মহালয়া

১২:৩১ PM চিরশ্রী দেবনাথ 0 Comments

মহালয়া মানেই দেবী দুর্গার আবাহন নয়

চিরশ্রী দেবনাথ

মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন নয় তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পিত়ৃলোক হিসেবে যা কল্পনা করা হয়,মহালয়ার দিন সেই পিতৃলোক থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিছুটা নিচে নেমে আসেন,  সেই সময় উত্তর প্রজন্ম তাঁদের উদ্দেশ্যে  তিল জল চাল বা জব অর্পণ করেন , পূর্বপুরুষরা তৃপ্ত হোন , সব মিলিয়ে যেন একটি মহান ও পবিত্রতম আলয় সৃষ্টি হয় যা থেকেই শব্দটি মহালয় । যে কেউ এইদিনে তার পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে পারে আর এই শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের অতি ক্ষুদ্র অংশের নাম হচ্ছে তর্পণ।
 মানুষ জন্মলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি ঋণের দ্বারা আবদ্ধ হয়। দেবঋণ,  ঋষিঋণ এবং পিতৃঋণ। কারণ প্রত্যেক ধর্মের মানুষই সাধারন
ভাবে মনে করে তারা   ঈশ্বরের সন্তান। অতএব এই জীবনলাভের জন্য ভগবানের কাছে ঋণী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যাগ যজ্ঞের মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি আমরা। ঋষিঋণ মানে গুরুর প্রতি ঋণ যা প্রাচীনভারতের তপোবন শিক্ষা থেকে শুরু করে এখনকার বিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত , বিদ্যা অর্জন , গুরুকে উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন এবং গুরুদক্ষিণার মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার একটি আজীবনের প্রচেষ্টা থাকে আমাদের।  
 আর অবশ্যই জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর প্রতি মানুষের চির ঋণ। ওরা আমাদের শিশু থেকে যেভাবে বড় করেছেন বার্ধক্যে তাদেরকে আবার তা ফিরিয়ে দিতে হবে। আর আমাদের সুবিশাল পিতৃলোক,  মহালয়ার বিশেষদিনে  এটা শুধু
মাত্র বংশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট থাকেনা, লতায়পাতায় বিস্তৃত হয়ে সমস্ত মৃত আপনজনদের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়। ‘মহ’ শব্দের প্রাথমিকভাবে  আরো একটি অর্থ রয়েছে।  ‘মহ’ বলতে বোঝায় পুজো বা উৎসব। তা থেকে ব্যুৎপত্তি করলে হয়  মহ+আলয় = মহালয় অর্থাৎ পুজো বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। তবে শব্দটিকে কেন স্ত্রীলিঙ্গ করা হলো এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোন কারণ না থাকলেও যেহেতু অমাবস্যার আঁধার কেটে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয় কয়েকদিন পরেই , সেই আসন্ন উৎসবের কথা ভেবেই শব্দটিকে বলা হয় মহালয়া ।
 মহালয়া শব্দটির আরো কিছু বিশেষ অর্থ রয়েছে। এখানে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। যা ডাক্তারি পরিভাষায় মাল্টি অর্গ্যান ফেলিউর। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না বা ব্রেণ ডেথ হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই এই শব্দটিকে হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 
 ১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই মহালয়াকে দুর্গাপুজোর আবাহনের রূপ দেওয়ার কারিগর  বলা যায়।
বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 
আর একটি জিনিস যেটা হলো সেলিব্রেশন বা উৎসব। আমরা সবকিছুই আজকাল সেলিব্রেট করি। শিক্ষক দিবস থেকে শুরু করে, মহালয়া  এক ভয়ানক সেলিব্রেশন। কারণ মানুষ এখন শোক বয়ে নেবার মতো ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। তাই শোকের সঙ্গে মিশে যায় সেলিব্রেশন। 
মহালয়া প্রকৃতপক্ষে পরম শ্রদ্ধায় একান্তমনে পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের দিন। কিন্তু নদীবক্ষে যখন কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়ে এই কাজটি করে তখন তা ব্যক্তিগত থাকে না। ছড়িয়ে পরে। বহুজন একত্রিত হয়ে কোন কাজ করাটাই হয়ে যায় সেলিব্রেশন। আমরা তখন বলতে চাই শুভ মহালয়া ।
পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের বহু গল্প আছে। তারমধ্যে একটি বিখ্যাত গল্প দাতা কর্ণের গল্প। এ দিয়েই শেষ করব লেখাটি । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।


এই পক্ষই পৃথিবীতে পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

তেমনি রামায়নে রাম দুর্গার পুজো করার আগে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। কারন যেকোন ভালো কাজ করার আগেই পূর্বপুরুষকে
তৃপ্ত করতে হয়। এজন্যই শরৎকালে দুর্গার যে অকাল বোধন হয় তার আগে মহালয়ায় পিতৃ তর্পণ এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ বলে মনে করা হয়। 









0 মন্তব্য(গুলি):