মহালয়া

৬:২৭ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

#মহালয়া দেবী দুর্গার আবাহন নয়
.........................

 এই প্রথমবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের 
“ আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর “ শুনলেই কেন যেন ভীষণ মনখারাপ লাগছে । শুনতেই ইচ্ছে করছে না । 
মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার আবাহনের যে সত্যিকার অর্থে কোনো যোগাযোগই নেই  অন্তঃস্থল থেকেই অনুভব করতে পারছি।
আসলে তো মহালয়ার সকালে বাজলো তোমার আলোর বেণু আসন্ন দুর্গাপুজোর সঙ্গে জোর করে সংযোগ করিয়ে দেওয়ার একটি নস্টালজিক সেতু মাত্র । সেই অর্থে শাস্ত্রীয় কোনো যোগাযোগ নেই মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর। 
 চারদিকে মেয়েদের ওপর এতো হিংস্র,  নিষ্ঠুর,  রূঢ় অত্যাচার শক্তি আরাধনার অর্থটাকেই স্থূল এবং মূল্যহীন করে দিয়েছে। 
বহু মানুষের রুটি রোজগার জড়িয়ে থাকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে শুধুমাত্র একারণেই পুজো হোক। আসলে তো কোথাও আলোর বেণু বাজছে না । মৃত্যুরূপী এক আসুরিক শক্তির কাছে মেয়েরা জন্মমাত্র পরাজিত হয়ে আছে। বহু কিছু জিতে নিতে পারলেও এখানে মেয়েদের হারতেই হবে। সেই মুহূর্তে তার দুহাতে কোন ধারালোো  অস্ত্র আশ্চর্য উপায়ে কোনদিনই গজিয়ে উঠবে না যার মাধ্যমে সে নিজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া অসুরকে বধ করে দিতে পারে। 

 মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার এক তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন তো  নয়ই ,  তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে ।

মহালয়া শব্দটিতে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। 
 কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না  হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই প্রেত শব্দটিকে কখনই  হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 

মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ মানেই আমাদের তিনটি ঋণ আজীবনের সঙ্গী,  দেবঋণ, ঋষিঋণ আর পিতৃমাতৃ ঋণ। দেবার্চ্চনার মাধ্যমে দেবঋণ,  গুরু দক্ষিণার মাধ্যমে ঋষিঋণ বা শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ঋণ আমরা কিছুটা হলেও শোধ করি। আর মাতা পিতার প্রতি যে ঋণ তা আসলে তাদের প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই আংশিক শোধ করা যায়,  তবুও তর্পণের মাধ্যমে হয়তো সেই অদেখা পুর্বপুরুষদের প্রতি জল তিল দান করে আমরা বাহ্যিকভাবে হলেও কিছুটা ঋণ শোধ করার একটি প্রয়াস চালিয়ে যাই। যদিও আমার মনে হয় বৃদ্ধ মা বাবার প্রতি কোনো কর্তব্য পালন না করে মৃত্যুর পর ঘটা করে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করা অর্থহীন। 
 ধর্ম মানলে ঋণ শোধ করার শ্রেষ্ঠ দিন হচ্ছে মহালয়া । সেদিন  আমাদের সমস্ত পূর্বপুরুষেরা পিতৃলোক থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়  আর সেজন্যই সৃষ্টি হয় এক মহান আলয়ের,  তাই দিনটি মহালয় ।
কিন্তু আমরা তাকে স্ত্রীলিঙ্গ বা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত করি তার সঙ্গে আসন্ন  দেবীপক্ষের উৎসবমুখর যোগাযোগ রয়েছে একারণে বলেই মনে করা হয়। 
কারণ মহ শব্দের আর একটি অর্থ উৎসব। মহালয় মানে উৎসবের আলয়। 
রাম  রাবণকে যুদ্ধে হারাবার জন্য শরৎকালে দেবীকে অসময়ে অন্য তিথিতে আবাহন করেন। আর  আমাদের ধর্মে যেকোন বড় কাজের আগে পিতৃপুরুষদের পুজো করার বিধান রয়েছে। রামও দুর্গা পুজো করার আগে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন, সেজন্যও মহালয়ায় পিতৃপুরুষদের জন্য শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার ধর্মীয় রীতির সঙ্গে দুর্গাপুজো জড়িয়ে যায় । আর একটি বহুল প্রচলিত গল্প তো সবারই জানা,  দাতা কর্ণের গল্প।  কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। তা থেকেই তর্পণ নামের
অনুষ্ঠানটির সূচনা হয় হিন্দু ধর্মে , এটাও মনে করা হয়। 
 মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।
১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 

কিন্তু বহু দুঃখজনক  কারণের  সমাপতন ঘটে যাওয়ায় এবছরের দুর্গাপুজো উৎসব নয়,  উৎসব এবার একটি কাঠামো মাত্র , যার ওপর রঙ চড়ানোর তুলিতে হাত রাখতে আমার মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। মহালয়ার সকালে চণ্ডীপাঠ এক দুঃসহ কালকুণ্ডলীর নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনে হচ্ছে শুধু।  পুজোর আগে যে মা বাবার কন্যা চিরতরে বিসর্জিত হয়ে গেল এক নারকীয় হত্যায়, তা ভুলতে পারছি না কিছুতেই।)

#চিরশ্রীদেবনাথ

0 মন্তব্য(গুলি):