন্তু পৃথিবীর ধুলো মাখা পথিক, দৃশ্যকল্পতার এই মায়াবর্তে দাঁড়িয়ে তাই আমার কাছে মনে হয়, দু মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা থাকলে একটি কবিতা লেখাই যেতে পারে, যা বিনামূল্যে নীল জ্যোৎস্নার আনন্দ দিতে পারে।

0 মন্তব্য(গুলি):