রাঁধুনি

৭:৩৩ PM চিরশ্রী দেবনাথ 3 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ


রাঁধুনি 


কাছাকাছি বাড়ি থেকে ঝাঁঝালো ফোড়নের গন্ধ এলো, বিছানায় শুয়ে শুয়ে  বিরাশি বছরের নিত্যসুন্দরী , সংক্ষেপে নেতার মা অস্ফুট স্বরে বলে উঠল ভুল ভুল, সম্বরায় গলদ আছে, মনে হয় পাঁচফোড়নে সর্ষে , তেলে আবার পেঁয়াজ দিছে, এই  সম্বার, বিষ...বিষ। 

বুড়ির মরতে আর বেশি বাকি নেই, এখনো বেড়ালের মতো ঘ্রাণ, ঘর মুছতে মুছতে নিজের মনে আওরালো নেতার মার ছেলের বউ।

নাহ্ ছেলের বউ খারাপ নয়, তবে মুখ বড় চোপা। 


কিছু বছর আগেই তো, 

সূর্য বড় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছটার ওপর তেরছা করে সকালের আলো ফেলেছে, লোহার বড় গেটের সাইডের দরজা দিয়ে দত্ত বাড়িতে ঢুকে গেছে নেতার মা। বড় মা সবে রান্নাঘরে স্নান সেরে এসেছেন ,

চায়ের কেটলী বসিয়েছেন, এই নিয়ে দুবার। নেতার মা, ছাতাটা রাখল, বাড়ি থেকে পরে আসা কাপড়টা পাল্টে আগের দিনের কাচা কাপড় পরে, পা হাত ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।

বড় মা এক গ্লাস চা আর একবাটি মুড়ি দিয়ে বললেন, আগে গালে ফেল, তারপর লাগিস কাজে। 


 বাজারে গেছে বাড়ির মেজ ছেলে আলোকেন্দ্র, সঙ্গে টোপর। টোপর হলো ছুটকা ছেলে। ছয় বছর বয়সে মা বাবা হারানো ছেলেটিকে রাস্তায় ভিক্ষে করতে দেখে তুলে এনেছিলেন বড়দাবাবু। লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, হয়নি, বড়ই চঞ্চলমতি। তবে খুব করিৎকর্মা ছোকরা, বাড়ির যাবতীয় ফুটফরমাস খাটে, ছাতের ওপরের ছোট  ঘরে ঘুমোয়। পরিশ্রম করতে পারে খুব, ইদানীং পারিবারিক ব্যবসার অনেক কাজও বোঝাচ্ছেন তাকে বড়দাবাবু। আরেকটি কাজ ন্যাড়া খুব ভালো করে, সেটা হলো নেতার মা'র রান্নার সোয়াদ দেখা। কুড়ি বছর বয়সে এই বাড়ির হেঁশেলে ঢুকেছিল নিত্যসুন্দরী, স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লে, বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে একটি ভদ্র কাজ চাইছিল পড়াশোনা না জানা গরীব বউটি।

প্রথম প্রথম বড় মা রান্নায় হাত দিতে দেয়নি। কুটনোকোটা, মশলা বাটা, মাছ মাংস কাটা, বাছা, এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া, দুবেলা খাবার আর এ বাড়ির সকালের বেঁচে যাওয়া খাবার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, সঙ্গে মাইনের কটা টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছিল মেয়েটি।

সে সময়  বড় মা অসুস্থ, সকালে বিকেলে , চাকরবাকর, আত্মীয় স্বজন নিয়ে দত্ত বাড়ির খাবার লোক পঁচিশ জন তো হবেই। সকালবেলা ও আসার সঙ্গে সঙ্গে বড় মা ডেকে পাঠালেন, কিছুদিন তো দেখলি, সকলের পছন্দ, অপছন্দ, রান্নার ধরনধারন, পারবি না কি কয়েকটা দিন চালিয়ে নিতে, মাইনে বাড়িয়ে দেবো, আর খাবার দাবারও বেশি করে নিয়ে যাস, তোদের একবেলা হয়ে যাবে। 

সেদিন নিত্যসুন্দরী বড় মার জন্য পথ্য রান্না করেছিল, তেল ঝালহীন সুক্তো, থানকুনি পাতা দিয়ে ছোট মাছের ঝোল। বাড়ির অন্যান্যদের জন্য শাক, মুগডাল, ভাজাভুজি, মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক, পোনা মাছ দিয়ে কচু আর আলু  গোটা গোটা করে কেটে সামান্য কাঁচালঙ্কা ছেঁচে সোনালী রঙের তরকারি, নারকেল কোরা, গুড় আর ডুমো ডুমো পেঁপে কেটে মিষ্টি চাটনী।

সবাই খুব তৃপ্তিতে খেয়েছিল আর নিত্যসুন্দরীও যোগানদার থেকে হয়ে গেল পাকা রাঁধুনি।


বহুদিন হয়ে গেছে, বাড়িতে নববধূমাতারা এসেছেন, কন্যাদের বিয়ে হয়েছে, বিবাহ অনুষ্ঠান, নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে, ব্রত, অন্নপ্রাশন। 

বড় মার শ্বশুর শ্বাশুড়ির  মৃত্যু হয়েছে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এসব কাজে বাইরে থেকে পাচক এসেছে, কিন্তু নেতার মা'র রান্নাঘর এজন্য

 কোনদিন বন্ধ থাকেনি।

ঘরের রান্নার দায়িত্ব তার হাতেই থেকেছে। 

 শখের রান্নাবান্না হয়তো দুই এক বেলা কেউ করেছে, কিন্তু সকাল, দুপুর আর রাতের সমস্ত আয়োজনই নেতার মার। পরিবেশন করেন শুধু বাড়ির বউরা বা বড়মা কখনো সখনো।

জন্মদিনে পোলাও, পাঁঠার কষা মাংস, বৃষ্টির দিনে খিচুরী, টুকরির অবশিষ্ট সব সব্জি মিশিয়ে শুকনো ঘেঁট, পুজোর দিনে ছানার কালিয়া, আলুর কুচো ভাজা, শোকের সময় কাচা মুগের ডাল, লাউ আর বড়ি দিয়ে হালকা তরকারি । অমৃতের মতো খেয়েছে সকলে।

যারা দশটায় বেরোয়, তারাও শাক, সেদ্ধ, দু পদ তরকারি,  গরম ভাত তো পেয়েছেই, আর দুপুরে আবার পুরনো নতুন মিশিয়ে কয়েকরকম। বড় কর্তা একবারই খান দিনে, সাদাসিদে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন দু তিনটে পদ, একটু ঘরে পাতা দই।

সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল নিত্যসুন্দরীর।

কোনদিন বাজার আনার কেউ না থাকলে, নিত্যসুন্দরীর আনন্দ দেখে কে!

সেদিন সে শখের শিল্পী। বিরাট বাড়ির পেছনে রয়েছে বাগান, ঝোপঝাড়, জঙ্গল। সেখানে সব্জির বীজ প্রায়ই ফেলে দিত নেতার মা।

অসুবিধের দিনে,  গেলে চোখ জুড়োয়।

ঐ তো লকলকিয়ে উঠেছে কুমড়োর ডাটা। কিছু পাট শাক। ঝোপের মতো হয়ে আছে  কাঁচা পাকা অযত্নের টমেটো, কোথাও কয়েকটি বেগুন। বিলেতী ধনে পাতা। কলাগাছে

মোচা বেরিয়েছে, বারোমেসে কাঁঠাল গাছে দুতিনটে কাঁচা কাঁঠাল, আর কি লাগে!  

 ঝুড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসত নেতার মা । বাড়ির সদস্যদের এসব দেখার সময় নেই। 


 ভাঁড়ার ঘরে চিড়ে আর আলু আছে। গরম মশলা, পাঁচফোড়ন, আদাবাটা দিয়ে চিরেঘণ্ট , লতা পাতা ডাটা তো আছেই, সেইসঙ্গে  ডাল বেটে ছোট ছোট বড়া করে অনুপম তরকারি,

বেগুন পুড়িয়ে ধনেপাতা দিয়ে ভর্তা, কাঁচা কাঁঠালের মাংসল পদ, থোর পুড়িয়ে সেই সঙ্গে সর্ষে বেটে ভর্তা । 

কাঁচা পাকা টমেটোর সঙ্গে ভাজা মশলার গুঁড়ো দিয়ে অম্বল। কাউকে কোন অসুবিধায় ফেলেনি

এই রাঁধুনি। 

 বাড়ির রান্নাঘরটাই তার কর্মক্ষেত্র। বিশাল দোতলা বাড়ির সব ঘরে সারা জীবনেও কখনো যাওয়া হয়নি তার। একমাত্র বড় মার ঘর ছাড়া। শেষে তিনি  নীচে কম আসতেন। 

তার একটি অলিখিত আদেশ ছিল হেঁশেলের ব্যাপারে, যা করবে নেতার মা, কারণ রোজদিন ওখানে কেউ রাঁধতে যাবে না দায়িত্ব নিয়ে, সুতরাং বেশী নাক গলিয়ে যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা হয়। বরং কারো কিছু খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে তাকে বললেই হবে। 


নেতার মা সব পাট চুকিয়ে বিকেলে যেত বড় মার ঘরে । নিজের হাতে একটি পান সাজিয়ে দিতেন বড় মা। সবার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করতে, পেট ভরে ভাত খেয়েছে কিনা, বাড়ির জন্য নিয়েছে কিনা, নিতাই কত বড় হয়েছে। দু একটা বিশেষ পদ পরের দিনের জন্য বলে রাখতেন। বাকি নেত্যর মার ইচ্ছেমত। ভাঁড়ারে সব কিছু মজুত আছে কিনা খোঁজ নিতেন প্রতিদিন ।

বাড়ির মেয়ে বউরা কি খেতে ভালোবাসে গোপনে বলতেন নেত্যর মাকে।

পরের দিন অসীম যত্নে সেই রান্নাটি রাঁধা হত। চমকে যেত বাড়ির সদস্যটি। নেত্যর মা এক ভালোবাসার সেতু যেন। কাউকে তৃপ্তি করে খেতে দেখলেই ভরে ওঠে তার বুক।  


মাঝখানে একবার দত্তবাড়ির অবস্থা পরে গিয়েছিল, ব্যবসায় অনেক টাকা ঠকে গিয়েছিলেন বড়দা বাবু।

তখন মানুষের সংখ্যাও বেশী। ছেলেমেয়েরা পড়ছে। মেজদা বাবু সবে চাকরিতে ঢুকেছেন, বেতন তেমন পান না, ছোটদা বাবু চাকরির চেষ্টা করছেন। বাড়ির এইসব বিপদের দিনে যে রাঁধে তার বড় অসুবিধে। বাজার হয় না তেমন। মাছ মাংস আসে কম। সব্জি পরিমান মতো নয়। তেল মশলাপাতিও কম কম।

বড় মা কাউকে রান্নাঘরে হাত লাগাতে দিতেন না এই সময়ে, শুধু তিনি আর নেত্যর মা। মুখটা শুকনো করে  বলতেন, তুই তো বুঝিস রে সব, কিছু ফেলিস না। 

নেত্যর মা তখন সব্জির খোসাও ফেলত না। কালো জিরে,  রসুন, পেঁয়াজ দিয়ে বাটা করতো।

গরম ভাত উড়ে যেত সেই স্বাদে গন্ধে। চালকুমড়ো, লাউ, মিষ্টি কুমরোর বীচি সব দিয়ে বড়া হতো। ফুলকপির ডাঁটা, বাঁধাকপির সবুজ পাতা কিছুই বাদ যেত না।

তারপর আবার অবস্থা ফিরে এলো। 

সকালে দুপুরে গাদা গাদা বড় মাছ, ছোট মাছ, মাংস আসতে লাগল, বেশী দাম দিয়ে নতুন ওঠা সব্জি, ছানা। ততদিনে মেজ বউঠান গিন্নী হয়ে উঠেছেন ।  ভেড়ার মাংস দিয়ে কিভাবে কাটলেট বানাতে হয়, ডিমের ডেভিল, রকমারি টিফিন সেসবও শেখালেন মেজ বউমণি।

তিনি শহরের মেয়ে ছিলেন, তেমন অন্তরঙ্গ হোননি কোনদিনও নিত্যসুন্দরীর সঙ্গে, তবে "নিত্যদিদি" ডাকতেন আস্তে করে। মনটা ভালো ছিল, সহজ সরল, কিন্তু একটু সরে থাকতেন, আবার প্রয়োজন হলে হাত লাগাতে দ্বিধা করতেন না। 

একবার ঈদের সময়, ছোটদাবাবুর এক মুসলমান বন্ধু, বাড়ি যেতে পারে নি কোন কারণে, তো ছোটদাবাবু এ বাড়ি নিয়ে এলেন।

সঙ্গে দুই কেজি পাঁঠার মাংস। 

সেদিন বিরিয়ানি , হালিম, সেমাই নিজের হাতে রান্না করলেন বড় মা। এই মোটা রান্নার বই ছিল বড় মার।

রাঁধতে রাঁধতে বললেন মুসলমানেরা হালিম রান্নায় গরুর মাংস দেয়, শুনেই কান চাপা দিলো নেত্যর মা, কি যে বলেন বড় মা ! 

বড় মা হাসলেন, যার যার খাদ্যাভ্যাস, এগুলো নিয়ে তুই আমি বলার কেউ নই রে। 

এই যে বিরিয়ানিতে গোটা আলু দিলাম, এটা কিন্তু আসল বিরিয়ানিতে  দেওয়া হয় না, ব্রিটিশ আমলে বিশাল সৈন্যবাহিনীকে বিরিয়ানি দেওয়ার সময়  খরচে কুলোনোর জন্য আওয়াধির নবাব বিরিয়ানিতে সেদ্ধ আস্ত মশলাদার আলুর আমদানি করেন ।

এখন সব্বাই দেখি আলু দিচ্ছে,  আমিও দিলাম রে।

বড় মার গালের এককোণে উঁচু হয়ে আছে পানের খিলি, ঘামছেন, গল্প করছেন।

তারপর কাপড় ছেড়ে, স্নান করে খাবার দিলেন অতিথিকে। খুব পরিতৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিল ছোটদাবাবুর বন্ধুটি।

কত কি জোগাড় দিল নেত্যর মা সেদিন। টোপর দোকানে গেলো কয়েকবার। 

সেই রাতে আর বাড়ি ফেরেনি নেত্যর মা। 

অনেক রাতে সে আর বড় মা সবার খাওয়া হয়ে গেলে খেতে বসেছিল। কি অপূর্ব স্বাদ হয়েছিল রান্নার, আজও যেন মুখে লেগে আছে ।


বহুদিন পড়ে বড় মা গল্প করেছিলেন, ছোটদাবাবুর সেই বন্ধুটি নাকি বড় অফিসার হয়েছে আর ছোটদাবাবুর কাছে বড় মাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে, সেই চিঠিতে শুধু সেদিনের রান্নার বর্ণনা, এই মধুর স্মৃতি তিনি  কোনদিন ভুলবেন না। 


 বড়দাবাবুর তিন মেয়ে একে একে পরের বাড়ি গেলো। দুই ছেলে বাইরে কলেজে পড়ছে।

মেজদাবাবুর এক মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে, একটি ছেলে আর মেয়ে এখন বাড়িতে।

ছোটদাবাবুর ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, বাইরে থাকে বউ নিয়ে, মেয়েটি ছোট,  বড় হচ্ছে। 

তেমনই এক প্রখর চৈত্রদিনে, প্রচুর কাঁচা আম, গতরাতের ঝড়ে যেগুলো মাটিতে পরেছিল, শেষ বিকেলে সেগুলো কাটছিলো নেতার মা, হলদে, লঙ্কা আর নুন মিশিয়ে কাল রোদে দেবেন। কত টক রাঁধতে হয় তাকে বছর ভর। 

হঠাৎ দেখলো লাল পার তাঁতের শাড়িটি পরে বড় মা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন।

খুব কাহিল লাগছে শরীরটা। দুর্গার মতো মুখটিতে যেন সাদা সর পরেছে, নেতার মা'র কাছে এসে মোড়া পেতে বসলেন।

বললেন, আমি না থাকলেও তোর দাদাবাবুকে তুই রেঁধে খাওয়াস। এ বাড়ি ছাড়িস না। বাগানের দিকের ছোট ঘর দুটো খালি পরে আছে। তোর ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে চলে আয়। বাড়িতে এখন মানুষ কমে যাচ্ছে, সবাই তো বাইরে চলে যাবে পড়াশোনা করতে, বিয়ে হয়ে। 

নেতার মা হতভম্বমুখে শুধু বলল, কি হয়েছে বড় মা, ভালো জায়গা থেকে ডাক্তার দেখিয়ে এসো।

সেই শেষ বার, আর বড় মা নীচে তদারকিতে আসেননি।

এর ঠিক একমাস পরেই ভরা পূর্ণিমায় বড় মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

তখন থেকে নেত্যর মার আর রাঁধতে ভালো লাগে না, শুধু বড় মা  বলে গেছেন, তাই দায়িত্ব পালন করে। বড়দাবাবুর মনও ভেঙে গেছে, এই বাড়িতেই এখন তার সংসার, নিতাই কাজকম্ম করছে। বড় দা বাবু দাঁড়িয়ে থেকে নিতাই এর বিয়ে দিলেন।

নেত্যর মাকে এখন সাহায্য করে ছেলের বউটি।

এখন শুধু যাবার পালা। বড়দাবাবু চলে গেলেন।

শ্রাদ্ধবাড়ির রান্না দেখতে দেখতে তার চোখে শুধু জল আসে।

এবার মেজদাবাবু আর মেজ বউমণি আটকালেন। তুমিই সামলাও।

ভাঙা মনগুলো জোড়া লাগানোর জন্য সেবার বাড়িতে দুর্গাপুজো হলো। সবাই এলো। প্রচুর রান্না যন্ত্রের মতো করছিল নেত্যর মা। আর ভাল লাগে না।

কচি কচি ফুলকপি এক ঝুড়ি নিয়ে এসেছে ছোটদা বাবু। নেত্যর মা, সিঙারা বানাও। তোমার হাতের ফুলকপির সিঙারা কি তা নাতি নাতনীরা বুঝুক।

চোখে জল এলো নিত্যসুন্দরীর।

সে এক হাড় কাঁপানো পৌষ মাস। শেষবিকেলে, তখন তার বাড়ি ফেরার সময়, এই ছোটদাবাবুই

অনেক ফুলকপি এনে রান্নাঘরের বারান্দায় ফেলে বলেছিলেন সিঙারা করো কিন্তু, বড় বৌদিকে ডাকো। 

উপর থেকে বড় মা দেখে নেমে এসেছিলেন। চল্ রে মা, সংক্ষেপে করে ফেলি, টোপর তোকে পৌঁছে দেবে। কি শীত সেদিন।

কোথায় আর সংক্ষেপ। টোপর দোকানে ছুটল। পোস্টম্যান তেল এলো, চীনে বাদাম, কিসমিস, হিং, মটরশুঁটি।

বড় মা ফুলকপির পুর করলেন, নেত্যর মা ময়দার লেচি। এক ঝুড়ি ভর্তি মুচমুচে সিঙারা হলো। বাইরে তখন ঘন কুয়াশা, পথঘাটে মানুষ নেই। কাগজের মধ্যে পেঁচানো গরম শিঙারা নিয়ে টোপরের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে নেতার মা। টোপরের দুহাতে দুটো সিঙারা। একবার এটায় কামড়, আর একবার অন্যটায়। 

নিত্যসুন্দরীর শেখা হলো, তারপর প্রতি শীতে অন্ততঃ দুবার তাকে সিঙারা করতে হয়েছে, এতে তার খুশিই হতো। নিতাই আর নিতাই এর বাবার মুখেও তো সে তুলে দিতে পারত।


কয়েকবছর হলো এ বাড়ির রান্নাঘর বন্ধ হয়ে গেছে। আর কেউ নেই দত্ত বাড়িতে। মেজদাবাবু মারা যাওয়ার পর, মেজ বউঠান ছেলের ওখানে চলে গেলেন। ছোটদাবাবুর শরীর খুব খারাপ, তাই বউ আর মেয়েকে নিয়ে ছেলের ওখানে।

শোনা যায় তিনি আর আসবেন না এই বাড়িতে। 

 সব ঘরে তালা পরে গেলো। শুধু বিশাল বাড়ির এককোণের দুটো ঘরে নেত্যর মার সংসার। নিতাই এর বাবাও আর নেই।

নিতাই সেদিন তার বউকে বলছে, শুনেছি এই বাড়ি নাকি প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের উঠে যেতে হবে।

অনেককিছুই আর না বুঝলেও, নেত্যর মা প্রোমোটার শব্দটি শুনেছে। তারা হলো সেই মানুষ যারা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানায়।

ভগবান তাকে আর কত দেরীতে নেবেন, এ কথাই ভাবে শুধু সে।

চরচরে রোদ উঠেছে। বর্ষাকাল। গাছগাছালির রঙ ঘন সবুজ। বাড়িতে হঠাৎ অনেক লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ। ট্রাক গাড়ি থামল যেন। ভারী ভারী যন্ত্র ঘষটে ঘষটে আনার আওয়াজ। খুব কষ্টে বালিশ থেকে মাথা তুলল, নেত্যর মা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে রান্নাঘরটাই চোখে পড়ে প্রথমে।

একটা হলুদ রঙের বুল ডোজার দাঁড়িয়ে আছে, দু তিনজন লোক কিছু একটা বলল, চোখের নিমেষে গুঁড়িয়ে গেলো জরাজীর্ণ ইটবালির রান্নাঘরটি।

সেদিন রাতেই নিত্যসুন্দরী মারা গেলেন।

তার মুখ চোপা ছেলের বউটি বলে শাশুড়ির চিতা থেকেও নাকি মুড়িঘণ্টের এর সুঘ্রাণ আসছিল। 




  

৩টি মন্তব্য: