বিশ্ব কবিতা দিবসে


কেন যাবো কবিতার কাছে

পৃথিবীর কিছু মানুষ কবিতা লেখে কারণ পৃথিবীর বাকি মানুষ কবিতা লেখে না। তবে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই কখনো কখনো কবিতা শুনেছে, বলেছে বা পড়েছে।
একটি অটোর পেছনে দেখলাম লেখা আছে,
“আবার আসিব ফিরে মনুনদীর তীরে “ এই অটোচালক খুব রসিক। সে কোন এককালে জীবনানন্দ পড়েছিল, তার অন্তঃস্থলে লেগে আছে লাইনটি, “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে “, একটু খানি নকলই তো করেছে মাত্র। এই নকলটি সহস্রাধিক বার যেন হয়। কবিতা তুমি সেই যুবকের নারী হয়ে থাকো।  

আবার নেট ঘাটতে গিয়ে একটি প্রবন্ধ পেলাম তাতে আছে,
চিলির সান্তিয়াগো শহরের রাস্তায় একটি ছোট ছেলে কবিতা বলতে বলতে তরমুজ বিক্রি করছিল, এখন একজন ভ্রমণকারী ও পাবলো নেরুদার কবিতার অনুরাগী, যে কিনা ওনার কবিতা অনুবাদ করতে চায়, এই লাইনগুলো শুনে  সে আরো কাছে গেলো, তরমুজ কিনলো, আরো দু একবার কবিতাটি শুনল। অবশেষে সেই অনুবাদক যখন পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদ করতে যান তখন আবিস্কার করেন এই দুটো লাইন পাবলো নেরুদার, "ওড "কবিতা থেকে নেওয়া। কিভাবে যেন  লাইনগুলো ঢুকে গিয়েছিল ছেলেটির বিক্রিবাটায়।

কবিতার সবচেয়ে নিজস্ব গুণটি হলো কবিতা একইসঙ্গে ভীষণ মহৎ, দুর্দান্ত ধ্রুপদী, কবিতা পড়ার আগে নিজেকে সব দিক থেকে প্রস্তুত করে আস্তে আস্তে চিক্কন আলোর মতো ঢুকে যেতে হবে এই আভিজাত্যে।  আবার একই সঙ্গে কবিতা মাঠে পরে থাকা পাখির পালক, করুণ চোখে চেয়ে আছে পৃথিবীর যাবতীয় ধূসরতা নিয়ে।

কবিতা সেই মাদক, যে সব আভিজাত্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলে,

"তুমি আমায় অবজ্ঞাতে উড়িয়ে  দিলে,
ফুউউউ ...
তবুও শালা হতচ্ছাড়া  কোকিল ডাকে কুউউউ "
....কবি সালেহীন শিপ্রা ( বাংলাদেশ)।

কবিতা কবির চিরকালীন কলঙ্করচিত  কল্পনা, দ্বিতীয় নারী বা পুরুষ যার সঙ্গে সহাবস্থান কেবল অভিমান আর মিলনের।
কবিতা কি কেউ পড়ে এখন, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন?
পাঠ্যপুস্তকের বাইরে "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ "কিংবা "বিদ্রোহী "কিংবা "মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় "ইত্যাদি ইত্যাদি, যেহেতু বাচ্চারা আবৃত্তিশিল্পের চর্চা করছেন তাই অভিভাবকদের কানে পৌঁছে যাচ্ছে জবরদস্তি করেই। আবৃত্তি শিখতে আসা  শিশু বা কিশোর কিশোরীদের কাছে এইসব কবিতা একটি বোধের সূচনা ঘটায় মনে। পরবর্তীতে তার কবিতাপ্রেম, কবিতাকে চেনা, কবিতাকে ভালোবাসা কিরকম হবে তা নির্ভর করে ছেলে বা মেয়েটির চেতনা এবং মনোজগতের উন্নতির ওপর।
কবির মনোজগত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলৌকিক জায়গা। এখানে তিনি সমস্ত দুর্বোধ্যতা নিয়ে বসে থাকেন। এই আঁধারের ধার নেই, দান আছে, এক কবি থেকে অন্য কবিতে, এজন্যই কবিতা সংক্রামক এবং না সারাইযোগ্য ব্যাধি।

"কিছু লোক
তার মানে সবাই নয়,
এমন কী অধিকাংশও নয়, সামান্য কয়েকজন,
স্কুল পড়ুয়া ছাড়া, তারা পড়তে বাধ্য হয়,
আর কবিরা ছাড়া,
তুমি যদি গোনো হয়তো এক হাজারে দু জন।
..................
কবিতা
যা হোক কিন্তু কবিতা কী?
অনেক উত্তর
প্রথম দিনের প্রশ্নটির পর থেকে,
কিন্তু সে সব আমি না জেনেই থাকি, আঁকড়ে থাকি  তাকে
সিঁড়ির রেলিঙের অবলম্বনের মতো। "

এই কবিতাটি লিখেছেন ভিসলাওয়া সিমব্রসকা, পোল্যান্ডের কবি, ১৯৯৬ সালে তিনি সাহিত্যে  নোবেল পুরস্কার পান। উপরে উদ্ধৃত অংশটি অমিতাভ চৌধুরী কৃত অনুবাদ থেকে নেওয়া।
এটা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কবিতা নয়। পৃথিবীতে আরো বহু সুন্দর কবিতা লিখিত হয়েছে। আমার কাছে আকর্ষণীয় কবিতায় উল্লিখিত ঐ রেলিঙটি। অবলম্বন। বেঁচে থাকার অবলম্বন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের পর কবিতা একটি বেঁচে থাকার উৎস হতে পারে, যার কিনারায় দাঁড়িয়ে কবি নীচের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর তার চোখ থেকে এক ঝলক
‘বেঁচে থাকা ‘  প্রবাহিত হয় বহু দূর অব্দি।

কেনেডি এবং চার্চিল দুজনেই বলেছেন, "পোয়েট্রি ক্লিনস, পলিটিক্স পল্যুটেড  "।
অথচ কবিতা এবং রাজনীতি একজন আরেকজনকে জড়িয়ে আছে খুব বেশী করে। কোনদিনই হাজার হাজার মানুষ কবিতা পড়ে না, একটি সীমাবদ্ধ বিশেষ বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে কবিতা চর্চিত হয় তার যাবতীয় মায়াকুশলতা, সৌন্দর্য আর মেধাবী লাইন নিয়ে, কিন্তু এই কবিতাই পৌঁছে গেছে এক লহমায় হাজার হাজার মানুষের কাছে যখন যুদ্ধ,  রাজনীতি আর মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে কবিতা।
১৯৭১, বাংলাদেশ যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষরা দিনের মধ্য দিয়ে। চলছে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা। অ্যালেন গিন্সবার্গ  কলকাতায় এলেন, সুনীল গাঙ্গুলীর বাসায়, তাঁকে নিয়েই দেখলেন যশোর রোডে নেমে আসা উদ্বাস্তুদের ঢল, বন্যা, ঘর বাড়ি দেশ হারানো মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচাইতে প্রভাব বিস্তার করা সমকালীন এবং চিরকালীন একটি কবিতা রচিত হয়েছিল তখনই, "সেপ্টেম্বর ওন যশোর রোড "। এই কবিতায় সুরারোপ হলো, গাইলেন আর এক জগত কাঁপিয়ে দেওয়া গায়ক বব ডিলান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে যে কনসার্ট হয় তাতে রবি শঙ্কর থেকে শুরু করে ছিলেন আরো বহু শিল্পী,  অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল ঠিকই, তবে তার চাইতেই যা বেশী পাওয়া গেলো তা হলো কবিতা আর গানের মাধ্যমে, “সেপ্টেম্বর ওন যশোর রোড “ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বের দরবারে আরো বেশী করে এবং আন্তর্জাতিক মহল বুঝতে পেরেছিল একটি স্বাধীনতাকামী দেশের হৃদয়কে। কবিতা সবকিছুকে ছাপিয়ে এইভাবেই সময়ের ভাষ্য হয়ে ওঠে বার বার বহুবার।

কবিতাটির একটি অংশ,

"শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।l
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল,
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।"

অনেকেই বলবেন এটাই হচ্ছে আসলে মানুষের কবিতা, কত সহজে বোঝা যাচ্ছে লাইনগুলো।  চিন্তাজগতের কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই কবিতার অন্তঃস্থলে ঢোকা যাচ্ছে। কবিতা বলে দিচ্ছে একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, দুর্দশার কথা। আমার কাছে এই কবিতাটির আসল  রচয়িতা সময়, অ্যালেন গিন্সবার্গ হলেন বিশেষ সময়টিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সেই অলৌকিক মাধ্যম ।

একইভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, দুর্ভিক্ষ,  স্বাধীনতা উত্তর ভারত, নকশাল আন্দোলন সমস্ত রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিক্ষেপণ রচনা করেছে বহু বহু কবিতা, লোকের কন্ঠে কন্ঠে ফিরেছে, এখনও ধ্বনিত হচ্ছে।
তাহলে বলে দেওয়া যায়, যখনই কোন বিরাট অস্থিরতার সৃষ্টি হবে তখনই আমরা কবিতার কাছে যাবো। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে ভারত
কিংবা বাংলাদেশ কবিতার উর্বর ক্ষেত্র। সবসময় কিছু না কিছু হয়েই চলেছে। আর এইসব ঘটনাপ্রবাহ কবিতাকে প্রাণ দেয়, জীবন্ত করে তোলে। রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজম্,
সুররিয়ালিজম তিন মিলে কবিতাকে আরোও সমৃদ্ধ হবার জনপদ তৈরী করে দেয়।
মানুষের মনোভূমির তিনটি স্তর, ইদ, ইগো ও সুপার ইগো। এই ইদ ( Id) বা অবচেতন মনই সুররিয়ালিজমের উৎসভূমি।

“কেরোসিন, কাঠ, গালা, গুণচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে
ধনুকের ছিলা রাখে টান “ ( ‘রাত্রি’, জীবনানন্দ দাশ) ,
সাধারণ মানুষের কাছে সমস্যাটি তৈরী হয়েছে এখানেই, এইসময়ের সবচেয়ে প্রচলিত বিতর্কিত শব্দ ‘জীবনমুখী’ ব্যবহার করবো, বলবো যে জীবনমুখী সহজ কবিতার বিরাট জনপ্রিয়তার পর, হঠাৎ করে গভীরতম বোধের কবিতাগুলো এলেই, কবিতা  জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কারণ পাঠক তৈরী হয়নি।

পাঠক তৈরী করার দায়িত্বও কবির।
একটি বিশাল পাঠকশ্রেণী তৈরী করতে, বাংলা কবিতার বিপুল বৈভব বোঝার বোধ জাগ্রত করতে আরো দীর্ঘ সময় দরকার।
আস্তে আস্তে এই মনোভূমি সবুজ হবে।
খুব স্বাভাবিক ভাবে মানুষ বলে দেয় এইসময়ের কবিতা বুঝি না। এই "বুঝি না " জিনিসটাকে  গুরুত্ব দেওয়ারই দরকার নেই। কবিতা সবসময় দুই ভাষ্যেই রচিত হয়। সরল এবং কঠিন।
মানুষের বোধকে উচ্চতর মাধ্যমে নিয়ে যাওয়াটা কবিতার অন্যতম কাজ।

কবি তার নিজস্ব বোধ বুদ্ধি মেধা দিয়ে কবিতা রচনা করবেন।
আমাদের দায়িত্ব কার্তিকের জ্যোস্নার প্রান্তরে মহীনের ঘোড়াগুলোর কাছে পৌঁছে যাওয়া, প্রস্তর যুগের ঘোড়াগুলো এখনও ঘাসের লোভে চরে কেন, এ সম্পর্কে ভাবা।
পরক্ষণেই বলব
কেন ভাবব, এই চিন্তা ভাবনা আমার দৈনন্দিন জীবনের স্নান, খাওয়া, মৈথুন পেরিয়ে কোন কাজে আসবে?  ভাববো, প্রবলভাবে ভাববো, নাহলে থেমে যেতে হবে।
কবিতা নিয়ে না ভাবলে, কবিতা না লিখলে, কবিতার চর্চা না হলে সাহিত্য থেমে যায়। সময় স্থবির হয়ে যায়। স্থবিরতার কাছে পৌঁছে গেলে মানুষ যেতে থাকে পেছনের দিকে, অন্ধকারের দিকে, কুসংস্কারের দিকে।
যাপনের সব অন্ধকারই কবি বমন করেন,আর তার মাধ্যমেই আলো ফোটে।

“একটি সতেরো বছরের মেয়ের পায়ের তলায়
লুটিয়ে পড়তে পারে না একবার      একবারো তাবৎ সংসার? “ ...কবিতা সিংহ।

কবিতা আসলে সেই সতেরো বছরের মেয়ে, যার গর্ভ শূন্য, সহস্র সন্তান ধারণ করবে বলে উদাসীন জ্ঞানের মতো বসে আছে।

ভীষণ অশুভ আর কুৎসিত থেকে কবিতা তুলে আনে সেই খন্ডচিত্র যা বিশ্বজনীন।
গ্রীষ্মের দুপুরে মৃত কুকুরের দেহ দেখে বোদলেয়ার লিখলেন,

“আর্দ্র নারীর ধরনে শূন্যে পা দুটি তোলা,
    তাপে, ঘামে বিষ কীর্ণ,
লজ্জাবিহীন, উদাসীন ভাবে উদরখোলা,
বিকট বাষ্পে পূর্ণ। “( অনুবাদক : বুদ্ধদেব বসু)  

কুকুরটি এখানে নারীর রূপ। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে থাকা অজস্র যুদ্ধ ক্লান্ত নারী বললেও কবিতাটি এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

শিল্পকে কোনদিনও আঞ্চলিক দৃষ্টি নিয়ে দেখতে নেই। খুব ক্ষুদ্রভাবে কখনো শিল্প চর্চা হয় না। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজনসমূহকে যত বেশী স্পর্শ করা যায় তত মানসিক উত্তরণ ঘটে। কবিতার কাছে যাবো, তাহলে আগে যাবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর কাছে। তবেই এক মুহূর্তে বুঝে যাবো, কেন যেতে হয় কবিতার কাছে।

“শিশুর প্রথম হাসি শুরু হলে
তেতো ও মিঠা ছেড়ে যায় একে অন্যকে,
মহাসাগরীয়, অরাজকতার মধ্যে
খোলা সেই হাসির প্রশান্ত সীমা।

সবকিছু অপরাজেয় সুন্দর তার কাছে
খেলে সে, গরিমা নিয়ে ঠোঁটের কোনায়
বস্তুর অমেয় প্রকৃতিকে জেনে নেবে বলে
ধরে ফেলে রামধনুর প্রান্তের জোড়। “

( ওসিপ মান্দেলস্তামের কবিতা, অনুবাদ অমিতাভ কর)

কবিতা একটি অপরাজেয় শিশু, যাকে আমরা প্রত্যেকেই নিজের ভেতর বহন করে চলেছি। খুব ছোট থেকে ছড়া আমাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে আঘাত করে। এই যে খুব প্রচলিত ছড়াগুলো, কিন্তু ব্যাপক অর্থ নিয়ে বিরাজমান।

“খোকা ঘুমুলো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কি সে “
পরবর্তীতে শিশুটি বড়ো হয়ে গেলে যদি তাকে ছড়াটির সঠিক অর্থ ধরিয়ে দেওয়া যায়, যা একটি চুরান্ত অরাজক অন্ধকার সময়ের সুচিন্তিত সুলিখিত প্রতিফলন তবে সে ছড়ার প্রেমে পড়তে বাধ্য, সহজেই বুঝে যাবে কবিতা কতটা সর্বগ্রাসী ভাবে আশ্রয় করতে পারে সময়কে।
কিংবা, “ আগডুম বাগডুম ঘোড়া ডুম সাজে “,এখানে “আগডুম বাগডুম “ মানে হচ্ছে, আগে ডোম, পরে ডোম। ডোম, যারা সেইসময় ( এইসময়ও কি?  ) সামাজিক ভাবে অচ্ছ্যুৎ, তারা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অচ্ছ্যুৎ ছিল না, আগেও তারা, পরেও তারা। একটি তীব্র সামাজিক বিভাজনতার শিকার সেই জনগোষ্ঠীকে, হয়তো কোন এক ছড়াকার অবচেতন ভাবেই  ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন ছড়ায়।

সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ কিছুদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার জগতে, তিনি আকতার হোসাইনকে দেওয়া  তাঁর একটি স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আত্মগোপন কবির কাজ নয়, আত্মপ্রকাশই কবির কাজ। যদি আপনি ভালো লিখেন, তাহলে আপনি জানান দিন ...আছেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন যে এখন একজন বড় কবির আত্মপ্রকাশের সময় ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, তবে একসঙ্গে যদি সব তরুণই একই ধরনের ভালো লেখেন, তবে কবিতায় পুনঃপৌনিকতার সৃষ্টি হয়, মনে হয় একটি কবিতাই সবাই লিখছেন। তবে এর মধ্য থেকেই কেউ হয়ে উঠবেন ব্যতিক্রমী, আর সেই ব্যতিক্রমী কবিতাকে জানার জন্য আমরা কবিতার কাছে যাবো।

“রাত্রির গান গেয়েছিল এক নারী
আমার সাথেও ছিল কিছু পরিচয়,
এক হাতে রেখে আগুনের মতো শাড়ি
বলেছিল, ভীতু তোমারও কি আছে ভয়? “( আল মাহমুদ )

লাইন চারখানি বার বার পড়ি। কেন পড়ি, তার উত্তরে বলি  তারা সুন্দর।

“পুরুষ পাথর বটে কিন্তু যদি দশটি চুম্বনে
পাষাণ বিদীর্ণ হয়ে ভাস্করের কান্না হয়ে যায়
শিলার কাঠিন্য নিয়ে তবে আর স্বপ্নে জাগরণে
বলো কোন্ নদী আর প্রস্তরের বদনাম গায় “..
( আল মাহমুদ )

পড়লে একটি দৃঢ় নিস্তব্ধতা নেমে আসে তাই কবিতার কাছে যাই চুপ করে থাকার জন্য।
কবিতা আত্মক্ষরণের  মর্মান্তিক কাটাকুটি। প্রতিটি মানুষ সারা জীবন ধরে নিজের মধ্যে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখতে থাকেন,
এই কবিতাটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, শুধু বলা যায়,

“কী খুঁজে বেড়াচ্ছ তুমি সারাদেশ জুড়ে?
 রুটি, শুধু রুটি।

দিন নেই রাত নেই ঘুম নেই
খোঁজা শুধু খোঁজা

কী খুঁজে বেড়াচ্ছ তুমি সমস্ত জীবন?

ভালোবাসা শুধু।  “ ( ভাস্কর চক্রবর্তী)

এই অমৃত শ্লোকগুলো পড়বার জন্য আমরা কবিতার কাছে যাবো।

বসন্তসময়  চলছে, একটি প্রেমের কবিতা ছুঁয়ে যাই, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পেয়েছি। কবির নাম অনুত্তমা ব্যাণার্জী।

“প্রথমে নাকাল হবো, ধুলোবালি ঢুকে যাবে চোখে
নির্বুদ্ধিতা নিয়ে রসিকতা করে যাবে লোকে
কপালে দু:খ আছে - ইংগিত দেবে ঠারেঠোরে
মান সম্মান সব একে একে খোয়াবো বেঘোরে

শাস্তি ঘোষণা হবে, গর্দান যাবে রাজদ্রোহে
তবে না এসেছো প্রেম!
এসেছো তবে না
সমারোহে…”  

ফেসবুক থেকে আমরা আজকাল প্রাণভরে টেনে নেই এভাবেই কবিতার অক্সিজেন।

আমাদের মনে একটি মাটির উঠোন আছে, টুকরো জ্যোৎস্না, নিমগাছ রচিত ছায়া, তুলসীতলা, শঙ্খ আর আজানের ধ্বনি, সেখানে এক কথকঠাকুর বাস করেন, যিনি দুলে দুলে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েন, মেঠো সুরে,

“সূর্য্যবংশে দশরথ হবে নরপতি।
রাবণ বধিতে জন্মিবেন লক্ষ্মীপতি।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।
তিন গর্ভে জন্মিবেন এই চারি জন।।
সীতাদেবী জন্মিবেন জনকের ঘরে।
ধনুর্ভঙ্গ পণে তাঁর বিবাহ তৎপরে।।
পিতার আজ্ঞায় রাম যাইবেন বন।
সঙ্গেতে যাবেন তাঁর জানকী লক্ষ্মণ।।”

আর তা ছড়িয়ে যেতে থাকে আমাদের
রক্তমাংসে ছোট থেকেই।  সেজন্য কোনজীবনই কবিতাহীন নয়।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার শহরের হোটেল গুলোর নাম হোক, “ ডহরের ঘোর “ বা
“গহনের টানে “, রেস্টুরেন্টের নাম হোক
“সাতনরী হার “, লন্ড্রীটির নাম হোক, “রাজহাঁসের পালক “।
হতে পারে না   কবিতায় বসবাস ! কিংবা  কবিতার সঙ্গে বারোমাস?

"প্রকাশিত, "দৈনিক সংবাদ পত্রিকা "ত্রিপুরা

তথ্যসুত্র : বিভিন্ন বই, আন্তর্জাল এবং ফেসবুক



২০১৯

বাদামী খোলসে "২০১৯ "
..................................

ক্যালেন্ডারের তারিখ, ছুটির আমেজ, পিকনিকের গাড়ি, কাঁটাতার না মানা পরিযায়ী পাখির দল বলে দিচ্ছে শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০১৯, 
উল্টে পাল্টে দেখে নিই, ঝড়ের মতো গতিময় এই বছরটিকে। 
যে মানুষ কখনও রাজনীতি করেনি, রাজনীতির ঘোর প্যাঁচ কিছুই বুঝতে চেষ্টা করেনি, যাদের কাছে ভারতের সংবিধান একটি দুর্বোধ্য গ্রন্থ মাত্র, সেই ভারতের হাজার হাজার মানুষ আজ পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধানটি নিয়ে একটু মাথা ঘামিয়েছেন, বাধ্য হয়ে শুনতে চেয়েছেন, অন্ততঃ কিছু একটা জানতে চেয়েছেন। ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত এই ধারণা থেকে অন্ততঃ মুক্ত হতে পেরেছি আমরা, দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ২০১৯ পেরিয়ে এসেছি,  ২০২০ কি হবে জানা নেই, অথচ একটি গরম আঁচ অনুভব করতে পাচ্ছি। 
দুই একটি দশক ধরে মূলত কয়েকটি ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে, মাঝে মাঝে তাতে শান দেয় তাৎক্ষণিক কিন্তু আসলে তাৎক্ষণিক নয় তেমন কিছু ঘটনা। বছরের শুরুতেই আমরা বহুকথিত একটি কঠিন সমস্যার কালো ছায়া দেখেছি, যার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব জড়িত। সমস্যাটির নাম জল। ক্রমেই কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। শুকিয়ে যাচ্ছে ভারতের বড় বড় নদীগুলোর জলধারা। এক অভাবনীয় জলসঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ভারতের অন্যতম মেট্রোপলিটন সিটি চেন্নাই। আশংকা করা হচ্ছে অন্যান্য বড় বড় শহরগুলোও সম্মুখীন হবে জল সমস্যার। চারশ টাকা, পাঁচশো টাকা লিটার হয়েছিল জলের দাম সেখানে, অন্য রাজ্য  থেকে আমদানি করতে হয়েছে ট্রেনে করে । বিশাল ভারতবর্ষের খাদ্য শস্যের একটা বড় অংশ আসে পাঞ্জাব থেকে। সেই পাঞ্জাবের ভূগর্ভস্থ জলের পরিমান অনেকটাই নীচে নেমে গেছে। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষ অচিরেই জল নিয়ে বিরাট সমস্যায় পড়বে বা পড়ে গেছেই বলা যায় । 
সেইসঙ্গে গোটা পৃথিবী সাক্ষী থাকল পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত আমাজনের হাজার হাজার একর বনভূমি, পশুপাখি পুড়ে যাওয়ার এক নারকীয় দাবানলে। ২০১৯ বলে দিয়ে গেলো পরিবেশ নিয়ে ভাবো সারা পৃথিবী, সারিয়ে তোলো তার ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার।
 সামজিক, রাজনৈতিক,  অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে টালমাটাল ২০১৯ এর ভারত। 
আমাদের দেশে অবশেষে তিন তালাক নিষিদ্ধ হলো। ভালো জিনিসকে স্বাগত জানালাম আমরা। কিছু বিরোধ এবং পাল্টা যুক্তি তর্ক চললেও বলা যেতে পারে এটা অবশ্যই আলোর ঝলক।
আবারও ভারতীয় সংসদে চলল দীর্ঘ বিতর্ক, 
  স্বাধীনতা লাভের অনেকগুলো দশক পেরিয়ে কাশ্মীর থেকে অবশেষে উঠিয়ে নেওয়া হলো ৩৭০ ধারা। একটি দেশে দীর্ঘদিন ধরে যখন কোন নিয়ম চলতে থাকে তখন হঠাৎ করে সেই নিয়ম ভঙ্গ হলে লোকে ভয় পেয়ে যায়। দীর্ঘদিন কাশ্মীরবাসী ইন্টারনেট পরিষেবা পাননি। কাশ্মীরের বাইরের মানুষ জানতে পারেনি ঠিক কি ঘটছে কাশ্মীরে। তবে আগামীদিনগুলোতে ভারতের অন্যান্য রাজ্য গুলোর মতোই কাশ্মীর একটি স্বাভাবিক  রাজ্য হিসেবে তার অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে সবাইকে আরোও বেশি আকর্ষণ করুক তাই চাই। 
৩৭০ ধারা যদি একটি দেয়াল হয় তবে সব অর্থেই তা ভেঙে ফেলা হোক, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ থেকে বেরিয়ে আসুক আমার দেশ।

বহু বিতর্কিত আসাম এন আর সি এর চুরান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে এই বছরের ৩১ শে আগস্ট।  নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়লেন উনিশ লক্ষ মানুষ। দেশহারা মানুষদের নিয়ে সারা দেশ এখন উদ্বিগ্ন, বিচলিত, আন্দোলনতৎপর, পক্ষে বিপক্ষে আইনি বেড়াজালের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে, তো চলছেই। মানুষ স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের মতামত জানাচ্ছেন, জানাতে সাহস করছেন, এটাই বোধহয় প্রকৃত ভারত আত্মা। একসময় ভয় থেকে বেরিয়ে আসে জনগন, নিজেদের কথা বলে। 
একশ তিরিশ কোটির স্বপ্ন নিয়ে ২২ শে জুলাই পৃথিবীর চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদের মাটিতে এবং পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশ্যে শ্রী হরিকোটা থেকে রওনা দিয়েছিল ইসরোর তৈরি চন্দ্রযান-২। ৯৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতের এই প্রকল্প শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সাফল্যের  মুখ দেখতে পায়নি। সেপ্টেম্বরে চাঁদের মাটিতে সঠিক অবতরণ হয়নি ল্যান্ডার বিক্রমের । কিন্তু চন্দ্রযান -২ উৎক্ষেপণ নিয়ে জনসাধারণ বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেখা গিয়েছে প্রবল এক মহাকাশ উন্মাদনা। ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা সমস্ত খবর নিয়ে ছিলেন আপ টু ডেট। গ্রামের স্কুল থেকে শহরের স্কুল সবজায়গায় আলোচিত হয়েছে দুই হাজার উনিশের  চন্দ্রাভিযান। চন্দ্রযান -২ এর এই সাফল্যটিও কিন্তু কম উল্লেখযোগ্য নয়। 
একটি মন খারাপ করা খবরের পাশেই আসে ভালো খবর। আমরা যেমন পেলাম অর্থনীতিতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের যৌথভাবে নোবেল প্রাপ্তি। 
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করেছিল, ১৯৯০ এ চরম দারিদ্রে বাস করেছে ১৭৫ কোটি মানুষ, ২০১৫ তে তাদের সংখ্যা ৭০.২১ কোটি। এই অতি দরিদ্রদের এক বড় অংশ প্রায় অর্ধেকের বসবাস পৃথিবীর মাত্র দুটি অঞ্চলে নিম্ন সাহারা এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। কয়েক দশক আগেও বড় অর্থনীতিবিদরা এইসব ছোটখাটো কোন দেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, তারা জানতে চাইতেন " বিগ পিকচার ",তারপর উন্নয়ন সম্পর্কে নানান তত্ত্ব উঠে আসত এইসব ম্যাক্রো অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে। ২০১৯ এ অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন যে ত্রয়ী, তার মধ্যে রয়েছেন  অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, ওনার ফরাসী পত্নী এস্থার দুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার । উন্নয়ন ও দারিদ্রমোচনের বড় প্রশ্নগুলোকে তাঁরা ছোট ছোট ভাগ করে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেরিয়েছেন, এইসব ভ্রমণবৃত্তান্ত ও গরীবমানুষের জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে অভিজিৎ ও দুফলো লিখেছিলেন তাদের বিখ্যাত বই, "পুওর ইকোনমিক্স ",২০১১ তে, তারো আগে ২০০৩ এ তারা গড়ে তুলেছিলেন, "আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব, যেখানে আপাতত চারশো অর্থনীতিবিদ কর্মরত। এই অধ্যাপক দম্পতির নতুন বই " গুড ইকনমিকস ফর হার্ড টাইমস্ ",বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে তারা কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, যেখানে ভারত সম্পর্কে লেখকদের মন্তব্য, ভারতের মতো দেশের পক্ষে যা কাম্য তা হলো, "সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রকল্প "বা " Universal Ultra Basic Income "। 
যাই হোক নোবেলজয়ীদের মূল কাজ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশীরভাগই সঠিকভাবে অবগত নই। আমরা ভাসলাম আমাদের আবেগ নিয়ে, বাঙালিয়ানা নিয়ে, তার খাওয়া, থাকা, হবি এমনকি ওনাদের ব্যক্তিগত  জীবন নিয়ে রসালো আলোচনা করে। কোনো কোনো বছর আমাদের হাতে যখন এরকম একটি মূল্যবান, গর্ব করার মতো বিষয় উপহার দেয় তখন একটু সংযত আচরণ হলে হয়তো মূল বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

সত্তর বছর ধরে এবং তারও কয়েক শতাব্দী আগে থেকে চলে আসা ভারতের অন্যতম ঐতিহাসিক এবং বিতর্কিত অযোধ্যা মামলার রায়ও পেলাম এই বছরে। সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া এই রায় নিয়েও বহু বিতর্ক হচ্ছে, পক্ষে বিপক্ষে সওয়াল করছেন সাধারণ মানুষ। তবুও ভারতবর্ষের আর কোন মামলা নিয়ে বোধহয় খবরের কাগজ থেকে টি ভি চ্যানেল এতো রসদ পায়নি। ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতা, সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, বিশ্বের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি প্রশ্ন গুলোর সঙ্গে দিনের পর দিন জড়িয়ে থেকেছে অযোধ্যার রাম মন্দির বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ। 
 বলা যায়, ভারতবর্ষের মানুষ ক্ষোভ বিক্ষোভ, সাধুবাদ সমস্তকিছু দিয়েই সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া  রায়কে শান্তিপূর্ণভাবেই মেনে নিয়েছেন। 
বছরের শেষে নিষ্ঠুরতম ধর্ষণকান্ড সমগ্র দেশকে স্তম্ভিত করে কাঁদিয়ে দিয়ে গেলো। এরকম ধর্ষণ এবং হত্যা যে এর আগে ঘটেনি তা নয় তবুও ব্যাঙ্গালোররের তরুণী পশু চিকিৎসককে ধর্ষণ করে তারপর জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া প্রমাণ করলো সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন  সম্পূর্ণ আলাদা কিছু প্রাণী তৈরি হয়েছে যাদের মধ্যে নৃশংস পাশবিক প্রবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নেই। আর উন্নাও এর সেই মেয়েটি যে আগুন গায়ে নিয়ে দৌড়ে গেছে সে বুঝিয়ে গেছে ভারতের হৃদয় আসলে জ্বলছে ক্রমাগত। এই দহন থেকে কবে ভারতীয় নারী মুক্তি পাবে জানা নেই। 
আসছে ২০২০, আহা ভারত যদি ধর্ষণমুক্ত একটি দেশ হতো!  
ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় সারা ভারত শীতের আমেজ নিতে চাইলেও, ঠিক যেন কোথাও একটি অবিশ্বাসের বাতাবরণ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিক্ষোভ, এন আর সি, এন পি আর, ক্যা, এইসব নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠা হঠাৎ করেই যেন চেনা ছকটাকে বদলে দিচ্ছে। 
এদিকে সমীক্ষা বলছে ভারতে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব বেড়েছে।  অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে ভারতকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ)। এজন্য বর্তমান সরকারকে কয়েকটি নীতি বদল এবং সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতে এমন অর্থনৈতিক মন্দায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হিসেবে, ভারতের বাজারে পণ্য বিক্রির পরিমাণ হ্রাস, পুঁজি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও রাজস্বের পরিমাণ হ্রাসকে দায়ী করা হয়েছে।
বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশেই ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার আরও নিম্নমুখী হবে। ভারতে সেই হার হবে আরও বেশি নিম্নগতির, এরকমটাই আশংকা।
ভারত তার অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠুক, সাময়িক রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠে দেশের মূল সমস্যাগুলোর দিকে সবাই আরোও যত্নবান হয়ে উঠুক। আর সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যে সমস্যাটির করাল থাবা আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তা হলো পরিবেশ।  ক্রমাগত বৃক্ষসংহার মরুভূমির হাতছানি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মধ্যে একটি সবুজ খবর হলো, পরিকল্পনা করা হয়েছে, হরিয়ানার পানিপথ থেকে গুজরাটের পোরবন্দর পর্যন্ত ১৪০০ কি মি দীর্ঘ, ৫ কি মি প্রস্থ বিশিষ্ট এক গ্রীণ ওয়াল তৈরি করার, যেখানে লাগানো হবে হাজার হাজার গাছ, এই রিফরেস্টেশনের মূল উদ্দেশ্য অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলটিকে মরুভূমি হওয়া থেকে রক্ষা করা, কারণ ইসরোর বিজ্ঞানীগন এমন একটি আশংকার কথাই শুনিয়েছেন।
একটি ছোট্ট  সবুজ ফুসফুসের জন্ম মানেই পরিবেশকে ফিরে পেতে সামান্য পাপ সংশোধন, আশার কিরণ। 
প্রতিবছরই আমরা হারাই কিছু মানুষকে, যাদের বৈদগ্ধ্য আমাদের সমৃদ্ধ করেছে বহুকাল। যুগিয়েছে প্রাণের আনন্দ, বিষাদের সময় আমাদের হৃদয়ে তুলে দিয়েছে সরস, প্রাণবন্ত কিংবা চিরন্তন কাব্য পংক্তি। বহু খ্যাতনামা মানুষকে হারিয়েছি, বছর শেষে আমি দুজনের কথা বলব, প্রথম জনের কথা বলতে গেলে বলব তিনি হয়ত ভারতের নাগরিক নন, কিন্তু কবির কি সত্যিই কোন দেশ থাকে? কবিতা তো দেশ কালকে ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বত্র। 
তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ, ২০১৯ এর শুরুতেই ১৫ ফেব্রুয়ারি মাসেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন "সোনালী কাবিন "এর কবি আল মাহমুদ। তাঁর লেখা থেকে,

 "প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস৷"

আর ৭ নভেম্বর বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখিকা 
নবনীতা দেবসেন, তার "ভাল বাসা ", ছেড়ে আনন্দধামে নতুন ঠিকানায় পাড়ি দিয়েছেন, অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী সদা হাস্যমুখ এই লেখিকা আমাদের জন্য রেখে গেছেন বিরাট এক সাহিত্যসম্ভার। তিনি অনন্য সব রূপকথার গল্প লিখেছেন, যাতে আছে নিত্যনতুন কল্পনা, শিশুমনকে ভাবিয়ে তোলার,  জাগিয়ে তোলার স্বপ্নিল পৃথিবী । ২০১৯ এর এই শেষ সপ্তাহে এসে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষের মনে যেন সেই সরল শিশুভাবটি জেগে ওঠে, শিশুর মতো সহজভাবে বুঝতে পারে মানুষ মানুষের সমস্যা, ভারতকে কি তাহলে রূপকথার সেই দেশ বানানো যাবে, সুখী সুখী মানুষে ভরা, ঠিক যেন "আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই  রাজার রাজত্বে,
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি স্বত্ত্বে "। 

( প্রকাশিত, "স্যন্দন ")
@ চিরশ্রী দেবনাথ।

অনন্তলোকের সিম্ফনি

অনন্তলোকের সিম্ফনি ( গণিত দিবসের গল্প) 
.....

দূরে পাহাড়ের গায়ে যেন কিছু বরফ পড়েছে। এসব অঞ্চলে কোনোদিনই বরফ পড়ার মতো তাপমাত্রা হয়নি। তাই খানিকটা বিস্মিত হয়েছে গার্গী। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির। একটি অদ্ভুত শান্তি যেন এই মুহুর্তে । ঠিক এসবই আগামীকাল থেকে মিস করবে গার্গী।
বার কয়েক ভ্রমণে গার্গী বুঝতে পেরেছে  সেই নির্জনতা আর সেই নিস্তব্ধতাই সুন্দর যেখানে পাখির ডাক , ঝর্ণার উচ্ছল শব্দ বা কখনো কখনো হঠাৎ কোনো মানুষের বা বাচ্চার আওয়াজ থাকে। কারণ তখনই নীরবতাকে আঁকড়ে ধরা যায়। না হলে শুধুই বিষণ্ণতা ।
 পৃথিবীর বাইরে চলে গেলে সবকিছুই নিথর। এবার ঠিক কবে ফেরা হবে এটা এখনো জানে না গার্গী। 
সময়টা ২২৭৩ । 
গার্গীকে বর্ণনা করতে হলে প্রথমেই বলতে হবে তার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। চোখ খয়েরি রঙের। ঠোঁটের কোণে একটি হাসি সবসময়ই লেগে থাকে যা অন্তত বলে 
পদার্থবিদ্যা জটিল হলেও বোরিং নয়। 
সে সবুজ রঙের শাড়ি পরে আছে। আগামীকাল থেকে শাড়ি পরা বন্ধ এজন্য আজই শখ মেটাচ্ছে । গার্গী মূলত স্ট্রিং থিয়োরি নিয়ে গবেষণা করে। পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ চলছে। তাবড় তাবড় পদার্থবিদ এবং অংকবিদরা বুঝতে পেরেছেন যে মহাবিশ্বের মূল কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত অংক এবং মহাবিশ্বের প্রতিটি কণাই একটি সুনিদিষ্ট স্ট্রিং কোড দ্বারা নির্ধারিত। এইসমস্ত এনার্জি পার্টিকলস বা শক্তিকণাদের এনার্জি নির্ণয়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্টমান সহ ইনফাইনিট সিরিজের কথা কয়েকশো বছর আগে নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন রামানুজন নামে একজন গণিতজ্ঞ।
গার্গীর সঙ্গী  প্রফেসর বিদুর । যিনি বৈদিক ম্যাথমেটিক্স এবং আধুনিক অংকের ধারার একজন সফল সমন্বয়কারী।
গত সফরেও তারা পরস্পরের সঙ্গী ছিলেন। সেময়ই গার্গী লক্ষ্য করেছিল কয়েকটি কণার বিশেষ আচরণ যা তার গবেষণালব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে মিলছে না। এই পর্যায়ে প্রফেসর বিদুর বহু পরিশ্রমে কণাটির একটি খণ্ডিত অংশের ডি কোডিং করেন এবং আবিষ্কার করেন প্রাচীনকালের  সিরিজ যার নাম ফিবোনেসি সিরিজ সেটিই এই কণাটির ডি কোডিংএর ভিত্তি সূত্র   এবং তখনই তারা বুঝতে পারেন মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক কোড দিয়ে সিম্ফনির মতো পরিচালিত হয়। যার মধ্যে সামান্য অদল বদল করালে কী হবে সেটা তারা জানেন না। হয়ত ভয়ঙ্কর কিছু বা হয়ত দারুণ সুন্দর কিছু। কিন্তু সেই পর্যায়ে তারা আর পরীক্ষা নীরিক্ষা না করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন নিজেদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে।
 এখন আবার তারা যাত্রা করছেন গতবারের রহস্যের উন্মোচনে। 

আমরা আবার অনন্তলোকে যাত্রা করছি তাই তো? 
কিন্তু প্রফেসর বিদুর , অনন্তলোক মানে তো মৃত্যু তাই না!
সে তো আগে হতো। এখন অনন্তলোক মানে মহাকাশ হয়ত বা মাল্টিভার্স ।
হেই একটু দেখো তো?  
গার্গীর কথায় বিদুর সামনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন। আরো একটি মহাকাশযান ।আয়তনে তাদের থেকে অনেকটাই ক্ষুদ্র। কিন্তু এই এলাকায় তো কোনো ট্রাফিকের খবর ছিল না।
কে তিনি?  আমাদের পরিচিত কেউ?  
কিন্তু এখন তো সবাই বন্ধু তাই না?  শত্রুপক্ষ বলে কিছু নেই। আমাদের তো একটাই পৃথিবী।
তবুও একবার সংকেত পাঠাও। দেখো কেউ কথা বলে কিনা।
ওকে । 
সেই মহাকাশযানের গতিবেগ অত্যন্ত বেশি ।এবং দ্রুত হারিয়ে গেল স্ক্রিন থেকে। সংকেতের কোন রিপ্লাই এলো না। 
আর আসবেও না মহাকাশযানটিতে ছিল ডঃ লুকাস । সুন্দর ইউনিভার্সের একজন গোপন , অসুন্দর,  দক্ষ এবং মেধাবী শয়তান। যিনি স্ট্রিং থিয়োরি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন একটি ব্ল্যাক হোল  বোমা । যার মাধ্যমে পুরো মহাবিশ্বকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। যা এক বিপুল মহাজাগতিক যুদ্ধের অনভিপ্রেত সূচনা মাত্র ।

কিছুক্ষণ পর অপূর্ব একটি টিউন বেজে উঠল প্রফেসর বিদুরের রেডারে। বিদুর যেন একটু হাসলেন খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে।
ও ইয়েস । তুমিও সুইট হার্ট!
গার্গী অবাক হলো। আপাদমস্তক গম্ভীর এই গণিতবিদকে এতোটা লঘু ভাষায় কথা বলতে আগে কখনো শোনেনি গার্গী।
কিন্তু যতক্ষণ না বিদুর নিজে থেকে কিছু বলছে গার্গীও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ সংকেত বিনিময় হলো। সামনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল উজ্জ্বল রঙের আর একটি মহাকাশযান ।
এবার বিদুর গার্গীর দিকে তাকিয়ে বলল দুর্গা এসেছে।
একমুহূর্ত সময় লাগল গার্গীর। দুর্গা মানে এক  তরুণী  পদার্থবিদ। যাকে এখনও সামনাসামনি দেখেনি গার্গী। ছবি দেখেছে। এই তরুণ পদার্থবিদ  মাল্টি-ডাইমেনশন বিশেষজ্ঞ।
তিনি এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেছেন, যা ১১টি মাত্রার গাণিতিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতে পারে। 
ওর সঙ্গে কাজ করার জন্য অনেকদিন ধরেই বিদুর গার্গীকে অনুরোধ করছে কিন্তু কোথাও গার্গীর ইগোতে লাগছে ।তার দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কি কম পড়েছে যে অর্ধেক বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিদুর বোধহয় গার্গীর মনের কথা বুঝতে পেরেছেন ।
গবেষণায় তো বড় ছোট নেই গার্গী।
আমরা কিন্তু বিশেষ একটি রহস্য উদ্ধার করতে এসেছি।
এখনই দুর্গার সঙ্গে যোগ দিচ্ছি না গার্গী। ও নিজেই এসেছে ওর নিজের কাজ নিয়ে। তবে সাহায্য লাগতে পারে।
পরবর্তী কয়েকদিন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে কাটল।
গার্গী ও বিদুর একটি পরীক্ষা চালিয়ে একটি ক্ষুদ্র ভৌতিক ঘটনা তৈরি করল—একটি কণা মুহূর্তের জন্য স্থানান্তরিত করা হলো মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে। কিন্তু এটাই বিপদের সূচনা। স্ট্রিং কোডে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে মহাবিশ্বের এক অংশে সময়ের গতি থেমে যায়!
 গার্গী ও বিদুর সেই নিথর সময়ের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ে।
বিদুর এবং গার্গী বুঝতে পারে যে এই কোডকে সামঞ্জস্য করার জন্য তাদের স্ট্রিং কোডের পুরো কাঠামো বুঝতে হবে।  কিন্তু তার আগে নিজেদের বের করতে হবে এই সময় কয়েদ থেকে।
এক অনন্ত অন্ধকার খণ্ডের মধ্যে তারা বন্দি হয়ে আছে। কে কীভাবে উদ্ধার করবে তাদের ? কোনো সংকেতই কাজ করছে না। এই কি তবে তাদের অনন্তলোক।

মহাবিশ্বে যেসব স্থান "স্ট্রিং কোডে “র অসামঞ্জস্যের কারণে অস্থির হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো শনাক্ত করার জন্য একটি এআই-চালিত যন্ত্র , নাম "অ্যানোমেলি হান্টার", যা পরবর্তী বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে। এটাই তৈরি করে ডঃ দুর্গা সর্বাপেক্ষা আলোচিত একটি নাম এই মুহূর্তে ।
দুর্গার সঙ্গে থাকা যন্ত্রটি সেই মুহূর্ত থেকেই অস্থির সব সমীকরণ তৈরি করছে আর দুর্গা বুঝতে পারছে তাকে যে করেই হোক এর সমাধান করতে হবে। মনে হচ্ছে প্রফেসর বিদুর এবং প্রফেসর গার্গী কোন একটি বিপদে পড়েছে।
দ্রুত কোনো একটি অজ্ঞাত টাইমলুপ থেকে এদের বের করতে হবে।

হঠাৎ দুর্গার মনে হয় গার্গী তাকে পছন্দ না করলেও গার্গীর একজন ছাত্রী রয়েছে যে কোয়ান্টাম টাইমলুপ নিয়ে কাজ করে এবং একটি বিশেষ ইটারনাল ম্যাট্রিক্স আবিষ্কার করার পথে। পৃথিবীতে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো সলিউশন বের করা সম্ভব। যার মাধ্যমে সময়ের গতিকে সামনে বা পেছনে চালিত করা যায়।
স্ট্রিং থিয়োরি এবং ক্যালকুলাসের সমন্বয়ে ইটারনাল ম্যাট্রিক্সের সমাধান অবশেষে সম্ভব হয়। পৃথিবীতে গার্গীর ছাত্রী আশা সেই মাস্টার ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হয় এবং দীর্ঘসময়ের প্রচেষ্টায় বিদুর ও গার্গী ,দুর্গা ও আশার তৎপরতায় সময়কয়েদ থেকে বের হয়।
তারা বুঝতে পারে এই বিশেষ কোয়ান্টাম লুপ বা গাণিতিক প্যাটার্ন জটিল সমীকরণের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখতে হবে। না হলে হয়তো পৃথিবীর সব ভালো বিজ্ঞানী এবং  গণিতজ্ঞ দুষ্টদের দ্বারা সময়কয়েদ হয়ে যাবে।

এর জন্য তারা একটি গাণিতিক "মাস্টার ফর্মুলা" তৈরি করেন,  স্ট্রিং থিয়োরি এবং ক্যালকুলাসের সম্মিলন।

তাদের এই সমীকরণ ব্যবহার করে সময়ের থেমে যাওয়া প্রবাহ আবার সচল হয়।

অনিচ্ছা আর সম্ভব হলো না। মহাবিশ্বের ঘন আঁধারে দুর্গাকেই বন্ধু করতে হলো গার্গীকে।
শুধু হৃদয়ের একটি জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল যেখানে একটি  স্ট্রিংও তার অস্তিত্ব আর জাহির করছে না। কেবল ভ্যাকুয়াম।

আস্তে আস্তে, দুর্গা এবং গার্গী মিলে স্ট্রিং কোডকে ভেঙে ফেলার একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করে।
মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা শুধু স্ট্রিং কোড নয়, বরং নির্দিষ্ট একটি ফ্রিকোয়েন্সি বা "কোয়ান্টাম রেজোন্যান্স" অনুযায়ী আন্দোলিত হয়। যদি এই ফ্রিকোয়েন্সি বদলানো যায়, তবে কণাগুলোর আচরণও বদলে যায়।

আর  মাল্টি-ডাইমেনশনাল প্রিজম হচ্ছে
একটি বিশেষ যন্ত্র, যা ১১টি মাত্রায় (ডাইমেনশন) স্ট্রিং কোডকে আলাদা করতে পারে। এই যন্ত্রটিরও আবিষ্কারক দুর্গা।  

অপরদিকে গার্গী একটি তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন, যার নাম "ইটারনাল ম্যাট্রিক্স"
যার মাধ্যমে তারা সময় কয়েদ থেকে মুক্ত হয়েছেন। 
 এটি এমন একটি গাণিতিক সূত্র যা মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাকৃতিক নিয়ম (ভর, শক্তি, গতি) একটিমাত্র সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে।

আপাতত মহাকাশ থেকে ফেরার সময় হলো।
এতোকিছু ফলাফল পাওয়ার পরও গার্গীর মন ভালো নেই।
মহাবিশ্বের গবেষণায় সে নিজেকে আর সংযুক্ত রাখতে চায় না।
পৃথিবীর এক কোণে ছোট্ট বাড়িতে ফিরে যেতে চায় সে , যেখান থেকে সত্যিই কোনো অনন্তলোকে যাওয়া যায়।
 ইনফিনিটির রেজাল্ট বের করার ইচ্ছে আর তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

দুটো মহাকাশযানই আপাতত তীব্র গতিতে নীল গ্রহে ফিরছে।

শুধু একটি মহাকাশযান রয়ে গেছে হাজার নক্ষত্রের মধ্যে ।

ডঃ লুসাই সেখানে সূচনা করছেন এক মহাজাগতিক স্বৈরাচারের। 

#চিরশ্রীদেবনাথ 
#বাংলাগল্প 
#কল্পবিজ্ঞানেরগল্প 
#কল্পবিজ্ঞান 
#ছোটগল্প

chirasree Debnath

Chirashree Debnath: A Journey in Literature and Mathematics

Chirashree Debnath, a prominent literary figure and mathematician from the northeastern Indian state of Tripura, was born on February 12, 1979, in the small town of Kailashahar. Her father, Radhagobinda Majumder, was a Sanskrit scholar, and her mother, Mayarani Majumder, was a homemaker. Both her parents are no more. Chirashree completed her higher education in mathematics at Assam University, securing second place in her class. She currently pursues a career in teaching while passionately dedicating herself to writing.

From a young age, Chirashree exhibited a natural talent for storytelling, poetry, and essay writing. Her works are regularly featured in various little magazines and newspapers. Her contributions to literature have earned her numerous accolades, including:

Advaita Mallabarman Short Story First Prize (Government of Tripura)

Srot Sahitya Short Story Award

First Prize in Essay Competition (Government of Tripura's Information Commission)

Sumitra Kar Young Author Award (2019)


One of her short stories, "Barronfield," was adapted into a short film by Kolkata-based filmmaker Ratnadeep Roy. The film was showcased at the In Short Film Festival in Nigeria.

Editorial Work and Literary Beliefs
For over eight years, Chirashree has been co-editing a literary journal titled "Keenakal." She believes poetry is deeply intertwined with the soul and that it becomes an inseparable part of one’s existence.

Published Works
Chirashree has authored 18 books, including poetry collections, short story anthologies, novels, and children’s literature. Some of her notable works include:

Poetry Collections:

"Shadows of Clouds on Watery Afternoons" (2016)

"Through the Sunshades of Seasonal Change" (2016)

"In Love and Chaos" (2017)

"Good Afternoon" (2018)

"The Geometry Box and Casuarina Trees" (2018)

"Let It Fly Away" (2019)

"Bowing to Faith" (2019)


Story Collections and Novels:

"Mayarani" (2019)

"The Sun’s Blueprint" (2021)

"From the City of Mermaids" (2022)

"The Adventures of Jhilmar" (a children’s novel)



Recent Recognition
In 2024, Chirashree received the prestigious "Tripura Excellence Award in Literature" during the Mega Career Carnival.

Chirashree regards writing as the essence of her existence. As she once expressed, “The day my words cease to flow, I, too, will cease to exist.”

মহালয়া

মহালয়া মানেই দেবী দুর্গার আবাহন নয়

চিরশ্রী দেবনাথ

মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন নয় তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পিত়ৃলোক হিসেবে যা কল্পনা করা হয়,মহালয়ার দিন সেই পিতৃলোক থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিছুটা নিচে নেমে আসেন,  সেই সময় উত্তর প্রজন্ম তাঁদের উদ্দেশ্যে  তিল জল চাল বা জব অর্পণ করেন , পূর্বপুরুষরা তৃপ্ত হোন , সব মিলিয়ে যেন একটি মহান ও পবিত্রতম আলয় সৃষ্টি হয় যা থেকেই শব্দটি মহালয় । যে কেউ এইদিনে তার পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে পারে আর এই শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের অতি ক্ষুদ্র অংশের নাম হচ্ছে তর্পণ।
 মানুষ জন্মলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি ঋণের দ্বারা আবদ্ধ হয়। দেবঋণ,  ঋষিঋণ এবং পিতৃঋণ। কারণ প্রত্যেক ধর্মের মানুষই সাধারন
ভাবে মনে করে তারা   ঈশ্বরের সন্তান। অতএব এই জীবনলাভের জন্য ভগবানের কাছে ঋণী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যাগ যজ্ঞের মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি আমরা। ঋষিঋণ মানে গুরুর প্রতি ঋণ যা প্রাচীনভারতের তপোবন শিক্ষা থেকে শুরু করে এখনকার বিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত , বিদ্যা অর্জন , গুরুকে উপযুক্ত শ্রদ্ধা নিবেদন এবং গুরুদক্ষিণার মাধ্যমে এই ঋণ শোধ করার একটি আজীবনের প্রচেষ্টা থাকে আমাদের।  
 আর অবশ্যই জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর প্রতি মানুষের চির ঋণ। ওরা আমাদের শিশু থেকে যেভাবে বড় করেছেন বার্ধক্যে তাদেরকে আবার তা ফিরিয়ে দিতে হবে। আর আমাদের সুবিশাল পিতৃলোক,  মহালয়ার বিশেষদিনে  এটা শুধু
মাত্র বংশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট থাকেনা, লতায়পাতায় বিস্তৃত হয়ে সমস্ত মৃত আপনজনদের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয়। ‘মহ’ শব্দের প্রাথমিকভাবে  আরো একটি অর্থ রয়েছে।  ‘মহ’ বলতে বোঝায় পুজো বা উৎসব। তা থেকে ব্যুৎপত্তি করলে হয়  মহ+আলয় = মহালয় অর্থাৎ পুজো বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। তবে শব্দটিকে কেন স্ত্রীলিঙ্গ করা হলো এ নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কোন কারণ না থাকলেও যেহেতু অমাবস্যার আঁধার কেটে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয় কয়েকদিন পরেই , সেই আসন্ন উৎসবের কথা ভেবেই শব্দটিকে বলা হয় মহালয়া ।
 মহালয়া শব্দটির আরো কিছু বিশেষ অর্থ রয়েছে। এখানে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। যা ডাক্তারি পরিভাষায় মাল্টি অর্গ্যান ফেলিউর। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না বা ব্রেণ ডেথ হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই এই শব্দটিকে হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 
 ১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই মহালয়াকে দুর্গাপুজোর আবাহনের রূপ দেওয়ার কারিগর  বলা যায়।
বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 
আর একটি জিনিস যেটা হলো সেলিব্রেশন বা উৎসব। আমরা সবকিছুই আজকাল সেলিব্রেট করি। শিক্ষক দিবস থেকে শুরু করে, মহালয়া  এক ভয়ানক সেলিব্রেশন। কারণ মানুষ এখন শোক বয়ে নেবার মতো ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। তাই শোকের সঙ্গে মিশে যায় সেলিব্রেশন। 
মহালয়া প্রকৃতপক্ষে পরম শ্রদ্ধায় একান্তমনে পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের দিন। কিন্তু নদীবক্ষে যখন কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়ে এই কাজটি করে তখন তা ব্যক্তিগত থাকে না। ছড়িয়ে পরে। বহুজন একত্রিত হয়ে কোন কাজ করাটাই হয়ে যায় সেলিব্রেশন। আমরা তখন বলতে চাই শুভ মহালয়া ।
পূর্বপুরুষের প্রতি তর্পণ প্রদানের বহু গল্প আছে। তারমধ্যে একটি বিখ্যাত গল্প দাতা কর্ণের গল্প। এ দিয়েই শেষ করব লেখাটি । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে
বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।


এই পক্ষই পৃথিবীতে পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

তেমনি রামায়নে রাম দুর্গার পুজো করার আগে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন। কারন যেকোন ভালো কাজ করার আগেই পূর্বপুরুষকে
তৃপ্ত করতে হয়। এজন্যই শরৎকালে দুর্গার যে অকাল বোধন হয় তার আগে মহালয়ায় পিতৃ তর্পণ এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ বলে মনে করা হয়। 









মহালয়া

#মহালয়া দেবী দুর্গার আবাহন নয়
.........................

 এই প্রথমবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের 
“ আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর “ শুনলেই কেন যেন ভীষণ মনখারাপ লাগছে । শুনতেই ইচ্ছে করছে না । 
মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার আবাহনের যে সত্যিকার অর্থে কোনো যোগাযোগই নেই  অন্তঃস্থল থেকেই অনুভব করতে পারছি।
আসলে তো মহালয়ার সকালে বাজলো তোমার আলোর বেণু আসন্ন দুর্গাপুজোর সঙ্গে জোর করে সংযোগ করিয়ে দেওয়ার একটি নস্টালজিক সেতু মাত্র । সেই অর্থে শাস্ত্রীয় কোনো যোগাযোগ নেই মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর। 
 চারদিকে মেয়েদের ওপর এতো হিংস্র,  নিষ্ঠুর,  রূঢ় অত্যাচার শক্তি আরাধনার অর্থটাকেই স্থূল এবং মূল্যহীন করে দিয়েছে। 
বহু মানুষের রুটি রোজগার জড়িয়ে থাকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে শুধুমাত্র একারণেই পুজো হোক। আসলে তো কোথাও আলোর বেণু বাজছে না । মৃত্যুরূপী এক আসুরিক শক্তির কাছে মেয়েরা জন্মমাত্র পরাজিত হয়ে আছে। বহু কিছু জিতে নিতে পারলেও এখানে মেয়েদের হারতেই হবে। সেই মুহূর্তে তার দুহাতে কোন ধারালোো  অস্ত্র আশ্চর্য উপায়ে কোনদিনই গজিয়ে উঠবে না যার মাধ্যমে সে নিজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া অসুরকে বধ করে দিতে পারে। 

 মহালয়া শুভ অশুভের উর্দ্ধে  নত হওয়ার এক তীর্থসময়। পিতৃপক্ষ , মাতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে   শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার শ্রেষ্ঠতম দিন। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
শুভেচ্ছা জানানোর দিন তো  নয়ই ,  তবে শুভত্ব জাগ্রত করার দিন হতে পারে ।

মহালয়া শব্দটিতে মহা বা মহান মানে হচ্ছে ব্রহ্ম ,
সাংখ্য দর্শনে যখন অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্ত প্রকৃতির বিকাশ হয়, তখন জীব সত্তাকে কল্পনা করা হয় অনেকটা এভাবে , প্রথমে তার মধ্যে ব্রহ্ম বা বুদ্ধি বা মস্তিস্ক বা মেধা বা অহং এর সৃষ্টি হলো,  এই অহং মানে অহংকার নয়,  এই অহং মানে হচ্ছে অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শন “অহং ব্রহ্মাস্মি” , তারপর আস্তে আস্তে তার সমগ্র দেহ গঠিত হয় ক্ষিতি , অপ , তেজ, মরুৎ ও ব্যোম থেকে উপাদান গ্রহণ করে,সত্ত্ব, তমঃ এবং রজঃ গুণের সমাবেশে ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হয়, মানবশরীরের সম্পূর্ণ বিকাশ হয়, সৃষ্টি হয় মন বা হৃদয়,  ভৌতিক মায়া মমতার লীলাময় সত্তা। 
জীবনকালের পরিক্রমার শেষলগ্নে আস্তে আস্তে  
মৃত্যুর সময় আমাদের দেহের প্রবিলাপন ঘটে। 
একটি একটি করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল হতে থাকে। 
 কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্কের মৃত্যু হয় না  হয়না চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন না। এখানেই সেই আমিত্ব বা অহং বোধের সমাপ্তি হয়। আমরা আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাই বা পরম ব্রহ্মের মধ্যে লয় হয়ে যাই , মহালয় ঘটে আমাদের। ‘ মহ ‘শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘প্রেত’ । প্রেত মানে ভূত নয় । ‘প্র’ উপসর্গের সঙ্গে ই ধাতু যার সঙ্গে ‘ ত’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হলো ইত  অর্থাৎ প্রকৃষ্ট ভাবে যিনি গত হয়েছেন। আমাদের পারলৌকিক কার্যের সময় পুরোহিত বলেন ‘ অমুকস্য প্রেতস্য ‘ মানে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির আত্মা  । তাই প্রেত শব্দটিকে কখনই  হীন অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। 

মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ মানেই আমাদের তিনটি ঋণ আজীবনের সঙ্গী,  দেবঋণ, ঋষিঋণ আর পিতৃমাতৃ ঋণ। দেবার্চ্চনার মাধ্যমে দেবঋণ,  গুরু দক্ষিণার মাধ্যমে ঋষিঋণ বা শিক্ষকদের প্রতি আমাদের ঋণ আমরা কিছুটা হলেও শোধ করি। আর মাতা পিতার প্রতি যে ঋণ তা আসলে তাদের প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই আংশিক শোধ করা যায়,  তবুও তর্পণের মাধ্যমে হয়তো সেই অদেখা পুর্বপুরুষদের প্রতি জল তিল দান করে আমরা বাহ্যিকভাবে হলেও কিছুটা ঋণ শোধ করার একটি প্রয়াস চালিয়ে যাই। যদিও আমার মনে হয় বৃদ্ধ মা বাবার প্রতি কোনো কর্তব্য পালন না করে মৃত্যুর পর ঘটা করে শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করা অর্থহীন। 
 ধর্ম মানলে ঋণ শোধ করার শ্রেষ্ঠ দিন হচ্ছে মহালয়া । সেদিন  আমাদের সমস্ত পূর্বপুরুষেরা পিতৃলোক থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়  আর সেজন্যই সৃষ্টি হয় এক মহান আলয়ের,  তাই দিনটি মহালয় ।
কিন্তু আমরা তাকে স্ত্রীলিঙ্গ বা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত করি তার সঙ্গে আসন্ন  দেবীপক্ষের উৎসবমুখর যোগাযোগ রয়েছে একারণে বলেই মনে করা হয়। 
কারণ মহ শব্দের আর একটি অর্থ উৎসব। মহালয় মানে উৎসবের আলয়। 
রাম  রাবণকে যুদ্ধে হারাবার জন্য শরৎকালে দেবীকে অসময়ে অন্য তিথিতে আবাহন করেন। আর  আমাদের ধর্মে যেকোন বড় কাজের আগে পিতৃপুরুষদের পুজো করার বিধান রয়েছে। রামও দুর্গা পুজো করার আগে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন, সেজন্যও মহালয়ায় পিতৃপুরুষদের জন্য শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার ধর্মীয় রীতির সঙ্গে দুর্গাপুজো জড়িয়ে যায় । আর একটি বহুল প্রচলিত গল্প তো সবারই জানা,  দাতা কর্ণের গল্প।  কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্তের পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়। ধর্মরাজকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ধর্মরাজ বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। তা থেকেই তর্পণ নামের
অনুষ্ঠানটির সূচনা হয় হিন্দু ধর্মে , এটাও মনে করা হয়। 
 মহালয়া এবং তর্পণ এভাবেই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে দৈব এবং মানবিক সেতু বন্ধন রচনা করে।
১৯২৭ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বেতার কলকাতায় যোগদান করেন আর খুব সম্ভবত ১৯৩১ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া অর্থাৎ চণ্ডীপাঠ সহ সমগ্র আলেখ্যটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে । এই মহালয়া অনুষ্ঠান কিন্তু পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতেও করা হয়েছিল। তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 
কিন্তু যেদিন থেকে মহালয়ার দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ রেডিওতে বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে এই প্রজন্মের ভাষায় তা হয়ে গেলো চিরকালীন ভাইরাল । এতোদিনে যেন সঠিক সময় খুঁজে পেলো অনুষ্ঠানটি। আর সেই সঙ্গে কেমন  করে যেন মহালয়া তার পৌরানিক শাস্ত্রব্যাখ্যাকে ভুলিয়ে দেবীর বোধনে পরিনত হয়ে গেল। হয়ে গেল অনেকটা উৎসবের সূচনা গানের মতো মাঙ্গলিক । বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মহালয়ার ভোর , বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ আর দুর্গাপুজো এক লয়ে বেঁধে গেল। 

কিন্তু বহু দুঃখজনক  কারণের  সমাপতন ঘটে যাওয়ায় এবছরের দুর্গাপুজো উৎসব নয়,  উৎসব এবার একটি কাঠামো মাত্র , যার ওপর রঙ চড়ানোর তুলিতে হাত রাখতে আমার মন কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না। মহালয়ার সকালে চণ্ডীপাঠ এক দুঃসহ কালকুণ্ডলীর নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনে হচ্ছে শুধু।  পুজোর আগে যে মা বাবার কন্যা চিরতরে বিসর্জিত হয়ে গেল এক নারকীয় হত্যায়, তা ভুলতে পারছি না কিছুতেই।)

#চিরশ্রীদেবনাথ

ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ..আবহ ও প্রবহমানতা

চিরশ্রী দেবনাথ



ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ...আবহ এবং প্রবহমানতা 

......................................................



কবিতা, কোন একটি ভূখন্ডের সাহিত্য নির্যাস , সেই ভূখন্ডের আত্ম অভিমান। আলো ও আঁধারের ঐকতান নিয়ে কবিরা লিখে ফেলেন জনপদের সংগ্রাম ও ভালোবাসার কথা। কবিদের পৃথিবী একটাই। তবুও পাঠক সব কবিদের কাছ থেকে সতন্ত্রতা আশা করে। মনে করে কবিদের বক্তব্যে মিশে থাকবে বিশেষ কোনো অঞ্চলের আবেগ মুক্তির অপরূপ ব্যথা আর আনন্দের যুগ্ম প্রতিলিপি।

ভারতবর্ষের এক কোণে পড়ে থাকা এই প্রাচীন ভূখন্ডের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, অজস্র সাহিত্যপদাতিকের কলমে লেখা হয়েছে বিচিত্র কথকতা। কাব্য থেকে কবিতা হতে সময় লেগেছে বহুদিন, আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে কেটে গেছে অনেক বছর। কবিতার কোন শেষ কথা হয় না, তেমনি কোন কবিতাই পুরনো হয়  না।  কালজয়ী কবিতার ভাষ্য চিরদিনই নতুন এবং স্রোতের 

মুখে দাঁড়িয়ে থাকে  পর্বত চুড়োর মতো। তাকে পাশে রেখেই নতুন সময়ের কবিতা ভাসিয়ে দেয় তার 

সিডার কাঠের আড়ম্বরহীন মজবুত নৌকো, যা ঝড়কে বলে সঙ্গে আয়, প্রেম ও  যৌনতাকে দেখে পাখির তীক্ষ্ণ চোখে, খুঁটে খায় জঞ্জাল, ডানায় সোনালী রোদ পড়লে উড়ে যায় দিকচক্রবালের দিকে, যেখানে সূর্যদেব নিরন্তর গভীর ধ্যানরত। 

প্রথমে চলে যেতে হয় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদে। রাজন্য ত্রিপুরার এই অভিজাত জীবন স্রোত থেকেই শুরু হয়েছে ত্রিপুরার বাংলা কাব্যের পথচলা।  রাজ আমলের আখ্যান কাব্যগুলো এক একটি ঐতিহাসিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে সময়কার ত্রিপুরার জীবন, যুদ্ধ, সংগ্রাম, ধর্মীয় আচার আচরণ, রাজ্যশাসন, রাজভক্তি ইত্যাদি নিয়ে চিরাচরিত কাব্যছন্দে, সম্পূর্ণ ভাবে স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে রচিত হয়েছে। ত্রিপুরায় বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটতে আরম্ভ করে মহারাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য এবং রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের পর থেকেই। বীরচন্দ্রের নিজস্ব সাহিত্যকৃতির মাধ্যমেই সূচিত হয়েছে সহজাত 

কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রথম গীতিকবিতার বিস্তার। তিনি নিজের মনের চিন্তনকে কাব্যরূপ দিলেন। 

বীরচন্দ্রমাণিক্য ছয়টি কাব্য রচনা করেন, হোরি ,ঝুলন ,প্রেমমরীচিকা ,অকাল কুসুম ,সোহাগ ,উচ্ছাস ।এসব কাব্যগুলো মূলত গানের সংগ্রহ। বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর বাংলার শেষ বৈষ্ণব পদকর্তা নামে অভিহিত হয়েছেন। ত্রিপুরায় আখ্যান ও পাঁচালি রীতির কাব্যের ধারা ভেঙে দিলেন কবি বীরচন্দ্র।

মন্দ পওন  চুম্বত ফুল

     গন্ধ চহুদিশি ডারিয়া,

গুন গুন করু  মত্ত মধুপ 

পিউ পিউ বোলে পাপিয়া,

আমার গৌরকিশোর করু নবভাবে

   কতহুঁ নবীন ভঙ্গিয়া,

ঝুলতহি পহুঁ কতহুঁ ভাতি

সঙ্গে কতহুঁ সঙ্গিয়া 

বীরচন্দ্র মূলত ব্রজবুলি  মৈথিলি, ও বাংলাতেই তার পদগুলো রচনা করেছিলেন।

বীরচন্দ্র কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী। জন্ম আঠারশো চৌশট্টিতে।  তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, প্রথম কাব্য 'কণিকা ', দ্বিতীয় কাব্য 'শোকগাথা ' তৃতীয় কাব্য 'প্রীতি '।প্রকৃতির সঙ্গে আপন অনুভবের সংমিশ্রণের কাব্যময় প্রকাশ ঘটে তার লেখায়।  মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এই নারী ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাহিত্যচর্চা, শিল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে  মানসিকতা সমৃদ্ধ করেছেন , কবিতায় নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিক জগতকে খুঁজেছেন, সুললিত ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। আধুনিক আলোচকদের বেশীরভাগেরই অভিমত, রাজগী ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী। সমসাময়িক কবি, সভাকবি মদনমোহনমিত্রের কন্যা কুমুদিনী বসু, ছিয়াশিটি কবিতা নিয়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ আভা ঢাকা গেজেট ও সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিল। রাধাকিশোর তনয় নরেন্দ্রকিশোর দেববর্মণের ভাবসমৃদ্ধ কবিতা এবং সঙ্গীতও সুখপাঠ্য। অনঙ্গমোহিনীর কবিতায় কবিতা আস্তে আস্তে বাস্তবের জগতে পা বাড়িয়েছিল, চলে আসে চল্লিশের দশক, রাজ পরিবার থেকে সতন্ত্র কবিতাধারার সূত্রপাত। স্বাধীনতা পূর্বোত্তর ভারত, অস্থির সময় ইত্যাদি মিলেমিশে অনঙ্গমোহিনীর পরবর্তী কালে অনেকদিন ত্রিপুরার কাব্যজগতে তেমন কেউ আসেনি।

বা যারা লিখেছেন বেশীরভাগই গীতিকবিতার অনুসারী, ব্যক্তিগত বিলাপ কিংবা অলস মেদুর জীবনের হাতছানি। কিন্তু সেইসময় বাংলা কবিতার রূপ বদলে যাচ্ছিল দ্রুত। অথচ ত্রিপুরা আধুনিক কবিতার সুর থেকে তখন পর্যন্ত ছিল  বিচ্ছিন্ন, তাই আধুনিক কবিতাচর্চার ইতিহাস ত্রিপুরায় খুব বেশী প্রাচীন নয়। বৃহত্তর বঙ্গসমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এইসময়ের ত্রিপুরার সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বাঙালিদের ঢল। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপও ততটা প্রভাব ফেলেনি এ রাজ্যের অরণ্যলালিত নিস্তরঙ্গ অলস জীবনপ্রবাহকে। তবুও এই সময়ের কিছু দুর্বল কারিগর যা আধুনিক কবিতার বীজ ধারণ করতে শুরু করেছিলেন তারা হলেন অজিতবন্ধু দেববর্মণ, নুরুল হুদা, সমাচার চক্রবর্তী, বিধূভূষণ ভট্টাচার্য, মণিময় দেববর্মণ, অশ্বিনী আঢ্য, আব্দুল মতিন প্রমুখ। ষাটের দশক, রবীন্দ্রভাব, বৈষ্ণবকাব্যের ললিতময় বিভঙ্গ পেরিয়ে যে যুগসন্ধির কবিরা পদার্পন করলেন তাদের প্রচেষ্টার সফল রূপায়ন দেখা যায়, প্রান্তিক ( ১৯৬২) ত্রিপুরার প্রথম কবিতা সংকলনে । রণেন্দ্রনাথ দেব, বিজনকৃষ্ণ  চৌধুরী, সলিল কৃষ্ণ  দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, সত্যব্রত চক্রবর্তী, প্রদীপ চৌধুরী, কিরণশঙ্কর রায়, অশোক দাশগুপ্ত, প্রবীর দাস প্রমুখ। ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় সলিকৃষ্ণ  দেববর্মণ, জোড়ালো সতন্ত্র স্বর। কবিতা তার কাছে সচেতন নির্মান নয়, তিনি কবিতাকে বলেছেন, উদ্বুদ্ধ অবস্থার শব্দভাষ্য। ১৯৭৩ সালে, কবি স্বপন সেনগুপ্তের সম্পাদনায় বের হয়, গুরুত্বপূর্ণ একটি কাব্য সংকলন, দ্বাদশ অশ্বারোহী । 

ষাটের দশক এবং সত্তরের দশক থেকেই ত্রিপুরার বাংলা কবিতার নিজস্ব রূপটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এই সময়ে যারা বিশিষ্ট ভাবে নিজেদের চেনালেন, খুব অল্প কয়েকজনের নাম বলছি, কল্যানব্রত চক্রবর্তী, পীযূষ রাউত, শঙ্খপল্লব আদিত্য, স্বপন সেনগুপ্ত, নকুল রায়, দিব্যেন্দু নাগ,অসীম দত্ত রায়,  সমরজিৎ সিংহ, প্রমুখরা।  মহিলাদের মধ্যে অপরাজিতা রায়, করবী দেববর্মণ, সুনীতি দেবনাথ, শক্তি দত্ত রায়।    কারো কারো কবিতা এইসময়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কখনো কখনো সে ব্যঞ্জনাহীন রাজনৈতিক বিবৃতি কিংবা প্রচার, আবার ঘৃণা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, প্রতিরোধ, স্থানিকতা  সমস্ত আবেগই তুমুল ভাবে চলে এলো ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় । 

এই সময়কালে ত্রিপুরার বাংলা কবিতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নকশাল ও হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে কবিতায়, অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন এই আন্দোলনকে তাঁদের লেখালেখির মাধ্যমে। তবে  তাৎক্ষণিক উন্মাদনা কবিতার গায়ে সময়ের ছাপ রাখলেও, অনেক কবিসত্ত্বাকে বিভ্রান্ত এবং বিপর্যস্ত করেছে, তাঁদের নিজস্ব কবিতার ভাষা পরিবর্তিত হয়ে অন্যের কাছ থেকে ধার করা আঙ্গিক নিয়ে দুর্বলতর এবং কৃত্রিম হতে হতে হারিয়ে ফেলেছে সজীব কবিতার ভাষ্য।  

গ্রুপ সেঞ্চুরী কাব্য আন্দোলন, ত্রিপুরার কবিতাকে বিভিন্ন রূপ ও সত্তা দেয়। 

গ্রুপ সেঞ্চুরি আন্দোলন ছিল একটি সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। কবিতাকে আত্মায় স্থাপন করে  করে চিত্রকলা, সংগীত, ভাস্কর্য, নাটক  সব কিছুর মাধ্যমে প্রতিটি শিল্পী যাতে প্রাণখুলে নিজের শিল্পসত্ত্বার উন্মোচন করতে পারে সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলন ছিল ইস্তেহার বিহীন।

এইসময় ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে থাকে। বাম আন্দোলন তখন চুরান্ত পর্যায়ে। কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক অভিঘাত আসে। তারপর আবার নতুন শাসনকালের প্রবর্তন এবং লেখক শিল্পীদের বক্তব্যকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা। কবির স্পর্ধাকে দমিয়ে রাখার চিরাচরিত প্রয়াস। যদিও কবি মাত্রই এই দাবিয়ে রাখার কৌশলের বাইরে রক্ত পলাশের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠেন। তাই তিনি যুগ নির্নায়ক।  

১৯৮০ র উগ্রপন্থী বিধ্ধস্ত ত্রিপুরা, দাঙ্গা, নকশাল ভাবধারা, প্রাপ্ত স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের হাভাতে চেহারা, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে কবিতা চলতে লাগলো।

সত্তরের প্রবহমানতা এবং আশির দশককের অস্থিরতাকে যারা কবিতায় ধারণ করেছেন তাদের মধ্যে  উল্লেখযোগ্য কবিরা, হলেন, সেলিম  মুস্তাফা, অমিতাভ কর, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, দিলীপ দাস,  কিশোররঞ্জন দে, সন্তোষ রায়, লক্ষণ বণিক, সুবিনয় দাশ, শুভেশ চৌধুরী  এবং আরো অনেক।

ভারতীয় পুরাণ, বেদ, দর্শনতত্ত্ব , চতুর শব্দ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার ইত্যাদির ঘনঘোর নিয়ে কবি মিলনকান্তি দত্ত, সমাজ সময়ের বিশ্লেষণ, পুঁজিবাদ, নিরাবেগ শৈল্পিক সুষমা, তীব্র শ্লেষ অথচ সুগভীর অনুচ্চ স্বর নিয়ে কবি পল্লব ভট্টাচার্য।  কবি মণিকা বরুয়া, পাঞ্চালী দেববর্মণ, মাধব বণিক, রসরাজ নাথ, সুজিত দেব, রত্নময় দে, প্রত্যুষ দেব, বিশ্বজিৎ দেব, হিমাদ্রী দেব,  সত্যজিৎ দত্ত, অলক দাশগুপ্ত প্রমুখ,তাঁদের লেখা অসংখ্য কাব্য গ্রন্থ এবং সংকলন আমাদের সম্পদ। 

নব্বইয়ের দশকে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা বিষয়ের বিভিন্নতায়, পরিবেশনের সৌকুমার্য ও তীক্ষ্ণতায় ছুঁয়ে গেছে মানব জীবনদলিলের সমস্ত সীমা এবং অন্তহীন পরিসীমার মেধাবী দিগন্ত। এই দশকের উজ্জ্বল নাম  অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, প্রদীপ মজুমদার, কাকলী গঙ্গোপাধ্যায়,   স্বাতী ইন্দু,  বিধাত্রী দাম, সুতপা রায়,  অশীন বর্মণ, জাফর সাদেক,আকবর আহমেদ, পদ্মশ্রী মজুমদার, প্রীতি আচার্য, শিউলি শর্মা প্রমুখ।

উদার অর্থনীতিবাদ, বিশ্বায়ন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ, উগ্র ধর্মীয় মতবাদ, সাম্প্রদায়িকতার নতুন রসায়ন, দিশাহীন তরুণ প্রজন্ম, চরম বেকারত্ব, অন্ধকার এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকা নিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি একবিংশ শতকে। ত্রিপুরার কবিতা এই সমস্ত কিছুকে প্রত্যেক মুহূর্তে ধারণ করে  আরোও অনেক বেশি উজ্জ্বল  এবং বৈচিত্র্যে ঝলমল  হয়ে উঠছে, কবিতার আকুতি আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন যুগের আহ্বানে  । শূন্য দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের প্রথমভাগে ত্রিপুরার বাংলা কবিতা পৌঁছেছে  বিশ্বমানে। এই যে আলোকময় বিস্ফোরণ, আমরা এই সময়ে যারা লিখছি, তারা চাই না কখনো এর শেষ হোক। অভিঘাত এবং ভাঙচুরের আশ্চর্য সম্মেলনে ত্রিপুরার বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সময় হোক চিরপ্রবহমান । ত্রিপুরার সাম্প্রতিকতম কবিতা চর্চার কথা বলব আমি। বর্তমান সময় যেভাবে দগ্ধ করছে কবির হৃদয়কে, কবিতা তো সেই রক্তাক্ত অক্ষরের মেঠো সুর। 

কবিতা কোন সংগঠিত শিল্প নয়, সমস্ত সংগঠন আর সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়ে যেখানে বিপন্ন সংঘাত আর প্রেমের সুর বেজে ওঠে সেটাই কবিতা।

"দেহের অসুখ জানালা খুলে চাঁদ দেখতে বেরোয় / খুব একা হয়ে গেলে পড়ে ", ( অনিরুদ্ধ সাহা)  ত্রিপুরার এই সময়ের এক  তরুণ কবির কবিতার লাইন, এই পংক্তি দিয়েই প্রবেশ করব আমরা একবিংশ শতকের অস্থির, বিষাদাচ্ছন্ন কবিমনের ব্যাকুলতার কাছে।

"মানুষ বাড়িতে না থাকলে গাছ

মানুষ বাড়িতে না থাকলে পাখি

বনের গন্ধ ছড়িয়ে যায়

দীর্ঘদিনের মঞ্জুরীর ক্ষুধা

আগ্রাসী হয়ে উঠে

কতদিনের প্রতিশোধ "( অভিজিৎ চক্রবর্তী) 

কবিতার কথা লিখতে বলেন অনেকেই। আসলে যে কবিতার কাছে এলে নীরব হয়ে যায় মন, সেই কবিতার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ত্রিপুরার শূন্য দশক বা প্রথম দশকের কবিতার মধ্যে স্নিগ্ধতা বেশি। শ্লেষ বা বিদ্রুপের তেমন কালোয়াতি দেখা যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। হয়তো সেই আততায়ী ছোরা অন্যভাবে কবিতায় এসেছে,

"রিক্সায় কোনো আয়না থাকে না

কেউ কেউ পরে লাগান

পেছনে আসা গাড়ি দেখতে নয়

পেছনে বসা যাত্রী দেখতে

যখন ছোরা মারেন পেছন থেকে কেউ

তখন তাঁদের চেহারা যেমন হয়

অনেক রিক্সাওয়ালাই সেটা দেখতে ভালোবাসেন। "( অভিজিৎ দাস) ।

এক আজব মহামারী আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, গভীর ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার স্তব করছে পৃথিবীর নতুন তরুণটি,

"ডিপ্রেশন এক বুদ্ধিজীবী রোগ।

ক্রমাগত আমরা হেরেই যাই শুধু

ক্রমাগত নিরর্থক জিতেই যাই আমরা

সমস্ত জয় ও পরাজয়ের সম্মিলিত যোগফল    

নিয়ে আমরা ক্রমশ নীল হতে থাকি। '( পার্থ ঘোষ ) '।

বিশ্বাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বিষসিক্ত তির চলে যায়, তার পাশ থেকে কুড়িয়ে আনা কবিতা,

"বিশ্বাসেরও বয়েস হয়েছে ঢের

ঝুলকালিতে মাখামাখি এখন

আমরাও এসে দাঁড়াই কার্নিশে

অন্ধকারে হাতে হাত রেখে,

নিজেরা বলাবলি করি

বুকের ভেতর একটা আস্ত সূর্য

জ্বলে উঠতে

আর কতটা সময় বাকি? " ( শঙ্খ সেনগুপ্ত)  

ত্রিপুরার একজন নবীনতম কবির কবিতা থেকে,

"কী খোলা খোলা আঙুল তোমার আজও

মধ্যমায় ছড়িয়ে রাখে

পুরনো হাওয়াকল! 

নিষাদ বয়ে এনে কোমল গান্ধর্ব,

মূর্ছনা, মেতেছিলো তেমনি

অঙ্গনবাড়ির জানালা ..."( সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য )। 

 অঙ্গনবাড়ির জানলা দিয়ে কবিতা ঢুকে পড়ল আমার শৈশবে, এটাই অসাধারণ লাগল আমার। 

ত্রিপুরার কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের তরুণ গবেষক, অভিজিৎ চক্রবর্তী বলেছেন,

"নাগরিক জটিলতা, ত্রিপুরার কবিতার কখনোই মূল স্বর নয়। স্থানিক ভূগোলের যন্ত্রণা, ক্ষোভ, টানাপোড়নের চাইতেও প্রকৃতির অসীম ব্যাপ্তি বা উদারতার ভিতর দিয়ে ত্রিপুরার কবিতা বিকাশ লাভ করেছে। "

আসলে একদিকে উদ্বাস্তু মানসিকতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ভয়, ত্রিপুরার কবিদের স্পষ্টবাদিতায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তাই কবিতায় এসেছে ভাষার সৌকর্য, ভাব, নান্দনিকতা ইত্যাদি।

আমরা পড়ব ত্রিপুরার কবি মৃণালকান্তি দেবনাথের একটি কবিতা,

"আমাদের বাড়ির সামনে কোন শমীবৃক্ষ ছিল না। যার নীচে এসে বসতে পারেন বোধিসত্ত্বের মতো প্রাজ্ঞ তরুণ। তবে পেছনে ছিল ঝিঁঝি ডাকা কাঁঠালবাগান। যেখানে হলুদ চোখের তক্ষক শিশুদের স্কুলের, ঘুমোবার সময় ইত্যাদি অ্যালার্ম ঘড়ির মতো মনে করিয়ে দিত। বিল ক্লিন্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যখন পোখরানের জবাবে পাকিস্তান পরমাণু বোমা বানালো তখন আমরা বড়ো হচ্ছিলাম। আসলে সুদের হার কমা বাড়া, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এসবে শিশুদের কোনোদিন কিছু যায় আসেনি "।

পঙ্কজ বণিক,  রাহুল সিনহা, চিত্তরঞ্জন দেবনাথ, মৌলিক মজুমদার, প্রাণজয় সিনহা, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, বাপ্পা চক্রবর্তী, গোবিন্দ ধর, সুমিতা ধর বসু ঠাকুর, অর্পিতা আচার্য, দেবাশ্রিতা চৌধুরী, মন্দিরা লস্কর, রিয়া দেবী, অভীক কুমার দে, হারাধন বৈরাগী, শুভ্রসংকর দাশ, পায়েল দেব, জেরী চন্দ, সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য, দেবাশীষ চৌধুরী, মুনমুন দেব, প্রিয়তমা দত্ত, অনুরাগ ভৌমিক,  অমলকান্তি চন্দ আরোও প্রমুখ।  এইমাত্র যাদের কথা বললাম, তারা সবাই কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ের লেখক নন, কেউ কেউ অনেকদিন আগে থেকেই লিখছেন, এখনো লিখছেন আবার কেউ সদ্য লিখছেন। এই প্রজন্মের কবিদের কাছে ধরা দিয়েছে লেখার গলিত লাভা।যারা একইসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে পরিযায়ী মানুষের গৃহহীনতা। দেখতে পাচ্ছে দীর্ঘদিন একটি দেশে বাস করলেও মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না আসলেই তার কোন দেশ আছে কী নেই। কখনো পার্শ্ববর্তী দেশ অথবা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে  আসা অসহায় রিফিউজির দল বাস করতে বাধ্য হচ্ছে আর একটি ভূখন্ডে। তাদের সন্তানসন্ততিদের শৈশব, যৌবন কেটে যাচ্ছে শরনার্থী শিবিরে। ত্রিপুরার বর্তমান বাংলা কবিতা এসব দেখছে, লিখছে, তাদের পূর্বসূরীরাও লিখেছিল অতীতকে, আজ আবার অনিশ্চিত বর্তমান আমাদের সামনে।

এই নিয়ে নতুন করে ত্রিপুরার সৈকত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হল, "দেশভাগের কবিতা " পড়ব কিছু লাইন এই বইটি থেকে।

কবি তমা বর্মনের কবিতায়, 

"রাষ্ট্রের করপুটে গণকবর বিছিয়ে শুয়ে আছে উনিশ লক্ষ জীবন, পরিচয় পত্র, 

স্বদেশপ্রীতির প্রতিটি যুদ্ধাক্ষর থমকে বঙ্গবুকে অপমানে

সংলাপে ছয়লাপ রাজতন্ত্র প্রপিতামহের সমাধির পাশে

ধ্বনি দিচ্ছে কারা 'ওরা আমরা '!"

"কবি সুমন পাটারী লিখেছেন,

"বরাক আর ব্রহ্মপুত্রের তীরে

উনিশ লক্ষ ভোটার

উনিশ লক্ষ তারার মাস্তুল থেকে

উনিশ লক্ষ দড়ি ঝুলিয়ে

আত্মহত্যা করেছে এক রাতে

কারণ রাষ্ট্র তাদের ভূমি ও দড়ি ঝুলানোর গাছ থেকে উচ্ছেদ করেছে রাতারাতি। "



আমরা যাচ্ছি বৈশ্বিক অতিমারীর মধ্যে দিয়ে। পেনডেমিক আমাদের সমস্ত অহংকারকে চূর্ণ করে দিয়েছে। লকডাউনের দিনগুলোতে মানুষ নিজেদের বিষাদ অতিক্রম করতে গান বেঁধেছে, কবিতা লিখেছে। সৃজনশীলতার কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে আত্ম উন্মোচন করতে চাইছে। এই আবহে রচিত হয়েছে প্রচুর কবিতা। সৈকত প্রকাশন পেনডেমিকের সময়কালকে ধরে রাখতে আরো একটি কাব্য সংকলন বের করেছে, "কোরনাকাল "।সেখান থেকে কয়েকটি পংক্তি উচ্চারিত হোক। 



"রক্তে বাঁধানো শ্রমিকের পা,

উচ্ছ্বাসের মতো বহুল প্রচারিত মৃতদেহের কাছে শিশুটি কাঁদে,

তার একমাত্র প্রজাপতিটি হারিয়ে গেছে বলে "।( আম্রপালী দে)।



"একটা পৃথিবীর দু 'চোখেই কোরোনার ভয়!

আরেকটি পৃথিবীর ভয় ত্রি নয়নে

এক চোখে কোরোনা আরেক চোখে ক্ষুধার ছোবল

আর তৃতীয় চোখে রাষ্ট্রীয় লাঠি!  '( সঞ্জীব দে)  '।



হঠাৎ করে এই  ধারাবাহিক মৃত্যু মিছিল আমাদের কেমন যেন সংকুচিত, ভয়ার্ত করে দিচ্ছে। আর্তনাদ হারিয়ে বুক ঠেলে উঠে আসছে কেবল অস্ফুট শব্দ অনর্গল। 



"আমাদের কথা হয়েছিল মহামারীতে

আমাদের সাক্ষীর ভার নিয়েছে এই পেনডেমিক

আমরা কথা বলার ভার পাখিদের দিয়ে নির্ভার থেকেছি

আমরা নিস্তব্ধ হওয়ার অনুভব মহামারী থেকে নিয়েছি

আমাদের শরীর স্পর্শ করে গেছে সমুদ্রের জলো হাওয়া

আমাদের প্রিয় আগুন হওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নিষ্ঠুর খবর

আমাদের ব্যথার ইতিহাস খেলো হয়ে গেছে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার কাছে

আমরা ক্রমাগত তুচ্ছ হয়ে গেছি মহামারীর কাছে ...( চিরশ্রী দেবনাথ )।



সৃজন হলো প্রবহমানতার ধারক ও বাহক। পৃথিবীর বুকে যত যুদ্ধ, যত মৃত্যু, যত অসুস্থতাই আসুক, মানুষ কবিতা লেখা    বন্ধ করবে না। মানুষ ভালোবাসবে, কবিতা  লিখবে, চারপাশ থেকে কুড়িয়ে আনবে সময়ের বিচ্ছুরিত স্তোত্র, ত্রিপুরার কবিতা, ত্রিপুরার মানুষের সম্মিলিত সত্তার বাস্তব প্রতিফলন, যার মধ্যে রহস্যবিস্তারের জন্য ঢুকে পড়েছে মেখলা চিতার ক্ষিপ্রতা, নাগকেশরের গন্ধ, পাহাড়ী ছরার মুখরতা।



কবি তমালশেখরের একটি কবিতা  দিয়ে আজ ইতি টানব এই লেখার,

" দারিদ্র বিলাস " কবিতার নাম। 



"ভাঙা দেওয়াল -

আরো একটু ভেঙে দিয়ে

দেখছি চাঁদ। "

এই বিপন্ন ঝুলন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হতে থাক ত্রিপুরার  বাংলা কবিতা।