কনফেশনাল পোয়েট্রি ( স্বীকারোক্তি যখন কবিতা)

৫:১৮ PM চিরশ্রী দেবনাথ 6 Comments

চিরশ্রী দেবনাথ 

স্বীকারোক্তি যখন কবিতা 

আমি একটি ট্রেনলাইনের পাশাপাশি হাঁটছি, দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি সিগনাল, আমার অন্তঃস্থলে দুর্ধর্ষ মেঘ ডাকছে, সমবেত কুয়াশা চারপাশ থেকে আমার দিকে ছুটে আসছে, আমি এখুনি আরেকটা জগতে চলে যেতে চাই, একটু রক্তপাত হবে, শীতল দীর্ঘ শব্দ কেটে দেবে শরীর, কিন্তু পারছি না, আটকে রেখেছে কলম, কলমেই লিখবো এইমাত্র না হওয়া মৃত্যুকে। কেন ফিরে এলাম, পায়ের পাতা থেকে ব্রেন অব্দি উঠে এসেছে যে সংঘবদ্ধ লাইন সেগুলো কীটময়, পতঙ্গের দুঃসহ একঘেয়ে সঙ্গীত, মেপল পাতার অরণ্য থেকে বাঁশবন আশ্রিত, গীর্জার দক্ষিণ অংশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছবির মতো নদীটির তীরভূমি আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের পল্লীগ্রামে, নীরব দরিদ্র চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছেন কোন লেখক, তিনি কি কবি? 
বিকেলে যে কালবৈশাখী আসবে তারই নীল আঁচলভূমির অপেক্ষায় আছেন, লিখবেন যে প্রেমের কাছ থেকে সরে এসেছেন, বিরহ লিখবেন বলে, সীমান্ত থেকে কুড়িয়ে এনেছেন যাবতীয় ক্ষোভ, ছিন্ন মাংসপিন্ড, গলিয়ে গলিয়ে স্বর্ণাভ  রূপ দেবেন তার, এই ভূমিকা হয়তো অভিনয়, হয়তো আত্মার ডাক, হয়তো স্বীকারোক্তি মরুভূমি হতে থাকা পৃথিবীর শেষ  তৃণের কাছে। 
এই কনফেশন কি বোঝা গেলো কিছু না শুধুই ধোঁয়াশা।কনফেশনের শরীরী রূপ কি এভাবেই তৈরী হয়, জানি না। 

 মস্তিস্কে এবং হৃদয়ে যন্ত্রণা যখন তীব্র জট পাকিয়ে যায় তখন একজন কল্পনাপ্রবণ, আত্মনিপীরণকারী  এবং  আত্মহত্যাবিলাসী কবি  লিখতে থাকেন আত্মপ্রলাপ বা স্বীকারোক্তি, এসব নিয়েই কবিতার আরেক ভুবন কনফেশনাল পোয়েট্রি। 
 যথেষ্ট যত্ন সহকারে অনেক কবি প্রচুর বিতর্কের মুখোমুখি হবেন জেনেও জীবিত অবস্থাতেই সেগুলো ছাপতে দেন এবং বই আকারে বের হলে পাঠক মহলে ব্যাপক কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে এইসব কনফেসন কাব্য পড়ার। কবিতাগুলো বেশীরভাগই যেন স্বেচ্ছাচারিতার এক লিখিত রূপ।  জন্ম, মৃত্যু অথবা এক আধিভৌতিক রহস্যের মধ্যে নিজেকে রেখে ক্রমাগত স্বীকারোক্তি। এই কবিতাগুলোর অধিকাংশের  মধ্যেই  রয়েছে নিজেদের ঘনিষ্ট পারিবারিক সদস্যদের প্রতি অনুভূতির অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশটিকে ভীষণভাবে কাঁটাছেঁড়া করা । যৌন অনুভব, বিকৃত কাম ইত্যাদির সঙ্গে প্রজ্ঞার  সংমিশ্রণ, মনের গভীরে অবচেতনে যেসব অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলো ক্রমাগত মানুষ চাপা দিয়ে রাখে সেগুলোকে তুলে এনে লোকসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করা। নিজেকেই নিজে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করা। আত্মহত্যার দিকে  চালিত করা, কখনো আত্মহত্যার খুব কাছ থেকে ফিরে এসে, আবার লেখা, তখন লেখাগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে আত্মশুদ্ধিতে, কারণ ছত্রে ছত্রে থাকে পাপের ঘোষণা। কবি নির্দ্বিধায় লিখে যাচ্ছেন আত্মপাপ, অবদমিত ইচ্ছেগুলোর লিখিত ভাষ্য, আর তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সেগুলো। কারণ একটাই, মানুষ কোথাও না কোথাও নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভবের  সঙ্গে এগুলোকে মেলাতে পারছেন। 
  আর ভাবছেন কবি তো তাহলে সত্যদ্রষ্টা, বিবেকহীন কিংবা জলের মতো দুর্বার তিনি,  যিনি নির্দ্বিধায়  সব লিখতে পারেন। এইসমস্ত আত্মজৈবনিক প্রলাপের কাছে তখন মানুষ নত হয়। ঘৃণার বদলে শ্রদ্ধা আসে মনে। তার বিকৃতিমূলক বিবৃতির মধ্যেও পাঠক খুঁজে পান বীভৎস রস, বিষাদের সীমানাহীন অবগাহন। 
কবির সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি জগৎ থাকে। এই জগতের সঙ্গে সাধারণ চিন্তাভাবনার কোন মিল নেই। এতটাই মুক্ত এবং স্বাধীন সেই পৃথিবী যে, কোন কোন কবি এই জগতটাকে সারাজীবনেও ছুঁতে পারেন না বা ছুঁতে চান না, সাহস করেন না। হয়তো তাকে আখ্যায়িত করা হতে পারে মানসিক রোগী হিসেবে। কিন্তু কবি মানেই অন্তহীন মানসিক অস্থিরতার শিকার। অস্থিরতা ছাড়া পৃথিবীতে কোন সার্থক কবিতা রচিত হয়নি। রোমান্টিক এবং স্নিগ্ধ কবিতার পৃথিবী থেকে বেরিয়ে কনফেশনাল পয়েটরা চেষ্টা করেছেন কবিতার ভাষ্যকে সম্পূর্ণ বদলে একটি নতুন রূপ দেবার। আত্মঘৃণার সংবেদনশীল প্রকাশ। যার মধ্যে রয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিঅনুভূতির বহুমুখী প্রকাশ। 
 আমার মনে হয়েছে বহু কবি এটিকে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেও করেছেন। তাঁরা সমসাময়িক কবিতাধারার থেকে নিজেকে বেশী স্মার্ট কিংবা আলাদা কবি সত্তার জন্ম দেওয়ার জন্য আত্মজৈবনিক বিকৃত বিবৃতিমূলক কবিতার জন্ম দিয়েছেন। 


 এখন এই যে স্বীকারোক্তি মূলক কবিতা, এটির মূল ভিত্তি বিদেশ। বিদেশের জীবনযাত্রা, তথাকথিত আধুনিকতা ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের সাধারণ মানুষের অনেক অনেক অমিল। বিদেশী কবিরা অকাতরে লিখে গেছেন  চুরান্ত জৈবিক কবিতা যা নেশা,  যৌনাচার, যৌনকর্মীদের সান্নিধ্য  প্রভৃতির  সংমিশ্রণে রচিত হয়েছে। সাদামাটা বাঙালী জীবনধারার সঙ্গে কবিতাগুলোর মিল নেই। কিন্তু বাঙালীরা মেধাবী, বিদেশী সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী, বিদেশী সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত, কখনও কখনও বিদেশী কাব্যের নিবিড় অনুকরণপ্রিয়, তাই এধরনের কবিতা বাঙালী কবিরা সহজেই হজম করেছেন এবং আত্মস্থ করে তাঁরাও চেষ্টা করেছেন কনফেশনাল পোয়েট্রি ধারার জন্ম দিতে, দিয়েছেনও।  এই জাতীয় কাব্য লোকে কতদূর মনে রাখল বা হৃদয়ে কি আসন দিল সেটা মূল কথা নয়, মূল কথা হলো বাঙালীরাও কনফেশনাল পোয়েট্রি সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
তিরিশের দশকের পর পঞ্চাশের দশকে  সর্বপ্রথম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলীর হাত ধরে বাংলা কবিতায় এই দারুণ ভাঙচুর সৃষ্টি হয়,  যারা ছিলেন অ্যালেন গীন্সবার্গের ভাবশিষ্য। ষাটের দশকে, আমেরিকা থেকে ফিরে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেন, "আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি "। বাংলায় কনফেশনাল পোয়েট্রি সৃষ্টি করার প্রয়াস। 
 একই সঙ্গে বাংলাদেশের শামসুর রহমানের, "দুঃসময়ের মুখোমুখি ", আবুল হাসানের, "রাজা যায় রাজা আসে ", "যে তুমি হরণ করো ","পৃথক পালঙ্ক ", নির্মলেন্দু গুণের
"সর্বগ্রাসী হে নাগিনী ", "কবিতা, অমীমাংসিত রমণী ", এগুলো কনফেশনাল পোয়েট্রির বঙ্গদেশীয় উদাহরণ। 


সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ যেসমস্ত অনুভব আছে, কবিতায় প্রবলভাবে সেগুলোকে নিয়ে আসাই, কনফেশনাল পোয়েট্রির মূল ভিত্তি। ১৯৫০ সালে আমেরিকায় এই নূতন কবিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, এই ধারার পৃথিবী বিখ্যাত কবিরা হলেন Sylvia 
Plath ,Robert Lowell, Anne Sexton, W. D. Snodgrass,John Berryman, Randall jarrel এবং আরো অনেকেই। আর সর্বপ্রথম এই শব্দবন্ধটির জন্ম দেন সাহিত্য সমালোচক আর এল রোজেন্থাল, যখন তিনি রবার্ট লাওয়েলের, "Life studies "কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। 

কনফেশনাল পয়েটদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এই আত্মহত্যা আর সাধারণ মানুষের আত্মহত্যা এক  নয়। কেউ কেউ দীর্ঘদিন থেকেছেন মানসিক হাসপাতালে। সুদীর্ঘ সুইসাইড নোট লিখেছেন, প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন। বিষণ্ণতার তীব্র অনুভবের কথা লিখেছেন, এসব নিয়েই তৈরী হয়েছে কনফেশনাল পোয়েট্রি বা স্বীকারোক্তিমূলক সাহিত্যের অন্যতম ধারা।

প্রাচীন চীনে সিমা সিয়েন নামে এক সাহিত্যিক বলে গেছেন, মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু একজন সাহিত্যিক যখন মারা যাবেন তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা। 
এটা  আমি একজায়গায় পেয়েছি, কিন্তু তিনি ঠিক  কি    বোঝাতে চেয়েছিলেন বা আর কোন ব্যাখ্যাও তার সঙ্গে ছিল না। তবে কনফেশনাল পয়েটদের অনেকেই হঠাৎ আর কিছু লিখব না, বা  আর কিছু লেখার নেই পৃথিবীতে এসব বলে ব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন, খরস্রোতা ঝর্ণায় নিজেকে রক্তাক্ত করতে করতে কষ্টকর মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। এতে বোঝা    যায় একই সঙ্গে  মেধা এবং  মানসিক রোগ তাদের মননকে যেভাবে ক্ষয়িত করছিল তারই ফলশ্রুতিতেই এই কাব্যধারা। জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি ব্যাখ্যাতীত  ব্যাপারটিকেই হয়তো পাথরের মতো ভারী বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও    হালকা বলা হয়েছে।  

 সিলভিয়া প্লাথ, অ্যানি সেক্সটন ও জন ব্যারিম্যান এই তিনজন কবিই আত্মহত্যা করেছেন এবং অনন্য কবিতা লিখেছেন, যা পৃথিবীর অন্যতম সেরা কবিতা হিসেবে স্বীকৃত।
সিলভিয়া প্লাথ তাঁর মৃত্যুর উনিশ বছর পর "দি কালেক্টেড পয়েমস " বইটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান, যা সম্পাদনা করেন তাঁর হ্যাজব্যান্ড কবি টেড হিউজ স্বয়ং এবং পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ  বিক্রিত কবিতার বই এটি । সারা জীবন অদ্ভুত এক  হতাশা গ্রস্ততার মধ্যে তিনি জীবন কাটিয়েছেন। বাবার কঠোর মনোভাব তাঁর ছোটবেলাকে প্রভাবিত করেছে, সে থেকেই    তিনি লিখেছিলেন  বিখ্যাত "ড্যাডি " কবিতাটি। বিবাহিত জীবনে হাজব্যান্ড অন্য বিখ্যাত কবি টেড হিউজের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন, অতিরিক্ত সংবেদনশীল অপূর্ব সুন্দরী এই কবিকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাজনিত অপরূপ শান্তি দেয়। অপরূপ বললাম এই কারণে যে বহুচর্চিত কবি সিলভিয়া প্লাথ সবসময় মৃত্যুর দিকেই যেতে চাইতেন, মনে করতেন মৃত্যুতেই সকল শান্তি। 
 তিনি বলতেন  তাঁর মধ্যে সবসময় এক প্রস্বর কাজ  করে, যা তাকে ক্রমাগত লিখিয়ে নেয়, আর নিরন্তর  এক ঐশ্বরিক মৃত্যুর হাতছানি, জীবনে বহুবার মরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং শেষপর্যন্ত সফল হয়েছেন। 

অ্যানি সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এক সেমিনারে তাদের দেখা হয়। তারপর থেকেই নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। দুজনেই কবি, কবিতাপ্রাণ, বিষাদময়তায় ভোগেন এবং মনে করেন মৃত্যুই তাদের অপার স্বাধীনতা দেবে। ১৯৬৩ সালে সিলভিয়া প্লাথ সুইসাইড করেন কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস দিয়ে এবং ১৯৭৪
সালে অ্যানি সেক্সটনও  আত্মহত্যা করেন, উপাদান একটাই কার্বন    মনোক্সাইড । কিন্তু অ্যানি সেক্সটনের কাছে কবিতা এসেছিল কবিতা থেরাপি হয়ে। বিষণ্ণতার অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকা মেয়েটিকে ডাক্তার বলেন কবিতা লেখো। তিনিও লিখতে আরম্ভ করেন, বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে এইসব কনফেশনাল পোয়েট্রি। সত্তরের দশকে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোয়েট্রি থেরাপি কোর্সটি চালু ছিল। 

অ্যানি সেক্সটনের একটি কবিতার অংশবিশেষ, কবিতাটির নাম, "45 Mercy street ",এটির অনুবাদ করেছেন, কল্যাণী রমা। 

"ব্যাগটা খুলি,
যেভাবে মেয়েরা ব্যাগ খুলে থাকে,
মাছেরা টাকা আর লিপ্স্টিকের মাঝ দিয়ে
সামনে পিছনে সাঁতার কাটে।
আমি ওদের ধরে
একটা একটা করে
রাস্তার সাইন-বোর্ডের দিকে ছুঁড়ে দিই,
ছুঁড়ে দিই নিজের ব্যাগটা
চার্লস নদীতে।
তারপর স্বপ্নটাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে
যে কদাকার ক্যালেন্ডারের পাতায়
জীবনটা কাটাচ্ছি
তার সিমেন্টের দেয়ালে আছড়ে পড়ি,
আমার জীবন,
আর তার টেনে টেনে বয়ে বেড়ানো
নোটখাতা। "
[“45 Mercy Street” কবিতাটির বাংলা ভাষান্তর। কবিতাটি “45 Mercy Street”(১৯৭৬) বইটি থেকে নেওয়া। এই বইতে কবির জীবনের ব্যক্তিগত কথা বড় বেশি উঠে এসেছে বলে অ্যান সেক্সটন বেঁচে থাকতে বইটি প্রকাশিত হয়নি।]
আমেরিকায় কনফেশনাল কাব্যধারার সূত্রপাত ঘটে W. D. Snodgrass এর Heart's Needle কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে।এর জন্য তিনি Pulitzer Prize পুরস্কার পেয়েছিলেন 1960 সালে। সেইসময় স্নোডগ্রাস বিবাহবিচ্ছিন্ন হোন এবং একইসঙ্গে কন্যার থেকেও দূরে সরতে হয়, এই বিচ্ছেদ আর কন্যার প্রতি তীব্র স্নেহজনিত মনোকষ্ট গ্রন্থটির মূল ভাষ্য। তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তখনকার সাহিত্য মহলে এইসব সৃষ্টি নিয়ে।
স্নোডগ্রেসের, Heart's Needle কবিতাটি থেকে কয়েকটি লাইন,

No one can tell you why
the season will not wait;
the night I told you I
must leave, you wept a fearful rate
to stay up late.

Now that it's turning Fan,
we go to take our walk
among municipal
flowers, to steal one off its stalk,
to try and talk.

We huff like windy giants
scattering with our breath
gray-headed dandelions;
Spring is the cold wind's aftermath.
The poet saith.
রবার্ট রাওয়েল ছিলেন স্নোডগ্রাসের কাব্য অনুরাগী। তারপর তিনিও স্বীকারোক্তি মূলক কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন এবং জনপ্রিয় হয়। 
জন ব্যেরিম্যান, অপর মুখ্য ষাটের দশকের কনফেশনাল পয়েট। বারো বছর বয়সে তাঁর বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন, এই ঘটনা তাঁকেও আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে এবং বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ সমস্ত ঘাত প্রতিঘাত যখন তাঁকে গ্রাস করছিল, তিনি তার মেন্টর কর্তৃক নির্দেশ পান কবিতা লেখার। কবিতাই মুক্তি। তারপরই অদ্ভুত রহস্যময় এক কবিতাভুবন তৈরী করেন তিনি,  যা কারোর মতো না, কেউ কেউ বলেছেন তিনি ইলিয়টস্ এর মতো, তবে তিনি আসলে তাঁর মতো। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি আত্মহত্যাই করেছিলেন। "ড্রিম সঙ্গস " তাঁর খুব বিখ্যাত একটি বই, যেখানে তিনি হেনরি নামের একটি চরিত্রকে সামনে রেখে কবিতাগুলো রচনা করেছেন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে এর মধ্যে পুলিৎজার পুরস্কারও রয়েছে। 
বাক্ ওয়েবজিন থেকে কবি  বারীন ঘোষালের অনুবাদ কৃত জন ব্যেরিম্যানের একটি কবিতা দিলাম  ।  
         
 স্বপ্ন গান – ৪৫

সর্বনাশের দিকে চেয়ে আছে। নাশও তারই দিকে ফেরা।
ভেবেছিল তারা পুরনো বন্ধু। সিড়িতেই টের পেল,
যেখানে মেয়েটার বাবা তাদের উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছিল,
ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল তারা। দোস্তির গোপন কথার চিরকুট
যেদিন হারিয়ে গেল, ভেবেছিল খুব ভেবেছিল, ঝোঁক তার
নাশের, তাদের পথ আড়াআড়ি আঁকা

এবং একবারই পরস্পর এড়িয়ে গিয়েছিল জেলে; বিছানাতেও;
আর নিস্বাক্ষর চিঠিতে দেখা হয়েছিল তাদের চোখের ,
কোন এক এশিয়ার আশ্চর্য শহরে, অনির্দেশ
আর ইতস্তত, এই দুটো আর তিনটের মধ্যে
অথবা একটা টেলিফোনের আশংকায় চমকিত
ঠিক যখন তার মাথায় কেউ তার জড়িয়েছে

একটা ভুল ধারণায় পৌঁছতে, মৃগ থেকে ‘মৃগি’।
অথচ সে যখন টের পেল -- তারা পুরনো বন্ধু নয়,
এটা তার জানা ছিল। না।
এই তো অচেনা একজন, শুধরে দিতে এসেছে
সমস্ত ভন্ডামি, আর সেটাই জারি করতে।
হেনরি রাজি হল না -- ।

আমি মনে করি বাংলা কবিতার অন্যতম প্রিয় কবি ভাস্কর চক্রবর্তীও একজন কনফেশনাল পয়েট। তাঁর অসংখ্য কবিতার মধ্যে ছড়িয়ে আছে বিষাদাচ্ছন্ন সব স্বীকারোক্তি, নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আর মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া,  ঘুরে আসা। ওনার একটি কবিতা, 



এমন নয় যে তিনিই শুধু সকাল ৮টায় মারা গিয়েছিলেন ।
সেদিন ছিল শনিবার
আমার ছোটো বোনও মারা গিয়েছিলো সকাল ৮টায় ।
পরের শনিবার শামশের মারা গেলো সকাল ৮টা ৫ মিনিটে ।
দীপক মজুমদার ? না, তিনি বিকেলবেলায় বিদায় জানালেন ।
আমি তো ঘুরছিলাম
শামশের কোমায় পড়েছিলো পুরো ৪ মাস
কতগুলো যে ঘুমের বড়ি খেয়েছিলো !
আমি শামশেরের কেবিনে ঢুকেছিলাম কিন্ত ওকে ঠিক চিনতে পারিনি
সেই রাজকীয় রূপটা উধাও হয়েছিলো আর এমন একটা গন্ধ ভাসছিলো ঘরে
যেটা মোটেই সুবিধার ছিলো না-
একটু কথাবার্তা বলতে পারলে আমাদের দুজনেরই কিছুটা ভালো হতো
২০ বছর বয়সে শামশেরকে বলেছিলাম ৫৫ পর্যন্ত লিখবো
কেন যে ৫৫ বলেছিলাম কে জানে
কেন যে মৃত্যু আর মৃত্যুর কথাই আমি লিখে চলেছি কে জানে

(মৃত্যুকথা : ভাস্কর চক্রবর্তী)

কবিতার ধারা, উপধারার শেষ নেই।  কাব্য ইতিহাসে যেখানে, যতদূরেই কোন নতুন কিছু লেখা হোক না কেন তার ঢেউ আছড়ে পরেছে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও, আর বাংলার কবিরা তো এসব আত্মস্থ এবং প্রয়োগ করার জন্য ব্যাকুল হয়েই থাকেন। তবে আমার মনে হয় বাস্তবে কনফেশনাল পোয়েট্রি বলে আলাদা কিছু নেই। বিষাদ এবং মৃত্যুচিন্তা সবসময়ই কবিতার উপাদান। আর কবি মাত্রই কবিতার কাছে নিজের ক্ষয়, বিরহ, বিচ্ছেদ, কাম, ক্রোধ, বুভুক্ষুতা, অবদমিত ইচ্ছা, অবিরাম
দহন, আত্মপাপ ঢেলে দেন, তাই কবিতা হীরকদ্যুতি ছড়ায়, তার অবগাহনে  প্রতিটি পংক্তি  ক্লেদ মেখে জীবন্ত মানুষ হয়ে যায়। কনফেশনাল পোয়েট্রিতে ইচ্ছাকৃত বা অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা এনে কবিতাকে আলঙ্কারিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে কোথাও কোথাও। এককথায় বলা যায়, মেধাবী, বুদ্ধিমান, চির বিষাদগ্রস্ত, মানসিক অস্থিরতার সৃজনশীল মানব মানবীরা মৃত্যুর বিনিময়ে সেইসব সৃষ্টি পৃথিবীর সাহিত্যকে দিয়ে যেতে চেয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে অমরত্ব পাওয়ার সুচিন্তিত লোভ। 



৬টি মন্তব্য:

  1. সুচিন্তিত লেখা।খুব ভাল লাগল পড়ে।কল্যাণী রমার অনুবাদ দারুণ।

    উত্তরমুছুন
  2. পড়লাম। নতুন ধরনের একজগৎ। অনেক কবি এরকম হন তবে এটা যে একটা কাব্যধারা তা প্রথম জানলাম। অনেকটা গবেষনামূলক লেখা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা রইল আমার, সুস্থ থাকুন সপরিবারে

      মুছুন
  3. পড়লাম। নতুন ধরনের একজগৎ। অনেক কবি এরকম হন তবে এটা যে একটা কাব্যধারা তা প্রথম জানলাম। অনেকটা গবেষনামূলক লেখা।

    উত্তরমুছুন