অনন্তলোকের সিম্ফনি
অনন্তলোকের সিম্ফনি ( গণিত দিবসের গল্প)
.....
দূরে পাহাড়ের গায়ে যেন কিছু বরফ পড়েছে। এসব অঞ্চলে কোনোদিনই বরফ পড়ার মতো তাপমাত্রা হয়নি। তাই খানিকটা বিস্মিত হয়েছে গার্গী। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির। একটি অদ্ভুত শান্তি যেন এই মুহুর্তে । ঠিক এসবই আগামীকাল থেকে মিস করবে গার্গী।
বার কয়েক ভ্রমণে গার্গী বুঝতে পেরেছে সেই নির্জনতা আর সেই নিস্তব্ধতাই সুন্দর যেখানে পাখির ডাক , ঝর্ণার উচ্ছল শব্দ বা কখনো কখনো হঠাৎ কোনো মানুষের বা বাচ্চার আওয়াজ থাকে। কারণ তখনই নীরবতাকে আঁকড়ে ধরা যায়। না হলে শুধুই বিষণ্ণতা ।
পৃথিবীর বাইরে চলে গেলে সবকিছুই নিথর। এবার ঠিক কবে ফেরা হবে এটা এখনো জানে না গার্গী।
সময়টা ২২৭৩ ।
গার্গীকে বর্ণনা করতে হলে প্রথমেই বলতে হবে তার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। চোখ খয়েরি রঙের। ঠোঁটের কোণে একটি হাসি সবসময়ই লেগে থাকে যা অন্তত বলে
পদার্থবিদ্যা জটিল হলেও বোরিং নয়।
সে সবুজ রঙের শাড়ি পরে আছে। আগামীকাল থেকে শাড়ি পরা বন্ধ এজন্য আজই শখ মেটাচ্ছে । গার্গী মূলত স্ট্রিং থিয়োরি নিয়ে গবেষণা করে। পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ চলছে। তাবড় তাবড় পদার্থবিদ এবং অংকবিদরা বুঝতে পেরেছেন যে মহাবিশ্বের মূল কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত অংক এবং মহাবিশ্বের প্রতিটি কণাই একটি সুনিদিষ্ট স্ট্রিং কোড দ্বারা নির্ধারিত। এইসমস্ত এনার্জি পার্টিকলস বা শক্তিকণাদের এনার্জি নির্ণয়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্টমান সহ ইনফাইনিট সিরিজের কথা কয়েকশো বছর আগে নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন রামানুজন নামে একজন গণিতজ্ঞ।
গার্গীর সঙ্গী প্রফেসর বিদুর । যিনি বৈদিক ম্যাথমেটিক্স এবং আধুনিক অংকের ধারার একজন সফল সমন্বয়কারী।
গত সফরেও তারা পরস্পরের সঙ্গী ছিলেন। সেময়ই গার্গী লক্ষ্য করেছিল কয়েকটি কণার বিশেষ আচরণ যা তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে মিলছে না। এই পর্যায়ে প্রফেসর বিদুর বহু পরিশ্রমে কণাটির একটি খণ্ডিত অংশের ডি কোডিং করেন এবং আবিষ্কার করেন প্রাচীনকালের সিরিজ যার নাম ফিবোনেসি সিরিজ সেটিই এই কণাটির ডি কোডিংএর ভিত্তি সূত্র এবং তখনই তারা বুঝতে পারেন মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক কোড দিয়ে সিম্ফনির মতো পরিচালিত হয়। যার মধ্যে সামান্য অদল বদল করালে কী হবে সেটা তারা জানেন না। হয়ত ভয়ঙ্কর কিছু বা হয়ত দারুণ সুন্দর কিছু। কিন্তু সেই পর্যায়ে তারা আর পরীক্ষা নীরিক্ষা না করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন নিজেদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে।
এখন আবার তারা যাত্রা করছেন গতবারের রহস্যের উন্মোচনে।
আমরা আবার অনন্তলোকে যাত্রা করছি তাই তো?
কিন্তু প্রফেসর বিদুর , অনন্তলোক মানে তো মৃত্যু তাই না!
সে তো আগে হতো। এখন অনন্তলোক মানে মহাকাশ হয়ত বা মাল্টিভার্স ।
হেই একটু দেখো তো?
গার্গীর কথায় বিদুর সামনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন। আরো একটি মহাকাশযান ।আয়তনে তাদের থেকে অনেকটাই ক্ষুদ্র। কিন্তু এই এলাকায় তো কোনো ট্রাফিকের খবর ছিল না।
কে তিনি? আমাদের পরিচিত কেউ?
কিন্তু এখন তো সবাই বন্ধু তাই না? শত্রুপক্ষ বলে কিছু নেই। আমাদের তো একটাই পৃথিবী।
তবুও একবার সংকেত পাঠাও। দেখো কেউ কথা বলে কিনা।
ওকে ।
সেই মহাকাশযানের গতিবেগ অত্যন্ত বেশি ।এবং দ্রুত হারিয়ে গেল স্ক্রিন থেকে। সংকেতের কোন রিপ্লাই এলো না।
আর আসবেও না মহাকাশযানটিতে ছিল ডঃ লুকাস । সুন্দর ইউনিভার্সের একজন গোপন , অসুন্দর, দক্ষ এবং মেধাবী শয়তান। যিনি স্ট্রিং থিয়োরি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন একটি ব্ল্যাক হোল বোমা । যার মাধ্যমে পুরো মহাবিশ্বকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। যা এক বিপুল মহাজাগতিক যুদ্ধের অনভিপ্রেত সূচনা মাত্র ।
কিছুক্ষণ পর অপূর্ব একটি টিউন বেজে উঠল প্রফেসর বিদুরের রেডারে। বিদুর যেন একটু হাসলেন খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে।
ও ইয়েস । তুমিও সুইট হার্ট!
গার্গী অবাক হলো। আপাদমস্তক গম্ভীর এই গণিতবিদকে এতোটা লঘু ভাষায় কথা বলতে আগে কখনো শোনেনি গার্গী।
কিন্তু যতক্ষণ না বিদুর নিজে থেকে কিছু বলছে গার্গীও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ সংকেত বিনিময় হলো। সামনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল উজ্জ্বল রঙের আর একটি মহাকাশযান ।
এবার বিদুর গার্গীর দিকে তাকিয়ে বলল দুর্গা এসেছে।
একমুহূর্ত সময় লাগল গার্গীর। দুর্গা মানে এক তরুণী পদার্থবিদ। যাকে এখনও সামনাসামনি দেখেনি গার্গী। ছবি দেখেছে। এই তরুণ পদার্থবিদ মাল্টি-ডাইমেনশন বিশেষজ্ঞ।
তিনি এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেছেন, যা ১১টি মাত্রার গাণিতিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
ওর সঙ্গে কাজ করার জন্য অনেকদিন ধরেই বিদুর গার্গীকে অনুরোধ করছে কিন্তু কোথাও গার্গীর ইগোতে লাগছে ।তার দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কি কম পড়েছে যে অর্ধেক বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিদুর বোধহয় গার্গীর মনের কথা বুঝতে পেরেছেন ।
গবেষণায় তো বড় ছোট নেই গার্গী।
আমরা কিন্তু বিশেষ একটি রহস্য উদ্ধার করতে এসেছি।
এখনই দুর্গার সঙ্গে যোগ দিচ্ছি না গার্গী। ও নিজেই এসেছে ওর নিজের কাজ নিয়ে। তবে সাহায্য লাগতে পারে।
পরবর্তী কয়েকদিন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে কাটল।
গার্গী ও বিদুর একটি পরীক্ষা চালিয়ে একটি ক্ষুদ্র ভৌতিক ঘটনা তৈরি করল—একটি কণা মুহূর্তের জন্য স্থানান্তরিত করা হলো মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে। কিন্তু এটাই বিপদের সূচনা। স্ট্রিং কোডে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে মহাবিশ্বের এক অংশে সময়ের গতি থেমে যায়!
গার্গী ও বিদুর সেই নিথর সময়ের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ে।
বিদুর এবং গার্গী বুঝতে পারে যে এই কোডকে সামঞ্জস্য করার জন্য তাদের স্ট্রিং কোডের পুরো কাঠামো বুঝতে হবে। কিন্তু তার আগে নিজেদের বের করতে হবে এই সময় কয়েদ থেকে।
এক অনন্ত অন্ধকার খণ্ডের মধ্যে তারা বন্দি হয়ে আছে। কে কীভাবে উদ্ধার করবে তাদের ? কোনো সংকেতই কাজ করছে না। এই কি তবে তাদের অনন্তলোক।
মহাবিশ্বে যেসব স্থান "স্ট্রিং কোডে “র অসামঞ্জস্যের কারণে অস্থির হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো শনাক্ত করার জন্য একটি এআই-চালিত যন্ত্র , নাম "অ্যানোমেলি হান্টার", যা পরবর্তী বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে। এটাই তৈরি করে ডঃ দুর্গা সর্বাপেক্ষা আলোচিত একটি নাম এই মুহূর্তে ।
দুর্গার সঙ্গে থাকা যন্ত্রটি সেই মুহূর্ত থেকেই অস্থির সব সমীকরণ তৈরি করছে আর দুর্গা বুঝতে পারছে তাকে যে করেই হোক এর সমাধান করতে হবে। মনে হচ্ছে প্রফেসর বিদুর এবং প্রফেসর গার্গী কোন একটি বিপদে পড়েছে।
দ্রুত কোনো একটি অজ্ঞাত টাইমলুপ থেকে এদের বের করতে হবে।
হঠাৎ দুর্গার মনে হয় গার্গী তাকে পছন্দ না করলেও গার্গীর একজন ছাত্রী রয়েছে যে কোয়ান্টাম টাইমলুপ নিয়ে কাজ করে এবং একটি বিশেষ ইটারনাল ম্যাট্রিক্স আবিষ্কার করার পথে। পৃথিবীতে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো সলিউশন বের করা সম্ভব। যার মাধ্যমে সময়ের গতিকে সামনে বা পেছনে চালিত করা যায়।
স্ট্রিং থিয়োরি এবং ক্যালকুলাসের সমন্বয়ে ইটারনাল ম্যাট্রিক্সের সমাধান অবশেষে সম্ভব হয়। পৃথিবীতে গার্গীর ছাত্রী আশা সেই মাস্টার ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হয় এবং দীর্ঘসময়ের প্রচেষ্টায় বিদুর ও গার্গী ,দুর্গা ও আশার তৎপরতায় সময়কয়েদ থেকে বের হয়।
তারা বুঝতে পারে এই বিশেষ কোয়ান্টাম লুপ বা গাণিতিক প্যাটার্ন জটিল সমীকরণের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখতে হবে। না হলে হয়তো পৃথিবীর সব ভালো বিজ্ঞানী এবং গণিতজ্ঞ দুষ্টদের দ্বারা সময়কয়েদ হয়ে যাবে।
এর জন্য তারা একটি গাণিতিক "মাস্টার ফর্মুলা" তৈরি করেন, স্ট্রিং থিয়োরি এবং ক্যালকুলাসের সম্মিলন।
তাদের এই সমীকরণ ব্যবহার করে সময়ের থেমে যাওয়া প্রবাহ আবার সচল হয়।
অনিচ্ছা আর সম্ভব হলো না। মহাবিশ্বের ঘন আঁধারে দুর্গাকেই বন্ধু করতে হলো গার্গীকে।
শুধু হৃদয়ের একটি জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল যেখানে একটি স্ট্রিংও তার অস্তিত্ব আর জাহির করছে না। কেবল ভ্যাকুয়াম।
আস্তে আস্তে, দুর্গা এবং গার্গী মিলে স্ট্রিং কোডকে ভেঙে ফেলার একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করে।
মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা শুধু স্ট্রিং কোড নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি ফ্রিকোয়েন্সি বা "কোয়ান্টাম রেজোন্যান্স" অনুযায়ী আন্দোলিত হয়। যদি এই ফ্রিকোয়েন্সি বদলানো যায়, তবে কণাগুলোর আচরণও বদলে যায়।
আর মাল্টি-ডাইমেনশনাল প্রিজম হচ্ছে
একটি বিশেষ যন্ত্র, যা ১১টি মাত্রায় (ডাইমেনশন) স্ট্রিং কোডকে আলাদা করতে পারে। এই যন্ত্রটিরও আবিষ্কারক দুর্গা।
অপরদিকে গার্গী একটি তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, যার নাম "ইটারনাল ম্যাট্রিক্স"
যার মাধ্যমে তারা সময় কয়েদ থেকে মুক্ত হয়েছেন।
এটি এমন একটি গাণিতিক সূত্র যা মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাকৃতিক নিয়ম (ভর, শক্তি, গতি) একটিমাত্র সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে।
আপাতত মহাকাশ থেকে ফেরার সময় হলো।
এতোকিছু ফলাফল পাওয়ার পরও গার্গীর মন ভালো নেই।
মহাবিশ্বের গবেষণায় সে নিজেকে আর সংযুক্ত রাখতে চায় না।
পৃথিবীর এক কোণে ছোট্ট বাড়িতে ফিরে যেতে চায় সে , যেখান থেকে সত্যিই কোনো অনন্তলোকে যাওয়া যায়।
ইনফিনিটির রেজাল্ট বের করার ইচ্ছে আর তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।
দুটো মহাকাশযানই আপাতত তীব্র গতিতে নীল গ্রহে ফিরছে।
শুধু একটি মহাকাশযান রয়ে গেছে হাজার নক্ষত্রের মধ্যে ।
ডঃ লুসাই সেখানে সূচনা করছেন এক মহাজাগতিক স্বৈরাচারের।
#চিরশ্রীদেবনাথ
#বাংলাগল্প
#কল্পবিজ্ঞানেরগল্প
#কল্পবিজ্ঞান
#ছোটগল্প
0 মন্তব্য(গুলি):