ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ..আবহ ও প্রবহমানতা
চিরশ্রী দেবনাথ
ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ...আবহ এবং প্রবহমানতা
......................................................
কবিতা, কোন একটি ভূখন্ডের সাহিত্য নির্যাস , সেই ভূখন্ডের আত্ম অভিমান। আলো ও আঁধারের ঐকতান নিয়ে কবিরা লিখে ফেলেন জনপদের সংগ্রাম ও ভালোবাসার কথা। কবিদের পৃথিবী একটাই। তবুও পাঠক সব কবিদের কাছ থেকে সতন্ত্রতা আশা করে। মনে করে কবিদের বক্তব্যে মিশে থাকবে বিশেষ কোনো অঞ্চলের আবেগ মুক্তির অপরূপ ব্যথা আর আনন্দের যুগ্ম প্রতিলিপি।
ভারতবর্ষের এক কোণে পড়ে থাকা এই প্রাচীন ভূখন্ডের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, অজস্র সাহিত্যপদাতিকের কলমে লেখা হয়েছে বিচিত্র কথকতা। কাব্য থেকে কবিতা হতে সময় লেগেছে বহুদিন, আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে কেটে গেছে অনেক বছর। কবিতার কোন শেষ কথা হয় না, তেমনি কোন কবিতাই পুরনো হয় না। কালজয়ী কবিতার ভাষ্য চিরদিনই নতুন এবং স্রোতের
মুখে দাঁড়িয়ে থাকে পর্বত চুড়োর মতো। তাকে পাশে রেখেই নতুন সময়ের কবিতা ভাসিয়ে দেয় তার
সিডার কাঠের আড়ম্বরহীন মজবুত নৌকো, যা ঝড়কে বলে সঙ্গে আয়, প্রেম ও যৌনতাকে দেখে পাখির তীক্ষ্ণ চোখে, খুঁটে খায় জঞ্জাল, ডানায় সোনালী রোদ পড়লে উড়ে যায় দিকচক্রবালের দিকে, যেখানে সূর্যদেব নিরন্তর গভীর ধ্যানরত।
প্রথমে চলে যেতে হয় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে। রাজন্য ত্রিপুরার এই অভিজাত জীবন স্রোত থেকেই শুরু হয়েছে ত্রিপুরার বাংলা কাব্যের পথচলা। রাজ আমলের আখ্যান কাব্যগুলো এক একটি ঐতিহাসিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে সময়কার ত্রিপুরার জীবন, যুদ্ধ, সংগ্রাম, ধর্মীয় আচার আচরণ, রাজ্যশাসন, রাজভক্তি ইত্যাদি নিয়ে চিরাচরিত কাব্যছন্দে, সম্পূর্ণ ভাবে স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত হয়েছে। ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটতে আরম্ভ করে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য এবং রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের পর থেকেই। বীরচন্দ্রের নিজস্ব সাহিত্যকৃতির মাধ্যমেই সূচিত হয়েছে সহজাত
কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রথম গীতিকবিতার বিস্তার। তিনি নিজের মনের চিন্তনকে কাব্যরূপ দিলেন।
বীরচন্দ্রমাণিক্য ছয়টি কাব্য রচনা করেন, হোরি ,ঝুলন ,প্রেমমরীচিকা ,অকাল কুসুম ,সোহাগ ,উচ্ছাস ।এসব কাব্যগুলো মূলত গানের সংগ্রহ। বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর বাংলার শেষ বৈষ্ণব পদকর্তা নামে অভিহিত হয়েছেন। ত্রিপুরায় আখ্যান ও পাঁচালি রীতির কাব্যের ধারা ভেঙে দিলেন কবি বীরচন্দ্র।
মন্দ পওন চুম্বত ফুল
গন্ধ চহুদিশি ডারিয়া,
গুন গুন করু মত্ত মধুপ
পিউ পিউ বোলে পাপিয়া,
আমার গৌরকিশোর করু নবভাবে
কতহুঁ নবীন ভঙ্গিয়া,
ঝুলতহি পহুঁ কতহুঁ ভাতি
সঙ্গে কতহুঁ সঙ্গিয়া
বীরচন্দ্র মূলত ব্রজবুলি মৈথিলি, ও বাংলাতেই তার পদগুলো রচনা করেছিলেন।
বীরচন্দ্র কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী। জন্ম আঠারশো চৌশট্টিতে। তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, প্রথম কাব্য 'কণিকা ', দ্বিতীয় কাব্য 'শোকগাথা ' তৃতীয় কাব্য 'প্রীতি '।প্রকৃতির সঙ্গে আপন অনুভবের সংমিশ্রণের কাব্যময় প্রকাশ ঘটে তার লেখায়। মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এই নারী ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাহিত্যচর্চা, শিল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে মানসিকতা সমৃদ্ধ করেছেন , কবিতায় নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিক জগতকে খুঁজেছেন, সুললিত ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। আধুনিক আলোচকদের বেশীরভাগেরই অভিমত, রাজগী ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী। সমসাময়িক কবি, সভাকবি মদনমোহনমিত্রের কন্যা কুমুদিনী বসু, ছিয়াশিটি কবিতা নিয়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ আভা ঢাকা গেজেট ও সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিল। রাধাকিশোর তনয় নরেন্দ্রকিশোর দেববর্মণের ভাবসমৃদ্ধ কবিতা এবং সঙ্গীতও সুখপাঠ্য। অনঙ্গমোহিনীর কবিতায় কবিতা আস্তে আস্তে বাস্তবের জগতে পা বাড়িয়েছিল, চলে আসে চল্লিশের দশক, রাজ পরিবার থেকে সতন্ত্র কবিতাধারার সূত্রপাত। স্বাধীনতা পূর্বোত্তর ভারত, অস্থির সময় ইত্যাদি মিলেমিশে অনঙ্গমোহিনীর পরবর্তী কালে অনেকদিন ত্রিপুরার কাব্যজগতে তেমন কেউ আসেনি।
বা যারা লিখেছেন বেশীরভাগই গীতিকবিতার অনুসারী, ব্যক্তিগত বিলাপ কিংবা অলস মেদুর জীবনের হাতছানি। কিন্তু সেইসময় বাংলা কবিতার রূপ বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। অথচ ত্রিপুরা আধুনিক কবিতার সুর থেকে তখন পর্যন্ত ছিল বিচ্ছিন্ন, তাই আধুনিক কবিতাচর্চার ইতিহাস ত্রিপুরায় খুব বেশী প্রাচীন নয়। বৃহত্তর বঙ্গসমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এইসময়ের ত্রিপুরার সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বাঙালিদের ঢল। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপও ততটা প্রভাব ফেলেনি এ রাজ্যের অরণ্যলালিত নিস্তরঙ্গ অলস জীবনপ্রবাহকে। তবুও এই সময়ের কিছু দুর্বল কারিগর যা আধুনিক কবিতার বীজ ধারণ করতে শুরু করেছিলেন তারা হলেন অজিতবন্ধু দেববর্মণ, নুরুল হুদা, সমাচার চক্রবর্তী, বিধূভূষণ ভট্টাচার্য, মণিময় দেববর্মণ, অশ্বিনী আঢ্য, আব্দুল মতিন প্রমুখ। ষাটের দশক, রবীন্দ্রভাব, বৈষ্ণবকাব্যের ললিতময় বিভঙ্গ পেরিয়ে যে যুগসন্ধির কবিরা পদার্পন করলেন তাদের প্রচেষ্টার সফল রূপায়ন দেখা যায়, প্রান্তিক ( ১৯৬২) ত্রিপুরার প্রথম কবিতা সংকলনে । রণেন্দ্রনাথ দেব, বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী, সলিল কৃষ্ণ দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, প্রদীপ চৌধুরী, কিরণশঙ্কর রায়, অশোক দাশগুপ্ত, প্রবীর দাস প্রমুখ। ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় সলিকৃষ্ণ দেববর্মণ, জোড়ালো সতন্ত্র স্বর। কবিতা তার কাছে সচেতন নির্মান নয়, তিনি কবিতাকে বলেছেন, উদ্বুদ্ধ অবস্থার শব্দভাষ্য। ১৯৭৩ সালে, কবি স্বপন সেনগুপ্তের সম্পাদনায় বের হয়, গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্য সংকলন, দ্বাদশ অশ্বারোহী ।
ষাটের দশক এবং সত্তরের দশক থেকেই ত্রিপুরার বাংলা কবিতার নিজস্ব রূপটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এই সময়ে যারা বিশিষ্ট ভাবে নিজেদের চেনালেন, খুব অল্প কয়েকজনের নাম বলছি, কল্যানব্রত চক্রবর্তী, পীযূষ রাউত, শঙ্খপল্লব আদিত্য, স্বপন সেনগুপ্ত, নকুল রায়, দিব্যেন্দু নাগ,অসীম দত্ত রায়, সমরজিৎ সিংহ, প্রমুখরা। মহিলাদের মধ্যে অপরাজিতা রায়, করবী দেববর্মণ, সুনীতি দেবনাথ, শক্তি দত্ত রায়। কারো কারো কবিতা এইসময়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কখনো কখনো সে ব্যঞ্জনাহীন রাজনৈতিক বিবৃতি কিংবা প্রচার, আবার ঘৃণা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, প্রতিরোধ, স্থানিকতা সমস্ত আবেগই তুমুল ভাবে চলে এলো ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় ।
এই সময়কালে ত্রিপুরার বাংলা কবিতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নকশাল ও হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে কবিতায়, অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন এই আন্দোলনকে তাঁদের লেখালেখির মাধ্যমে। তবে তাৎক্ষণিক উন্মাদনা কবিতার গায়ে সময়ের ছাপ রাখলেও, অনেক কবিসত্ত্বাকে বিভ্রান্ত এবং বিপর্যস্ত করেছে, তাঁদের নিজস্ব কবিতার ভাষা পরিবর্তিত হয়ে অন্যের কাছ থেকে ধার করা আঙ্গিক নিয়ে দুর্বলতর এবং কৃত্রিম হতে হতে হারিয়ে ফেলেছে সজীব কবিতার ভাষ্য।
গ্রুপ সেঞ্চুরী কাব্য আন্দোলন, ত্রিপুরার কবিতাকে বিভিন্ন রূপ ও সত্তা দেয়।
গ্রুপ সেঞ্চুরি আন্দোলন ছিল একটি সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। কবিতাকে আত্মায় স্থাপন করে করে চিত্রকলা, সংগীত, ভাস্কর্য, নাটক সব কিছুর মাধ্যমে প্রতিটি শিল্পী যাতে প্রাণখুলে নিজের শিল্পসত্ত্বার উন্মোচন করতে পারে সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলন ছিল ইস্তেহার বিহীন।
এইসময় ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে থাকে। বাম আন্দোলন তখন চুরান্ত পর্যায়ে। কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক অভিঘাত আসে। তারপর আবার নতুন শাসনকালের প্রবর্তন এবং লেখক শিল্পীদের বক্তব্যকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা। কবির স্পর্ধাকে দমিয়ে রাখার চিরাচরিত প্রয়াস। যদিও কবি মাত্রই এই দাবিয়ে রাখার কৌশলের বাইরে রক্ত পলাশের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠেন। তাই তিনি যুগ নির্নায়ক।
১৯৮০ র উগ্রপন্থী বিধ্ধস্ত ত্রিপুরা, দাঙ্গা, নকশাল ভাবধারা, প্রাপ্ত স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের হাভাতে চেহারা, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে কবিতা চলতে লাগলো।
সত্তরের প্রবহমানতা এবং আশির দশককের অস্থিরতাকে যারা কবিতায় ধারণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিরা, হলেন, সেলিম মুস্তাফা, অমিতাভ কর, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, দিলীপ দাস, কিশোররঞ্জন দে, সন্তোষ রায়, লক্ষণ বণিক, সুবিনয় দাশ, শুভেশ চৌধুরী এবং আরো অনেক।
ভারতীয় পুরাণ, বেদ, দর্শনতত্ত্ব , চতুর শব্দ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার ইত্যাদির ঘনঘোর নিয়ে কবি মিলনকান্তি দত্ত, সমাজ সময়ের বিশ্লেষণ, পুঁজিবাদ, নিরাবেগ শৈল্পিক সুষমা, তীব্র শ্লেষ অথচ সুগভীর অনুচ্চ স্বর নিয়ে কবি পল্লব ভট্টাচার্য। কবি মণিকা বরুয়া, পাঞ্চালী দেববর্মণ, মাধব বণিক, রসরাজ নাথ, সুজিত দেব, রত্নময় দে, প্রত্যুষ দেব, বিশ্বজিৎ দেব, হিমাদ্রী দেব, সত্যজিৎ দত্ত, অলক দাশগুপ্ত প্রমুখ,তাঁদের লেখা অসংখ্য কাব্য গ্রন্থ এবং সংকলন আমাদের সম্পদ।
নব্বইয়ের দশকে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা বিষয়ের বিভিন্নতায়, পরিবেশনের সৌকুমার্য ও তীক্ষ্ণতায় ছুঁয়ে গেছে মানব জীবনদলিলের সমস্ত সীমা এবং অন্তহীন পরিসীমার মেধাবী দিগন্ত। এই দশকের উজ্জ্বল নাম অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, প্রদীপ মজুমদার, কাকলী গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতী ইন্দু, বিধাত্রী দাম, সুতপা রায়, অশীন বর্মণ, জাফর সাদেক,আকবর আহমেদ, পদ্মশ্রী মজুমদার, প্রীতি আচার্য, শিউলি শর্মা প্রমুখ।
উদার অর্থনীতিবাদ, বিশ্বায়ন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ, উগ্র ধর্মীয় মতবাদ, সাম্প্রদায়িকতার নতুন রসায়ন, দিশাহীন তরুণ প্রজন্ম, চরম বেকারত্ব, অন্ধকার এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকা নিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি একবিংশ শতকে। ত্রিপুরার কবিতা এই সমস্ত কিছুকে প্রত্যেক মুহূর্তে ধারণ করে আরোও অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং বৈচিত্র্যে ঝলমল হয়ে উঠছে, কবিতার আকুতি আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন যুগের আহ্বানে । শূন্য দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথমভাগে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা পৌঁছেছে বিশ্বমানে। এই যে আলোকময় বিস্ফোরণ, আমরা এই সময়ে যারা লিখছি, তারা চাই না কখনো এর শেষ হোক। অভিঘাত এবং ভাঙচুরের আশ্চর্য সম্মেলনে ত্রিপুরার বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সময় হোক চিরপ্রবহমান । ত্রিপুরার সাম্প্রতিকতম কবিতা চর্চার কথা বলব আমি। বর্তমান সময় যেভাবে দগ্ধ করছে কবির হৃদয়কে, কবিতা তো সেই রক্তাক্ত অক্ষরের মেঠো সুর।
কবিতা কোন সংগঠিত শিল্প নয়, সমস্ত সংগঠন আর সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়ে যেখানে বিপন্ন সংঘাত আর প্রেমের সুর বেজে ওঠে সেটাই কবিতা।
"দেহের অসুখ জানালা খুলে চাঁদ দেখতে বেরোয় / খুব একা হয়ে গেলে পড়ে ", ( অনিরুদ্ধ সাহা) ত্রিপুরার এই সময়ের এক তরুণ কবির কবিতার লাইন, এই পংক্তি দিয়েই প্রবেশ করব আমরা একবিংশ শতকের অস্থির, বিষাদাচ্ছন্ন কবিমনের ব্যাকুলতার কাছে।
"মানুষ বাড়িতে না থাকলে গাছ
মানুষ বাড়িতে না থাকলে পাখি
বনের গন্ধ ছড়িয়ে যায়
দীর্ঘদিনের মঞ্জুরীর ক্ষুধা
আগ্রাসী হয়ে উঠে
কতদিনের প্রতিশোধ "( অভিজিৎ চক্রবর্তী)
কবিতার কথা লিখতে বলেন অনেকেই। আসলে যে কবিতার কাছে এলে নীরব হয়ে যায় মন, সেই কবিতার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ত্রিপুরার শূন্য দশক বা প্রথম দশকের কবিতার মধ্যে স্নিগ্ধতা বেশি। শ্লেষ বা বিদ্রুপের তেমন কালোয়াতি দেখা যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। হয়তো সেই আততায়ী ছোরা অন্যভাবে কবিতায় এসেছে,
"রিক্সায় কোনো আয়না থাকে না
কেউ কেউ পরে লাগান
পেছনে আসা গাড়ি দেখতে নয়
পেছনে বসা যাত্রী দেখতে
যখন ছোরা মারেন পেছন থেকে কেউ
তখন তাঁদের চেহারা যেমন হয়
অনেক রিক্সাওয়ালাই সেটা দেখতে ভালোবাসেন। "( অভিজিৎ দাস) ।
এক আজব মহামারী আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, গভীর ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার স্তব করছে পৃথিবীর নতুন তরুণটি,
"ডিপ্রেশন এক বুদ্ধিজীবী রোগ।
ক্রমাগত আমরা হেরেই যাই শুধু
ক্রমাগত নিরর্থক জিতেই যাই আমরা
সমস্ত জয় ও পরাজয়ের সম্মিলিত যোগফল
নিয়ে আমরা ক্রমশ নীল হতে থাকি। '( পার্থ ঘোষ ) '।
বিশ্বাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বিষসিক্ত তির চলে যায়, তার পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা কবিতা,
"বিশ্বাসেরও বয়েস হয়েছে ঢের
ঝুলকালিতে মাখামাখি এখন
আমরাও এসে দাঁড়াই কার্নিশে
অন্ধকারে হাতে হাত রেখে,
নিজেরা বলাবলি করি
বুকের ভেতর একটা আস্ত সূর্য
জ্বলে উঠতে
আর কতটা সময় বাকি? " ( শঙ্খ সেনগুপ্ত)
ত্রিপুরার একজন নবীনতম কবির কবিতা থেকে,
"কী খোলা খোলা আঙুল তোমার আজও
মধ্যমায় ছড়িয়ে রাখে
পুরনো হাওয়াকল!
নিষাদ বয়ে এনে কোমল গান্ধর্ব,
মূর্ছনা, মেতেছিলো তেমনি
অঙ্গনবাড়ির জানালা ..."( সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য )।
অঙ্গনবাড়ির জানলা দিয়ে কবিতা ঢুকে পড়ল আমার শৈশবে, এটাই অসাধারণ লাগল আমার।
ত্রিপুরার কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের তরুণ গবেষক, অভিজিৎ চক্রবর্তী বলেছেন,
"নাগরিক জটিলতা, ত্রিপুরার কবিতার কখনোই মূল স্বর নয়। স্থানিক ভূগোলের যন্ত্রণা, ক্ষোভ, টানাপোড়নের চাইতেও প্রকৃতির অসীম ব্যাপ্তি বা উদারতার ভিতর দিয়ে ত্রিপুরার কবিতা বিকাশ লাভ করেছে। "
আসলে একদিকে উদ্বাস্তু মানসিকতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ভয়, ত্রিপুরার কবিদের স্পষ্টবাদিতায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তাই কবিতায় এসেছে ভাষার সৌকর্য, ভাব, নান্দনিকতা ইত্যাদি।
আমরা পড়ব ত্রিপুরার কবি মৃণালকান্তি দেবনাথের একটি কবিতা,
"আমাদের বাড়ির সামনে কোন শমীবৃক্ষ ছিল না। যার নীচে এসে বসতে পারেন বোধিসত্ত্বের মতো প্রাজ্ঞ তরুণ। তবে পেছনে ছিল ঝিঁঝি ডাকা কাঁঠালবাগান। যেখানে হলুদ চোখের তক্ষক শিশুদের স্কুলের, ঘুমোবার সময় ইত্যাদি অ্যালার্ম ঘড়ির মতো মনে করিয়ে দিত। বিল ক্লিন্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যখন পোখরানের জবাবে পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানালো তখন আমরা বড়ো হচ্ছিলাম। আসলে সুদের হার কমা বাড়া, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এসবে শিশুদের কোনোদিন কিছু যায় আসেনি "।
পঙ্কজ বণিক, রাহুল সিনহা, চিত্তরঞ্জন দেবনাথ, মৌলিক মজুমদার, প্রাণজয় সিনহা, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, বাপ্পা চক্রবর্তী, গোবিন্দ ধর, সুমিতা ধর বসু ঠাকুর, অর্পিতা আচার্য, দেবাশ্রিতা চৌধুরী, মন্দিরা লস্কর, রিয়া দেবী, অভীক কুমার দে, হারাধন বৈরাগী, শুভ্রসংকর দাশ, পায়েল দেব, জেরী চন্দ, সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য, দেবাশীষ চৌধুরী, মুনমুন দেব, প্রিয়তমা দত্ত, অনুরাগ ভৌমিক, অমলকান্তি চন্দ আরোও প্রমুখ। এইমাত্র যাদের কথা বললাম, তারা সবাই কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ের লেখক নন, কেউ কেউ অনেকদিন আগে থেকেই লিখছেন, এখনো লিখছেন আবার কেউ সদ্য লিখছেন। এই প্রজন্মের কবিদের কাছে ধরা দিয়েছে লেখার গলিত লাভা।যারা একইসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে পরিযায়ী মানুষের গৃহহীনতা। দেখতে পাচ্ছে দীর্ঘদিন একটি দেশে বাস করলেও মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না আসলেই তার কোন দেশ আছে কী নেই। কখনো পার্শ্ববর্তী দেশ অথবা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে আসা অসহায় রিফিউজির দল বাস করতে বাধ্য হচ্ছে আর একটি ভূখন্ডে। তাদের সন্তানসন্ততিদের শৈশব, যৌবন কেটে যাচ্ছে শরনার্থী শিবিরে। ত্রিপুরার বর্তমান বাংলা কবিতা এসব দেখছে, লিখছে, তাদের পূর্বসূরীরাও লিখেছিল অতীতকে, আজ আবার অনিশ্চিত বর্তমান আমাদের সামনে।
এই নিয়ে নতুন করে ত্রিপুরার সৈকত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হল, "দেশভাগের কবিতা " পড়ব কিছু লাইন এই বইটি থেকে।
কবি তমা বর্মনের কবিতায়,
"রাষ্ট্রের করপুটে গণকবর বিছিয়ে শুয়ে আছে উনিশ লক্ষ জীবন, পরিচয় পত্র,
স্বদেশপ্রীতির প্রতিটি যুদ্ধাক্ষর থমকে বঙ্গবুকে অপমানে
সংলাপে ছয়লাপ রাজতন্ত্র প্রপিতামহের সমাধির পাশে
ধ্বনি দিচ্ছে কারা 'ওরা আমরা '!"
"কবি সুমন পাটারী লিখেছেন,
"বরাক আর ব্রহ্মপুত্রের তীরে
উনিশ লক্ষ ভোটার
উনিশ লক্ষ তারার মাস্তুল থেকে
উনিশ লক্ষ দড়ি ঝুলিয়ে
আত্মহত্যা করেছে এক রাতে
কারণ রাষ্ট্র তাদের ভূমি ও দড়ি ঝুলানোর গাছ থেকে উচ্ছেদ করেছে রাতারাতি। "
আমরা যাচ্ছি বৈশ্বিক অতিমারীর মধ্যে দিয়ে। পেনডেমিক আমাদের সমস্ত অহংকারকে চূর্ণ করে দিয়েছে। লকডাউনের দিনগুলোতে মানুষ নিজেদের বিষাদ অতিক্রম করতে গান বেঁধেছে, কবিতা লিখেছে। সৃজনশীলতার কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে আত্ম উন্মোচন করতে চাইছে। এই আবহে রচিত হয়েছে প্রচুর কবিতা। সৈকত প্রকাশন পেনডেমিকের সময়কালকে ধরে রাখতে আরো একটি কাব্য সংকলন বের করেছে, "কোরনাকাল "।সেখান থেকে কয়েকটি পংক্তি উচ্চারিত হোক।
"রক্তে বাঁধানো শ্রমিকের পা,
উচ্ছ্বাসের মতো বহুল প্রচারিত মৃতদেহের কাছে শিশুটি কাঁদে,
তার একমাত্র প্রজাপতিটি হারিয়ে গেছে বলে "।( আম্রপালী দে)।
"একটা পৃথিবীর দু 'চোখেই কোরোনার ভয়!
আরেকটি পৃথিবীর ভয় ত্রি নয়নে
এক চোখে কোরোনা আরেক চোখে ক্ষুধার ছোবল
আর তৃতীয় চোখে রাষ্ট্রীয় লাঠি! '( সঞ্জীব দে) '।
হঠাৎ করে এই ধারাবাহিক মৃত্যু মিছিল আমাদের কেমন যেন সংকুচিত, ভয়ার্ত করে দিচ্ছে। আর্তনাদ হারিয়ে বুক ঠেলে উঠে আসছে কেবল অস্ফুট শব্দ অনর্গল।
"আমাদের কথা হয়েছিল মহামারীতে
আমাদের সাক্ষীর ভার নিয়েছে এই পেনডেমিক
আমরা কথা বলার ভার পাখিদের দিয়ে নির্ভার থেকেছি
আমরা নিস্তব্ধ হওয়ার অনুভব মহামারী থেকে নিয়েছি
আমাদের শরীর স্পর্শ করে গেছে সমুদ্রের জলো হাওয়া
আমাদের প্রিয় আগুন হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নিষ্ঠুর খবর
আমাদের ব্যথার ইতিহাস খেলো হয়ে গেছে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার কাছে
আমরা ক্রমাগত তুচ্ছ হয়ে গেছি মহামারীর কাছে ...( চিরশ্রী দেবনাথ )।
সৃজন হলো প্রবহমানতার ধারক ও বাহক। পৃথিবীর বুকে যত যুদ্ধ, যত মৃত্যু, যত অসুস্থতাই আসুক, মানুষ কবিতা লেখা বন্ধ করবে না। মানুষ ভালোবাসবে, কবিতা লিখবে, চারপাশ থেকে কুড়িয়ে আনবে সময়ের বিচ্ছুরিত স্তোত্র, ত্রিপুরার কবিতা, ত্রিপুরার মানুষের সম্মিলিত সত্তার বাস্তব প্রতিফলন, যার মধ্যে রহস্যবিস্তারের জন্য ঢুকে পড়েছে মেখলা চিতার ক্ষিপ্রতা, নাগকেশরের গন্ধ, পাহাড়ী ছরার মুখরতা।
কবি তমালশেখরের একটি কবিতা দিয়ে আজ ইতি টানব এই লেখার,
" দারিদ্র বিলাস " কবিতার নাম।
"ভাঙা দেওয়াল -
আরো একটু ভেঙে দিয়ে
দেখছি চাঁদ। "
এই বিপন্ন ঝুলন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হতে থাক ত্রিপুরার বাংলা কবিতা।
0 মন্তব্য(গুলি):